জানে জিগার পর্ব – ৬

0
972

#জানে জিগার
#হৃদয়ের আকাশে মেঘ রোদ বর্ষণ
#Part-06
#Writer-NOVA

স্তুপ করা বস্তার ওপর উপুড় হয়ে পরে আছে একটা ছেলে। তার পরনের প্যান্ট-শার্ট ছিঁড়ে ধুলোর ময়লায় মাখামাখি। মুখে বেদম মারের চিহ্ন। ঠোঁট কেটে রক্ত বের হচ্ছে। রডের বারিতে পিঠের অবস্থা নাজেহাল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে একটু আগে তার ওপর ঝড় গিয়েছে। জ্ঞান আছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না। পাঁচ বন্ধু সোজা এসে সেই রুমে ঢুকলো। সাথে আরেকটা ছেলে। তার নাম আরাফাত। সে মেঘকে এই ছেলের কথা বলেছিলো। বর্ষণ এগিয়ে এসে ছেলেটাকে লাথি দিয়ে সোজা করে আরাফাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— এই শালাকে কোথা থেকে তুলে আনছিস আরাফাত?

আরাফাত একগালে হেসে বললো,
— শালায় নিজে এসে আমাদের জালে ধরা পরছে।

মেঘ সামনের চেয়ারে বসে আকাশকে বললো,
— এর জ্ঞান ফেরানোর ব্যবস্থা কর।

আকাশ দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।মিনিট কয়েকের মধ্যে এক মগ পানি নিয়ে এসে দৌড়ে ফিরে এলো। পানির ঝাটকা মেরে চুলের মুঠি ধরে উঠিয়ে বসাতে বসাতে বললো,

— এই উঠ!

রোদ ঘুরেফিরে ছেলেটাকে দেখতে লাগলো। মেঘকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— মেঘ ভাই, এর ব্যবস্থা কে করবে?

মেঘ, রোদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে হৃদয়ের দিকে তাকালো। হৃদয় হাতের ঘড়ি খুলে সামনের টেবিলে রাখছে। মোবাইল, ওয়ালেট রেখে শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে সামনে এগিয়ে এলো। রোদ, মেঘের হাসির উৎস খুঁজে পেলো। সে যা বোঝার বুঝে গেছে। এই আরাফাতের শায়েস্তা করবে হৃদয়। রোদ ছেলেটার পাশে বসে গালে মৃদু দুই থাপ্পড় দিয়ে বললো,

— নাম কি?

ছেলেটা ঢুলে পরে যাচ্ছে। চোখ টেনে মেলতে পারছে না। রোদের কথা বুঝতে পারলো কিনা কে জানে। বিরবির করে বলতে লাগলো,

— আমি কিছু বলবো না। আমি কিচ্ছু বলবো না।

রোদ এবার কষিয়ে এক থাপ্পড় বসালো গালে। আকাশ রোদের হাত থেকে ছেলেটাকে সরিয়ে নিয়ে নাকে দুটো পাঞ্চ মারলো। ছেলেটা হুরমুর করে সচকিত হয়ে বললো,

— আমার নাম, আমার নাম তিশান।

রোদ মুচকি হেসে বললো,
— সে তো নাম বললি। তবে ভালো কথায় না।

হৃদয় হাতা গুটানো শেষ করে বললো,
— সর দেখি। ওকে আমার হাতে ছেড়ে দে। ওর দিক আমি দেখছি।

আকাশ, রোদ সেখান থেকে উঠে গেলো। বর্ষণ হৃদয়কে উদ্দেশ্য করে বললো,
— কিছু লাগবে?

হৃদয় একবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
— বড় হাতুড়িটা নিয়ে আয়। বেশি তিড়িংবিড়িং করলে এক বারিতে ঘিলু বের করে ফেলবো।

বর্ষণ দুই হাত পকেটে পুরে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো হাতুড়ি আনতে। ওদের কথা শুনে তিশান নামের ছেলেটা ভড়কে গেলো। এর আগে যে মার খেয়েছে তার ব্যাথা এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো। ভয়ার্ত চোখে হৃদয়ের দিকে তাকাতেই হৃদয় ভিলেনি হাসি দিলো। মেঘ, আরাফাতকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— আরাফাত বাকি কাজের কি খবর?

আরাফাত একদমে বললো,
— বড় ভাই সব কমপ্লিট। এখন শুধু একটা মেয়ে লাগবে। ওর থেকে পরবর্তী টার্গেট প্লেসের কথা জেনে টোপ ফেলতে হবে।

মেঘ হৃদয়কে বললো,
— তুই এদিকটা দেখ। আমি আরাফাতের সাথে বাকি কাজ সামলাচ্ছি।

হৃদয় হাতে থাকা ছোট স্ক্রু-ড্রাইভারটা ঘুরাতে ঘুরাতে মেঘকে বললো,
— টেনশন করার কোন দরকার নেই। এর ব্যবস্থা করা হৃদয়ের বা হাতের কাজ।

মেঘ বিনিময়ে ঠোঁট দুটো হালকা বাকালো। রোদকে চোখের ইশারায় কিছু বুঝিয়ে আরাফাতকে নিয়ে বের হয়ে গেলো।হৃদয় চেয়ার টেনে তাতে পা তুলে বসে তিশানকে বললো,

— ভালোই ভালোই সব বলবি। তাহলে বাচবি। নয়তো তোর অস্তিত্ব কেউ খুঁজে পাবে না।

তিশান শরীর টানতে টানতে পেছনে চলে গেলো। হৃদয় তা দেখে আকাশ ও রোদকে বললো,
— যা, হাত দুটো শক্ত করে ধর।

দুজনে অনুমতি পেয়ে দ্রুত পায়ে এসে তিশানের হাত পেছনে মুচড়ে ধরলো। হৃদয় চট করে স্ক্রু-ড্রাইভারটা একদম তিশানের চোখের সামনে এনে রেগে বললো,

— যা জানিস সব বল।

তিশান ভয়ে চোখ বন্ধ করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কান্না জড়ানো কন্ঠে বললো,
— বলছি, সব বলছি।

হৃদয় শান্ত হয়ে চেয়ারে বসে বললো,
— এক সেকেন্ড দেরী যাতে না হয়।

তিশান ঢোক গিলে বলতে লাগলো,
— আমরা শুধু বাচ্চাগুলোকে ছিনতাই করি। বাইক থেকে বাচ্চা নিয়ে যাই। তারপর বাচ্চাগুলোকে সামনের এক পুরনো বাড়িতে নিশাথের কাছে দিয়ে দেই। এরপর বাচ্চাগুলো কি হয় তা আমি জানি না। আমাদের কাজ শুধু এতটুকুই। আগে এমনি টুকটাক ছিনতাই করতাম। একদিন ঐ নিশাথ এসে বললো এই কাজ করতে। তিনগুণ লাভ দেখে আমি রাজী হয়ে যাই।কাজ শেষ হলে টাকা আমাদের একাউন্টে চলে আসতো।কে বা কারা এর সাথে সংযুক্ত তা আমি জানি না।

আকাশ হাত মুচড়ে ধরে বললো,
— এই নিশাথকে কোথায় পাবো?

তিশান চুপ হয়ে গেলো। এতখনে ওদের কথার মধ্যে বর্ষণ বড় এক হাতুড়ি নিয়ে হাজির। তিশানকে চুপ করে থাকতে দেখে হৃদয়ের মাথায় রক্ত উঠে গেলো। বর্ষণের হাত থেকে ছোঁ মেরে হাতুড়িটা নিয়ে তিশানের কপালে জোরে এক বারি দিলো। তিশান ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো। হৃদয় থামলো না। সর্বশক্তি লাগিয়ে ওর দুই হাঁটুর মধ্যে আবারো বারি দিলো।তিশান চোখে, মুখে অন্ধকার দেখছে। হৃদয় মুখ চেপে ধরে রাগী গলায় বললো,

— বলবি কিনা?

তিশান ভয়ে ভয়ে বললো,
— বলবো বলবো। ওকে আগামীকাল বিকেলে নতুন মার্কেটের পেছনের মাঠে পাবেন। সেখানে মেলা বসবে।সেই মেলা থেকে এক ডজন বাচ্চা ছিনতাই করার চিন্তাভাবনা করেছে।

হৃদয় রেগে হাতুড়ি দিয়ে হার্ট বরাবরি একটা বারি দিলো। তিশান মুখ দিয়ে পিচকিরির মতো রক্ত ছিটকে পরলো। মুখ থুবড়ে নিচে পরে গেলো। বর্ষণের দিকে হাতুড়িটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

— এবার তোরা তিনজন পালা করে ডোজ দে। আমি মেঘের কাছে যাচ্ছি।

🔥🔥🔥

পরেরদিন বিকেলে….

রোদ আশেপাশে তাকিয়ে একের পর এক পপ্পন খাচ্ছে। তবে তার তীক্ষ্ণ নজর মেলার গেইটের সামনে। সেখান দিয়ে কোন সন্দেহভাজন বাইকার গেলে তার খবর দেওয়ার দায়িত্বে আছে। পাঁচ বন্ধু ও তাদের লোক আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সাধারণ বেশে ঘুরে বেরাচ্ছে। কিছু সময় পর বর্ষণ তার সাথে যোগ দিলো। দুই বন্ধু ভীড় থেকে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে মনের সুখে পপ্পন চাবিয়ে চারিদিক লক্ষ্য করতে লাগলো। হঠাৎ পেছন থেকে দুটো মেয়ের ধাক্কায় তারা পরতে পরতেও টাল সামলিয়ে ফেললো। কিন্তু হাতে থাকা পপ্পন সব নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বর্ষণ, রোদ সামনে তাকাতেই দুটো মেয়ে ইনোসেন্ট ফেস করে একসাথে বলে উঠলো,

— সরি সরি!

পাপড়ি,সানিয়া মুখ কুচোমুচো করে দাঁড়িয়ে আছে। দুই বোন আজ মেলায় ঘুরতে এসেছে লুকিয়ে। হঠাৎ নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। সানিয়া পাপড়ির মাথায় চাপর মেরে সামনের দিকে ছুটে চলে আসে। তখুনি রোদ ও বর্ষণের সাথে ধাক্কা খায়। রোদ, বর্ষণ দুজনেই সরু চোখে পাপড়ি,সানিয়াকে খেয়াল করছে। বর্ষণের দৃষ্টি সানিয়ার দিকে৷ আর রোদের দৃষ্টি পাপড়ির দিকে। ইনোসেন্ট ফেস করে রাখায় দুই বন্ধুর কাছে মনে হচ্ছে কোন বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে সানিয়াকে দেখে বর্ষণের মনে ঘন্টা বেজে গেছে। কিন্তু রোদের অবস্থা ভাবলেশহীন। পাপড়ির ভীষণরকম অস্থির লাগছে রোদ এভাবে তাকিয়ে থাকায়। গলা ঝেড়ে মিষ্টি কন্ঠে বললো,

— আসলে আমরা খেয়াল করিনি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। মাফ করে দিবেন প্লিজ। আমরা আসলেই দুঃখীত।

মিহি কন্ঠের ঝংকার শুনে রোদ চমকে উঠলো। কি মিষ্টি কন্ঠ!এমন করে কেউ কথা বলতে পারে? তার ভেতরে তোলপাড় চলছে। বর্ষণকে নিজের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে চোখের সামনে সানিয়া হাত নাড়িয়ে বললো,

— এই যে হ্যালো, আছেন কোথায়?

বর্ষণ আনমনে বললো,
— তোমার মাঝে।

সানিয়া কপালে ভাজ ফেলে জোরে চেচিয়ে বললো,
— কি?

সানিয়ার চেঁচানোতে বর্ষণের হুশ ফিরলো। হুশ ফিরতেই মাথা চুলকে লাজুক ভঙ্গিতে বললো,
— কিছু না।

সানিয়া চোখ দুটো ছোট করে এক মিনিট কি জানি ভাবলো। তারপর পাপড়িকে টানতে টানতে ভেতর দিকে নিতে নিতে বললো,
— এখান থেকে জলদী চল।

যাওয়ার আগে পাপড়ি রোদের দিকে তাকিয়ে হালকা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসি দিলো। সেই হাসিতে রোদ কপোকাত। যতখন পাপড়িকে দেখা গেলো ততক্ষণ তাকিয়ে রইলো। বর্ষণ রোদকে ধাক্কা মারতেই ওর হুশ ফিরলো। এতখন যেন সে ঘোরের মধ্যে ছিলো। বর্ষণ সানিয়াকে দেখিয়ে বললো,

— রোদ, আমার কিন্তু ঐ কমলা রঙের ড্রেস পরা মেয়েটাকে ভীষণ ভালো লাগছে।

রোদ প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। তবে তার ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি খেলে বেড়াচ্ছে। কাউকে ভালো লাগার খুশিতে। বর্ষণকে আকাশ কল দিতেই সে সেখান থেকে চলে গেলো। রোদ আবারো তার ওপর দেয়া দায়িত্বে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু বারবার পাপড়ির মিষ্টি হাসিটা চোখে ভাসতে লাগলো। তখুনি পেছন থেকে একটা মেয়ালি সুর ভেসে এলো,

— আরে আপনি মিস্টার রোদ না?

~~~পৃথিবীতে কেউ খারাপ হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। পরিস্থিতি নামক শব্দটাই মানুষকে খারাপ হতে বাধ্য করে🖤।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে