জানে জিগার পর্ব – ৫

0
970

#জানে জিগার
#হৃদয়ের আকাশে মেঘ রোদ বর্ষণ
#Part-05
#Writer-NOVA

পরেরদিন………

রাত প্রায় এগারোটা বাজে। একটা কফি রঙের প্রাইভেট কার এসে থামলো ভুতুড়ে বাড়ির সামনে।চার বন্ধু কার থেকে নামলো।হৃদয় ড্রাইভারের সিট থেকে জানালা দিয়ে মাথা বের করে বাকিদের উদ্দেশ্য করে বললো,

— তোরা যা আমি গাড়ি পার্ক করে আসছি।

বর্ষণ হাতে থাকা মোবাইল ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
— ওকে,তাড়াতাড়ি আসিস। একসাথে ডিনার করবো।

হৃদয় “ওকে” বলে গাড়ি নিয়ে ভেতরের দিকে চলে গেলো। চারজন কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে এলো। হৃদয়ের গাড়ি রেখে এসে সোফায় বসে পরলো।বেশ হয়রান লাগছে তার। তাই সোফায় বসেই চেচিয়ে রাণী বেগমকে বললো,

— খালা, এক গ্লাস লেবুর শরবত দিয়োতো।

রাণী বেগম কিচেনে টুকটাক কাজ করছিলো। হাতের কাজ গুছাতে গুছাতে উত্তর দিলো,
— আসতেছি।

হৃদয় সোফায় বসে মাথা হেলিয়ে দিলো। মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে। কপালটা দুই আঙুলে চেপে চোখ বন্ধ করে চুপ করে বসে রইলো। হঠাৎ চুড়ির রিনঝিন শব্দ কানে পেতেই হৃদয় হকচকিয়ে গেলো। এই বাসায় রাণী বেগম ছাড়া আর কোন মেয়ে নেই। আর রাণী বেগম বুড়ো বয়সে হাতে কাচের চুড়ি পরবে না। হৃদয় ভুল ভেবে আবারো চোখ বন্ধ করে রইলো। আবারো রিনঝিন শব্দ কানে এলো। চোখ সরু করে সামনের সোফার দিকে তাকালো। মনে হচ্ছে সোফার মধ্যে সোজা হয়ে কেউ চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। সেখান থেকে চুড়ির টুংটাং শব্দ এলো। হৃদয় কপাল স্লাইড করতে করতে তীক্ষ্ণ চোখে সামনে তাকিয়ে রইলো। চাদরের আড়াল থেকে একটা ফর্সা হাত বের হলো। তাতে এক মুঠ সবুজ রঙের রেশমি চুড়ি এদিক সেদিক খেলা করছে। ফর্সা হাতে সবুজ চুড়ি ফুটে রয়েছে। চুড়ির দিকে তাকিয়ে হৃদয়ের কিছুটা ঘোর লেগে গেলো। ইচ্ছে করছে তার হাতের চুড়িগুলো আলতো করে ছুঁয়ে দিতে। আবারো হাতটা চাদরের আড়ালে চলে যেতেই হৃদয়ের সম্বিত ফিরলো। সোফা থেকে উঠে এগিয়ে গিয়ে এক ঝাটকায় শুয়ে থাকা মানুষের হাতটা ধরে উঠিয়ে বসলো।

আচমকা কেউ হাত ধরে উঠে বসাতেই মাইশা চমকে উঠলো। এক হাতে বিরক্তির সাথে মুখের ওপর থেকে চাদর সরালো। চোখ, মুখে তার বিরক্তির প্রকাশ। চোখ বন্ধ করেই মুখের সামনে থাকা বেবী চুলগুলো পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে বিরবির করে বললো,

— উফ, শান্তিতে একটু ঘুমাতেও পারবো না। যাও তো ফুপু। আমাকে ডিস্টার্ব করো না।

হৃদয়ের ভ্রূকুটি কুঁচকে এলো। তার চোখের সামনে এক ঘুমন্ত পরী বসে আছে। তার হাত যে কেউ ধরে বসিয়ে দিয়েছে তবুও তার কোন হুশ নেই। চোখ বন্ধ করেই বিরবির করছে।আনমনেই হৃদয়ের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলে গেলো। মাইশা ঘুম ঘুম চোখে সামনে তাকাতেই আৎকে উঠলো। সাথে সাথে তার ঘুম হাওয়া। অচেনা, অজেনা একটা ছেলে তার সামনে হাঁটু ভেঙে বসে আছে। পরমুহূর্তেই হাতের দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেলো হৃদয় ওর হাত ধরে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। ঝাটকা মেরে হাত সরিয়ে ইতস্তত করে লাফ মেরে দাঁড়িয়ে গেলো। হৃদয় ভ্রু জোড়া কুঁচকে দাড়িয়ে গেলো। তখুনি মাইশা এক কান্ড ঘটিয়ে ফেললো। হৃদয়ের কোমড় পেচিয়ে ধরে জোরে জোরে চোর বলে চিৎকার করে উঠলো।

— চোর, চোর কে কোথায় আছো? জলদী এসো।আমি চোর ধরেছি।

আচমকা এমন হামলা হওয়ায় হৃদয় ভড়কে গেলো। নিজের বাসায় চোর অপবাদ পাচ্ছে সে।মেয়েটার হাত কোমড় থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললো,

— আরে করছোটা কি ছাড়ো! এই মেয়ে সাহস হয় কি করে তোমার? আমাকে চোর বলছো কোন সাহসে?

— চুরি করতে এসে আবার বড় বড় কথা। ফুপু কোথায় তুমি? জলদী এসো। দেখো, আমি চোর ধরেছি।

রাণী বেগম শরবতের ট্রে নিয়ে এসে চোখ কপালে তুলে ফেললো। টি-টেবিলে ট্রে রেখে মাইশাকে হৃদয়ের থেকে সরাতে সরাতে বললো,

— মাইশা,ছাড় ওকে। করোস কি?

মাইশা জোরে চিপকে ধরে বিস্মিত কন্ঠে বললো,
— কি বলো তুমি? তুমি চোরকে ছাড়তে বলছো কেন?

মাইশাকে জোর করে রাণী বেগম ছাড়িয়ে আনলো। হৃদয় দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টানছে।মেয়েটা ওকে যেভাবে ধরেছিলো তাতে সে হয়রান। একটা মেয়ের সাথে সে তো ধস্তাধস্তি করতে পারে না।এটা কোন ভদ্রতা নয়। মাইশা আবারো এগিয়ে আসতে গেলে রাণী বেগম কোমড় পেচিয়ে ধরে পেছনে টেনে নিয়ে গেলো। মাইশা রেগে ওর ফুপুকে বললো,

— আরে ছাড়ো। তুমি চোরকে না ধরে আমাকে ধরছো কেন? উনি এখানে চুরি করতে এসেছে। আমার চুড়ির সাথে তার হাত না লাগলে তো বুঝতেই পারতাম না। সে আমার হাত ধরে উঠিয়ে বসেছিলো।

মাইশার এমন অগোছালো কথা শুনে রাণী বেগম নিষ্পলক চাহনিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

— ঐ ছেমরি তোর মাথা কি গেছে? কি উল্টাপাল্টা বলতাছোস? চুরি করতে আসলে তোর চুড়ি কেন ধরবো? তোকে কেন উঠাইবো?

মাইশা কিছুটা দমে গেলো। সত্যি কথাই তো! তবে সে হারবে না। তাই জোর গলায় বললো,

— আমার চুড়িই চুরি করতে এসেছে।

হৃদয় চমকে মাইশার দিকে তাকালো। বলে কি মেয়েটা?মাথায় কি কোন সমস্যা আছে নাকি? বাজে বকছে কেনো? রাণী বেগম ধমক দিয়ে বললো,

— তোর চুরি দিয়া হৃদয় বাবাজী কি করবো? হাত পিইন্দা(পরে) বইয়া থাকবো? তুই পাগল হয়ে গেছিস। যা কিচেনে কাজ কর।

মাইশা আবারো চেচিয়ে বললো,
— তুমি বিশ্বাস করো ফুপু। আমি নিজ চোখে…..

পুরো কথা শেষ না হতেই রাণী বেগম ধমকে উঠলো,
— চুপ ছেমরি। আরেকটা কথাও কইবি না।

মাইশাকে ধমকে হৃদয়ের সামনে এসে নরম গলায় বললো,
— বাজান ওর এমন কাজে কিছু মনে কইরো না। ও একটু এমনি।

হৃদয় একবার মাইশার দিকে তাকিয়ে সামনের সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে বসলো। মাইশা মুখ ভেংচালো।তার ফুপু তাকে বকে এর সাথে মিছরির সুরে কথা বলছে। ততক্ষণে বাকি চারজন ফ্রেশ হয়ে সিঁড়িতে চলে এসেছে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মেঘ জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে খালা?

হৃদয় একবার মাইশার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
— কিছু না।

রোদ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে হন্তদন্ত হয়ে বললো,
— মামলা কি দোস্ত?

হৃদয় দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— বললাম তো কিছু না।

আকাশ একবার চোখ দুটো ছোট করে মাইশার দিকে তাকালো। সবার উৎসুক দৃষ্টি মাইশার দিকে। নিজের দিকে সবাইকে এমনে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাইশা কিছুটা ভরকে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। বর্ষণ মাইশার চারপাশে একবার ঘুরে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,

— কে তুমি?

মেঘ এতখন মোবাইলে বুদ হয়ে ছিলো। বর্ষণের কথা শুনে চট করে মাইশার দিকে তাকালো। তারপর চোখ, মুখে প্রশ্ন রেখে রাণী বেগমের দিকে তাকালো। রাণী বেগম আমতাআমতা করে বললো,

— মেঘ বাবা, ওর নাম মাইশা। ওর কথাই বলছিলাম তোমারে। আমার ভাইয়ের মেয়ে। ছোট বেলায় জন্মের সময় মা মইরা গেছে। কয়েক মাস আগে ভাই মইরা যাওনে ও পুরা একলা হইয়া গেছে। গেরামে (গ্রামে) তো একলা রাখোন যায় না। বিয়ার বয়সী মাইয়া। মাইনসে (মানুষে) কুনজর দেয়।

মেঘ মোবাইল পকেটে রেখে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। চেয়ার টেনে বসে প্লেট সোজা করে বললো,

— কোন সমস্যা নেই। ও এখানে থাকলে আমাদের কোন আপত্তি নেই। ওর যাতে কোন সমস্যা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।

মেঘ চুপচাপ খাবার বেড়ে খেতো লাগলো। হৃদয় সরু চোখে একবার মাইশাকে দেখে ধুপধাপ পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। মাইশা ভয়ে জড়সড়। শুকনো ঢোক গিলে একবার হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে ফেললো।জিহ্বায় কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কাকে চোর বলেছে সে?বাড়ির মালিককে চোর অপবাদ দিলো। তখুনি রোদ এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বললো,

— হাই আমি রোদ। তুমি আমাকে বানি বলতে পারো।

— আমি মাইশা হক।

দুজন সোফায় বসে আলাপ জুড়ে দিলো। বর্ষণ, আকাশ, মেঘ খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগলো। আকাশ রোদের দিকে তাকিয়ে বললো,

— রোদ খেতে আয়।

রোদ মাইশার সাথে গল্প করতে করতে বললো,
— একটু পর খাচ্ছি।

হৃদয় ফ্রেশ হয়ে চলে এলো। চেয়ারে বসে প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে চুপচাপ খেতে লাগলো। হৃদয়কে দেখে মাইশা আস্তে করে উঠে তার ফুপুর কাছে চলে গেল। রোদের কাছে সবার বায়োডাটা পেয়ে গেছে। হৃদয়ের সব কথা শুনে সে এখন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। তাই সে এখান থেকে চম্পট দিলো। রোদ সোফা থেকে উঠে ওদের সাথে শামিল হলো। বর্ষণ খাবার মুখে দিয়ে টিটকারির সুরে হৃদয়কে বললো,

— কি ব্যাপার হৃদয়, ঘটনা কি?

হৃদয় খাবার রেখে চোখ দুটো ছোট করে জিজ্ঞেস করলো,
— কিসের ঘটনা?

আকাশ একগালে হেসে শয়তানি সুরে বললো,
— কি ঘটনা তুমি জানো না দোস্ত?

হৃদয় খাবারে মনোযোগ দিয়ে বললো,
— জানলে জিজ্ঞেস করতাম না।

বর্ষণ বললো,
— একটা মেয়ে তোকে চোর উপাধি দিলো। আর তুই তাকে কিছু বললি না? বিষয়টা আসলেই অবাক করার মতো।

আকাশ দাঁত বের করে বললো,
— কাহিনি কুছ ওর লাগরাহি!

হৃদয় বললো,
— তেমন কিছু না।

আকাশ বললো,
— তাহলে কেমন কিছু?

হৃদয় উত্তর দিলো না। এখন কথা বললেই কথা বাড়বে। মেঘ চুপচাপ খাবার খাচ্ছে। সে কিছু একটা ভাবছে। রোদ চেচিয়ে রাণী বেগমকে ডেকে বললো,

— খালা, একটু তরকারি দিয়ে যেয়ো।

রাণী বেগম চুপচাপ এসে বাটি নিয়ে চলে গেলো।ওরা নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলছে। মেঘের মোবাইলে কল আসতেই সবাই চুপ হয়ে গেলো।মেঘ কল রিসিভ করতেই তার চেহারার রং বদলে গেলো। কল কেটে মোবাইল পকেটে রেখে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— আমরা এখুনি বের হবো।

~~~ভালোবাসা বেশি প্রকাশ করতে নেই। তাহলে ফিকে হয়ে যায়😊।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে