জানে জিগার পর্ব – ৪

0
1055

#জানে জিগার
#হৃদয়ের আকাশে মেঘ রোদ বর্ষণ
#Part-04
#Writer-NOVA

সুমনা ও তার স্বামী রাকিব ফোমের গদি ওয়ালা চেয়ারে বসে আছে। সুমনার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। মুখটা ফোলা ফোলা। তার ছয় মাসের বাচ্চাটা ছিনতাই হয়ে গেছে গতকাল সকালে। তারপর থেকে সে পাগলামি শুরু করেছে। রাকিব অনেক কষ্টে তাকে সামলিয়েছে। সুমনা আবারো ফুপিয়ে উঠতেই রাকিব কিছুটা ধমকের সুরে বললো,

— চুপ কর দেহি। এহন কানলে কি আমগো পোলায় ফিরোত আইবো? তহন সাবধানে থাকলে এমনডা হইতো না। এহন আল্লাহ আল্লাহ কর। যাতে সব সামলায় উঠতে পারোস। তারা জানি আমগো পোলাডারে খুইজা পায়।

সুমনা ওড়নার কোণা ধরে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— আপনে কি মানুষ? আমাগোর পোলাডায় ছিনতাই হইয়া গেছে। আর আমি চুপ কইরা বইয়া থাকমু। আমার কলিজার টুকরোডা ওরা নিয়া গেছে। আল্লাহ জানে আমরা পামু কিনা।কই আছে, কেমন আছে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।

— কানলে যদি আইয়া পরতো তাইলে আমিও তোর লগে সুর কইরা কানতাম। এহন থাম। হুদাই চোখের পানি নষ্ট করিস না।

সুমনা তার স্বামীর কথা শুনে ফোঁস করে উঠলো।
— আল্লাহ আপনেরে কোন মাটি দিয়া বানাইছে? এমন কথা কন কেমনে? আমি হুদাই চোখের পানি নষ্ট করতাছি। দশ মাস দশ দিন পেটে আমি ধরছি আপনে না। আপনে কি বুঝবেন? আপনার মতো পাষাণ মানুষ দুইডা দেহি নাই আমি।

সুমনা মুখ ঝামটা মেরে নীরবে চোখের পানি ফেলতে লাগলো।বউয়ের কথা শুনে রাকিব থুম মেরে রইলো। তার যে বাচ্চার জন্য খারাপ লাগছে না। তা কিন্তু নয়। তার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে তো সুমনার মতো কেঁদে প্রকাশ করতে পারছে না। বাবাদের যে কাঁদতে নেই। বুকে পাথর চেপে রাখতে হয়।

পাঁচ বন্ধু তৈরি হয়ে নিচে চলে এলো। চেয়ারে বসে থাকা স্বামী-স্ত্রীর দিকে তাকালো তারা। মেয়েটার পাতলা গড়নের শরীরটা দেখে মনে হচ্ছে চৌদ্দ কি পনেরো বছরের একটা মেয়ে। ছেলেটার বয়সও বাইশ কি তেইশের কোঠায়। খুব কম বয়সে তাদের বিয়ে হয়েছে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। পাঁচজন চুপচাপ এসে সামনের ডেভিনে বসলো। ওদের দেখে রাকিব বসা থেকে উঠে কপালে হাত ঠেকিয়ে সালাম দিলো,

— স্লামালাইকুম।

বর্ষণ চোখের সরু ফ্রেমের চশমাটা খুলে হালকা করে ফুঁ দিয়ে রাকিবকে বললো,

— আসসালামু আলাইকুম হবে।

রাকিব কিছুটা ইতস্তত হয়ে মাথা নামিয়ে ফেললো।রোদ চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

— আপনাদের বাচ্চার বয়স কত?

রাকিব একবার সুমনার দিকে তাকিয়ে বললো,
— ছয় মাস শেষ হইয়া সাত মাসে পরছে।

আকাশ পিঠ সোজা করে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
— বাচ্চার নাম?

সুমনা জোরালো গলায় বললো,
— সাকিব শেখ। সাকিব ওর নাম। আমার লক্ষ্মী পোলা। মায়ের সব কথা হুনে। ওরা আমার মানিকরে ছিনাইয়া নিয়া গেছে।

হৃদয় সিরিয়াস ভঙ্গিতে বসে এক হাত পাশে রেখে প্রশ্ন করলো,
— বাচ্চা কি করে ছিনতাই হলো?

বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করতেই সুমনা ফুপিয়ে উঠলো। রাকিব ধমকের সুরে বললো,
— না কাইন্দা সবকিছু খুইলা কো।

মেঘ শান্ত চোখে সুমনাকে খেয়াল করছে। সন্তান হারানো একটা মায়ের কষ্ট কতটা জখমী তা একমাত্র সন্তানহারা মা বলতো পারে। আর যারা মা-বাবা হারা তাদের কষ্টটা কেমন সেটা নিশ্চয়ই ওরা পাঁচজন ভালো করে জানে। তাই একটু হলেও সুমনার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছে। মেঘ ছোট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। নরম গলায় সুমনাকে বললো,

— দেখুন আপনি প্লিজ কান্না করেন না। কান্না বন্ধ করে আমাদের সবটা খুলে বলুন। আপনি চুপ করে থাকলে আমরা কোনকিছু করতে পারবো না। আমাদের সবটা খুলে বললে যতদ্রুত সম্ভব আপনার ছেলেকে খুঁজে নিবো।

হৃদয় তার বড় চুলে হালকা টানতে টানতে মেঘের সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
— সেদিন যা হয়েছে প্রথম থেকে আমাদের বলুন।কোনকিছু বাদ দিবেন না। আপনি কাকে দেখছেন। কিভাবে তারা এসেছে সবকিছু।

রাকিব চোখ পাকিয়ে তার স্ত্রীকে কিছুটা রাগত স্বরে চেচিয়ে বললো,
— চুপ কইরা রইছোস কে? সবকিছু খুইলা কো।

আকাশ রাকিবকে হাত দিয়ে থামিয়ে বললো,
— আপনি উনাকে এমন ধমকি-ধামকি দেওয়া শুরু করছেন কেন?এসব করা বন্ধ করুন। উনি তাতে আরো ঘাবড়ে যাবে। এমনি তার মনের অবস্থা ভালো নয়। তাই এমন ব্যবহার করেন না।

রাকিব, আকাশের কথা শুনে মুখটাকে কুচোমুচো করে ফেললো। সুমনা বড় করে নাক টেনে প্রথম থেকে সবকিছু বলতে শুরু করলো। পাঁচজন মনোযোগ সহকারে তা শুনতে মন দিলো।

🔥🔥🔥

পড়ন্ত বিকেলের আলো এসে পরেছে ভুবনে। নির্জন একটা ভুতুড়ে বাড়ির সামনে রিকশা থামলো। রিকশায় থাকা মহিলা ও যুবতী মেয়ে নিচে নামলো।এই বাড়িকে ভুতুড়ে বাড়ি বলার একটা কারণ আছে। বাইরে থেকে রংচটা, কালো শ্যাওলাযুক্ত, চুনকাম খসে যাওয়া এই বাসাটা দেখলে যে কেউ ভয় পেয়ে প্রথমেই উচ্চারণ করবে ভুতুড়ে বাড়ি। অবশ্য এলাকার কাছে এটা ভুতুড়ে বাড়ি নামে পরিচিত।জং পরা ভাঙা গেইটের ভেতরে প্রবেশ করার সাহস কেউ করে না। প্রথমে মনে হবে এই বাড়িতে ঢুকলে জীবনে বের হতে পারবে না। রিকশা থেকে নেমে মাইশাও প্রথমে ভয় পেয়ে গেলো। এ কেমন বাড়ি? এখানে কি আদোও কোন মানুষ থাকে? তার ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে। চোখ দুটো দোতালা বাড়ির ওপর থেকে নিচ অব্দি বুলিয়ে থমকে দাঁড়ালো। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ঘাড়ের কাছে হাত রাখতেই মাইশা চমকে উঠলো। রাণী বেগম চোখ দুটো গোল করে বললো,

— কিরে মাইশা এমন চমকায় উঠলি কেন?

মাইশা আমতাআমতা করে বললো,
— কি কি কিছু না ফুপু।

— চল ভেতরে যাই।

— এই ভুতুড়ে বাড়িতে তুমি কাজ করো ফুপু?

— হো কেন?

— আমার তো মনে হচ্ছে এখানে ঢুকলে আর জীবনে বের হতে পারবো না। সত্যি এখানে মানুষ থাকে তো? নাকি তুমি আমাকে মেরে ফেলার ধান্দা-টান্দা করছো।

রাণী বেগম ফিক করে হেসে মাইশার মাথায় এক চাপর মেরে বললো,
— হুনো দেখি ছেমরির কথা। লো ভেতরে যাই।

রাণী বেগম রিকশার ভাড়া পরিশোধ করে কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে মাইশাকে বললো,
— এতো ভয় না পাইয়া ভেতরে আয়। ভেতরে গেলে তুই অবাক হইয়া যাবি। এখন যতটা ভয় পাইতাছোস। ভেতরে গেলে তা অবাকে পরিণত হবে।

তিনি ব্যাগ দুটো নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। মাইশা এদিক সেদিক ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছোট করে একটা ঢোক গিললো। এপাশ ওপাশ দৃষ্টি দিয়ে হাঁটতে লাগলো। হঠাৎ পাশের ছোট ঝোপের থেকে কিছু নড়েচড়ে উঠলে “আল্লাহগো” বলে চিৎকার দিয়ে রাণী বেগমের পাশে দৌড়ে গেলেন। রাণী বেগম চোখ, মুখ কুঁচকে মাইশাকে বললো,

— কি হয়েছে এমন কইরা চিৎকার পারস কেন?

— ফুপু ঝোপের কাছে কি জানি নড়লো।

— ওহ এই ব্যাপার। গাউছা ইন্দুর (গেঁছো ইঁদুর) হইবো। এতো ডরানের কিছু নাই।

মাইশা মুখটাকে হা করে বিস্মিত কন্ঠে বললো,
— এখানে আবার গেছো ইঁদুরও আছে?

— হো অনেক। ছাদে কোনকিছু রোদ দেওন যায় না। ইন্দুরে নিয়া যায়। সেইবার শুকনা মরিচ রোদে দিছিলাম। অর্ধেকই নিয়া গেছে।

মাইশা অবাক হয়ে সবকিছু শুনছে।তার ধারণামতে এসব শুধু গ্রামে দেখা যায়। কিন্তু ঢাকা শহরে গেছো ইঁদুরের কথা শুনে সে একটু নয় বেশি চমকে গেছে। সদর দরজার সামনে গিয়ে রাণী বেগম কোমড়ে থাকা পুঁটলি থেকে চাবি বের করে তালা খুললো। ব্যাগ নিয়ে মাইশাকে বললো,

— ভেতরে আয়।

মাইশা ভেতরে ঢুকতে অনেক ভয় পাচ্ছিলো। তার মনে হয়েছে ভেতরে ঢুকলে একদল বাদুড় শা করে ওর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাবে। সামনে ধুলোমাখা ময়লা আসবাবপত্রের দেখা মিলবে। মাকড়সার জালে সব ভুতুড়ে পরিবেশ থাকবে। যেমনটা হরর মুভিতে দেখা যায় সেরকম। এক মুহুর্তে তার ফুপুকে ভুত মনে হলো। যে কিনা তাকে এখানে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে এসে মেরে ফেলবে। আর তাকে মেরে তাদের ভূতের দল ভারী করবে।তারপর মাইশার আত্মা সারাজীবন এখানে আটকে থাকবে। কোন পূর্ণিমার রাতে কোন ভালো মানুষের সন্নিধ্যে ছাড়া পেয়ে যাবে। ভুতের মুভি দেখার কারণে তার ছোট মস্তিষ্কে এসব হানা দিলো।তাই সে চোখ, মুখ খিঁচে নিজেকে এরকম পরিবেশ দেখার প্রস্তুত করে নিলো। কিন্তু চোখ খুলে সে হতবাক। এটা কোন বাড়ি নাকি রাজপ্রাসাদ! এতো সুন্দর কোন বাড়ি হয়? বাইরে যতটা ভুতুড়ে ভেতরটা ততটা আকর্ষণীয়।চারিদিকে চোখ বুলিয়ে মাইশার আপনাআপনি মুখ দিয়ে বের হলো,

— আল্লাহ এটা কি দেখছি আমি! এত সুন্দর ডেকোরেশন কি করে করতে পারে মানুষ?

~~~ ছেলেদের বন্ধুত্ব শুধুমাত্র দুইটা কারণে নষ্ট হয়।
১. মেয়ে ২. টাকা। এই দুটো ছাড়া তাদের বন্ধুত্ব কেউ নষ্ট করতে পারবে না।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে