ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-০৩

0
1946

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি

পর্ব-০৩

সূর্য মামা যেই না একটু বিশ্রাম নিতে দিগন্তের কাছে পৌঁছাল অমনি সন্ধ্যা রানী হাসতে হাসতে তার আগমণের জানান দিল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে পথচারীরা যার যার গন্তব্যে যাচ্ছে। ঠিক তখন সাইফ আর মায়া আসলো ছোঁয়ার শপে। ছোঁয়া তখন কিছু একটা হিসাব করছিল। সাইফ আর মায়াকে দেখে সে খাতা বন্ধ করে ডেস্কে রেখে দিল।

একটা টেবিলে বসতে বসতে মায়া বলল, ‘ তাড়াতাড়ি আয় এদিকে। আজ একটা মজার কাণ্ড হয়েছে।’

মায়া আর সাইফের টেবিলের দিকে এগুতে এগুতে ছোঁয়া বলল, ‘ এমন কি হয়েছে যে তোরা দুই জন ঘটা করে বলতে এলি?’

‘শোন, সাইফ তো সব সময় বলে যে ওকে কোনো মেয়ে নাকি পছন্দ করে না।’

ছোঁয়া অধৈর্য গলায় বলল, ‘আরেহ্! তুই এত প্যাঁচাস কেন? আসল কথা বল।’

মায়া চোখ রাঙিয়ে বলল,’আমাকে আমার মতো করেই বলতে দে না! নইলে শুনে মজা পাবি না।’

‘আরেহ্! রাখ তোর মজা।’ ছোঁয়া ব্যস্ত ভঙ্গিতে সাইফের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই সাইফ, তুই বল।’

সাইফ আমতা আমতা করে যখনই বলতে যাবে তখন মায়া তাকে থামিয়ে বলল,’আজকে সাইফকে এক মেয়ে প্রপোজ করেছে।’

ছোঁয়ার চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে যাবে। সে অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘ মানে কি ?’ তারপর সাইফের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, ‘সত্যি সাইফ?’

সাইফ বিমর্ষ গলায় বলল, ‘ হুম।’

ছোঁয়া হাত নেড়ে বলল, ‘দেখলি তো তোর এত দিনের আফসোস খতম। তো মেয়েটা দেখতে কেমন রে?’

‘ভালোই।’ সাইফ আফসোসের সুরে বলল, ‘ কিন্তু আমি তো তাকে আজই প্রথম দেখলাম। আর আমার মনে হয় সেও আমাকে প্রথম দেখল। তবে কেন সে প্রপোজ করল সেটাই বুঝতে পারছি না!’ সাইফের কণ্ঠে এক গভীর হতাশা।

ছোঁয়া একটু ভাবল। তারপর বলল, ‘ কোনো বেট নয়তো!’

মায়া এইবার মুখ খুলল। সে বলল, ‘ ঠিক বলেছিস। হতে পারে। সাইফ তো শান্তশিষ্ট। আর আমরা দুজন ছাড়া ওর আর কোনো মেয়ে বন্ধু নাই। তাছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে তো সে তেমন একটা পাত্তা দেয় না। তাই হতে পারে এটা বেট।’

ছোঁয়া এবার সাইফের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল।।বলল, ‘ সাইফ তোর কী মনে হয়?’

সাইফ ভাবছে। মায়া দুষ্টুমির সুরে বলল, ‘ দিল দে দিয়া কিয়্যা?’

ছোঁয়া মায়ার হাতে আলতো করে মেরে বলল, ‘ এত্ত সোজা মন দেয়া?’ তার পরপরই একটু বেশিই আগ্রহী সুরে বলল, ‘তা দেখতে কেমন মেয়েটা? সেটা তো বললি না!’

সাইফ বিরক্তির সুরে বলল, ‘ বলেছি তো দেখতে ভালোই । কি এক ফালতু টপিক নিয়ে পড়লি তোরা। কাজের কথা বল।’

মায়া বলল, ‘ হ্যাঁ, তাই তো কাজের কথা তো পড়েই থাকল।’ একটু গাল ফুলিয়ে বলল, ‘ মানে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে অথচ কারো কোনো মাথা ব্যাথাই নাই।’

মোবাইলের বাজার শব্দে ধ্যান ভাঙলো তিন বন্ধুর। ছোঁয়া টেবিলের উপর থেকে তার ফোনটা নিয়ে স্ক্রিনে দেখল ফাহমিদা বেগম কল করেছে। সে তৎক্ষনাত রিসিভ করল। ওপাশ থেকে একটু রাগী রাগী গলায় ফাহমিদা বেগম বললেন, ‘ কি রে তোর আসার সময় হয় নাই এখনো?’

ছোঁয়া তার বাম হাত উল্টিয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নিল একবার। তারপর বলল, ‘ মা এখন বাজে মাত্র সাতটা । আমি কি এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরি?’

‘কয়টায় আসবি?’ ফাহমিদা বেগমের পাল্টা প্রশ্ন।

‘নয়টা তো বাজবেই।’ ছোঁয়া একটু ভেবে দৃঢ়তার সাথে বলল।

‘আচ্ছা ঠিক আছে। নাশতা করেছিস?’

‘করব। একটু পরেই করব। সাইফ আর মায়া আছে আমার সাথে তোমার টেনশন না করলেও চলবে।’ ছোঁয়া মৃদু হাসল।

‘আচ্ছা। সাইফকে দে তো একটু ফোনটা।’

‘মা! তুমি তাকে আবার বলবে যাতে আমাকে একটু বাসায় পৌঁছে দেয়। এইতো?’

‘তোকে দিতে বললাম দে।’ ফাহমিদা বেগম একটু জোরেই বললেন।

অগত্যা ছোঁয়াকে ফোনটা সাইফকে দিতে হলো। সাইফ মোবাইল কানে নিতেই ফাহমিদা বেগম আদেশের সুরে বললেন, ‘ ছোঁয়াকে বাসায় পৌঁছে দিবি।’

‘জো হুকুম, খালামণি।’ সাইফ হাসতে হাসতে বলল।

ছোঁয়া একটু কেশে দুই বন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘আচ্ছা শোন। কাল আমার অফিসে নতুন বস আসবে। কাল কিন্তু দেখা সাক্ষাত হবার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। তাই মায়ার বিয়ে নিয়ে যত প্ল্যান সব কালকের পর থেকে শুরু করতে হবে। তাছাড়া বিয়েতে তো এখনো ঢের দেরি। এতো আগে থেকে এত তাড়াহুড়ো করারও কোনো মানে নেই।’ সাইফের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ কী বলিস, সাইফ?

সাইফ সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘ একদম ঠিক।’

মায়া কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘ মানে কী! আমার বিয়ে আর তোদের কোনো আগ্রহই নাই।’

ছোঁয়া মায়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ আরে মাইয়া তোর চেয়ে আমরাই বেশি আগ্রহী। আগে আমার বসটারে একটু ফেইস করতে দে। তারপর তোর হবু বরকে ফেইস করব। এবার খুশি তো?’

মায়া প্রশস্ত হাসল। তারপর ছোঁয়াকে জড়িয়ে ধরল। ওদেরকে হাসতে দেখে সাইফও হাসল। বলল,’ কী আশ্চর্য! তোরা আমাকে কেন জড়িয়ে ধরছিস না?’

ছোঁয়া আর মায়া ভ্যাবলাকান্তের মতো কিছু সময় সাইফের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
________________

শিহরণ তাদের বাসার ছাদে একটা চেয়ারে বসে ছিল। ছাদ জুড়ে বাগান। একপাশে একটু ঝোপের মতো হয়ে গেছে। সেখানে চড়ুই পাখির একটা বাসাও আছে। একটু পরপর মা পাখিটা বেরিয়ে যাচ্ছে। আর বাচ্চাগুলো শব্দ করে ডাকছে। শিহরণের বেশ কৌতুহল হচ্ছিল বিষয়টা নিয়ে । সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল । তারপর ওপাশটাতে গিয়ে দেখল বাসাটাতে দুটো ছানা আছে। একদম পিচ্চি পিচ্চি বাচ্চাগুলো। দেখতে খুব কিউট লাগছে বাচ্চাগুলোকে। অনেক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সে, বাচ্চাগুলোর দিকে।

বহ্নি দুকাপ কফি নিয়ে এসে দেখল শিহরণ মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে । সে পাশে এসে দাঁড়াল । তারপর বলল, ‘ কি দেখছ এমন মনোযোগ দিয়ে ।’

শিহরণকে উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়ে বহ্নিই আবার বলে উঠল, ‘টুন আর মুনকে?’

শিহরণ ঘুরে দাঁড়াল । তারপর ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করল, ‘টুন আর মুন কে?’

‘তুমি যাদের দেখছ।’

‘মানে কি? চড়ুই পাখির ছানা দুটোকে বলছিস?’

‘হুম।’

‘তুই ওদের নামও দিয়ে দিলি!’

‘হ্যাঁ, ভাইয়া ।’ বহ্নি কফির একটা মগ শিহরণের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘যখন তোমার উপর আমার খুব রাগ ছিল তখন ওদের মা ছিল আমার বন্ধু । এখন ওরাও আমার বন্ধু। ওদের সাথে কথা বলতে খুব ভালো লাগে।’

শিহরণ যেন দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। তারপর ছোট্ট করে বলল, ‘হুম।’

‘কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে তো। খেয়ে নাও।’

‘হুম।’ শিহরণ অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘খাচ্ছি।’

কফির মগে চুমুক দিতেই বহ্নি বলল, ‘জানো ভাইয়া, আজ রাদিদ ভাইয়াকে দেখেছি।’

শিহরণ সহসা বহ্নির দিকে ফিরে তাকাল। অবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘সত্যি?’

‘হুম।’ বহ্নি মুহূর্তেই গম্ভীর গলায় বলল, ‘ আমি কি কখনও মিথ্যে বলি?”

‘আচ্ছা। কথা হয়েছে তোদের?’ শিহরণ সরু চোখে তাকাল বহ্নির দিকে।

‘হয়েছে।’ বহ্নি চিন্তিত সুরে বলল, ‘ অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। কীভাবে হলো সেটাই বুঝতে পারছি না!’

‘কী রকম পরিবর্তনের কথা বলছিস?’

‘এই যেমন: রাদিদ ভাইয়া আগে ছিল প্লে বয় টাইপ কিন্তু এখন খুবই ভদ্র, সুশীল, নম্র আর বাধ্য হয়ে গেছে মনে হলো।’

‘কী বলিস?’ শিহরণের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস, ‘এত পরিবর্তন! কীভাবে হলো?’

‘তা তো জানি না। তবে অনেক বেশিই পরিবর্তন হয়ে গেছে।’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, বহ্নি ।

‘হুম।’ শিহরণ হতাশ গলায় বলল, ‘ মোহনা ছাড়া আর কারও সাথেই তো কোনো যোগাযোগ নেই।’

‘তোমরা একে অপরের থেকে দূরে আছো নিজেদের বোকামির কারণে। আমার ভাবতেই অবাক লাগে তোমাকে কেউ আমার বা অতল ভাইয়ার বিরুদ্ধে কিছু বলল আর তুমি ঝট করে বিশ্বাস করে ফেললে!’

অতলের নাম শুনে শিহরণের মনের মধ্যে এক দুর্জ্ঞেয় ঝড় শুরু হয়ে গেল। কত করে বলতে চেয়েছে সে। কিন্তু শিহরণ তার একটা কথাও শুনেনি। তার উপর আঘাত করেছে বারংবার । এতটা নিষ্ঠুর সে কী করে হতে পারল–শিহরণ তা ভেবে পায় না ! কেন যে সে তার রাগটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না! তার এই অনিয়ন্ত্রিত রাগের কারণে আজ তাদের বন্ধুত্বের বিনাশ হয়েছে। রাগের মাথায় সে আসলেই অন্য এক মানুষ হয়ে যায় !

শিহরণ হঠাৎ আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে মেঘ করেছে। ঘন কালো মেঘ। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেও আকাশটা ঝকঝকে ছিল। ছিল না মেঘের ছিটে ফোঁটাও । ঠিক এমনই করে তার বন্ধুরা একে অপর থেকে দূরে সরে গেছে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার।

‘তুই বলিসনি–আমার সাথে দেখা করার জন্য?’ ব্যথাতুর গলায় প্রশ্ন করল শিহরণ ।

‘বলেছি।’ বহ্নি চিন্তিত সুরে বলল, ‘কিন্তু কেন যেন সে দেখা করতে চাইছে না। কারণটা অস্পষ্ট এবং একইসাথে রহস্যময় মনে হলো আমার।’

‘রহস্যময় কেন?’

‘রাদিদ ভাইয়ার জায়গায় যদি অতল ভাইয়া হতো তবে না হয় মানা যেত । কিন্তু রাদিদ ভাইয়া কেন দূরে সরে গেল তা একটু চিন্তার বিষয় না?’

‘তা ঠিক বলেছিস।’

‘তোমার বন্ধুদের ফিরে পাবার চেষ্টা করো।’

‘হুম।’ শিহরণ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ যারা নিজে থেকেই দূরে সরে যায় তাদের ফিরে পাওয়া সম্ভব নয় বহ্নি ।’

‘আচ্ছা, মান্নাত আপুর সাথে কিছু হয়েছে কি তোমার?’

‘নাহ্! কেন?’

‘আম্মুকে তোমার নামে নালিশ দিতে শুনলাম।’ বহ্নি শিহরণের হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে চলে যেতে যেতে বলল, ‘তৈরী থেকো। আম্মু ডাকতে পারে তোমায়।’

শিহরণ একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। ফের আকাশপানে তাকিয়ে সাদা মেঘের ভেলার সাথে আকাশের বুকে ওড়াউড়ি করা কালো মেঘের ভেলার এক অদ্ভুত তুলনা করছে। হুট করেই তো আকাশের বুকে কালো মেঘগুলো রাজত্ব শুরু করে দিয়েছে । এখন কেবল বৃষ্টির অপেক্ষা। ঝুম বৃষ্টি এসে ধরিত্রীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তেই কালো মেঘগুলো কেটে গিয়ে আকাশের বুক পরিষ্কার হয়ে যাবে । শুধু সময়ের অপেক্ষা! মানুষের জীবনও তো এমনই!

_________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে