“তিমির”পর্ব ১৫

0
1130

“তিমির”পর্ব ১৫

আমি পায়েস খেতে লাগলাম। ঝাল পাকুরাগুলো মুখই পুড়ে দিয়েছে। এতো ঝাল খাবার এতদিন খেয়েছি ভাবলে সন্দেহ হয়।
ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সাবরিনা এসে আমার পাশে বসলেন।
“এখন কেমন লাগছে?”
“গরম। অনেক গরম অনুভব করছি।”
“ঠিক হয়ে যাবে। অলরেডি তিনদিন পার হয়ে গেছে। এর আগে তুমি আরও বেশি উত্তপ্ত ছিলে। আজকের দিনের ভেতর হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।”
দূরে তাকিয়ে আমি ধ্রুবকে দেখছি। আজ অনেকদিন পর ওর মুখের উজ্জ্বলতা খানিকটা ফিরে এসেছে। আমি অনেক খুশি। “আমি বুঝি অনেককিছুই মিস করেছি। কী হয়েছিল?” আমি বায়োডাটা রিডারের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, “কে ছিল লোকটি?”
“তোমার মা বোধহয় একদা অনেক পীর-ফকিরের তাবিজ লাগিয়েছিল। তাদের মধ্যে কিছু নাস্তিক খারাপ লোকও ছিল। হয়তো ওদের তাবিজগুলো তোমার মায়ের ওপর মানসিকভাবে প্রভাব ফেলেছিল। এমনই সময় ওই বীভৎস আত্মাটি তোমার মায়ের শরীর ধারণ করার জন্য তোমার মাকে উপযুক্ত পাওয়ায়, তার শরীরে প্রবেশ করেছে।
তোমার মা বোধহয়, তোমার মতোই স্ট্রং মাইন্ডেড আর সাহসি ছিল। নইলে এমন একটা খারাপ জিনিসের বিরুদ্ধে বেশিদিন লড়তে পারত না। যাইহোক, ওই বীভৎস লোকটা একজন ধর্ষক ছিল। তার যাবজ্জীবনে সে অনেকগুলো মেয়ের ধর্ষণ করেছে। সে খারাপ জিনিসের উপাসনাও করত। শেষে তার মাধ্যমেই ধর্ষিত মেয়েদের মাঝে একজন তাকে মেরে ফেলেছে। ইয়ে.. নগ্ন অবস্থায়।
তার লাশটা পচে যাওয়ার পরও তার আত্মা তৃপ্ত হয়নি। সে কাউকেই দেখা দিতে পারত না। তবে তোমার মায়ের মতো মেয়েদের দেহ সে ধারণ করতে পারত। সে তা করে এই যাবৎ অনেক অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। তোমারও করতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস, সময় থাকতে আসিয়া তোমাকে উদ্ধার করেছে। আসিয়া অনেকটাই পবিত্র। ওই শক্তির বিরুদ্ধে সে লড়তে পেরেছে। সে খুব বুদ্ধিমত্তার সাথে তার ঠান্ডা প্রভাবটা কার্যকর করে ওই লোকটির শক্তি কমাতে বাধ্য করেছে। লোকটি অবশ্য ধ্বংস হয়নি। কিন্তু তার মাঝে এখন আর কোনো শক্তি বাকি নেই যে, সে মেয়েদের শরীরে প্রবেশ করতে পারবে কিংবা ওই কতিপয় মেয়েদের দেখতে পারবে যাদের মস্তিষ্ক তোমার আর তোমার মায়ের মতোই।”
“এর সাথে তাবিজের সম্পর্কটা বুঝিনি।”
“তোমার মা গর্ভধারণ করার জন্য অনেককিছু ট্রাই করেছিল। অথচ তুমি গর্ভে এসে গিয়েছিলে। ওসব খারাপ তাবিজ তোমার মায়ের সাথে সাথে তোমারও মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলেছে। আর এই প্রভাবটির কারণেই লোকটি বাস করার জন্য তোমাদের দু’জনের শরীরকে উপযুক্ত পেয়েছিল।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

আদিল বলল, “সাবরিনা, এখানে কিছু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে। লক্ষ করেছ কিনা জানি না। আমি জীবিত থাকতে কিছুটা বদমেজাজি ছিলাম। অতৃপ্ত হওয়ার পর আমার কাছ থেকে ভ্যাঁপসা গরম বাতাস বেরুত। এই বাতাসে সবারই দম গুটে আসার উপক্রম হতো। আসিয়ার ক্ষেত্রে দেখ, সে হয়তো খুবই শান্ত একটি মেয়ে ছিল, যার দরুন সে খুব ঠান্ডা বাতাসের ওপর নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে। আর এই লোকটি, সে তার জীবনে এক নোংরা লোক ছিল বিধায় পরের অতৃপ্ত জীবনে বীভৎস গন্ধ পেয়েছে। আর এসবের মাঝে একটা ব্যাপার হলো, তাদের শরীর পচে যাওয়ার কারণে বা পচতে শুরু করার কারণে তারা মুক্তি পেয়েও আর দেহে প্রবেশ করতে পারেনি। তাদের আত্মা হয়তো রয়ে যাবে।”
কথাটি শুনে আমার অনেকটাই ভালো লাগল। এবার আমার পাশে বসে সাবিলা বলল, “আমি তোর জন্য একটি কাপড় এনেছি। একবার বলেছিলি, আমাদের সাদা কাপড়গুলো তোর খুব ভালো লাগে। আবির এগুলো যেখানে সেলাতে দেয়, ওখানে যেন তোর জন্যও একটি সেলাই করতে দেই।” সে আমাকে একটি প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। “লম্বা গাউন নয়। তবে ফ্রক। জিন্সের সাথে খুব ভালো মানাবে।”
আমি প্যাকেট খুলে খুশিতে আটখানা হয়ে গেলাম। অনেক সুন্দর কাপড়টি। হাত ট্রিকোয়ার্টারের চেয়ে একটু লম্বা, পুরোটা লম্বায় হাঁটুর কয়েক ইঞ্চি ওপরেই পড়বে। কিন্তু পরক্ষণে আমার খারাপ লাগতে শুরু করল। এতোবড় একটা দুর্যোগের পর সবাই আমার কাছে এসেছে। কিন্তু ধ্রুব এখনও দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সাবিলা ইশারায় তাকে ডাকল। ধ্রুব এগিয়ে এলে সাবিলা বলল, “নাও, তোমার বয়ফ্রেন্ড এসে গেছে।”
তাকে ‘বয়ফ্রেন্ড’ বলায় সবাই অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছে। সবার মুখের হাসি উধাও। তার মাঝে সাবরিনা সাবিলার দিকে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সাবিলা সাথে সাথে বলে উঠল, “সরি।”
ধ্রুব কিন্তু কিন্তু করে বসল। সাবিলা বলল, “তোমার বাবার আসার সময় হয়ে এসেছে। আমাদের যেতে হবে।”
তারা বিদায় জানিয়ে চলে যায়। ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করলাম, “সাবরিনা ওভাবে সাবিলাকে শাসালেন কেন?”
“আমাদেরকে ওই বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড বলার ব্যাপারটা মোটেও ঠিক নয়। তাই তিনি ওভাবে ভড়কে উঠেছেন।”
আমি একটু ছ্যাঁচড়ামি করলাম, “তুমি অন্য ভুবনের বলে কি আমরা তা হতে পারব না?”
সে আমার দিকে শান্ত ভঙ্গিতে তাকাল। ও নিশ্চয় কৌতুক বোধ করছে না। “সবকিছু ছেলেখেলা নয় আলিয়া। আমরা একবার যাকে ভালোবাসি, তাকে মন থেকে সহজে বের করতে পারি না। দেখ, সাবিলা আর আবির আলাদা থাকে। তারা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেই এটুকু ভাগ্য পেয়েছে। আমার ভাগ্য নেই। মানে আমি এখানের কাউকে সঙ্গী করতে পারব না। কারণ সাবিলা মানুষ হওয়ায় তাকে নিচে রাখার অজুহাত দেওয়া যায়। আমাকে কীভাবে দেওয়া যাবে?”
আমার অনেক খারাপ লাগল। কাউকেই কখনও পুরোপুরি ভাবে পেলাম না। ধ্রুব আমার জন্য রান্না করতে গেল। ফ্যানের বাতাসও আমার উত্তাপ কমাতে পারছে না। দুর্বল শরীরকে টেনে তুলে বাথরুমে গিয়ে গোসল করি। এসে অনেকক্ষণ শুয়ে রইলাম। একঘণ্টা পর নিজের ঘামানো দেখে মনে হলো, আমি যেন গোসল করিইনি। উঠে ছটফট করতে লাগলাম। তখন সাবিলার দেওয়া ফ্রকটা আমি পরে নেই। জিন্স আর পরতে ইচ্ছে করছে না। পা’গুলো অসম্ভব রকমের উত্তপ্ত।
দেড়টার সময় আমি ঘুম থেকে উঠি। এখন উত্তাপ কিছুটা কমেছে। কিন্তু এমন সময়, ধ্রুব নক করার প্রয়োজন নেই মনে করে ঘরে রীতিমতোই ঢুকে গেল। সাথে সাথে সে চোখ সরাল। আমি সঙ্কোচ করছি না। কারণ তার ওপর আমার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে যে, সে আমার দিকে এই সময় তাকাবে না। তাই হচ্ছে। সে চোখ নিচে রেখে টেবিলের ওপর খাবার রাখল। আমি অন্যদিকে মুখ করে রাখলাম।
সে সুরেলা কন্ঠে টেনে টেনে বলল, “আমি ভেবেছি, এতদিন আমরা দূরে থাকায় তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরবে।”
আমি তোমার অনেক আগেই ভেবেছি। কিন্তু আমি উত্তপ্ত। তোমাদের অতিরিক্ত ঠান্ডা অনুভূত হলে, উত্তাপও হওয়ার কথা। আর তুমি যেভাবে বললে ছেলেখেলা নয়.. আমি কিন্তু সিরিয়াস ছিলাম।
সে বলল, “তুমি কি কাঁদছ? এই, আমি উত্তাপ সইতে পারব। সত্যি!”
আরেক মুহূর্তও না ভেবে আমি ওকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলাম। ছেলেখেলা.. যাই ইচ্ছা সে ভাবুক। আমার এটুকুই ক্ষমতা ছিল, নিজের অনুভূতি লুকানোর। আর পারছি না। আহ্! এই সুগন্ধ। আমি ইচ্ছা করলেও ধ্রুবে কামড় বসাতে পারব না। অনেকদিন.. অনেকদিন হয়েছে ওর এই কর্কশিটের ন্যায় শরীরটার শীতলতা অনুভব করিনি। ওর হৃদস্পন্দন অনেক ধীর। হয়তো পাঁচ-ছয় সেকেন্ড পরপরই কম্পিত হচ্ছে। আমি কতক্ষণ এভাবে কাটিয়েছি খেয়াল করিনি। সে বলল, “খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
আমি কী করছি? ভেবে তো ছিলাম, আমি কিছুই প্রকাশ পেতে দেবো না। তবে এতক্ষণ কোন আক্কেলে জড়িয়ে ধরে রয়েছি?
আমি চোখ নামিয়ে খেতে বসলাম। সে আমার পাশে বসল। মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাইছে। আমি উদ্বিগ্ন হলাম না। সে এতটা নির্বোধ নয় যে, আমার মনোভাবনা হাত ধরা ছাড়া বুঝতে পারবে না। আমি নীরবে খাওয়াও শেষ করে ফেলেছি। সে কিছুই বলল না। আমি যখন প্লেট রেখে ঘরে এসেছি, তখনও সে ওভাবে বসে থেকেছে। আমি বাথরুমে গিয়ে একটা ব্লু জিন্স পরে নেই। বেরুনোর পর সে গলা খাঁকার দিলো। কিছু বলার ইঙ্গিত।
“শুনো।”
আমি শুয়েও পড়লাম। সে তবু বিপরীত দিকে মুখ করে রইল। মুখটা দেখাতে চাইছে না নাকি? “হ্যাঁ, বলো।”
“তুমি আমার সম্বন্ধে জানো না এমন কিছু বাকি আছে বলে মনে হয় না। কারও মনের অবস্থা সময়-সুযোগ কিছুই বুঝে না। তা আপন তালেই চলে। আমার মনে হচ্ছে, আমি এতদিন তোমার অতি নিকটে থেকে অনেক ভুল করেছি। তোমার মনের যা হয়েছে, তার জন্য ধরতে গেলে আমিই দায়ী। মায়ের এতো নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আমি তোমার আশেপাশে থেকেছি। আর এখন, আমি তোমার বন্ধুর চেয়ে বেশিকিছু হতে পেরে খুশি হওয়া উচিত হলেও হতে পারছি না। আমি এর যোগ্য নই। আমি মানুষ নই।”
তাইতো, নইলে সেই কবেই সরাসরি তোমাকে মনের কথাটি বলে দিতাম। কিন্তু তোমার ভালোর জন্যই কিছু বলিনি। আমার ভালোবাসাটা অপরাধ হলে সবচেয়ে অধিক শাস্তি তুমিই তো পাবে। তুমি কত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পৃথিবীতে থাকতে এসেছিলে! আমার কারণেই তোমার পুনরায় তোমাদের ভুবনে ফেরত যাওয়াকে আমি সহজেই মেনে নিতে পারব না। আমার.. আমি বাকিটা জীবন কোনোভাবে চালিয়ে নেব। তাই মনে পাথর রেখে বললাম, “তাহলে তোমার এখানে না থাকাটাই উচিত। তাই না?”
সে কিছু বলল না। তার তো বলা উচিত। এখন আমি প্রায় সুস্থ। “কলেজে কবে থেকে যাবে? তোমার উষ্ণতা সহনীয় পর্যায়ে এসেছে।”
“আমি কলেজে আর যাব না।” তোমাকে দেখলে আমি আরও বেশি কষ্ট পাব।
“এমনটা হয় নাকি? প্লিজ, আমার কারণে নিজের ক্যারিয়ার বরবাদ করো না।”
“ঠিক আছে।”
.
বাবা ফিরে এলেন। আমি তাঁকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রেখেছি। তিনি ধ্রুবকে মনের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানালেন, আমাকে সেরে তোলার জন্য। তারপর সে ব্যাগ নিয়ে বাইরে আসে। আমি কিছুই বলিনি। সে হাসিমুখে বিদায় নিয়েছে। আমার কেন যেন মনে হলো, এই হাসিটা ঠিক হাসি নয়। কোনো একটা প্রতিক্রিয়া ঢাকবার প্রচেষ্টা।
আমি আরেকটি দিন পর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠি। মনেই হয় না, আমার ওপর দিয়ে অনেক ঝড় গিয়েছে আর আমি এখনও জীবিত আছি। আমি কোনো স্বপ্নই দেখিনি। আমি আরও অবাক হই নিজেকে আয়নায় দেখে। চোখের নিচে কালচে ভাবটি নেই। সর্বোপরি আমার চেহারা আগে মতোই উজ্জ্বল।
আমি কলেজে যাওয়া শুরু করলাম। সাঈদ বলল, “আলু, তুমি এতদিন ছিলে কোথায়? ফোন কেন রিসিভ করতে না?”
“আমার নাম আলিয়া।”
“ওকে ওকে।”
“আমি অসুস্থ ছিলাম।”
“ওহ্, বাই দ্যা ওয়ে, তোমার সুগন্ধটা খুব ভালো লাগছে।”
স্বস্তি পেলাম। “থ্যাংকস।”
“দেড় মাস যে পড়ালেখা করনি। তার কী হবে?”
“আমি ম্যানেজ করে ফেলতে পারব। তুমি কেবল আমায় পড়াগুলো দেখিয়ে দাও।”
“শিওর ম্যাম। পারবে তো এতগুলো পড়া কভার করতে?”
“আমি প্রায় কিছু টেকনিক্যালি তাড়াতাড়ি মাথায় ধারণ করতে পারি। রুমন কোথায়?”
“ঘুরছে।”
“ওহ্।”
সবাই আমার সাথে ভালো ব্যবহার করল। তাদের মনে হচ্ছে, আসিয়ার বিয়োগের কারণে আমার সাথে সহানুভূতি টাইপ ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু তারা জানে না, আমি তাকে পুরোপুরি হারাইনি। কিন্তু এরই মাঝে অনেককিছু পেয়েছি, যা মানুষ হিসেবে খুব বেশিই পাওয়া। একটি অর্ধ পরী আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তার মা-বাবা বহুল ক্ষমতাধারী অমানব। তার হাসবেন্ড আমার ভাইয়ার ন্যায় এবং কলেজের অধ্যাপকও। ধ্রুবের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। সে কলেজে আসার পর আমার সাথে অন্তরঙ্গের ন্যায় কথা বলতে চেয়েছে। আমি কেবল বাকি ক্লাসমেটের মতোই তার সাথে কথা বললাম। একদিন.. দুই দিন.. অবশেষে একসপ্তাহ পেরুল। আমি ওর সাথে একটুও কথা বললাম না। খুব কষ্ট হয়। কিন্তু এটাই ওর জন্য ভালো।
আজ ছুটি শেষে ধ্রুব ঠিক আগের মতোই অন্য ভবনের সামনে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার পাশ কাটিয়ে তাকে না দেখার ভান করে চলে যেতে চেয়েও পারলাম না। সে তবু বলল, “আলিয়া, আমি মজিদকে পাঠিয়ে দিয়েছি। আজ তোমায় আমি ড্রপ করে দেই?”
“না থাক। আমি সিএনজি করে চলে যাব।”
“কী বলছ তুমি!”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছি না। আমি ওকে সত্যিই অবহেলা করতে চাইছি না। কিন্তু…
আমি বেরিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লাম। সে এখনও আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর এই প্রশ্নবোধক বিষণ্ণ চেহারা আমি দেখতে পারছি না। আমি চোখের পানিগুলো লুকালাম। গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হলো।
বিকেলে আমি জঙ্গলে সাবিলাদের বাসায় পৌঁছলাম। আহ্! আমি এই বাড়িটি আর তার মানুষ-অমানুষগুলো ব্যতীত একদিনই হয়তো থাকতে পারব না। প্রায় সবাই আমাকে একেক করে জড়িয়ে ধরল। কত খুশিই না আমার লাগছে। এই প্রথম আমি তাদের সুগন্ধকে উপভোগ করতে পারছি। এর আগে যে বিকর্ষণটি কাজ করত, তা একদমই করছে না। আমি সোফায় বসে থাকার সময় আমার সামনে সাবরিনা বসে একনাগাড়ে আমার দিকে চেয়ে ছিলেন। খেয়াল করলাম, মাঝে মাঝে তার চোখ কিছুটা নীলচে দেখাচ্ছে।
“তোমার বায়োডাটা এখনও পড়তে পারছি না।” তাহলে তিনি কারও মস্তিষ্কে প্রবেশ করলে হয়তো এমনটা হয়।
আমি হাসলাম, “আমি এখনও কাটাছেঁড়াকে ভয় পাই। এটা আমার নিজের বৈশিষ্ট্য।”
সাবিলা সংযোগ করল, “সে এখনও অন্যের ব্যথা নিজের করে অনুভব করতে পারে।” সে বলল, “আলিয়া, চলো আমার সাথে।”
তার সাথে আমি বাইরে এলাম। কবে সন্ধ্যা হয়েছে বুঝতেই পারিনি। বাবা হয়তো ভাবছেন, আমি ধ্রুবের সাথে কোথাও ঘুরতে গিয়েছি। সাবিলা আমায় বলল, যাতে তার পিঠের ওপর উঠি। আমি তাই করলাম। সে আমার হাঁটুর ওপরের অংশ হাত দিয়ে ধরল। আচমকা আমি তার ডানা চোখের সামনে দেখতে পাই। বিস্ময়ে আনন্দে নিজের মাঝেই আমি রইলাম না। আমাকে কি সে উড়াবে? মুহূর্তেই তার ঝকঝকে ডানা এক ঝাপটানোয় অনেক উপরে উঠে গেল।
“টাইট করে ধর।”
তার পেটের অংশ আমি শক্তভাবে ধরলাম। আমরা উড়ছি! মাটি আমাদের অনেক নিচে। আমরা উঁচু গাছগুলোর ঊর্ধ্বে পৌঁছে গেছি। আমি যাস্ট বিশ্বাসই করতে পারছি না। আমাকে অবাক করে দিয়ে সাবিলা কাঁত হয়ে উল্টোভাবে শোয়ার ন্যায় চিলের মতো ডানা ছড়িয়ে উড়তে লাগল। আমি আনন্দে হুয়া… ওয়াও.. নানা শব্দে চিৎকার করতে লাগলাম। সে জঙ্গলের গাছগুলোর এভারেজ উচ্চতার ওপরে উঠছে না। হয়তো কেউ আমাদের দেখতে না পাওয়ার জন্যই। এই মুহূর্ত, এই মুহূর্ত কখনও না ভোলার মতোই। এরপর আমার আনন্দ বুজে গেল। তা দেখে জঙ্গলের মাঝ পথে সাবিলা মাটিতে নেমে গেল।
“কী হয়েছে আলিয়া?”
আমি হাসার চেষ্টা করলাম, “কিছু না।”
“আমার বোন, তোমার কিউট চেহারাটা আমার কাছ থেকে কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারে না। কী হয়েছে বল?”
“ধ্রুব…”
“মা বলেছিল, তোদের মাঝে বন্ধুত্ব না টেকার অবস্থা হয়েছে। আফটার অল, সে ছেলে আর তুই মেয়ে। তোর ফিলিংস থাকতেই পারে।” সে আমার নির্লিপ্ত মুখ দেখে বলল, “এই, তুই কি ওকে ভালোবেসে ফেলেছিস?”
আমি কান্না কন্ট্রোল করতে ঠোঁট বাঁকিয়ে রাখলাম।
“নো.. এটা হওয়া মোটেও উচিত হয়নি। ধ্রুব যদি তোকে ভালোবেসে ফেলে তবে শেষ!”
“তুই কি পাগল? ও আর আমাকে ভালোবাসবে?”
“কেন নয়? আবেগের দিক থেকে ওদের মন মেয়েদের চেয়ে বেশি কোমল।”
“তাই বলে এতগুলো মেয়ে থাকতে সে আমাকে ভালোবাসতে আসবে না।”
“আমি অবশ্য ওর চোখে যে ভালোবাসাটা দেখেছি, তা হয়তো বন্ধুত্বেরই হতে পারে। অন্যকিছু না হলেই বেশি ভালো। আশা করি, তুই নিজেকে ঠিক করবি। নিজের জীবন নষ্ট করিস না। তোর জন্য ভালো কোনো মানুষও থাকতে পারে।”
ধ্রুবই সেই মানুষ.. সে আমার জন্য একদিক থেকে মানুষই। নইলে তাকে ভালোবাসতাম না। আমাকে ঠিক করতে সাবিলা আবারও উড়তে শুরু করল। এবার আমি চিৎকার করছি না। তবে উপভোগ করছি। একসময় সাবিলা জঙ্গলের ডানপাশটায় এলে বললাম, “থাম। থাম।”
সে না নেমে ওখানেই থামল, “এটা কী ধ্রুব? ও জঙ্গলে এই সময় কী করছে?”
“সময় কাটাচ্ছে।”
“এই, ওর হয়তো মন খারাপ। তুই কি উল্টাপাল্টা কিছু করেছিস?”
আমি আমতা আমতা করলাম। আমি আর সাবিলা দু’জনই তার সামনে নামলাম।
সাবিলা বলল, “কী হয়েছে?”
ধ্রুব আমাকে দেখে নীরবে দাঁড়াল। তবে কিছু বলছে না।
“তোমাদের মাঝে ঝগড়া হয়েছে নাকি?”
আমিও মুখ ঘুরিয়ে রেখে বললাম, “আমাদের এতদিন একসঙ্গে থাকাটা কিনা ভুল ছিল!”
সাবিলা এবার কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “অনর্থ হওয়ারটা হয়েই গেছে।” কাকে বলেছে কথাটি? “তোমরা দুজন এখানে থাক। আমি যাচ্ছি।”
আমাকে কিছুই বলার অবকাশ না দিয়ে সাবিলা আঁধারে মিলিয়ে গেল। আমি ব্যর্থ হয়ে ওর পিছু নিতে গেলাম, “সাবিলা, কোথায় যাচ্ছিস আমাকে একা ফেলে? আমি বাসায় কী করে যাব?”
কিন্তু আমার সামনে ধ্রুব চলে এলো। আমার মাথা ওর কাঁধের অনেক নিচে। ওহ্, সেই মাটি থেকে উপরে। “নিজের শক্তি দেখানো বন্ধ করবে? আমায় যেতে দাও।”
“আগে আমার কথাটি শোন।” কি কোমল-গম্ভীর ওর গলার স্বর!
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখলাম, আমার মাথা এখন ওর কাঁধ বরাবর। “সাবিলার কাছে যাচ্ছ নাকি আমার কাছ থেকে পালাচ্ছ?”
“তাতে তোমার কি?”
সে হাসল। কি সুন্দর সেই হাসি! আমার হৃৎপিন্ড… ফিসফিসানির মতো করেই সে বলল, “অনর্থ হওয়ারটা হয়েই গেছে।”
“সাবিলা কথাটি কেন বলেছে?”
সে আমার অনেক কাছে এলো। আমি মুখ নিচু করে রয়েছি। সে দুইহাত আমার গালে দিয়ে মুখটা তুলল। “আমার মন পড়ে বলেছে। তোমার আগে ভুলটা আমিই করেছি। আমি এতদিন তোমার কাছ থেকে দূরে থেকে সবকিছু বুঝেছি, কেন আমি তোমার এতো কেয়ার করি। আমি.. আমারও সেই রোগটি হয়েছে, যেটা তোমার হয়েছে।” আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। “আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি যে, তুমি দূরে থাকলে কষ্ট পাই। আমি সবসময় তোমার পাশে থাকতে চাই। তুমি কী করো, কী ভাবো একটা কিছুও মিস দিতে চাই না।”
আমি খুশি হব নাকি দুঃখিত হব জানি না। তবে একটু ন্যাকামি না করে পারলাম না, “যদি আমি তোমাকে এখন ভালো না বাসি?”
“হতেই পারে না।” সে হেসে আমার হাতটা নেয়। আমি কাকে বোকা বানাতে গিয়েছি? সে ওই হাতটা কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে অনুভব করে তার গালে স্পর্শ করায়। আমার হৃদস্পন্দন দ্রুতবেগে বেড়ে গেল। অসম্ভব একটা ছেলে! এসব করলে কে আর তাকে ভালো না বেসে থাকতে পারবে?
“তোমার হৃদস্পন্দনই জানান দিচ্ছে, তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো। তোমার ভালোবাসা সাধারণ নয়। যে আমাকে আঘাত না করার জন্য নিজেই কষ্ট কাঁধে নিয়েছে, সে দুইদিন পর ভালোবাসা কমিয়ে ফেলতে পারে না। তুমি তো একদমই না।”
“এটা হওয়ারই ছিল। এখন কী হবে? আমাদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে?”
“জানি না,” আমার হাত এখনও তার গালে। সে এখনও চোখ বন্ধ করে উপভোগ করছে। বাজি ধরছি, কেউই কখনও আমার ধ্রুবের মতো হতে পারবে না। “তবে এতদিন যেভাবে লুকিয়ে থেকেছি, এখনও তোমাকে নিয়ে তেমনটা থাকতে পারব। একটা খুশির কথাও হলো, আমাদের কেউ তোমাকে পড়তে পারে না। আমরা.. বাকি মানুষের মতো থাকব।”
“সত্যি?” আমার চোখ থেকে কবে ফোঁটা কয়েক পানি গড়িয়ে পড়েছে টেরই পাইনি।
“হ্যাঁ।”
আমি লাফিয়ে উঠে ওর ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
“ধ্রুব, তুমি জানো না। এই মুহূর্তে আমার চেয়ে বেশি সৌভাগ্য আর কারও নেই।’
“আমারও। আমি ভাবিনি, আমার কপালে বিজলীর চেয়ে অধিক ভালো কেউ আছে।”
আমার কতটা খুশি লাগছে, তার ধারণা নিজেই করতে পারছি না। এই প্রথম বোধ করি, আমি সুস্বপ্ন দেখছি।
সাবিলার বাসায় আর গেলাম না। ধ্রুবকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বাবা তাকে ডিনার করতে বললেন। সে করল না। বাসায় চলে গেল। আমি লম্বা একটা দিন কাটিয়ে এখন ক্লান্ত হয়ে বিছানায় ভারী শরীরটা ফেললাম। আহ্! একটু আগেই তো ধ্রুব গিয়েছে। আমি ওকে মিস করতে শুরু করেছি। আমার ভেতরে কেমন এক লজ্জা, ভালো লাগা সবকিছুই মিশ্রিত হয়ে দারুণ এক অনুভূতি তৈরি করেছে। মুখে অস্ফুটভাবে ভালোবাসার সাথে উচ্চারিত করলাম, “ধ্রুব।” এমন সময় একটা মৃদু শব্দ পেলাম। লাফ দিয়ে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই।
একটা মৃদু সুরেলা কণ্ঠ নিচুস্বরে বলল, “আমি এখানে আছি।” ধ্রুব দৃশ্যমান হলো।
“আমার ঘুম আসছিল না।”
“শিসস..” সে আমায় ফিসফিস করে বলল, “আসতে কথা বলো।”
আমিও ফিসফিস করলাম, “ভাগ্যিস বেলকনির দরজাটা খোলা রেখেছিলাম। নইলে আচমকা তোমার সুগন্ধ পাওয়ার চেয়ে বেশি খুশি আমি হতে পারতাম না।”
“না ঘুমিয়ে এতক্ষণ কী করছ? সাড়ে এগারোটা বাজছে।”
আমি খানিকটা লজ্জা পেলাম। “ঘুম আসছে না। আমার পাশে শুবে? প্লিজ?”
আমি বিছানায় শুলাম। সে মাঝখানে অর্ধহাত জায়গা রেখে আমার পাশে শুল। ওর কোমল বামহাতটা আমার ডানহাতের ওপর রেখে সে চোখ বন্ধ করল। আমিও আমার অন্যহাতটি তার ওই হাতের ওপর রেখে চোখ বন্ধ করলাম। এভাবে তাকে অনুভব করার সুখ আর কোথায় বা আমি পাব! চোখ খুলে দেখলাম, আধো অন্ধকারে সে চোখ বন্ধ রাখা অবস্থায় মিটিমিটি হাসছে।
“কী হয়েছে?”
“তোমার হৃৎপিন্ড অনুভব করছি। ভাবলেই খুব ভালো লাগছে যে, এটার দ্রুততা আমার কারণেই বেড়েছে।”
আমি আমার বামহাতটা ওর বুকের উপর রাখলাম। বিস্ময়ে বলে উঠলাম, “তোমার হৃদস্পন্দন একদম মানুষের মতো হয়ে গেছে।” কারণটা ভেবে আমি আবারও লজ্জা পেলাম। “আমি কিন্তু সারারাত এটার আওয়াজই শুনব।”
“না, ঘুমাও।” সে তৎক্ষণাৎ নিচুস্বরেই একটা ইংলিশ গান গাইতে শুরু করল। আমি চোখ বন্ধ না করে পারলাম না। কারণ ওর মধুর সুরের গান আমি মিস দিতে পারব না। সে গেয়ে চলল।
If I had to live my life without you near me
the days would all be empty
the night would seem so long.
With you I see forever oh so clearly
I might have been in love before
but it never felt this strong
Our dreams are young and we both know they’ll take us where we want to go
Hold me now
Touch me now
I don’t want to live without you
Nothing’s gonna change my love for you
You ought to know by now how much I love you
One thing you can be sure of, I’ll never ask for more than your love.
আমি বিমুগ্ধ হয়ে ভাবছি, আমার জীবনের আঁধার বুঝি অবশেষে কেটে গেছে।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার