জানে জিগার পর্ব – ২ ও ৩

0
1316

#জানে জিগার
#হৃদয়ের আকাশে মেঘ রোদ বর্ষণ
#Part-02_03
#Writer-NOVA

— না এ হতে পারে না! আমি থাকতে আমার আকাশের কিছু হতে পারে না।

কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকটা চেচিয়ে কথাটা বলে উঠলো চৈতী। কেবিনের ভেতর থাকা পাঁচ জোরা উৎসুক চোখ তার দিকে নিবদ্ধ। চৈতী আরেকবার চেচিয়ে উঠার আগে বর্ষণ বিরক্তি মাখা কন্ঠে বললো,

— ঐ ছেমরি চুপ কর।

চৈতী ভেতরে ঢুকে আকাশের দিকে তাকাতেই তার চোখ ছানাবড়া। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে ক্যানুলা। অথচ সে গুটিসুটি মেরে স্যালাইনের স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর ওর বেডে হাত পা ছড়িয়ে হৃদয়,মেঘ,বর্ষণ, রোদ চারজন যে যেরকমভাবে পেরেছে সে সেভাবে চিৎ কাত হয়ে শুয়ে, বসে আছে।ওদের পাঁচজনের বন্ধুত্বের কথা সে ভালো করেই জানে। পাঁচটা ছেলেই যেন পাঁচজনের জানের টুকরা। চৈতী চুপচাপ আকাশের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অভিনীত গলায় বললো,

— আকাশ, আমি তোমার কিছু হতে দিবো না।

আকাশ কপাল কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করলো। এমনি দাড়িয়ে থাকতে থাকতে তার পা ব্যাথা করছে। তার মধ্যে এই মেয়ে ঢং-এর পেঁচাল শুরু করছে। বাজখাই গলায় বললো,

— দূরে সর। নয়তো লাত্তি খাবি।

চৈতী ভেংচি কেটে হৃদয়ের পাশে বসে পরলো। চৈতী ওর পাশে বসতেই হৃদয় চোখ মুখ সরু করে বিদ্যুতের গতিতে সেখান থেকে উঠে গেলো। রোদের পাশ দিয়ে বসে পরলো।চৈতীকে তার গায়ে পরা মেয়ে মনে হয়। গায়ে পরা মেয়ে তার একদম সহ্য নয়। চৈতী সেদিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বিরবির করে বললো,

— ঢং😏!

মেঘের পাশে কিছুটা ঘেঁষে বসলো। মেঘ কিছুটা দূরে সরলেও সেখান থেকে উঠলো না। সে মনোযোগ দিয়ে মোবাইলে কিছু একটা করছে। চৈতী উকি মেরে দেখলো ক্যান্ডি ক্রাশ খেলছে। তীক্ষ্ণ চোখে প্রতিটা ক্যান্ডির দিকে তাকিয়ে কিছু সময় পর পর একটা চাল দিচ্ছে। মনে হচ্ছে দাবার চাল চালছে।এতে চৈতী বেশ বিরক্ত হলো। এতো সময় পর পর চাল দেওয়ার কি দরকার? এটা একটা গেম। কারো জীবন নয় যে বুঝেশুনে সবদিক দেখে গুটি চালতে হবে।হেরে গেলে পুনরায় খেলে নিবো। কিন্তু মেঘ এরকমি। সবকিছুতে তার একটা ধীরস্থিরভাব। কোন বিষয় নিয়ে সে তাড়াহুড়ো করে না। চৈতী বিরক্ত হয়ে মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। কিন্তু মেঘ পূর্বের ন্যায় ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে থেমে থেমে খেলছে। চৈতীর কোণার দিকে তাকাতেই রোদকে দেখতে পেলো। রোদ প্যান্টের পকেট থেকে সবে একটা গাজর বের করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কামড় বসিয়েছে। চৈতী হাত নাড়িয়ে ওর মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো।

— হেই বানি! ওয়ান ক্যারোট প্লিজ।

রোদ খাওয়া থামিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো তার কাছে আর কোন গাজর নেই। তাই হাতে থাকা গাজরে আরেকটা কামড় বসিয়ে কচমচ করে খেতে লাগলো। চৈতী সরু চোখ করে ওর দিকে তাকাতেই ও খরগোশের মতো সামনের দুই দাঁত বের করে হাসলো। সে চাইলে হাতে থাকা বাকি গাজরের অংশটুকু দিতে পারতো। কিন্তু গাজর নিয়ে তার কারো সাথে ভাব নেই।লাস্ট গাজর হওয়ায় কারো সাথে শেয়ারও করতে চাইছে না। সে গাজর প্রচুর পছন্দ করে। তাই সবাই ওকে বানি বলে ডাকে। চৈতীর ওদের পাঁচ বন্ধুর মধ্যে মেঘ ও রোদকে ভীষণ ভালো লাগে। বাকি তিনটাকে উগান্ডার সদস্য মনে হয়। যদিও পাঁচ বন্ধু আজব ক্যারেক্টারের। চৈতী আকাশের দিকে তাকিয়ে হে হে করে গা জ্বালানো হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— তুমি বেড থেকে উচ্ছেদ কেনো?

বর্ষণ, আকাশের দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিয়ে চৈতীকে বললো,

— এটা ওর শাস্তি।

চৈতী জিজ্ঞেস করলো,
— কেনো?

বর্ষণ একবার মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো,
— গতকাল ওর জন্য অনেক বড় লস হয়েছে তাই।

চৈতী সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
— কিসের লস?

আকাশ ধমক দিয়ে বললো,
— এতো প্রশ্ন করিস কেন? তোকে কি আমরা কৈফিয়ত দিতে বাধ্য?

চৈতী ভেংচি কেটে মুখের নানা অঙ্গিভঙ্গি করে আকাশের কথা অনুকরণ করে বললো,

— “এতো প্রশ্ন করিস কেন? তোকে কি আমরা কৈফিয়ত দিতে বাধ্য?” আমি কৈফিয়ত নিতেও চাইনি। কৌতূহল হয়েছে তাই জিজ্ঞেস করেছি। একদম ঠিক করেছে তোমাকে দাড়া করে রেখো। আজ সারাদিন তুমি এভাবেই থাকো। তা তোমায় এই শাস্তিটা কে দিলো? মেঘ ভাইয়া নাকি?

রোদ একধ্যানে গাজরে শেষ কামড়টুকু দিয়ে জোর গলায় বললো,

— হৃদয় ভাই দিয়েছে।

চৈতী খিলখিল হেসে হৃদয়ের দিকে তাকালো। হাসির শব্দে হৃদয় ভ্রু জোড়া কুঁচকে ওর দিকে তাকালো।দুজনের চোখে চোখ পরলো। চৈতী দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। কখন জানি আবার চোখের সাদা অংশ লাল করে অগ্নদৃষ্টিতে তাকায় সেই ভয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

— একদম ঠিক হয়েছে।

আকাশ চোখ গরম করে চৈতীর দিকে তাকালো। চৈতী মুখ চোখা করে হাত দিয়ে দুই কান ধরে, জিহ্বা দেখিয়ে ভেংচি কাটলো। কথায় কথায় ভেংচি কাটা এই মেয়ের অভ্যাস।ঠিক অভ্যাস নয় বদঅভ্যেস। আকাশের ইচ্ছে করছে চৈতীকে যদি ফুটবলের মতো করে একটা প্লান্টি শট মারতে পারতো। তাহলে এতখনে তার কার্যসিদ্ধ করে ফেলতো। কিন্তু তা সম্ভব নয়। এমনি দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার পা ধরে যাওয়ার উপক্রম। মেঘের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো ফেস করে বললো,

— মেঘ, এবারের জন্য মাফ করে দে।

মেঘ ক্যান্ডি ক্রাশের শেষ চালানটা দিতে দিতে ধীর কন্ঠে বললো,

— শাস্তিটা যেহেতু আমি দেইনি। তাই মওকুফ করার কোন চান্স আমার হাতে নেই। যে দিয়েছে তাকে বল।

আকাশ অসহায় চোখে হৃদয়ের দিকে তাকালো। হৃদয় আগের থেকেই ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেদিক তাকিয়ে আকাশ দমে গেলো। মনে মনে যে কথাগুলো সাজিয়েছিলো হৃদয়কে বলার জন্য সব ফুস করে উড়ে গিয়ে গোলমাল পাকিয়ে দিলো। এই ছেলেটা প্রচন্ড রাগী। খামোখা হুটহাট রেগে যায়। ওর রাগতে কোন কারণ লাগে না। অকারণে রাগতে সে বেশ পটু। ওর রাগকে বাকি চারজন কম-বেশি ভয় পায়।তাছাড়া আকাশ যা করেছে তাতে বড়মুখে কথা বলার মতো সাহস তার নেই।তবুও মনে মনে বেশ কিছু সাহস কুড়িয়ে হৃদয়কে কিছু বলতে নিলে ওর আগে হৃদয় গম্ভীর কন্ঠ বললো,

— একটা শব্দ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করবি তাহলে স্যালাইনের স্ট্যান্ড সহো তাকে বাইরে ফেলে আসবো।

আকাশ কুচোমুচো করে চুপ হয়ে গেলো। এই ছেলে এক কথার মানুষ। যা বলবে তাই করবে। ওর কথার নড়চড় হয় না। তাই এখন তার উচিত কোণায় গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকা। অন্ততপক্ষে রুমের ভেতরে তো থাকতে পারবে। চৈতী আকাশের দিকে তাকিয়ে দাত বের করে হাসি দিয়ে বললো,

— একদম ঠিক হয়েছে।

আকাশ রেগেমেগে সামনে এগিয়ে আসতে নিলে ক্যানুলায় টান লাগায় “আহ” শব্দ করে কুকিয়ে উঠলো। এতটুকু এনাফ।পুরো রুমের পরিবেশ বদলে গেলো। বাকি চারজন ছুটে এসে ব্যস্ত হয়ে গেলো “কি হয়েছে, কি হয়েছে” বলে। চৈতী এই বিষয়টা বেশ উপভোগ করে। একটু আগে কি ঝারি দিচ্ছিলো। আর এখন হাইপার হয়ে গেছে। সবগুলো উঠে আকাশকে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বেডে বসালো। মেঘ রোদকে বললো,

— বানি, জুসের গ্লাসটা দে তো।

হৃদয় জিজ্ঞেস করলো,
— ফলের প্লেট কোথায়?

সবগুলো হুলস্থুল করে জুসের গ্লাস,পানি, ফল, স্যুপের সন্ধানে নেমে পরলো। আকাশ পরলো বিপাকে। তার ইচ্ছে করছে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে। এখন যে তার ওপর খাবারের অত্যাচার চলবে। এমন জানলে সে তো মুখ দিয়ে এই ছোট আহ শব্দটাও উচ্চারণ করতো না। সবাই ব্যস্ত হয়ে আকাশকে খাওয়াতে লাগলো। চৈতী মুগ্ধ চোখে পাঁচ বন্ধুর কান্ডকারখানা দেখতে লাগলো।

🔥🔥🔥

গতকাল থেকে শৈত্যপ্রবাহ পরেছে। সারাদেশের কোথাও সূর্যের মুখ দেখা যায়নি। ঢাকার শহরটা মনে হচ্ছে সাদা চাদরে আবৃত হয়ে গেছে। সাথে কনকনে উত্তরের হিমেল হাওয়া তো আছেই। হুট করে শীতটা পরে গেলো। জনজীবন থমকে গেছে। ঠান্ডায় জমে যাওয়ার জোগাড়। টিভি, নিউজপেপারে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেদিকে চোখ কান যায় সেদিকেই শীতের আগমনী বার্তা।

মুখটা ওড়নায় মুছে ছেলের কপালে চুমু খেলো সুমনা। এতটুকু হেঁটে হয়রান হয়ে গেছে। ছোট ছয় মাসের বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বারবার হাঁপিয়ে উঠছে। শীতের মধ্যেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। তার পাতলা গড়নের কঙ্কালসার শরীরটা আর হাঁটতে সায় দিচ্ছে না। কিন্তু বেঁচে থাকার তাগিদে কাজ করতেই হবে। এখান থেকে তার কর্মস্থল গার্মেন্টসটা অনেক বেশি দূর। টাকার অভাবে রিকশায় করে যাওয়া হয় না। যে টাকায় রিকশা করে যাবে সেই টাকায় এক কেজি আটা কিনতে পারবে। গরীবের আবার এতো বিলাসিতা চলে না। তার স্বামী ভোর সকালে রিকশা নিয়ে বের হয়েছে। একটু ভালো থাকার অদম্য বাসনা নিয়ে ঢাকার শহরে এসেছে তারা। জীর্ণ শীর্ণ একটা মোটা মলিন তোয়ালে দিয়ে বাচ্চাটাকে পেচিয়ে রেখেছে। কুয়াশার কারণে সামনের কিছু দেখা যাচ্ছে না। তোয়ালেটা আরো ভালো করে জড়িয়ে ছেলেকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। অপর হাতে থাকা টিফিন বাটিটা কিছু সময় পরপর তার হাঁটুতে বারি খাচ্ছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগলো।

— বাজানের ঘুম ভাঙছে? কেন উঠলা মায়? এহন তো জ্বালাতন করবা। আরেকটু ঘুমাইলে কি হইতো? আইজ এতো তাড়াতাড়ি উঠতে কে কইলো কও তো? দেখছো বাইরে কি শীত! বাড়িত একটা মানুষ থাকলে তোমারে রাইখা আইতাম। এই শীতের মধ্যে আনতাম না। কিন্তু কেউ তো নাই।

ছেলে ঘুম থেকে উঠে যাওয়া তার সাথে নানা কথা জুড়ে রাস্তার কিনারা ঘেঁষে হাঁটতে লাগলো সুমনা। পেছন থেকে বাইক আসার শব্দ পেতেই আরেকটু কিনারে চলে গেলো। একবার পেছনে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো এদিকে আসে কিনা। কিন্তু সাদা কুয়াশা ভেদ করে তার দৃষ্টিতে কিছু পরলো না। চারিপাশে শুধু সাদা আর সাদা। হঠাৎ করে বাইকটা এগিয়ে এসে পেছন থেকে একজোড়া হাত তার কোলের থেকে শিশু বাচ্চাটাকে ক্ষীপ্র গতিতে ছোঁ মেরে নিয়ে কুয়াশার অতলে তলিয়ে গেলো। সুমনা হতভম্ব হয়ে চিৎকার জুড়ে দিলো। রাস্তায় বসে বিলাপ করে কান্না জুড়ে দিলো।ফাঁকা জায়গায় এক অসহায় মায়ের আর্তনাদ কারো কানে পৌঁছালো না।

~~~বন্ধু শুধু দুটো অক্ষরের শব্দ নয়। ভালোভাবে বেঁচে থাকার আরেক অবলম্বন। তবে অবশ্যই ভালো বন্ধু হতে হবে❤️।

#চলবে

#জানে_জিগার🔥
#হৃদয়ের_আকাশে_মেঘ_রোদ_বর্ষণ
#Part_03
#Writer_NOVA

—বিয়ে করলে একটা আনরোমান্টিক ছেলেকেই করবো। যে বৃষ্টি দেখলে কানের কাছে এসে বলবে না, “চলো বৃষ্টিতে ভিজি”। বরং আমি যখন আনমনে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো অনুভব করবো তখন ধমক দিয়ে বলবে, “করছোটা কি, ঠান্ডা লেগে যাবে তো। না তোমাকে নিয়ে আর পারি না”। প্রচন্ড গরমে আমি যখন তার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে হয়রান হয়ে যাবো। তখন অন্য রোমান্টিক ছেলেদের মতো হুট করে কোলে না তুলে, হাতে পানির বোতল দিয়ে বলবে, ” পানি খেয়ে একটু জিড়িয়ে নাও। তারপর না হয় হাঁটা যাবে”। কিচেনে রান্না করার সময় পেছন থেকে জড়িয়ে না ধরে এপ্রোন পরতে পরতে আমার পাশে এসে বলবে, “রান্নাটাও পারো না? আচ্ছা, কোন সমস্যা নেই। আমি শিখিয়ে দিচ্ছি। হাতে হাতে কাজ করে দিলে তোমার ওপর চাপ কমবে”। মৃদুমন্দ বাতাসে আমি যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবো তখন কাঁধে তার থুঁতনি রেখে খানিকটা কড়া সুরে বলবে, ” ভেতরে চলো, নয়তো অসুখ করবে। আমি রাত জেগে তোমার সেবা করতে পারবো না”। তার কথা শুনে আমি গাল ফুলিয়ে বসে থাকবো। ভীষণ অভিমান হবে আমার। সে গাল দুটো টেনে মুচকি হেসে বলবে, “রাগ করে না পাগলী। আমি তো তোমার ভালোর জন্য বলছি এসব। যাতে করে তুমি অসুস্থ না হয়ে যাও। তুমি অসুস্থ হলে কি আমার ভালো লাগবে? সকালে যে আধপোড়া রুটি কপালে জুটে তাও জুটবে না”। আমি প্রচন্ড রেগে দুই হাতে তার বুকে মৃদুতালে বারি দিতে থাকবো। তখনও সে আমাকে জড়িয়ে ধরবে না। আমি তখন চিমটি কেটে তার বুকে লুটিয়ে পরবো।না, তাকে কোন ছয় ফিট উচ্চতার,জিম করা বডির, ফর্সা রঙের, নায়কের মতো চেহারার অধিকারী হতে হবে না। সে কালো হোক তাতে আমার সমস্যা নেই। তবে তার পুরো মন জুড়ে আমার বিচরণ থাকতে হবে। সে আমাকে ভীষণ ভালোবাসবে। কিন্তু কখনো বুঝতে দিতে চাইবে না। আমি এমন একটা আনরোমান্টিক ছেলেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চাই, যে আমার বিষয়ে প্রচুর ল্যায়াল হবে।

পাপড়ি এক লম্বা রচনা বলে থামলো।পাপড়ির কথায় ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকালো সানিয়া। মেয়েটা কি গাঁজা-টাজা খেয়েছে নাকি। কিরকম উদ্ভট কথাবার্তা বলছে।তার কাছে জামাই মানেই হলো রোমান্টিক ছেলে।নয়তো সে বিয়ে করবে না। কিন্তু পাপড়ির কথা শুনে তাকে কি বলে আখ্যায়িত করবে তাই সানিয়া জানে না। এই মুহুর্তে পাপড়িকে তার পাগল মনে হচ্ছে। যদিও সবার পছন্দ এক নয় তবুও তার কাজিন হয়ে পাপড়ি এমন তা সে কিছুতেই মানতে পারছে না।মুখ খুলে পাপড়ি কিছু বলার আগে পাশে বসে বালিশে হেলান দিয়ে হাই তুলতে তুলতে সানিয়া বললো,

— হয়েছে বোন, এবার থাম। তোর এই বিশাল বক্তৃতা শুনতে শুনতে আমি হয়রান। তবে দেখিস এমন জামাই তোর কপালে জুটবে না। আমি দোয়া করলাম তুই যেনো একটা রোমান্টিক জামাই পাস। যে তোকে সকাল, বিকেল, সন্ধ্যা যেকোন সময় পেলেই তোকে রোমান্টিক অত্যাচার করবে।

পাপড়ি বড় করে একটা দম নিয়ে রেগে বললো,
— তুই জীবনে আমার জন্য ভালো কিছু চাইলি না। তোর মতো কাজিন থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। আমি কত সুন্দর করে আমার মনের ফিলিংসগুলো জানালাম। আর তুই দিলি এক মগ পানি ঢেলে।

সানিয়া দাঁত কেলিয়ে উত্তর দিলো,
— এক মগ নয় রে পাগলী এক বালতি।

— দেখিস তুই এমন দোয়া দিলি না। তোর কপালে একটা লুচ্চা জামাই পরবো। মিলিয়ে নিস তুই।

—- এই না, ছিঃ ছিঃ এমন বাজে দোয়া দিস না বোন। আমার দোয়া আমি ফিরিয়ে নিলাম। তোরটাও তুই ফিরিয়ে নে🥺।

পাপড়ি বিশ্ব জয় করা হাসি দিয়ে বললো,
— তা হচ্ছে না।

— তবে রে পাঁজি….

সানিয়া হেলান দেয়া বালিশ তুলে পাপড়ি কে মারতে লাগলো। পাপড়ি ওর হাত থেকে বাঁচতে সারা রুম চক্কর মারতে শুরু করলো। সাথে দুজনের হাসির ঝংকার তো আছেই। কিচেন থেকে পাপড়ির মায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু পাপড়ি বা সানিয়ার কারোরই সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা তো এখন সারা রুমে গোল গোল করে ঘুরতে ব্যস্ত।

🔥🔥🔥

— গত সপ্তাহে বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় ডজনখানেক ছোট বাচ্চা ছিনতাই হয়ে গেছে।হ্যাঁ,অবাক করার মতো কথা হলেও এটা ঘটেছে।ঢাকা শহরে বিভিন্ন অলিগলিতে মায়ের কোল থেকে বাচ্চা ছিনিয়ে নিয়ে ঘন কুয়াশায় আড়াল হয়ে যায় দুষ্কৃতিকারীরা। তারপর তাদের খোঁজ কেউ বলতে পারে না। বাচ্চা হারানো পরিবারে নেমে এসেছে শোকের মাতরম। যাদের বাচ্চা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তারা কেউ বলতে পারছে না তাদের বাচ্চার খোঁজ। তবে আশ্চর্যের বিষয় আরেকটি হলো, বাচ্চা হারানো স্বজনরা বেশিরভাগই খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ। কে বা কারা এর সাথে সংযুক্ত আছে তা এখনো জানা যায়নি। বাইক থেকে ছোঁ মেরে বাচ্চা নিয়ে মুহুর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে যায়। তাই কেউ তাদের খেয়ালও করতে পারে না। তবে একজন বলেছে বাইকে দুজন থাকছে। তাদের পরনে কালো পোশাকে আবৃত থাকায় কেউ মুখ দেখেনি।ঢাকা মহানগরীর পুলিশের প্রধান জানিয়েছেন তারা তদন্ত চালাচ্ছে। খুব শীঘ্রই এর রহস্য উদঘাটন করা হবে। আপনারা দেখছেন সময় টিভি নিউজ। ফিরছি বিজ্ঞাপন বিরতির পরপরই।

টিভির দিকে তাকিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে পাঁচ বন্ধু ব্রেকিং নিউজ দেখছিলো। প্রত্যেকের কপাল কুঁচকে গেছে। এরকমটা এই প্রথম হলো। বিষয়টা মোটেও স্বাভাবিক নয়। মেঘকে একটু বেশি চিন্তিত দেখা যাচ্ছে। বেশি চিন্তিত না থাকলে তার ভ্রুকুটি কুঁচকায় না। হৃদয় মেঘের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— অদ্ভুত বিষয় তাই না!

মেঘ সন্তপর্ণে ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,
— একটু বেশি অদ্ভুত।

রোদ গাজর নিয়ে বসে আছে। এই মুহুর্তে সে গাজরে কামড় বসাবে নাকি রেখে দিবে তার চিন্তায় বিভোর। বর্ষণ টিভির থেকে নজর সরিয়ে মোবাইল নিয়ে বসলো। আকাশ সামনের চেয়ারে পা তুলে পেছনে মাথাটা হেলিয়ে দিলো। সকালেই হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছে। সব বিষয় নিয়ে তারা ততক্ষণ মাথা ঘামায় না,যতক্ষণ না সেটা নিয়ে মেঘ মাথা ঘামায়। মেঘ একবার সবার দিক থেকে চোখ বুলিয়ে কপালের ডান পাশটা এক আঙুলে চেপে ধরলো। হৃদয় তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ততক্ষনাৎ একটা ছেলে এসে ভেতরে ঢুকে মেঘকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— বড় ভাই, দুজন আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে।

মেঘ শান্ত ভঙ্গিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগে হৃদয় বললো,

— কে এসেছে?

ছেলেটি নির্লিপ্ত ভাবে বললো,
— বিশ বছর বয়সের এক মেয়ে আর তার স্বামী।

মেঘ প্রশ্নসূচক চোখে বললো,
— কেনো?

ছেলেটি বললো,
— আমি তো তা জানি না। বললো আপনার সাথে তাদের কথা আছে। অনেক কষ্ট করে আপনাদের খোঁজ খবর নিয়ে এখানে এসেছে। অনেক বিপদে পরেছে তারা। আপনারাই পারেন তাদেরকে বাঁচাতে।

হৃদয় বললো,
— তুমি যাও, আমরা আসছি।

ছেলেটি আচ্ছা বলে মাথা দুলিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। আকাশ জিজ্ঞেস করলো,

— কোন বিষয় কথা বলতে পারে তোরা কি কিছু আন্দাজ করেছিস?

মেঘ একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
— বাচ্চা ছিনতাই হওয়ার বিষয়।

সবাই চমকে একসাথে বলে উঠলো,
— বাচ্চা!

মেঘ সামনের দিকের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
— হুম বাচ্চা।

বর্ষণ বললো,
— অন্য কিছু তো হতে পারে।

মেঘ একগালে হাসলো। ওর হাসিতে রহস্যের গন্ধ পেলো হৃদয়। এরকম করে মেঘ তখুনি হাসে। যখন কোন রহস্য খুঁজে পায়। সামনের চেয়ারে বসে চোখ দুটো সরু করে বললো,

— আমাদের এদিক থেকে গত তিনদিনে তিনটা বাচ্চা ছিনতাই হয়েছে। আমি সিউর ছিলাম সেই বাচ্চা খুঁজতে কেউ তো IS গ্যাং-এর খোঁজ অবশ্যই করবে।

সবাই কথার যুক্তি বুঝতে পেরে মাথা নাড়ালো। মেঘ যুক্তিছাড়া কথা বলে না। ওদের পাঁচজনের মধ্যে সবচেয়ে বিচক্ষণ ক্ষমতার অধিকারী মেঘ। তাই তাদের পাচজনেরর গ্যাং-এর প্রধান তাকে বানানো হয়েছে। IS মানে হলো ইন্টারন্যাশনাল সলিউশন। এটা বর্তমানে সাধারণ জনগণের কাছে খুব প্রিয় একটা গ্যাং।অনেকটা মাফিয়া গ্যাংএর মতোই। তবে মাফিয়াদের মতো তারা কোন চোরাকারবারি কিংবা কালো ধান্দায় নেই। তাদের গ্যাং-এর প্রধান কাজ অসহায়,গরীব, খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষদের সাহায্য করা।তবে তাদের কে কেউ চিনে না এমনকি আজ অব্দি দেখেওনি। আড়াল থেকে মানুষের সাহায্য করা তাদের মূল লক্ষ্য।

পাঁচ বন্ধু ছোট থেকে একসাথে এতিমখানায় বড় হয়েছে। আপন বলতে পাঁচ জন একে অপরের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। প্রথমে মেঘ তারপর হৃদয় এরপর আকাশ,বর্ষণ এবং সবার শেষে রোদ। বয়সের ডিফারেন্স খুব বেশি নয়। রোদ সবার ছোট বলে সে সবারি আদরের। রোদের কাজ সারাদিন এদিক সেদিক টো টো কোম্পানির ম্যানাজারের মতো ঘুরে গাজর খাওয়া। সে কোন ভেজালে নেই। তবে মাঝে মাঝে মেঘ ওকে বিভিন্ন ছোট ছোট মিশনে পাঠায়। খুব সহজে মানুষের মন জয় করার চমৎকার গুণ তার আছে। মেঘের অবর্তমানে হৃদয় সব সামলায়। ওদের পাচজনের বনিবনা দেখে যে কেউ প্রথম দেখায় বলবে পাঁচ ভাই। ওরা সবার কাছে পাঁচ ভাই বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করে।

রোদ হালকা গলা ঝেড়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— আমাদের নিচে যাওয়া উচিত। তারা কতখন বসে থাকবে?

আকাশও রোদের সাথে গলা মিলিয়ে বললো,
— হুম, চল সবাই।

মেঘ সবাইকে আঙুলের ইশারায় বসিয়ে কাবার্ড থেকে নিজস্ব পোশাক ও চোখের মাস্ক বের করে দিয়ে বললো,
— এগুলো পরে নে। কেউ যেনো আমাদের চিনতে না পারে।

বর্ষণ তার সরু ফ্রেমের চশমা ঠিক করতে করতে বিরক্তি গলায় বললো,

— আমি বুঝি না এসব পরার মানে কি? আমরা তাদের সাহায্য করছি তারা কেন এসব জানবে না?জানলে তো আমাদের ভালো।

হৃদয় হাঁটু অব্দি ব্লেজারটা পরতে পরতে বললো,
— তুই এখনো বেক্কল রয়ে গেলি। আমরা কাউকে জানানোর জন্য করি না।

বর্ষণ কোন উত্তর না দিয়ে বিরক্তিতে মুখ বাকালো।তারা কাজ করবে আর তাদের কেউ চিনবে না এই বিষয়টা তার পছন্দ নয়। মেঘ ওদের কথায় মুচকি হেসে তৈরি হয়ে নিলো। তারপর সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— সবাই কি তৈরি?

সবাই সমস্বরে চেচিয়ে বললো,
— হুম।

মেঘ সবার দিকে তাকিয়ে বললো,
— তাহলে বের হওয়া যাক।

~~~জীবনে ভালোবাসার চাইতে ভালো বন্ধু ভীষণ প্রয়োজন।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে