ডাক্তার ম্যাডাম পর্ব-৪৩+৪৪

0
1102

#ডাক্তার_ম্যাডাম
#পর্ব_৪৩(বোনাস পর্ব)
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

নোমান কাল সারারাত ডিউটি করে দুপুর বেলা বাসায় ফিরেছে।আর এসেই পুরোদমে ঘুম পারছে।কয়েক ঘন্টা ঘুম পেড়ে আবার তাকে সন্ধ্যাবেলাতেই চেম্বারে বসতে হবে।অন্যদিকে তানিশা এখনো চেম্বারেই আছে।আমান কিছুক্ষন আগেই বাসায় এসেছে।সে এসেই ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে রুমে বসে একটু রেস্ট নিচ্ছে।

হঠাৎ গোলাপি কালারের সুতি শাড়ি আর চোখে চশমা পড়ে এক ভদ্র মহিলা নোমানদের বাসায় প্রবেশ করলেন।যাকে লিনা চিনতে পারছে না।লিনা সেজন্য শিরিনকে ডাকতে লাগলো।শিরিন লিনার ডাক শুনে রুম থেকে বের হয়ে আসলো।

শিরিন এসেই জিজ্ঞেস করলো আপনি কে?কাকে চাই?
ভদ্র মহিলা তার শান্ত কন্ঠে বললেন,আমাকে তুমি চিনবে না মা?ডাক্তার তানিশা ম্যাডাম আছেন?

–না নেই।ও তো চেম্বারে আছে।

ভদ্র মহিলা পুরো বাড়ি টা এক নজর দেখে নিয়ে বললো, বাহঃ ভালোই তো সাজিয়েছে বাসাটা।অথচ যে থাকার কথা ছিলো সেই নেই।

শিরিন সেই কথা শুনে বললো, কিছু কি বললেন আমাকে?

–না মা।কিছু বলি নি।

এদিকে শিরিনের ভয় হতে লাগলো।সে মনে মনে ভাবতেছে মহিলা টি এভাবে দেখছে কেনো চারপাশ?সে তখন আমান কে গিয়ে বললো,দেখো তো কে এসেছে বাসায়?শুধু চারপাশ কেমন ভাবে দেখছে।

আমান সেই কথা শুনে তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে আসলো রুম থেকে।আমান আসতেই মহিলাটি অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো আমানের দিকে।মুহুর্তের মধ্যে ওনার চোখে পানি এসে গেলো।তিনি তার অজান্তেই আমানের চোখ মুখ স্পর্শ করে একটা চুমু খেলো।
আমান তো অবাক।এভাবে একজন অচেনা মহিলা এভাবে চুমু খেলো কেনো।কারণ আমানও চিনতে পারলো না মহিলাকে।সে তখন বললো কে আপনি?

মহিলাটি তখন কান্না ভরা চোখ নিয়ে হেসে হেসে বললো,চিনবা না বাবা আমাকে।

আমান তখন বললো তাহলে কি জন্য এসেছেন বাসায়?

মহিলা টি তখন বললো তাহমিনা আর তায়েব চৌধুরী কি বাসায় আছে?ওনাদের দুইজনের সাথে আমার কিছু হিসাব নিকাশ ছিলো।

–হিসাব নিকাশ?কিসের হিসাব নিকাশ?

এদিকে তানিশাও চেম্বার থেকে ফিরলো।সে তো মালিহা চৌধুরীকে দেখামাত্র বললো,আন্টি?আপনি?এভাবে হঠাৎ? তা আমাকে ডাকলেই তো আমি বাসায় আসতাম।

মালিহা চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো, আমি একটু দরকারে এসেছি মা।বেশিক্ষন দেরি করবো না।তায়েব চৌধুরী আর তাহমিনা চৌধুরী কে একটু ডেকে দিবা?খুব এমারজেন্সি কিছু কথা ছিলো।

তানিশা সেই কথা শুনে বললো আন্টি আপনি বাবা আর ফুপিকে আগে থেকেই চিনতেন?

–হ্যাঁ মা।চিনতাম।খুব ভালো করেই চিনতাম।

শিরিন এবার তানিশার কাছে এগিয়ে এসে বললো,কে ইনি?

তানিশা তখন বললো, ইনিই তো সেই আন্টি যিনি সেদিন খাবার রেঁধে দিয়েছিলেন।

শিরিন সেই কথা শুনে মালিহা চৌধুরীকে বললো,আসসালামু আন্টি।আমি শিরিন।তানিশার বড় জা হই।

মালিহা চৌধুরী সেই কথা শুনে বললো, মাশাল্লাহ মা।তোমাদের সবাইকে দেখে ভীষণ ভালো লাগলো।কারো নজর না লাগে যেনো।

মালিহা চৌধুরীর কথা শুনে তানিশা,শিরিন আর আমান খুব বেশি অবাক হলো।এ মহিলা এমন ভাবে কথা বলছে কেনো?মনে হয় তিনি তাদের কতই না আপনজন।

হঠাৎ তাহমিনা চৌধুরী আসলো। তিনি এসেই বললেন কি হয়েছে এখানে?আর ইনি কে?

মালিহা চৌধুরী তখন তার চশমা টা খুলে বললো, আসসালামু আলাইকুম আপা।চিনতে পারছেন আমাকে?

মালিহাকে চেনামাত্র তাহমিনা দশ হাত দূরে সরে গেলো?মনে হলো সে যেনো একটা বিদ্যুৎ এর ঝটকা খেলো।তাহমিনা একদম বোবার মতো চুপচাপ হয়ে রইলো।

মালিহা তখন আবার বললো, চিনতেন পারছেন আমাকে?না এখনো চেনেন নি?

তাহমিনা কোনো উত্তর না দিয়ে তার ভাইকে ডাকতে গেলো।

তায়েব চৌধুরীও তার নিজের ঘরে ঘুমিয়ে আছেন।তিনি তহমিনার চিৎকার শুনে বললো, কি হয়েছে?এভাবে ডাকছিস কেনো?

তাহমিনা তখন হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,ভাই মালিহা ভাবি এসেছে।

–মালিহা?

–হ্যাঁ মালিহা।কত বড় নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে! এতোদিন পর কোন লজ্জায় এসেছে দেখ।মনে হয় ছেলেদের কে ভুলভাল বোঝাতে এসেছে।

তায়েব চৌধুরী সেই কথা শুনে আর এক মুহুর্ত থাকলেন না রুমে। তাড়াতাড়ি করে তার রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমে চলে গেলেন।আর মালিহাকে দেখে বললেন, মালিহা আমার রুমে এসো।আমরা রুমে বসে কথা বলি।

মালিহা তখন চিৎকার করে বললো, না।রুমে না।আমি সবার সামনে আজ কথা বলতে এসেছি।

তাহমিনা তখন বললো,ভাই যা বলছে সেটাই শোনো ভাবি।রুমে চলো।

মালিহা তখন বললো আমি কি চোর না ডাকাত যে আলাদা ভাবে তোমাদের সাথে কথা বলতে হবে?আমি যা বলার এখানেই বলবো।

তায়েব চৌধুরী তখন তাহমিনা কে থেমে দিয়ে বললো, তুই চুপ কর তাহমিনা।বলতে দে ওকে।ও যদি নিজের মানসম্মান নিজের হাতে নষ্ট করতে চায় তাহলে করুক।

তাহমিনা তখন মালিহার কানে কানে গিয়ে বললো,আমান নোমান কিন্তু কেউই তোমার অপকর্মের কথা জানে না।আমরা তোমার দোষ ঢেকে রেখেছি।ওরা কিন্তু তাদের মাকে খুব সম্মান করে।তোমার আসল চরিত্র জানার পর কিন্তু থু থু ছিটিয়ে দেবে।

মালিহা সেই কথা শুনে হঠাৎ সবার সামনেই তাহমিনাকে জোরে করে একটা ধাক্কা দিয়ে বললো থু থু আমাকে দেবে না কেউ।থু থু দেবে তোকে।তোর মতো একটা কাল নাগিনী সাপকে।যে মানুষের সুখ নষ্ট করতে এক্সপার্ট।

মালিহা চৌধুরীর এমন কান্ড দেখে সবাই আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে গেলো।কেউ কিছুই বুঝতে পারলো না।অন্যদিকে নোমান সবার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে নিজেও এগিয়ে এলো।সে যখন এসে দেখলো তাহমিনা মাটিতে পড়ে আছে সাথে সাথে তাহমিনা কে উঠিয়ে বললো, কি হয়েছে ফুপি তোমার?
তাহমিনা কোনো উত্তর দিলো না।

এবার তায়েব চৌধুরী এগিয়ে গেলো মালিহার কাছে।আর বললো তুমি কোন শাসনে তাহমিনাকে ধাক্কা দিলে?

মালিহা তখন হাসতে হাসতে বললো, সাহসের দেখছো কি?আরো কি কি করি সেটা শুধু দেখো।

নোমান তখন বললো আন্টি!আপনি কখন এসেছেন? আর কি হয়েছে?আপনি বাবার সাথে এরকম ব্যবহার করছেন কেনো?

মালিহা তখন কাঁদতে কাঁদতে বললো, বাবা নোমান আর আন্টি বলে ডাকিস না আমাকে।বুকের এই জায়গাটা ব্যাথা করে আন্টি ডাক শুনলে।আমি তোদের মা হয়।মিসেস মালিহা চৌধুরী আমি।

–মা?সবাই অবাক হয়ে গেলো মালিহার কথা শুনে।আমান নোমান তার বাবার কাছে এসে বললো,বাবা!কি বলছেন ইনি?আমাদের মা তো মারা গেছে।

তায়েব চৌধুরী একদম বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।তিনি শুধু ভাবছেন,মালিহা কি করলো এটা?এতো বছর ধরে লুকানো কথা টা সে কেনো এভাবে টেনে আনছে?ছেলেরা ওর অপকর্মের কথা শুনলে একদম লজ্জায় শেষ হয়ে যাবে।

তাহমিনা চৌধুরী এবার আমান আর নোমানকে বললো হ্যাঁ ইনি তোদের মা হন।যে তিনবছরের আমান আর এক বছরের নোমানকে রেখে তার প্রাক্তন প্রেমিক আকবরের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলো।আমরা সবাই লজ্জায় আর শরমে সত্য টা প্রকাশ না করে তাকে মৃত বলে চালিয়ে দিয়েছি।যাতে কেউ তোদের বা আমার ভাই এর দিকে আংগুল তুলে কথা বলতে না পারে।

আমান আর নোমান তাহমিনার কথা শুনে একদম পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো।তারা এটা কি শুনছে?এই কথা শোনার আগে তাদের মরন কেনো হলো না?যে মাকে তারা এতো শ্রদ্ধা করে সেই মা তাদের কে ফেলে অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে?

এদিকে তায়েব চৌধুরী লজ্জায় মাথা নিচু করে আছেন।

তানিশা সেই কথা শুনে তাহমিনা কে বললো, ফুপি এসব কি বলছেন?

–হ্যাঁ ঠিক বলছি আমি।ইনি হলেন সেই মা যিনি সন্তান জন্ম দেওয়ার পরও প্রাক্তন প্রেমিক কে ভুলতে পারেন নি।আমার ভাই এর জীবন টা তছনছ করে ফেলেছে।ভাই তাকে কত ভালোবাসতো?তারপরেও ভাই এর বুকে লাথি মেরে চলে গিয়েছে।

তায়েব চৌধুরী তখন বললো তাহমিনা তুই চুপ কর।আমি এসব অতীতের কথা শুনতে চাই না।আমি বর্তমানে অনেক বেশি সুখে আছি।আমার মতো সুখী কেউ নেই।তুই ওকে যেতে বল।

মালিহা তখন কাঁদো কাঁদো গলায় বললো আমি এখানে থাকতে আসি নি তায়েব।আমি শুধু সত্য কথা টা বলতে এসেছি।আমি আমার কথাগুলো বলেই চলে যাবো।তোমাদের সংসারের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র লোভ নেই।আমিও এখন যেখানে আছি বেশ ভালো আছি।আমার মতোও সুখি মনে হয় আর কেউ নেই।

তাহমিনা তখন তায়েব কে বললো, ভাই ভাবি কিন্তু ছেলেদের কে ইমোশনাল করার জন্য এসেছে।ছেলেদের কে বশ করে এই সংসারে ঢোকার মতলব আঁটছে।নিশ্চয় আকবর ওরে ছেড়ে গেছে।

নোমান তখন বললো স্টপ ফুপি!তখন থেকে কি সব ভুলভাল বকে যাচ্ছো?মাকে তো কিছু বলতে দাও।আমরা আমাদের মায়ের কথা শুনতে চাই।আমাদের মা খারাপ হলেও তিনি আমাদের জন্ম দিয়েছেন।এটা তো অস্বীকার করতে পারবো না আমরা।
আমান তখন বললো হ্যাঁ মা। বলো তুমি।কি বলতে চাও বলো?

তাহমিনা নোমান আর আমানের কথা শুনে বললো, ভাই যা বললাম সেটাই ঠিক হলো।ভাবি তো ইতোমধ্যে ছেলেদের বশ করেও ফেলেছে।এই জন্যই এতোদিন পর এসেছে ভাবি।

তায়েব চৌধুরী তখন বললো তাহমিনা চুপ কর তুই।ভালোবাসার সাথে যে বেঈমানি করে তার ঠাঁই কখনোই এ বাড়িতে হবে না।ওকে বলতে দে।ওর যা মন চায় ও বলুক গিয়ে।বলা শেষ হলে এমনি চলে যাবে।

মালিহা তায়েব চৌধুরীর কথা শুনে হাসতে হাসতে বললো এতোটাই ঘৃনা করো আমাকে?যে একবারের জন্য সত্য মিথ্যা যাচাই করার প্রয়োজন মনে করছো না?

নোমান এবার ভীষণ রাগ হলো।সে চিৎকার করে বললো এই তোমাদের এসব ঘ্যানঘ্যানানি থামাবে এবার?আসল কাহিনী কি?আমি আসল কাহিনী শুনতে চাই।

মালিহা তখন বললো আমি যা বলবো সব সত্যি কথা বলবো।তবুও যদি আমার মুখের কথা বিশ্বাস না হয় এই যে আমি আমার দুই সন্তানের মাথা ছুঁয়ে বলছি।

তায়েব চৌধুরী তখন বললো, এই আমার ছেলেদের মাথা ছুঁবি না।আমার ছেলেদের মাথা ছেড়ে দিয়ে কথা বল।

মালিহা চৌধুরী সেই কথা শুনে আমান আর নোমানকে বললো,তোদের বাবাকে আমি আল্লাহর ফেরেশতা মনে করতাম।আর সবসময় ভাবতাম ওনার মতো স্বামী পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।তোদের বাবা আমাকে এতই ভালোবাসতো যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।

তবে এটা সত্যি যে আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না।তোদের নানু জোর করেই আমাকে বিয়েতে রাজি করিয়েছে।কারন আমার মামাতো ভাই আকবরকে আমি ভালোবাসতাম।তোদের নানু আবার আকবর কে পছন্দ করতো না।সেজন্য তাড়াতাড়ি করে তোদের বাবার সাথে বিয়ে টা দিয়ে দেয়।আমিও সবকিছু ভুলে মন প্রান দিয়ে সংসার করি।

কিন্তু আমার এই সুখের সংসার টাকে জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য তোদের দাদী আর ফুপি উঠে পড়ে লেগেছিলো।তোদের বাবা যে আমাকে ভালোবাসে সেটা ওই ডাইনি দুটির সহ্য হয় নি।তোদের বাবা যখন বাসায় থাকতো তখন কিছু বলতো না।কিন্তু উনি বাহিরে গেলেই দুই মা মেয়ে মিলে ভীষণ ভাবে অত্যাচার করতো আমার উপর।আমি আবার সব কথা বলতাম না তোদের বাবাকে।কারন উনি বাহির থেকে পরিশ্রম করে আসেন,আর এসেই যদি সংসারের এসব কাহিনি শোনে তাহলে মেজাজ গরম হয়ে যাবে বিধায় বলি না।
দুই এক দিন বলে ছিলাম।তাতে উনি আমার হয়ে মা আর বোন কে অনেক শাসিয়েছে।পরে আবার সেই প্রতিশোধ ওরা মা বেটি তুলতো আমার উপর।

তারপর আমান হলো,নোমান হলো।তারপর তাহমিনার বিয়ে হয়। তাহমিনার বিয়ে হয়ে গেলে আমি মনে মনে খুব খুশি হলাম।ভাবলাম এবার অন্তত একটু শান্তি পাওয়া যাবে।কিন্তু আমার ভাবনায় জল ঢেলে দিলো তাহমিনা।স্বামী আর শাশুড়ীর সাথে তার এক দিনও বনিবনা হতো না।প্রায় দিনই ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে আসতো।

সেদিন আমাদের বিবাহ বার্ষিকী ছিলো।আমি সেদিন তোদের বাবার জন্য হরেক রকমের পদ রান্না করেছিলাম।সেদিন তোদের বাবা দুইটা শাড়ি এনেছেন।আমার আর তোদের দাদীর জন্য।উনি কোনোদিনই আমার জন্য আলাদা ভাবে কিছু আনে না।কারন উনি জানতো তার মা দেখলে এটা নিয়ে ঝগড়া করবে।সেদিন আবার তাহমিনাও এসেছে।ওরা মা মেয়ে শাড়ি আমাকে না দিয়ে দুইজন ভাগ করে নিয়েছে।তোদের বাবা যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো শাড়ি পছন্দ হয়েছে কিনা?আমি উত্তরে বললাম হ্যাঁ।তো উনি বললেন এখনি পড়ে এসো।নতুন শাড়ি পড়ে দেখবো তোমাকে।
আমি তখন বললাম,আমার টা তাহমিনা নিয়েছে।তোদের বাবা সেদিন রাগ করে তাহমিনা কে একটু বকেছিলো।যে আজকের শাড়িটাও কি তোর নিতে হবে?তোকে কাল নতুন শাড়ি কিনে দেবো।ওটা তোর ভাবির জন্য এনেছি।

তোদের বাবা এইভাবে বলায় তাহমিনা ভীষণ ভাবে রেগে যায়।সে সেদিন রাগ করে বাসা থেকে চলে যায়।আর আসে না আমাদের বাড়িতে।তোদের বাবা অনেক বার গিয়েছে আনার জন্য তবুও আসে নি।কিন্তু সে যে মনে মনে আমাকে সংসার থেকে তাড়ানোর প্লান করছে তা আমি বিন্দুমাত্র বুঝতে পারি নি।

সেদিন রবিবার ছিলো।আমান ওর বাবার সাথে বাহিরে গিয়েছিলো।নোমান আর আমি শুয়ে ছিলাম।তারপর হঠাৎ কে যেনো আমার হাত পা চোখ মুখ বেঁধে বাসা থেকে বের করে।তারপর কোনো এক অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রাখে।সেখানে গিয়ে দেখি আকবর ও বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে।
তারপর ওরা জোর জবরদস্তি করে আমার আর আকবরের কয়েকটা ছবি তুলে।আমি তখনো বুঝতে পারি নি আমি সারাজীবনের জন্য আমার স্বামী আর সন্তান থেকে এভাবে দূরে সরে যাবো।
প্রায় তিন মাস আমরা ঘরবন্দি ছিলাম।তারপর আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।পরে বাহিরে এসে শুনি আমি আর আকবর নাকি পালিয়ে গেছি।
সব টিভি চ্যানেলে এ নিয়ে নিউজ ও হয়েছে যে,দুই সন্তান রেখে প্রাক্তনের হাত ধরে পালিয়ে গেছে গৃহবধু।

আমি তো শুধু তায়েব কে খুঁজে বেড়াচ্ছি।ওকে সত্য কথা বলা টা দরকার ছিলো আমার।আমার বিশ্বাস ওকে সবকিছু বললে নিশ্চয় বিশ্বাস করতো।কিন্তু তার আর খোঁজ পাই নি আমি।
এদিকে আমাকে আর তোদের নানুও উঠতে দেয় নি।সবাই ধরে নিয়েছে আমি আর আকবর সত্যি সত্যি পালিয়ে গেছি।

#চলবে,

#ডাক্তার_ম্যাডাম
#পর্ব_৪৪
#মুমতাহিনা_জান্নাত_মৌ

তায়েব চৌধুরী মালিহার কথা শুনে অনুশোচনা করতে লাগলেন। তিনি যে ক্ষমা পাওয়ারও যোগ্য না।তবুও মালিহার কাছে গিয়ে মাথানত করলেন।হাতজোড় করে বললেন,এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় মিস্টেক।আমার উচিত ছিলো তোমাকে খুঁজে বের করে তোমার মুখে সত্য কথাটা শোনা।কিন্তু তখন আমি মানসিক ভাবে ভীষণ ভেংগে পড়েছিলাম।আমি ভাবতেই পারছিলাম না এতো ভালোবাসার পরেও তুমি কি করে এই রকম একটা জঘন্য কাজ করতে পারো।আমি তো মানসম্মানের ভয়ে এভাবে নিজের বাসস্থান ছেড়ে পালিয়ে এসেছি এখানে।যাতে আমাকে আর আমার সন্তানদের কেউ আংগুল তুলে কিছু বলতে না পারে।

মালিহা তখন তায়েবের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,এতে কারো কোনো দোষ নাই।সব আমার কপালের দোষ। আমার ভাগ্যে সুখ লেখা ছিলো না বিধায় আমি এসব বিপদের সম্মুখীন হয়েছি।আমি আসলেই একজন পোড়াকপালি।

আমান আর নোমান তো তাদের মায়ের কথা শুনে কাকে কি বলবে সত্যি বুঝতে পারছিলো না।তারা তাদের মাকে কাছে পেয়েছে এটাই তো বেশি।সেজন্য তারা তাদের মাকে জড়িয়ে ধরলো। আর বললো মা,আমরা সবাই সত্যি অনুতপ্ত।আমরা যদি শুধু একবার জানতাম আমাদের মা বেঁচে আছে তাহলে পৃথিবীর যেখানেই থাকতে না কেনো ঠিক খুঁজে বের করতাম।
মালিহা তার দুই ছেলেকে নিজেই জড়িয়ে ধরলো আর তাদের কপালে চুমু দিয়ে আদর করতে লাগলো।মায়ের আদর পেয়ে আমান আর নোমান দুইজনই কাঁদতে লাগলো।তারা ভাবতেই পারছে না তারা তাদের মাকে খুঁজে পেয়েছে।

তায়েব চৌধুরী এবার তাহমিনার কাছে চলে গেলো।আর জোরে জোরে কয়েকটা চড় মেরে বললো,সত্যি করে বল সেদিন মালিহাকে বাড়ি থেকে কে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো?

তাহমিনা সেই চড় খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো আর কাঁদতে কাঁদতে বললো,তা আমি কি করে জানবো?তুমি আমাকে সে কথা বলছো কেনো?
আমি ভাবিকে পছন্দ করতাম না এটা ঠিক আছে,
আমি ভাবি কে হিংসা করতাম এটাও ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে এই ভাবে প্রতিশোধ নেবো?বিশ্বাস করো ভাই আমি এটা করি নি।আমি একটা মেয়ে মানুষ কিভাবে ভাবিকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাবো?

মালিহা তখন বললো তাহমিনা মিথ্যা কথা কেনো বলছো?তুমি ছাড়া আমার আর অন্য কোনো শত্রু নাই।একমাত্র তুমিই আছো যে চাইতে না আমি আর তায়েব মিলেমিশে সংসার করি।আমার জীবন থেকে এতোগুলো বছর কেড়ে নিলে,আমার সন্তানদের থেকে আমাকে দূরে রাখলে তবুও কি তোমার শান্তি হয় নি?এর পরেও অভিনয় করে যাচ্ছো?

তাহমিনা তখন আবার তার ভাই এর কাছে আসলো।আর বললো, ভাই তুমি যদি আমাকে মেরেও ফেলো তবুও আমি এটাই বলবো যে ভাবিকে আমি বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাই নি।তবে আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম যে ভাবি আমাদের বাড়ি থেকে দূর হয়েছে।কারণ ভাবি আসার পর থেকে তুমি শুধু ভাবিকেই ভালোবাসতে।আমাকে আর আগের মতো দেখতে পারতে না।ভাবি কে আমি আমার দুশমন মনে করতাম এজন্য।কিন্তু আমি এ কাজ করি নি।

নোমান এবার এগিয়ে আসলো তাহমিনার কাছে।আর বললো ফুপি আমরা কিন্তু তোমাকে যথেষ্ট সম্মান করি।এভাবে বার বার মিথ্যা কথা বলে আমাদের কে খারাপ ব্যবহার করতে বাধ্য করো না।প্লিজ সত্যি টা বলো।আমার মায়ের সাথে যেই অন্যায় করুক তাকে কিন্তু আমি আজ ছেড়ে দিবো না।
তাহমিনা সেই কথা শুনে গলা ছেড়ে দিয়ে কাঁদতে লাগলো।
আমান তখন বললো ফুপি! কান্নাকাটি করে কোনো লাভ হবে না।তুমি আমার মায়ের সাথে যে অন্যায় করেছো তার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে।এখনো সময় আছে সত্য টা স্বীকার করো।তা না হলে অন্যভাবে সত্য কথা বের করবো?তুমি ভালো করেই জানো আমি একজন পুলিশ অফিসার।অপরাধীর মুখ থেকে কিভাবে সত্য কথা বের করতে হয় তা আমি ভালো করেই জানি।পুলিশের হাতের পিটন যদি না খেতে চাও ভালো ভালোই সত্য টা বলো।

তাহমিনা আমান আর নোমানের কথা শুনে তার বুক থাপড়াতে থাপড়াতে বললো, এই দিন টা দেখার জন্যই বুঝি আমি বেঁচে ছিলাম এতোদিন।আল্লাহ আমারে কেন বেঁচে রাখলা?যাদের কে কোলে পিঠে বড় করলাম আজ তারাই শাসাচ্ছে আমাকে।মা ছিলো না তোদের,এই আমি বড় করেছি।নিজের সন্তানদের মতো দেখেছি।সেই তোরাই আজ আমার সাথে এরকম দুর্ব্যবহার করছিস?
আমি কত করে বলছি যে আমি কিছু করি নি।আর কিভাবে বললে তোরা বিশ্বাস করবি?
আমি আমার এ জীবন টাই আর রাখবো না।এই বলে তাহমিনা দৌঁড়ে তার রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।

তাহমিনাকে এভাবে দরজা লাগানো দেখে সবাই দৌঁড়ে গেলো আর দরজা ধাক্কা দিতে লাগলো।কিন্তু তাহমিনা দরজা খুললো না।আমান আর নোমান তখন দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করলো।এদিকে তাহমিনা গলায় ফাঁস দেওয়ার জন্য ফ্যানের সাথে তার শাড়ির আঁচল বেঁধেছে।জানালা দিয়ে সবাই শুধু চিৎকার করে করে ডাকতে লাগলো।তবুও তাহমিনা দরজা খুললো না।
আমান আর নোমান তখন একসাথে জোরে করে লাথি দিয়ে দরজার ছিটকিনি ভেংগে ফেললো।আর তাহমিনার গলার দড়ি খুলে দিলো।এদিকে তাহমিনা শুধু হাঁপাচ্ছে।সে কোনো কথা বলতে পারছে না।কারণ আর এক সেকেন্ড দেরী হলেই সে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতো।
তাহমিনা জোর করেই তার মুখ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করতে লাগলো।আর বললো,সবাই বিশ্বাস করো আমি মালিহা ভাবিকে তুলে নিয়ে যাই নি।তোরা যদি বিশ্বাস না করিস সত্যি আমি আমার এ জীবন টাই আর রাখবো না।

নোমান তখন বললো,ফুপি পরে শুনবো তোমার কথা এখন চুপচাপ থাকো।এই বলে নোমান আর আমান দুই জন মিলে তাহমিনা কে বিছানায় শুয়ে দিলো।এদিকে তানিশা এক গ্লাস পানি নিয়ে আসলো।তারপর তাহমিনাকে খেতে বললো।তাহমিনা ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি পুরাটাই খেলো।সে আজ মৃত্যু কে খুব কাছ থেকে দেখলো।তাহমিনা ভয়ে সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে গেলো।

এদিকে মালিহা বাসা থেকে চলে গেছে।সবাই তাহমিনাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারনে কেউ টের পাই নি।মালিহা এই সত্য টা প্রকাশ করার জন্যই শুধু এসেছিলো।কারন মিথ্যা অপবাদের বোঝা সে আর বয়ে বেড়াতে পারছিলো না।এত বছর পর সে যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
তার আর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই তায়েবের সংসার করার।সারাজীবন তো সে কষ্টেই পার করে দিলো।এই কয় দিনের জন্য এসে সবার বোঝা হতে চায় না সে।

এদিকে সবাই তাহমিনার জ্ঞান ফেরানো নিয়ে ব্যস্ত।তাহমিনার জ্ঞান ফিরলে সবাই যখন বাহিরে এলো এসে দেখে মালিহা নাই।নোমান আর আমান তা দেখে মা মা বলে ডাকতে লাগলো।কিন্তু মালিহার কোনো সাড়াশব্দ পেলো না কেউ।সেজন্য দুই ভাই দৌঁড়ে গেটের বাহিরে চলে গেলো।সবাইকে জিজ্ঞেস করলো।কিন্তু কেউই মালিহার কথা বলতে পারলো না।তায়েব নিজেও খুঁজতে লাগলো।কিন্তু কেউই মালিহা কে আর খুঁজে পেলো না।

তানিশা তখন বললো, মা হয় তো তার নিজের বাড়িতে চলে গেছে।চলো আমরাও সেখানে যাই।

তায়েব চৌধুরী তখন বললো তুমি কি জানো মালিহা কই থাকে?

–না জানি না বাবা।তবে আমাদের হাসপাতালে গেলেই ওনার ঠিকানা পাওয়া যাবে।কারণ উনি মাসে মাসেই সেখানে চোখ পরীক্ষা করার জন্য আসেন।

নোমান সেই কথা শুনে আর এক মুহুর্তও দেরী করলো না।তানিশা কে সাথে করে নিয়ে তার হাসপাতালে গেলো।আর চক্ষু ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে মালিহা নাম খুঁজতে লাগলো।মালিহা কোথায় থাকে সেটা দেখে নিলো।কিন্তু ঠিকানায় শুধু রাজবাড়ী লেখা ছিলো।রাজবাড়ী জেলা যেহেতু ঢাকার মধ্যেই আছে সেজন্য আমান পুলিশ বাহিনীকে পাঠালো খোঁজ নেওয়ার জন্য।
অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তারা মালিহা চৌধুরীর দেখা পেলো না।

তানিশা তখন হঠাৎ নোমান কে বললো, মা হয় তো আর ফিরে আসবে না নোমান।উনি হয় তো বাবাকে এই সত্য কথা টা বলার জন্যই শুধু এসেছিলেন।

নোমান তখন বললো, মা না আসতে চাইলেও আমরা জোর করেই নিয়ে আসবো।এতোদিন পর মাকে কাছে পেয়ে আর কখনোই তাকে হারাতে দিবো না।মা এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকবে।

তানিশা সেই কথা শুনে বললো আপনি কি আদ্রিয়ানের কথা ভুলে গেলেন নোমান?

নোমান তানিশার মুখে আদ্রিয়ানের নাম শোনামাত্র ওর মুখ টিপে ধরলো আর বললো চুপ থাকো।বাবাকে আগেই বলো না।বাবা ভীষণ কষ্ট পাবেন।আমরা আগে মাকে খুঁজে বের করবো।ওনার মুখে আদ্রিয়ানের সম্পর্কে জেনেই তবে প্রকাশ করবো।

তানিশা তখন বললো আমার কেনো জানি ভয় করছে,মা যদি আবার আকবর কে সত্যি সত্যি বিয়ে করে থাকে?তখন কি হবে?
নোমান তখন বললো,মুখ সামলিয়ে কথা বলো তানিশা। এরকম কখনোই হতে পারে না।বাবা যদি তার ভালোবাসার স্মৃতি নিয়ে এতোবছর একা একা থাকতে পারে নিশ্চয় মাও বাবার স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছে।এসব ভুলভাল কথা কিছুতেই মাথাতে এনো না তানিশা।

তানিশা সেই কথা শুনে বললো, আমিও তো এটাই চাই যে মা আবার বাবার কাছে ফিরে আসুক।কিন্তু আদ্রিয়ান তো তোমার মায়ের সন্তান।এটা তো মিথ্যা না।

তানিশার কথা শুনে এবার নোমানের মনেও ভয় ঢুকে গেলো।এতো বছর পর তার বাবা ভালোবাসার মানুষ কে দেখা পেয়ে কত খুশি হইছে,সেই খুশি এইভাবে কখনোই নষ্ট হতে পারে না।তার মা কখনোই এটা করতে পারেন না।

এইভাবে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলো, তবুও তারা মালিহার খোঁজ পেলো না।মালিহা নিজের থেকেও আর আসলো না।বাড়ির সবাই ভীষণ টেনশনের মধ্যে পড়ে গেলো।সবার চোখের ঘুম একদম হারাম হয়ে গেলো।

▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️

তানিশা চেম্বারে বসেছে।পেশেন্ট দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না তার আজ।কিন্তু দায়িত্ব থেকে তো সে আর পালিয়ে বেড়াতে পারে না।মন খারাপ নিয়েও রোগী দেখছে সে?এক সপ্তাহ ধরে নোমানের মুখে হাসি নেই।ঠিকভাবে খাচ্ছেও না।চেম্বারেও বসছে না।পাগলের মতো মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।হাসিখুশি ছেলেটা হঠাৎ মায়ের জন্য একদম পাগল হয়ে গেছে।এইভাবে তাদের মা কোথায় নিরুদ্দেশ হলো ভাবতেই পারছে না নোমান।

হঠাৎ নীলা প্রবেশ করলো তানিশার চেম্বারে।সে তার বয়ফ্রেন্ডের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে।কিন্তু তানিশা তো এখন পরোপকার করার মুডে নেই।কারণ সে নিজেও ভীষণ শোকের মধ্যে আছে।কিন্তু নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে আর না করতে পারলো না।নীলাকে বললো তুমি চলে যাও এখন।আমি ঠিকানা মতো ঠিক চলে যাবো।

নীলা তখন তানিশাকে বললো ম্যাডাম আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করবো না। আপনি আমার আপন কেউ না হয়েও যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন সত্যি আমি ভাবতে পারছি না।এরকম মানুষ যদি সবাই হতো সত্যি দুনিয়ার চেহারাটাই পালটে যেতো।
তানিশা তখন বললো ঠিক আছে নীলা। পরে ধন্যবাদ দিও।আগে কাজটা করি।এখন তুমি সাবধানে বাড়ি যাও।

নীলা তানিশার কথা শুনে যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

রাত দুই টা বাজে।আমান আর নোমান এতোক্ষণে বাসায় ফিরলো।বাসার বাকি সদস্য রাও জেগে আছে।তন্নি আর ইকবালও এসেছে।তাহমিনা তো সেদিনের পর থেকে আর রুম থেকেই বের হয় নি।সবাই যে এখনো তাকেই দোষারোপ করছে সে সেটা ভালো করেই জানে।

নোমান কারো সাথে কোনো কথা না বলে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো।সেজন্য তানিশাও নোমানের পিছু পিছু রুমে চলে গেলো।তানিশা নিজের থেকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না।এদিকে নোমান ফ্রেশ না হয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লো।

তানিশা তখন বললো কিছু কি খেয়েছেন?
–না।
তানিশা সেই কথা শুনে একটা প্লেটে খাবার এনে নোমান কে বললো উঠুন একটু।খেয়ে নিন।
নোমান সেই কথা শুনে বললো বিরক্ত করো না তো তানিশা।তানিশা সেই কথা শুনে নোমান কে জোর করেই ওঠালো আর বললো শুধু হা করেন আমি খাইয়ে দিচ্ছি।না খেলে আপনি তো নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়বেন।তখন মাকে খুঁজবেন কিভাবে?
নোমান তানিশার কথা শুনে হা করলো, আর তানিশা তখন খাইয়ে দিলো।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে তানিশা নোমানকে শান্ত্বনা দিয়ে বললো এতোবেশি ভেংগে পড়বেন না প্লিজ।এমনিতেই খুঁজে পাবেন মাকে।শুধু আল্লহর উপর ভরসা রাখুন।
নোমান হঠাৎ সেই কথা শুনে তানিশাকে জড়িয়ে ধরলো।তার খুব কান্না পাচ্ছে।এতোদিন পর মাকে খুঁজে পেয়ে আবার কি হারিয়ে ফেললো নাকি?সে বুঝতেই পারছে না এভাবে তার মা কই উধাও হলো?

▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️▪️

তানিশা তার ব্যাগ থেকে নীলার দেওয়া ঠিকানা টা বের করে দেখতে লাগলো।যেহেতু দায়িত্ব নিয়েছে, সেই দায়িত্ব তো পালন করতেই হবে এখন।নোমান যেহেতু ব্যস্ত আছে এ জন্য নোমানকে না বলে সে একা একা যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো।কিন্তু নীলার বয়ফ্রেন্ডের নাম দেখে তানিশার চোখ যেনো কপালে উঠে গেলো।তবুও সে ভালোভাবে আগে সিওর হয়ে নিলো।হ্যাঁ তার ধারনাই ঠিক হলো।পাত্র আর অন্য কেউ নয়।শিলার ভাই জিসান।

জিসানের নাম দেখে তানিশার মাথা একদম গরম হয়ে গেলো।সে ভাবতেই পারছে না জিসান এতো টা বেয়াদব একটা ছেলে।নিজের গার্লফ্রেন্ড কে রেখে সে তানিশাকে বিয়ে করতে গিয়েছিলো।এদিকে তার গার্লফ্রেন্ড আবার প্রেগন্যান্ট। একজন ডাক্তার মানুষ হয়ে জিসানের চরিত্র যে এতো টা বাজে সত্যি তানিশা ভাবতেই পারছে না।

তানিশা এবার নীলাকে ফোন দিলো আর নীলাকে বললো আমি এই ছেলেকে ভালো করেই চিনি।তুমি যদি আমাকে শুধু ওর নাম টা আগে বলতে তাহলেই আর এতো কষ্ট করে তোমাকে ওর বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করতে হতো না।
তারপর তানিশা নীলাকে আশ্বাস দিয়ে বললো,নীলা তুমি কোনো চিন্তা করো না।আমি কালকের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করছি।
নীলা যে কি পরিমান খুশি হলো সত্যি সে সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না।সে তো এই কলঙ্গের জন্য নিজের জীবন টাই শেষ করতে চাইছিলো।

তানিশা এবার নোমানকে সব খুলে বললো।নোমান নিজেও ভীষণ অবাক হলো জিসানের চরিত্র দেখে।নোমান এবার আমান,আর শিরিন কে বললো ব্যাপার টা।শিরিন তো কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছিলো না।তার ভাই এতো নীচে নেমে গেছে?

তানিশা তখন বললো ভাবি!এখন মাথা গরম করার সময় নয়।জিসানের সাথে যে করেই হোক নীলার বিয়ে টা দিতে হবে।কারণ পেটের বাচ্চার বয়স ইতোমধ্যে ৪+.কোনো ধুমধাম না করে চুপেচাপে কাজটা সারতে হবে।লোকে ভাববে অনেক আগেই হয় তো বিয়ে টা হয়েছে।

শিলা সেই কথা শুনে বললো, ছিঃ ছিঃ।এই কথা আমি আমার বাবা মাকে কি করে বলবো?বাবা মা শুনলে একদম হার্ট অ্যাটাক করবে।

নোমান তখন বললো, ওনাদের কে এতোকিছু বলার দরকার নাই।শুধু বললেই হবে দুইজন দুইজনকে পছন্দ করে।সেজন্য বিয়ে করতে চায়।তাছাড়া ওনারা তো জিসান কে বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়ে খুঁজছেই।

শিলা নোমানের কথা শুনে রাজি হয়ে গেলো।তারা ঠিক করলো জিসান কে সাথে করে নিয়ে নীলার বাড়ি তে যাবে।আর সেই দিনই বিয়ের ব্যবস্থা করবে।

একদিকে মালিহা চৌধুরী কে খুঁজে না পেয়ে ভীষণ চিন্তায় আছে তারা,তার মধ্যে নতুন এক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লো আমান আর নোমান। কিন্তু এ ঝামেলাও কিন্তু কম টেনশনের ছিলো না।একটা মেয়ের মানসম্মানের ব্যাপার জড়িত আছে এটার সাথে।

পরের দিন শিরিন জিসান কে কৌশলে ডেকে আনলো।আর এনেই ঘরের দরজা লাগিয়ে ইচ্ছেমতো কয়েকটা চড় মারলো।
জিসান কিছু বুঝতে পারলো না।সে শুধু বললো, আপু কি হয়েছে?এভাবে মারছিস কেনো?
এবার আমান ও রুমের মধ্যে এসে ইচ্ছেমতো কয়েকটা চড় মারলো জিসানকে।আর বললো নীলা কে?

জিসান ভীষণ অবাক হলো।আমান ভাইয়া নীলাকে চিনলো কিভাবে?

নোমান তখন বললো,ছিঃ জিসান। একজন ডাক্তার মানুষ হয়ে এই ধরনের কাজ করতে তোর বিবেকে বাঁধলো না?তুই সত্যি অমানুষ হয়ে গেছিস জিসান।আমাকেও ফাঁসাতে ধরেছিলি।ইচ্ছে করলে তোর উপর আমি মান হানির মামলা দিয়ে জেলে দিতে পারতাম।কিন্তু দেই নি। বন্ধু মানুষ বলে মাফ করে দিয়েছি।কিন্তু এবার তোর আর ক্ষমা নাই।

তানিশা এগিয়ে এসে নোমানকে থামিয়ে দিয়ে বললো, নোমান শান্ত হও।এভাবে মাথা গরম করলে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না।এখন নীলা যেহেতু প্রেগন্যান্ট হয়েছে আর ওর পেটের বাচ্চা জিসানের বলে দাবি করছে সেজন্য যত শীঘ্রই বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

জিসান সেই কথা শুনে বললো আমি ওই মেয়েকে কখনোই বিয়ে করতে পারবো না।কারণ ওই মেয়ে একজন নষ্ট প্রকৃতির মেয়ে।আমি আগে জানতাম না ওদের ফ্যামিলির ব্যাপারে।কিন্তু যখন জানতে পারলাম ওদের ফ্যামিলির ব্যাপারে তখন থেকেই সরে এসেছি।

নোমান তখন বললো সেটা সম্পর্ক করার আগে ভাবা উচিত ছিলো।এখন কোনো উপাই নাই।যেহেতু নীলার পেটে তোর বাচ্চা এখন তোকে নীলাকেই বিয়ে করতে হবে।

জিসান তখন বললো বাবা মা কখনোই ওইরকম একটা পরিবারে আমার বিয়ে দেবে না।কারণ ওর বাবা একজন সন্ত্রাস।যে দিনে রাতে অপকর্ম চালিয়ে বেড়ায়।আর নীলার চরিত্রও ভালো না।সেটা আমি এতো দিন দিয়ে জানতে পারলাম।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে