“তিমির” পর্ব ১৬

0
1902

“তিমির” পর্ব ১৬

খুব সকালে উঠে আমি কলেজের পড়াগুলো শেষ করে নেই। সময়গুলো কাটতেই চাইছে না। আটটার দিকে মজিদ ভাই ব্রেকফাস্টের জন্য ডাকলেন। আমি খেতে গেলাম। খাবার অর্ধেক শেষ করার পর খেয়াল করলাম, বাবা মিটিমিটি হাসছেন।
“কী হয়েছে?”
“তোকে খুব খুশি দেখাচ্ছে। তা দেখে আমারও খুশি লাগছে।”
বাবা এটার অন্য কোনো অর্থ বের করছেন না তো? আমার খানিকটা লজ্জাই লাগল। বাবা বলল, “তোর মা বোধহয় রাগী স্বভাবের ছিল না। বিয়ের পর এমনটা মনে হয়নি। তার মৃত্যুর আগে তার সাথে আমি একদমই দেখা করতে পারতাম না। সে কি রাগ! তখন তার সম্ভবত কোনো রোগ হয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে তোর রোগটা শাহানার কাছ থেকেই এসেছিল।”
আমার গলায় খাবার আটকে গেল। তাড়াতাড়ি পানি খেলাম। বাবা আবার মনে না করে বসেন, ওটা আসলে রোগ ছিল না। আর রাগটা, ওই চিনচিনে রাগটা অনেক ভয়ংকর। আমার মনে সামান্য ঘৃণা থাকলেও ওই রাগটা ঘৃণাটাকে টেনে অনেক লম্বা করেছে। বাবাকে সামান্যই অপছন্দ করতাম। শেষে আমি তাঁর সাথে কেমনই না করলাম! ভাগ্যিস এমন সময় আসিয়া চিঠি লেখায় তার প্রতি ঘৃণাটা একদমই কমে গিয়েছিল।
বাবা এবার বলল, “তুই আর ধ্রুব সারা সন্ধ্যা বাহিরে ছিলি। বাবা হিসেবে তোকে আমি বঞ্চিত করব না। যার সাথে সুখে থাকতে পারবি, তার সাথে তোকে থাকতে দেবো। নিউ জেনারেশন সাপেক্ষে ধ্রুবকে আমি তোর বয়ফ্রেন্ড হিসেবে মেনে নিতে পারি। কারণ সে তোর অনেক খেয়াল রাখে। কিন্তু আমাকে না বলে কোথাও যাস না।”
“ঠিক আছে। বাবা, আমি আর ধ্রুব একে অপরের সাথে সময় কাটাতে অনেক পছন্দ করি। ও আমাকে অনেক ভালোবাসে, যার কারণে আমরা কেউই বেশিক্ষণ একে অপরকে না দেখে থাকতে পারি না। আমি আশা করব, আপনি আমাদের সম্পর্কে ভুল কিছু ভাববেন না।” ভেবেই অবাক হচ্ছি, বাবার সাথে এতটা নিঃসঙ্কোচ হতে পেরেছি। হয়তো নিঃসঙ্কোচে কথা বলার মতো লোক কম থাকায়।
বাবা হা করে চেয়ে রয়েছেন, “তোরা এতটাই সিরিয়াস?”
“মানে?”
“মানে আমি ভেবেছি, আজকাল যেভাবে কিছুদিন রিলেশন করার পর ব্রেক আপ হয়ে যায়, তোদের মাঝে ওরকম সাময়িক কিছু আছে।”
“না, ধ্রুব এমন ছেলে নয়, যাকে দুইদিন পর ছেড়ে দেওয়া যাবে। আমি ওকে অনেক ভালোবাসি। কারণ সেই একমাত্র ছেলে, যে আমার সুখেদুঃখে সবসময় আমার সাথে আমার ছায়া হয়ে ছিল। ও আর আমি আলাদা হতে পারব না।”
“ওহ্, ধ্রুব এমনই একটি ছেলে। একবার সে আমার হাত ধরেছিল। খুব ভালো লেগেছিল। তার কোমলতা, তার নম্রতা সবই তার একটি ভালো ছেলে হওয়ার লক্ষণ।”
মৃদু হাসলাম। আমি তড়িঘড়ি করে ঘরে চলে এলাম। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ওই পিচ্ছিল সুতাটি স্বর্ণের আংটি পরে সেটির সাথে পেঁচিয়ে নেই। এরপর কলেজের জন্য বেরিয়ে পড়ি। ওখানেই ধ্রুবের সাথে দেখা হলো। ওকে দেখতেই আমার কেন যেন লজ্জা লাগা শুরু হয়ে গেল। এসব লক্ষ করে সেও মুচকি হাসি হাসে। আমি কেন যেন ওর সাথে একা যেভাবে কথা বলতে পারি, জনসমক্ষে সেভাবে পারছি না। আজ ক্লাস করার সময় পাশে বসে মৌমিতা জিজ্ঞেস করল, “এই, তোকে এতো খুশি খুশি দেখাচ্ছে কেন?”
অদ্ভুত! আজ সবাই একই প্রশ্ন কেন করছে? ধ্রুব যেভাবে আমার গাল ধরেছিল, আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল, কালরাত যেভাবে আমার হাত তার হাতে নিয়ে আমার হৃদস্পন্দন অনুভব করেছিল, এসবেরই হয়তো প্রভাব। মৌমিতা এবার বলে ফেলল, “তুই আর ধ্রুব কি..”
“হ্যাঁ। তুই আর রুমন যেমনটা।”
সে চুপসে গিয়ে বলল, “তুই অনেক লাকি। মানে ধ্রুবকেই বয়ফ্রেন্ড হিসেবে পেয়ে।”
ভুল বলেছিস। ধ্রুব আমার জীবনসঙ্গী। আর আমি তার। আমার ছুটি শেষে অন্য ভবনের সামনে ধ্রুবের সাথে দেখা হলো। সে আচমকা বলল, “থ্যাংকস।”
“কেন?”
“ব্যান্ডের অংশটি পরার জন্য। তোমার হৃদস্পন্দন এখন যেখানে-সেখানে শুনতে পারছি।”
আমি লজ্জার মাথা খেয়ে বললাম, “তো, আজকে কী কী প্ল্যান আছে?”
“কেমন প্ল্যান?”
“কী কী করব?”
“প্ল্যান তো করিনি।”

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

আমি ভেবেছি, তুমি আমার বাসায় আসবে। কালরাত যেভাবে আমার পাশে শুয়ে আমার জন্য গান গেয়েছিলে, ঠিক সেভাবেই আজ করবে। তোমাকে কেবল আমার পাশে রাখা চাই। আর কিছু চাই না। তোমাকে যতক্ষণ চোখের সামনে দেখি, ততক্ষণই আমি ঠিক থাকি, যেন তুমি মাদকতা। ঠিক সাবিলার মতোই আমিও এখন অনেক ভিন্ন কিছু অনুভব করি। আমি কালরাত যেভাবে না ছুঁয়ে থেকেছি, ঠিক সেভাবেই থাকতে পারব। কিন্তু তার পাশে থাকা চাই-ই চাই। আমি একটু রাগ দেখালাম, “আজ কি তুমি আমার বাসায় যাবে না বুঝি?”
সে ভ্রূ কুঁচকিয়ে বিরক্তির সাথে বলল, “যেতে হবে?”
“যেতে হবে মানে?”
সে শয়তানি হাসি হাসল, “সত্যিই, কোনো প্ল্যান নেই। তোমার সাথে সময় কাটানোর জন্য আমার কাছে প্ল্যানের দরকার হয় না।”
আমি আবার লজ্জায় ভরে গেলাম। হঠাৎ আর কিছু বলার জন্য কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। সে বলল, “আজ জঙ্গলে যাব কেমন? ওখানে রাতটা ভালো কাটবে।”
“আচ্ছা, সাবিলারা.. আমার মনে হয় সাবরিনা আর আদিলের কাছ থেকে আমাদের লুকিয়ে থাকা উচিত। আগেই তারা আমাদের জেরা করেছে, একে অপরকে ভালোবাসতে শুরু করেছি কিনা। তারা যদি আমাদের আলাদা করে দেয়?”
তাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। “তা নিয়ে আমি ভেবেছি। আমি তো লুকিয়ে থাকতে পারব। কথা হচ্ছে, তুমি সাবিলাকে ছাড়া থাকতে পারবে কিনা।”
আমি মনে পাথর রেখে বললাম, “সে এমন নয় যে, তার সাথে যোগাযোগ না রাখলে আমাকে ভুলে যাবে। সে আমার ফিলিংস বুঝে। সে মাইন্ড করবে না, তোমার সাথে থাকার কারণেই ওর সাথে দেখা করতে না গেলে।”
“তাহলে ঠিক আছে।”
জিসান ভাই তাদের গাড়ি করে চলে যায়। ধ্রুব কলেজে বাইক আনে না। মজিদ ভাই গাড়ি নিয়ে এলে আমরা দু’জনই উঠে বাসায় চলে আসি। রাত হওয়ার জন্য আমি খুব উত্তেজিত। সেই সাথে কিছুটা উদাসও। ধ্রুবকে সেই কবে সন্ধ্যাবেলায় দেখব!
আমি গোসল সেরে লাঞ্চ সেরে নেই। ঘরে বসে দুয়েকটা বই ঘাটাঘাটি করছি। সময় কাটছে না। ধ্রুবের সাথে তো খুব দ্রুত কেটে যায়! এখন আমি আগের মতো ঘুমাইও না। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ঠিক এমন সময় আমার বেলকনিতে শব্দ হলো। আমি খুশিতে উঠে দাঁড়াই। ধ্রুব হাসিমুখে এগিয়ে এলো। আজ সে অদৃশ্য হয়ে আসেনি। আমার কাছে সে যখন আসে, তখন তার সুগন্ধ উপভোগ করতে গিয়ে দেখিইনি তার হাতে একটি ঝুড়ি আছে। সে ঝুড়িটা এগিয়ে দেয়, “তোমার জন্য।”
আমি হা করে চেয়ে রইলাম। ঝুড়িতে ছোট একটা কিউট খরগোশ। “ওয়াও, কি কিউট!”
“আই হোপ, তোমার সময় ভালো কাটবে।”
“ওহ্, আমার সাথে না থাকার জন্যই বুঝি এটা দিয়েছ।” আমি ঠোঁট বাঁকালাম।
“প্রেয়সী,” কি সুন্দর করে সে ডাকল আমায়! হাত দিয়ে সে আমার চিবুক উপরে তুলে বলল, “আমি তো ওর চেয়ে বেশিই থাকব তোমার কাছে। আমিও যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি না।”
“তাহলে যেও না।” আমি ওকে ধরেই রাখলাম।
“যাচ্ছি না। বলো, তোমার গিফটটা ভালো লেগেছে?”
“হ্যাঁ, তবে আমার পোষা প্রাণী ভালো লাগে না। মানে এদের মল, ইয়াক।”
সে হাসল। তারপর কিউট খরগোশটার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো, “ও অবুঝদের মতো যেখানে-সেখানে কাজ সারবে না।”
“তা কীভাবে?” ভেবে অবাক হলাম, “তুমি কি ওকে বুঝিয়েছ যে, আমার এসব পছন্দ নয়?”
সে মুচকি হাসল, “এইমাত্র।”
“তুমি..”
“আমি…?”
“অসম্ভব।”
সে নিঃশব্দে হাসল। কি সুন্দর সেই হাসি!
“জানো, তোমাকে তোমার ক্লাস সাপেক্ষে অনেক বড় দেখায়।”
“হ্যাঁ, আমি কিন্তু পৃথিবীর মতে, প্রায় আবিরেরই সমান, গঠনের দিক থেকেও। এবং আমি পঁচিশ বছরের একটি ছেলের মতোই ম্যাচিউর। কিন্তু বয়সটা মানুষের মতোই বাড়ছে। উনিশে কোনোভাবে ইন্টারেই আসতে পারলাম।” সে হাসল।
আমরা দু’জন গল্প করতে লাগলাম। আমাদের বিষয়ে। আমরা একে অপরকে দেখার আগে কেমন ছিলাম। কী কী করেছি, সবই শেয়ার করতে লাগলাম। কারণ সে আমার হাত ধরে আমার বায়োডাটা পড়তে পারে না। আর আমি একটি মানুষ। তাদের জীবনীগুলো শুনতে খুব ইন্টারেস্টিং লাগে। আমার সাথে দেখা হওয়ার আগে, সে একটি সাধারণ জীবনই কাটাচ্ছিল। অবশ্য এটা আমার দিক থেকে। সে নানা মানুষের সাথে দেখা করেছে। নানা মানুষের ভিন্ন ভিন্ন ইন্টারেস্টিং স্বভাব দেখেছে। কারও ভালোবাসা দেখেছে, দেখেছে কারও প্রতারণা। এসব গল্পের সময় আমি কখনও ওর কোলে শুয়ে থেকেছি। কখনও বা ওর চুলের ঘ্রাণ নিয়েছি। কখনও তার কোমল হাত ধরে থেকেছি। এক মুহূর্তও আমি তাকে ছাড়তে পারিনি। আমার মনে হচ্ছে, এটা কোনো স্বপ্ন। চোখ খুললেই দেখতে পাব, ধ্রুব আমার পাশে নেই।
কেবল কথা বলতে বলতেই রাত হয়ে যাওয়ায় আমরা আর বেরুইনি। কেবল সে আমার পাশে থাকলে আমার কোনো জায়গাই লাগবে না। সত্যিই তো, আমার ক্ষেত্রেও তার সাথে সময় কাটানোর জন্য কোনো প্ল্যানের দরকারই নেই। সে মাঝখানে স্রেফ একঘণ্টার জন্য বাসায় গিয়েছিল। বাকিটা সময় আমার পাশেই থেকেছে। সে আজও আমার পাশে শুল। কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমি ঘুমানোর জন্য সে একটি গান গেয়েছে। এবার বাংলা একটি সুরেলা গান। আমি কয়েক মিনিট পর ঠিক গতরাতের মতোই ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে উঠলে দেখলাম, ঠিক আগের মতোই সে ভোর হওয়ার আগেই চলে গেছে।
আমাদের দিনগুলো এভাবেই যেতে লাগল। বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনও হয় না। বাসায় দু’জনের কথা বলতে বলতে সময় কেটে যায়। অবশ্য বাবার অজ্ঞাতসারে।
তিনদিন পর আমরা বাইরে সন্ধ্যার দিকে বেরুলাম। ধ্রুবকে বললাম, “প্লিজ, আমায় বাইক চালানো শেখাবে?”
“ওকে।”
আমি বাইকে বসলাম। সে হেসে আমার পেছনে বসল। কিছুই তো বুঝছি না। সে আমার হাতটা নিজের হাতে নিলো। এবার সে আমার কাছে থাকায় সে চোখ বন্ধ করার সময় তার চোখগুলো কিছুটা সবুজ দেখাল। সে চোখ বন্ধ করার পর আমার মস্তিষ্ক কেমন যেন উলটপালট হয়ে গেল! কোনো চিন্তাই কাজ করছে না। সে যখন হাত ছাড়ল, তখন বাস্তবে ফিরে এলাম। “কী করেছ?”
“তুমি এখন বাইক চালাও।” কিছুই বুঝছি না।
এখন মনে হচ্ছে যেন এভাবে বাইকে আমি প্রথমবার বসিনি। এর আগেও যেন বহুবার আমি বাইক চালিয়েছি এমন একটা ভাব উদয় হয়েছে। আমি বাইক স্টার্টও দেই। আশ্চর্য। মনে হচ্ছে, আমি সবকিছুই জানি। বাইক চালাতে শুরু করলে আমি দক্ষের ন্যায় চালাতেও লাগলাম। বাঁক নেওয়ার সময় একটুও দ্বিধা হয় না, ব্রেক কষার জন্যও প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে না। “তুমি আমায় শিখিয়েছ? কীভাবে?”
“আমার হাতের শক্তি দেখেছ কোথায়?”
“আর কী কী পার?”
“আমি তেমন কিছু শিখিনি। তবে বাবা-মা অনেককিছুই পারেন। তাদের বয়স নেই। মানে তারা সবচেয়ে প্রাচীন পূর্বপুরুষ। আমি তাদের শেষ সন্তান, যে কিনা অবশেষে তাদের শক্তি পেয়েছে। তাদের ছাড়া আমাদের প্রজন্মও হতো না।”
“তা কীভাবে?”
“যে জুটি সন্তান নিতে চায়, মা-বাবাই তাদের সাহায্য করেন। আমি যাস্ট ব্যাপারটা দেখেছি। তাও একবার। প্রক্রিয়াকরণ জানি না। হয়তো অনেক সিম্পল। দেখেছি, তারা কোনো পরীর পেটের অংশে তার সঙ্গীর হাত প্রথমে রাখেন, এরপর নিজেও ওই জ্বীনের হাতের ওপর হাত রাখেন। তারপর কীভাবে যেন প্রসেসিং করে জ্বীনের বৈশিষ্ট্য ওই পরীতে স্থানান্তর করেন। প্রায় এভাবেই কাজটা সম্পন্ন হয়।”
আমি হা করে রইলাম, “তবে কি মানুষের মতো কিছুই হয় না?”
সে হাসল, “না।”
“তাহলে সাবরিনা কীভাবে মানুষের সন্তানকে জন্ম দিয়েছেন?”
“ওটাই একটা আশ্চর্যের ব্যাপার। সর্দার ব্যতীত এখানে তখন কেউ আসেনি। তিনি ধারণা করেছিলেন, দুই জায়গার প্রজনন যেহেতু ভিন্ন, সেহেতু সাবরিনাকে এখানে রেখে যাওয়া রিস্কি হবে না। তিনি রেখে গেলেন। যখন সাবরিনা গর্ভধারণ করলেন, তখন তারা অবাক না হয়ে পারলেন না। এরপর সবাই ধারণা করেছে, আমরা যেহেতু নিজেদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অধিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারি এবং নিজেদের মানুষের মতো করে তৈরি করে নিতে পারি, সেহেতু মানুষের মতো গর্ভধারণ অসম্ভব ব্যাপার নয়।”
“তোমরা নিজেদের মানুষের মতো তৈরি করে নিতে পার মানে?”
সে হাসল, “তুমি কী ভেবেছ? আমরা কি আকাশে সম্পূর্ণই মানুষের মতো থাকি?”
“তবে?”
“এখানে আসার আগে আমাদের দৈহিক অনেককিছুই পাল্টাতে হয়। মনুষ্য উপযোগী করতে হয়। আমাদের ত্বক, নখ, দাঁত.. এমন আরও অনেককিছু পাল্টাতে হয়।”
“তোমাদের নখ কেমন?”
সে তার নখ দেখাল। মানুষের মতোই আছে। কিন্তু পরক্ষণে সে তা পাল্টাতে শুরু করছে। ওর নখ দেখতে কিছুটা গ্লাসের মতোই হয়ে গেল। দেখতে একদমই পাতলা মনে হচ্ছে না। অস্বাভাবিক! এবং সুন্দর ক্রিস্টাল ক্লিয়ার।
“আমাদের নখ বাড়ে না।”
“আর তোমাদের ত্বক?”
“এটা বিশেষ কিছু নয়। তা যেমন থাকা উচিত।” সে প্রসঙ্গটা বাদ দিতে আমার গাল ছুঁল।
“তোমার হাত এখন গরম।” হুহ!
“তোমার জন্য করেছি। তুমি যে ঠান্ডায় জমে থেকেছ!”
“সিরিয়াসলি? করতে পার?”
“হ্যাঁ। আরও করতে পারি না। তুমি তো জানোই, আমাদের নিজের ওপর কন্ট্রোল কতটুকু।”
“তাহলে আমায় জড়িয়ে ধরো।”
সে পেছন থেকে আমায় গলা বরাবর জড়িয়ে ধরল। আমি বাইক চালানোর সময় সে আমায় উষ্ণতা দিয়ে ঠান্ডা একদমই লাগতে দিলো না।
আমাকে জঙ্গলে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যানটা নিয়ে অবশেষে সে আরও দুইদিন পর ভেবেছে। এরই মাঝে এতদিন সে বিকালে আমার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে এসেছে। গতকাল আমার জন্য সে চুড়ি এনেছিল। আজ না জানি কী আনবে। দুপুরে বাবার সাথে খাওয়ার সময় কথা হয়। তাঁকে বললাম, “আজ একটু ধ্রুবের সাথে বাইরে ঘুরতে যাচ্ছি। দশটার আগে ফিরে আসার চেষ্টা করব।” মনে মনে বলছি, প্লিজ, জিজ্ঞেস করবেন না কোথায় যাচ্ছি।
বাবা হাসলেন, “নিজের খেয়াল রাখিস।”
“আপনি অনেক ভালো বাবা।” তিনি হাসলেন।
বিকেলের দিকে কলেজের পড়াশোনা শেষ করে দেখলাম, বেলকনির দরজায় ঠেশ দিয়ে আসিয়া দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে।
“তো আজ কী প্ল্যান?”
“জঙ্গলে যাব।”
“আর কোনো জায়গা নেই?”
“জায়গার তো প্রয়োজনই নেই। তবু সে যখন নিয়ে যেতে চাইছে..”
“এহেম।”
“আসিয়া!”
“চুপ করলাম ভাই। আমার সেই ভাগ্য কই ছিল!” পরক্ষণে সে বলল, “বোধহয় তোর রোমিও আসছে। চলি। বাই।”
বাবা ছাদে থাকায় ধ্রুব এবার মূল দরজা দিয়ে ঢুকল। তার হাতে প্যাকেট দেখেছিলাম ভেবে খুশিতে আটখানা হয়ে গিয়েছি। ধ্রুব এসে বলল, “প্রেয়সী,” আহ্, তার এই ডাক। অস্থির।
“বলো।” আমি না দেখার ভান করে রইলাম।
সে প্যাকেটটা এগিয়ে ধরল। আমি প্যাকেটটা খুলি। একটি নীল শাড়ি বেরিয়ে এলো! আমার মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরুচ্ছে না। কোনো মেয়েকে কী করে ইম্প্রেস করতে হয়, তা যেন কেউ ধ্রুবের কাছ থেকে শেখে। আমি বেগুনি রঙের ব্লাউজও পেলাম, “সাইজ কোত্থেকে পেলে?”
“তোমার সাইজ আমি জানব না? শোন, এটা পরে নাও। আমি তোমাকে শাড়িতে কখনও দেখিনি। আর হ্যাঁ, চুড়ি, টিপ, কাজল এসব পরতে ভুলো না।”
আমি এই প্রথমবারের মতো শাড়ি পেয়ে নাচতে নাচতে চলে এলাম। ধ্রুব হয়তো এখন বাসায় গেছে, আমাকে সাজতে কিছুটা সময় দিয়ে। আমি চুল খোলা রাখলাম, হাতে কালো রঙের চুড়িগুলো পরলাম, টিপ, কাজল সবই তার মনোমতো দেই। কোনোদিক দিয়ে কম হয়নি তো?
আমি যখন বাইরে আসি, তখন আমার ও আগে থেকেই বাইকের সামনে দাঁড়িয়েছিল। তার মুখ হা করানো। তার হাত পকেটে। সে একটি হালকা আকাশী রঙের প্লেইন শার্ট পরেছে। তাকে কম সুন্দর দেখাচ্ছে না। একদম নায়ক! আমি তার বাইকের কাছে গেলে ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বাবা হাসছে। আমি হাত নেড়ে তাকে বাই বললাম। ধ্রুবের হা করে থাকা চেহারা দেখে আমরা দু’জনই হাসলাম (আমি লজ্জাও পেলাম)। বললাম; “চলো।”
ধ্রুব এতক্ষণে বাস্তবে ফিরে এসে সুরেলা কণ্ঠে বলল, “ও আমার প্রেয়সী, তোমাকে যা লাগছে না! একদম অতুলনীয়।”
আমি কিছুটা লজ্জা পেয়ে তার পেছনে বসলাম, “এখানে আরেকজনও কিন্তু মডেলের চেয়ে কম নয়। জানো, ওটা কে?”
“কে?”
“আমার হাসবেন্ড।”
সে বাইক চালাতে শুরু করল, “তাই বুঝি? বিয়ে কবে করেছ?”
“বিয়ে করতে হয় নাকি? মনের মিলন হলে সব ধরনের সম্পর্ক আপনা থেকেই গড়ে উঠে।”
“তাহলে এটা অবশ্যই বলতে হচ্ছে, আমার স্ত্রীকে আজ বিশ্ব সুন্দরী দেখাচ্ছে।”
সে জঙ্গলের সামনে গাড়ি থামায়। এরপর সে আমার হাত ধরে আমাকে ভেতরে নিয়ে যেতে লাগল। সে সামনে হাঁটছিল আর আমি তার পেছনে পেছনে। চারিদিকে মৃদুমন্দ আলো ছড়ানো। কোথাও বা গাছের ফাঁক দিয়ে একটুখানি চাঁদনি আলো এসেছে। কোথাও একদম ঘন অন্ধকার। ধ্রুব থাকায় মোটেই ভয় লাগছে না। আমরা দু’জনই নীরবে হাঁটছি। তার এই নীরবতা আমাকে ভাবাতে বাধ্য করছে, যাতে এই পথ কখনও শেষ না হয়। আমরা যাতে আজীবন এভাবে নীরবে ভালোবাসা বিনিময় করে যেতে থাকি। সে বেশ কিছুক্ষণ পর বলল, “তুমি কি চাঁদকে পছন্দ করো?”
“করি। স্বাভাবিক।”
“চাঁদকে কতটুকু দেখ?”
“তেমন দেখি না।”
“তাহলে সম্ভবত উপভোগ করোইনি।’
“তা বলা যায়।”
একটি জায়গায় আসার পর সে আমায় কোলে তোলে নিলো। আমি নির্বাক হয়ে পড়ি। কতদিনই না হলো আমি শেষবার ওর কোলে উঠেছি! আমি তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছি। তার পা থামলে সে বলল, “আমি ছাড়া এখানে আরও কিছু আছে। তাকিয়ে দেখ।”
আমি এবার সামনে তাকাই। আমাদের সামনে সেই কুয়োটি, যেটি সাবরিনা একসময় খুব যত্ন করে তৈরি করেছিল। চারপাশে ঘেরানো গাছ। কি মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! আমি তার বলায় উপরেও তাকালাম। আমি যা দেখেছি তাতে আমার মুখ খোলা রয়ে গেল। চাঁদকে এতোবড় করে আগে কখনও দেখিনি। কি সুন্দর চাঁদটা!
“জায়গাটির নাম love bird’s cage হলে কেমন হতো?”
“সাবরিনা পছন্দ করবেন। ওয়াও। এখান থেকে কত সুন্দর করেই না চাঁদ দেখা যায়! মনে হচ্ছেই না, চাঁদ বেশি দূরে।’
“এদিকে আমার চাঁদ তো একদম আমার বাহুর সাথেই লাগানো।”
সে হাসল। আমি লজ্জা পাব, এমন একটা কথাও সে বলতে ছাড়ে না।
“সিরিয়াসলি! চাঁদে আমরা গিয়েছি, আমার যখন বয়স দুই বছর ছিল। কিন্তু আমার স্মৃতি বলছে, চাঁদ তোমার চেয়ে বেশি সুন্দর ছিল না।”
“সবই মিথ্যা। তুমি আমাকে ভালোবাসো বলেই এমনটা বলছ। চাঁদের চেয়ে সুন্দর কেউ হয় নাকি?” আমি তার কোল থেকে নামলাম।
“ট্রাস্ট মি। আমি মিথ্যা বলতে পারি না।”
তার কথায় আমি মুহূর্তে গলে গেলাম। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুবই ভিন্ন। আমি কখনও চাঁদ হতে পারব না! আমি কুয়োর দিকে এগিয়ে যাই। চাঁদের প্রতিচ্ছবি পুরোটাই পানিতে আবদ্ধ হয়েছে। এমন একটা রাত আমি কখনও দেখিনি, কল্পনাও করিনি। হঠাৎ আমার ঘাড়ে ঠান্ডা কিছু একটা স্পর্শ করল। আমি শিউরে উঠে ধ্রুবকে জড়িয়ে ধরলাম। কেন যেন ইচ্ছে হলো, তাকে কোলে নেই। চেষ্টা করে দেখলাম। কিন্তু সে মাটির ওপর বল প্রয়োগ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
“আমাকে কেন নিতে চাইছ?”
“বাহ্! চারিদিকে ছেলেরাই মেয়েদের নিতে পারবে। মেয়েরা কেন পারবে না?”
সে হাসল। সে হালকা বলেই আজ নিতে চাইছি। সে চাপ কমাল। সাথে সাথে সে আমার হাতে চলে আসে। জড়িয়ে ধরে থাকা অবস্থায় তার পেটের দিকটা ধরে তাকে কয়েক ইঞ্চি উপরে তুললাম, যেন সে একটা কর্কশিট। মনেই হয় না, আমি কিছু বহন করছি। আমার খুব খুব ভালো লাগছে। আমার ধ্রুবের ওপর আমার ব্যতীত আর কারওই কর্তৃত্ব রইল না, মাটিরও না। আহ্, কত বড় এক সুপুরুষকে আমি বহন করেছি!
সে আমার দুই ঘাড়ে হাত রেখে বলল, “কয়েক সেকেন্ড তো হলো। এবার নামাও।”
তাকে নামালাম। তার চিবুকটা আমার কপালে ঠেকল। সে তার একটি কোমল হাত আমার ডান গালে রেখে বলল, “চোখ বন্ধ করো।”
আমি রেডি রইলাম। আমার প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রস্তুত। চোখ বন্ধ করতে গিয়ে একবার দেখলাম, তার চোখগুলো কিছুটা সবুজ দেখাচ্ছে। আমি কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না। মনে হলো, তার চোখের ভেতরের গভীরতা অনেকখানি বেড়ে গেছে।
আমি পরমুহূর্তে আমার নিজের মনকে ভালোভাবে অনুভব করতে পারলাম না। কিছুটা ঝিমুনি ভাব আসছে। কী হচ্ছে? আবছা ভাবে মনে হচ্ছে, আমি অন্য কারও মনকে দেখছি। মনটি একটি ছেলের, ধ্রুবের। তার মন এই মুহূর্তে ভাবছে, ‘সামনে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, তারচেয়ে সুন্দর কোনো মেয়েকে আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি।’ যাস্ট অবিশ্বাস্য! আমি মনে মনে যেভাবে কল্পনা করি, কথাগুলো সেই কল্পনার ন্যায়। বিশ্বাসও হচ্ছে না, ওর মনের অনুভূতিকে আমি পড়ছি। তাও দুয়েকটি কথা নয়, শত শত কথা! কিছু কিছু সে অধিক প্রাধান্য দিয়ে দেখাচ্ছে।
আমি হঠাৎ একটি সাদা আলোকিত জিনিস দেখতে পাই। মনে হচ্ছে, আমি এর ওপর উড়ছি। আমার শরীর থেকে দ্যুতি বেরুচ্ছে এবং.. আমার গায়ে মেঘের পোষাক। এটা আমার শরীর না! পা’গুলো ছোট, যেন নয়-দশ বছরের কোনো ছেলে। এটা ধ্রুব! মনে হয়, সে খুব ছোট ছিল। আমি তার চোখ দিয়েই স্মৃতিটা দেখছি। নো.. অবিশ্বাস্য! এটা কি চাঁদ? হঠাৎ চাঁদের দৃশ্যটা মুছে গেল এবং মুহূর্তেই আমি আমাকে দেখতে পাই। না, না, এটা হতে পারে না। আমাকে এতটা সুন্দর কেন দেখাচ্ছে? এটা কি সত্যিই আমি? সে মনে হয়, ঠিকই বলেছিল, এই মেয়েটির চেহারা অন্তত চাঁদের চেয়ে বেশি সুন্দর। নাকি তার মনই আমাকে ওভাবে অপরূপা করে তুলেছে? তার মন ভাবছে, ‘পৃথিবীতে কিংবা আমাদের ভুবনে এমন কোনো মেয়ে নেই, যার সাথে কিনা আমার আলিয়ার তুলনা করা যায়। সে অদ্বিতীয়া।’ তার মনের মাধ্যমেই দেখলাম, আমার চোখ দিয়ে খুশিতে কয়েক ফোঁটা পানি বেরিয়ে এসেছে। এই পানিগুলোকে সে পড়তে দিলো না। তৎক্ষণাৎ আমার গালে সে মুখ বসিয়ে পানিগুলো শুষে নিলো। ‘পানি! এই নোনতা পানির প্রতি বিকর্ষণ কাজ করলেও আমি এই পানি নিজের শরীরে ধারণ করে রাখব। বিপাক তো হয়ই না। একদিন যখন আমার ভালোবাসা দেখাতে যাব, তখন আমার চোখ দিয়ে আলিয়ার নোনতা পানিগুলোই ঝড়বে।’
আমার চোখগুলো যেন পানির কল, ধ্রুবের অনুভূতিগুলো যতই পড়ছি চোখগুলো দিয়ে ততই অবিরাম ধারায় পানি ঝড়ছে। আর ধ্রুব সে পানি গাল থেকে নিচে পড়তে দিচ্ছে না। ঠোঁট দিয়ে জিহ্বায় নিয়ে নিচ্ছে। ‘আমার পৃথিবীতে থাকাটা সার্থক হলো। যদি আগেই জানতাম, বিজলীর চেয়ে অনেকগুণে উৎকৃষ্ট আমার জীবনসঙ্গী পৃথিবীতেই আছে, তবে অনেক আগেই আলিয়ার খুঁজে আমি বেরিয়ে পড়তাম।’ হঠাৎ আমার কান্না থেমে গেল। আমি আরও উদ্বিগ্ন হয়ে অনুভব করছি। এটা কি আমার হৃদস্পন্দন? না তো, এটা দ্রুত হলেও মানুষের মতো নয়। তবে কি তা ধ্রুবের? আমি আর আমার মাঝে রইলাম না। যেন ওর মাঝে কোনো আকাশ আছে, আমি ওখানেই বিচরণ করছি। তার অনুভূতি, হৃদকম্পন সবগুলো যেন প্রবলভাবে মাইক দিয়ে শোনানো হচ্ছে। হঠাৎ এই মনে আমি আরও উত্তেজনা অনুভব করলাম। ধ্রুবের চোখের মাধ্যমেই দেখলাম, একটি হাত তো আমার গাল ধরেই রয়েছে, দ্বিতীয় হাতটিও সে তুলল। সে আমার চুল স্পর্শ করল। তার মনের ভেতর মনে হচ্ছে, কেউ একটা মধুর গান বাজিয়ে দিয়েছে। ঠিক সেদিন ওর গান শুনে আমার যেমনটা লেগেছিল, সেও এখন তেমনটাই অনুভব করছে। সে আমার কপাল ছুঁল। তার মনের চারিদিক দিয়ে যেন মাতাল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। আমিও আরও উদ্বিগ্ন হলাম। তার মন ভাবছে, ‘এই কালচে ভ্রূগুলোর আকৃতি অনন্য। এই বন্ধ চোখগুলো, পরীদের চেয়েও যদি সুন্দর কেউ থাকে, সে বোধহয় চোখ বন্ধ করলে আলিয়ার মতোই তাকে দেখাবে। এই নাক, মূর্তির নাকও হয়তো কেউ এতো সুন্দর করে কাটতে পারে না। আহ্! এই লজ্জামাখা গাল, যেন গোলাপের রঙটাই ধারণ করেছে।’ সে আমার মুখের সবকিছুই তার কোমল হাতে ছুঁয়ে অনুভব করছে। মনে হচ্ছে, আমি দুইদিক থেকেই স্পর্শগুলো অনুভব করছি। তার কোমল মৃদু ঠান্ডা আঙুলগুলো আমার ঠোঁটকে ছুঁল। সাথে সাথেই অনুভব করলাম, তার মন অনেক উত্তেজিত হয়ে গিয়েছে। তার মন অনুভূতির জন্যও ভাষা পাচ্ছে না। ‘এই তুলতুলে লালচে ঠোঁট.. মনে হচ্ছে যেন এই ঠোঁটে স্ট্রবেরির দোকান খুলে রাখা হয়েছে। কি কোমল!’ আমি আর অপেক্ষা করলাম না। ওর হাতটা আমি সরিয়ে ফেললাম। কেননা কেবল নিজের উত্তেজনা সহ্য করারই আমার ক্ষমতা আছে।
মিনিট খানেক পর ধ্রুব ইতস্তত করলে আমি নিজের মুখটা সরাই। ওর চেহারায় প্রশান্তি দেখব ভেবেছিলাম। কারণ একটু আগে সেই বেশি উত্তেজিত ছিল। কেননা তাদের অনুভূতি শক্তি বেশি। কিন্তু তার স্থলে আমি আতঙ্ক দেখতে পেলাম। সে মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে অন্যদিকে তাকাল। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও আমাদের কাছ থেকে কিছুদূরে তাকাই। ক্রমে আমি ধ্রুবের চেয়ে অধিক জমে গেলাম। সাবরিনা আর আদিলকে দেখে আমরা ভয়ে একে অপরের বাহু আরও চেপে ধরি। কারণ মনে হচ্ছে, এই যেন আমরা মিলেছি, আর তাঁরা আমাদের একে অপরের কাছ থেকে দূর করে দেবে।
.
পরিশিষ্ট
.
আজ কতদিন পরই না সাবিলাকে দেখছি! ইচ্ছে হলো, ওকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু আমি স্বার্থপরতা করেছি। ধ্রুবকে পাওয়ার জন্যই আমি তার কাছে আসিনি, তার পরিবারের কাছ থেকেও লুকিয়ে রয়েছিলাম। কিন্তু সাবিলা এসব গায়ে মাখেনি। আমি ধ্রুবের একবাহু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকা অবস্থায়ই সে আমাকে জড়িয়ে ধরতে এলো। সে ফিসফিস করে বলল, “মায়ের পয়েন্ট অফ ভিউ বুঝার চেষ্টা করিস।”
আমি তাদের বিশ্বাস করি, তারা আমায় অনেক ভালোবাসে। কিন্তু এই ভালোবাসার খাতিরেই যদি আমাদের দু’জনকে তারা আলাদা করে দেয়! আর ধ্রুবের আতঙ্কিত চেহারার কারণে ভয়টা আরও বেড়েছে। সে তো আমাকে আরও বেশি ভালোবাসে, যা মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়।
হলে আসার পর আরিয়ান ও সজীব স্যার, নাঈমা ও নাদিয়া আপু সকলে আমাদের দিকে তাকাল, যেন আমরা অনেক বড় একটি অপরাধ করেছি। আবির আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আমাকে আশ্বস্ত করল। আমরা দু’জনই সোফায় বসি। আবির বলল, “এতদিন আমাদের সাথে দেখা করতে আসোনি কেন?”
আমি আমতা আমতা করলাম।
সাবিলা বলল, “সে ভয় পেয়েছে। সে এখানে এলে আমরা ধরে ফেলতে পারব যে, তারা একে অপরকে ভালোবাসতে শুরু করেছে এবং মা তাদের আলাদা করে দেবে।”
“কিন্তু আলিয়ার আসার তো প্রয়োজনও ছিল না। সাবরিনা আগেই তোমার কাছ থেকে জেনে ফেলেছে।”
আমি অবাক হয়ে তাকালাম।
সাবরিনা বললেন, “যেদিন আমি এখানে ধ্রুবকে দেখেছি, সেদিনই আমার মনে হয়েছে, তোমার প্রতি ধ্রুবের বন্ধুত্ব অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। আমার তখনই তোমাদের আলাদা করা উচিত ছিল। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি, সে তোমাকে ভালোবেসে ফেলবে। এখন দেরিও হয়ে গেছে। আমি চাইলেও তোমাদের আলাদা করতে পারব না।”
আমি স্বস্তি পেলাম। ধ্রুব এবার স্বস্তি বোধ করে শক্ত করে ধরে থাকা আমার হাতটা হালকা করল।
“আমি ভালোভাবে বুঝি, ভালোবাসার কাছ থেকে আলাদা হওয়ার বেদনা কী। আমি আদিলকে হারিয়েছিলাম। তোমাদের আলাদা করার স্বার্থ কিংবা ক্ষমতা আমার নেই। তবে আমি সর্দার সহ মিলে পূর্বপুরুষদের সাথে থাকি। আমিও নিয়ম বানাই। তাই নিয়মকে আমি অমান্য করতে পারি না। তোমাদেরকে এভাবে আমি মুক্ত ছেড়ে দিতে পারব না।”
“কী বুঝাতে চাইছেন?”
“তোমরা এখন থেকে আমাদের সাথে থাকবে।”
ধ্রুব হয়তো তাঁর মস্তিষ্ক থেকে আগেই পড়ে ফেলেছে। সে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে না। আমি কিছুটা জমে গিয়েছি। কারণ সাবিলার মতো ধৈর্য আমার নেই। ধ্রুব আর আমি আলাদা ঘরে থাকা.. অসম্ভব। এতদিন তার সাথে ঘুমিয়ে আমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। তাকে না দেখে আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারি না। সে নেশার মতোই।
“কিন্তু কীভাবে?”
“এটা কঠিন কাজ নয়।”
“কিন্তু আপনি কথা দেন, আমাদের আলাদা থাকতে বলবেন না।”
“আলাদা থাকতে হবে। ধ্রুবকে পেয়ে পৃথিবীতে থাকতে দিয়ে আগে থেকেই আমি নিয়ম ভঙ্গ করছি। তোমাদের একসাথে থাকার ব্যাপারটা আমি এলাউ করতে পারব না।”
আমি নির্লজ্জ হয়ে বললাম, “আমি ওর কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে ঘুমাতে পারি। তবে ওকে পাশে থাকা চাই আমার।”
সবাই হাসল। ধ্রুবও মৃদু হাসল। সাবিলা বলল, “ব্যাপারটা এতটা সহজ নয়। বিয়ের আগে আমিও তাই ভাবতাম। এমনকি যেদিন আমরা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করেছিলাম, ওই রাত ওর কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে আমি ঘুমিয়েছি। কিন্তু আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকে ওই মনোবাসনা পাল্টেছে। দেখবে, তোমারও পাল্টে যাবে।’
আমি লজ্জিত হলাম।
সাবরিনা, পরীদের জগতের সবচেয়ে ছোট পূর্বপুরুষ বললেন, “তোমরা এখন কী ভাবছ?”
ধ্রুব বলল, “আপনার ধারণামতে বিয়েই সঠিক পথ। কিন্তু এই বয়সে আমাদের বিয়ে কেউ এলাউ করবে না। আমাদের ইন্টারও শেষ হয়নি।”
আমি বললাম, “এই বিয়ে কি পাঁচ বছর পর হতে পারবে না?”
“কিন্তু এরই মাঝে তোমরা যদি কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেল? এমন কিছু যদি করে ফেল যাতে ধ্রুবের অস্তিত্ব হুমকির পথে চলে আসে?”
ধ্রুব বলল, “আমি এতদিন যেভাবে মানুষের মাঝে থাকতে পেরেছি, আগামীতেও থাকতে পারব।”
“তাই? তাহলে আলিয়া তো মানুষ। সে কি সত্য জানেনি? ধ্রুব, তোমাকে পাওয়ার পর অন্তত আমার তোমাকে নজরে রাখতে হবে। তোমাদের বাইরে মুক্ত থাকতে দেওয়াটা আমার কেন যেন যুক্তিসংগত বলে মনে হয় না।”
এবার আদিল বলল, “আহ্, তুমি বাচ্চাদেরই কেন দোষ দিচ্ছ?” বাচ্চা? আদিলের মুখে একথা মানাচ্ছেই না। “যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। ওদের জীবন এখনও পড়ে রয়েছে। ভুলো না, তোমাকে পাওয়ার পাশাপাশি আমি আমার ক্যারিয়ারও গড়েছি। আলিয়াকে সেই সুযোগটা দাও।”
ধ্রুবকে আমি ফিসফিস করে বললাম, “আমি তেইশ বছরের মহিলা হয়ে গেলেও তোমাকে কি এমনই দেখাবে?”
সে হাসল, “আমার এই গড়ন তো ত্রিশ বছর পর্যন্ত মানানসই দেখাবে।”
“কিন্তু এরপর? আমি বুড়ি হয়ে গেলেও কি তুমি এমনই ইয়াং থাকবে?”
“তুমি অহেতুক টেনশন করছ। আবিরকে দেখ। ও কি বাস্তবতা মেনে নিচ্ছে না?”
কথাটি ফাইনাল হলো। আমাদের লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর বিয়ে করে ফেলব এবং এখানেই থাকব। যাই হয়ে যাক না কেন, আমি ধ্রুবের সাথেই ঘুমাব এবং দূরত্ব বজায় রেখেই। সাবরিনা আমার ভ্রূদ্বয়কে কুঞ্চিত অবস্থায় দেখে ফেললেন। ভাগ্যিস, আমার মস্তিষ্ক পড়তে পারেন না।
“আপনার চোখ মাঝে মাঝে নীল দেখায়। এটা কি বায়োডাটা পড়ারই লক্ষণ?”
আদিল বলল, “দেখেছ, সাবরিনা? কেবল আমিই ব্যাপারটা লক্ষ করিনি।”
“ধ্রুবের কেমন হয়?”
আমি সাথে সাথে উত্তর দিলাম, “সবুজ।”
ধ্রুব বলল, “তাই নাকি?”
সাবরিনা বলল, “আমাদের যাদের এক্সট্রা ক্ষমতা আছে, তাদেরই ক্ষেত্রে হয়তো এমনটা হয়। আর আমরা এটাকে বিশেষত্ব দেইনি।”
আমার স্বস্তি বোধ হলো। এতদিন এই পরিবার থেকে লুকিয়ে থেকে অপরাধ বোধ করছিলাম।
সাবিলা বলল, “তোমাকে শাড়িতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। তোমরা নাকি কিস..”
চোখের ইশারায় আমি ওকে থামালাম। কিন্তু ক’জনের কাছে লুকিয়ে আছে? অমানবরা তো ধ্রুবের চোখ দেখেই বুঝে ফেলেছে। আমরা টুকটাক বিষয়ে কথা বলতে লাগলাম। খেয়াল করলাম, ধ্রুব পাশে নেই। সে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার কাছে গেলাম।
“কী হলো?”
“সাবরিনা যখন আমাদের একসাথে দেখে ফেলেছেন, আমার খুব ভয় হয়েছিল। ভেবেছি, এখানেই আমাদের আলাদা করে দেবেন। কিন্তু.. পাঁচ বছর তো সময় পেলাম।”
“হুম।”
“রাত শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি চলো।”
আমি বাকিদের বিদায় জানালাম। যখন বাইরে এলাম, তখন হঠাৎ ধ্রুব আমাকে কোলে নিলো। যেই আমি চোখ সরালাম, লক্ষ করলাম, ও আমাকে এমনি কোলে নেয়নি। আমরা দৌড়ার গতিতেই জঙ্গলে ছুটছি। সে মাটিতে পা না রাখায় বুঝতেই পারিনি, আমরা নড়ছি, দৌড়াচ্ছি। এমন সময়, তার সুরেলা কণ্ঠে করা গান শুনতে পেলাম। মনে হলো, আমরা এভাবেই অনন্তকাল একে অপরের সাথে কাটিয়ে দিতে পারব।
(সমাপ্ত…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার
[“তিমির” এর প্রথম পর্যায়টা এখানেই শেষ হলো। পরবর্তী উপন্যাসটা কাল থেকে শুরু করব। নাম হয়তো “মেঘনাদ” হবে। এটা কিন্তু তিমিরেরই পুনরাবৃত্তি। তবে ভিন্ন। অর্থাৎ ওই গল্পের উত্তম পুরুষ ধ্রুবই হবে। কিন্তু কাহিনি একই। আর ওটা তিমিরের শেষ অবধিই শেষ হবে না। তিমিরের অর্ধেক কাহিনিতেই মেঘনাদ শেষ হবে(সম্ভবত)। ধ্রুব শুরুতে কেমনটা ফিল করত, কী ভাবত, এগুলো লেখার খুবই তেষ্টা। যাইহোক, প্রকৃতপক্ষে তিমিরের পরবর্তী উপন্যাস শুরু হবে মেঘনাদেরই পর।]