ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-০২

0
2297

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি

পর্ব-০২

‘বার্বি ডল!’ শিহরণ বহ্নির রুমের দিকে এগুতে এগুতে ডাকল।

বহ্নির রুমের দরজা ভেজানো ছিল। শিহরণ সেই দরজা হালকা ঠেলে দাঁড়িয়ে বলল,’হেই বার্বি ডল! মাই কিউট কাপকেক।’

বহ্নি তখন কলেজে যাবার জন্য রেডি হচ্ছিল। শিহরণের ডাক সে শুনতে পেয়েছে । কিন্তু কথা বলছে না। দুই ভাই বোনের মান অভিমান কিছু সময়ের ব্যবধানে শুরু হয় আবার শেষ হয়। এ যেন এক নিত্য নিয়মে পরিণত হয়েছে। শিহরণ এবার রুমে ঢুকে বলল,’কাপকেক! কী করছিস?’

‘দেখতেই তো পাচ্ছ।’ বহ্নি নির্বিকারভাবে বলল।

‘এখনও এরকম করবি?’ শিহরণ অসহায় মুখ করে বলল।

বহ্নি শিহরণের দিকে মুখ ফিরে দাঁড়িয়ে একটা হাত তুলে বলল, ‘দেখ ভাইয়া! আমার আজ খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে। দেরি হয়ে যাবে। কিছু বলার থাকলে বলে ফেল। আমি শুনছি।’

শিহরণ বহ্নির এ কথায় একদম চুপসে গেল। তার এই মুহূর্তে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা নেই। সে এমনিতেই, অকারণে বোনকে দেখতে এসেছিল। তাই মুহূর্তেই কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে সে নিভৃতে বহ্নির রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে বহ্নি দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ব্রো! অ্যা’ম রিয়েলি ইন অ্যা হারি। আই উইল টক টু ইউ লেটার।’ শিহরণের মুখের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’ওকে?’

শিহরণের মুখে তৎক্ষনাত হাসি ফুটল। সে বলল,’ওকে, কাপকেক। আজ ছাদে থাকব আমি।’

বহ্নি বলল, ‘ঠিক আছে। অনেক দিন পর তাহলে আজ জম্পেশ আড্ডা হবে। কি বলো?’

‘হুম, ঠিক বলেছিস।’ শিহরণ হাসি হাসি মুখ করে বলল।

শিহরণ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই বহ্নি বলল, ‘হেই ! ব্রো। রিয়া হ্যাজ আ গ্রেট ক্রাশ অন ইউ।’

‘সিরিয়াসলি?’ শিহরণ তার চোখে মুখে একরাশ বিস্ময় এনে বলল, ‘ওই পুঁচকে আমার উপর ক্রাশ খাচ্ছে! আজকালকার বাচ্চা মেয়েগুলো কি যে করে না! ‘

‘এত অবাক হচ্ছো কেন? তুমি তো এমনই; ক্রাশ খাওয়ার মতো।’

‘এবার কি তুইও শুরু করবি?’

‘হা হা হা! আমি আবার কি শুরু করব বলো? আমার ফ্রেন্ডরা পারলে আমাকে ডাকপিয়ন বানিয়ে ছাড়ত। মাঝেমধ্যে একটু স্ট্রিক্ট হই বলে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না।’

‘হুম। এমন স্ট্রিক্ট না থাকলে বোধহয় বেশ ভালো একটা দ্বন্দ্ব হয়ে যেত!’

‘একদম।’ বহ্নি প্রগাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘ওকে, ব্রো। অ্যা’ম গেটিং লেইট। সি ইউ লেটার।’

‘ওকে, মাই কাপকেক।’
_______________________

বহ্নি ক্লাস শেষে ফেরার পথেই ক্যাম্পাসের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলেকে দেখে থমকে দাঁড়ায় । খুব ভালো করে খেয়াল করতে থাকে সেই ছেলেটাকে। আগের তুলনায় স্বাস্থ্য একটু ভালো হয়েছে। চোখ দুটো উজ্জ্বল । মুখটা হাসি হাসি। কতদিন পর দেখছে তাকে! সেই দিনের অনাকাঙিক্ষত ঘটনা অনেক কিছুই তছনছ করে দেয় । তার ভাইয়ের বন্ধুত্ব, তার সাথে তার ভাইয়ের সম্পর্ক, তার মায়ের সাথে সম্পর্কের নমনীয়তা এছাড়া আরও অনেককিছুই ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। সবাই এক এক করে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল । সময়ের স্রোতে তার কিছুটা ম্লান হলেও আজও অনেককিছুই ঠিক হয়নি।

ভার্সিটির ক্যাম্পাসের ওই অংশটাতে গাছগাছালির সমাবেশ অনেক বেশি । বিশাল বৃক্ষের ছায়াতে অনেক ছাত্রছাত্রী জটলা হয়ে গল্পগুজব করছে। বন্ধুরা মিলে গোল হয়ে সবুজ, সতেজ ঘাসের উপর বসে আড্ডা দিচ্ছে কেউ কেউ। ছায়াঘেরা ওই অংশটির গাছপালার পাতার ফাঁক গেলে সোনালি রোদ্দুর যেন ঝরে পড়ছে। বহ্নি ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়িয়েছিল। নানান ভাবনা মস্তিষ্কের মধ্যে নিজেদের রাজত্ব তৈরী করেছিল। সে ভাবনাগুলোকে আপাতত এক পাশে রেখে ধীর পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল ছেলেটির দিকে।

ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে বলল,’এতদিন পর কোথা থেকে?’

ছেলেটি মুখ উঁচু করে তাকিয়ে ছিল সোনালি রোদ্দুরের নরম আলোর দিকে। একটা পাখি টিউ টিউ করে ডাকছিল। সেই পাখির ডাকটাই সে মনোযোগ দিয়ে শুনছিল আর পাখিটার গাছের ডালে নাচানাচিও দেখছিল । আচমকা প্রশ্নে সে সামনে তাকিয়ে দেখতেই একটু যেন বিষম খেল। কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা । নিস্তব্ধতার রেশ কাটিয়ে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে ছেলেটা প্রশ্ন করল,’তুমি বহ্নি?’

‘হুম,আমিই বহ্নি । চিনতে পেরেছ তাহলে?’ বহ্নির কণ্ঠে কিঞ্চিত অভিমান।

‘অনেকদিন পরে দেখছি তোকে। চিনতে একটু সময় লেগেছে। এই আরকি!’

‘অনেকদিন?’ ভ্রু কুঁচকে বলল বহ্নি ।

‘দশ বছর!’ দৃঢ়তার সাথে বলল ছেলেটা।

‘আচ্ছা, আমাকে বলো তো তুমি কেন চলে গিয়েছিলে? তোমার চলে যাবার তো কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না আমি।’

ছেলেটা মুচকি হাসল। কিন্তু প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না।

‘তোমার ডেটদের কি অবস্থা? এখনো চলে?’ বহ্নি হাসি হাসি মুখ করে ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করল।

আবারও ছেলেটা মুচকি হাসল। বলল,’এখন আর ওসব ডেটে আমার হয় না!’

-‘কেন? বিয়ে করে ফেলেছ?’ দুষ্টুমির স্বরে বলল বহ্নি ।

-‘নাহ! এমনিতে বিয়ে করলে বোধহয় ভালোই হতো।’ একটু থেমে বিড়বিড় করে ছেলেটা বলল,’যন্ত্রণা বোধহয় কিছুটা কম হতো।’

-‘বিয়ে করছ না কেন?’ কৌতুকের স্বরে বলল বহ্নি ।

-‘আমাকে কে বিয়ে করবে বল?’ ডানহাতে প্রশ্নবোধক ভঙ্গি করে বলল ছেলেটা।

-‘আমি দেখব মেয়ে?’

-‘না!’

-‘তাহলে বললে যে তোমাকে কে বিয়ে করবে?’

-‘ওই যে চোখ বন্ধ করলেই কেউ একজন চোখের দৃশ্যপটে এসে প্রচণ্ড বিরক্ত করে। তাই!’

-‘কি!’ প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে বলল, বহ্নি, ‘আমি ভাবতে পারছি না। তোমাকে কেউ এসে বিরক্ত করে! সিরিয়াসলি?’

-‘এত হাইপার হচ্ছিস কেন? আমাকে কি কেউ কখনো বিরক্ত করেনি?’

-‘নাহ্! আসলে তোমাকে কেউ বিরক্ত করছে সেটা বড় কথা না। তোমার চোখের ঘুম কেউ কেড়ে নিয়েছে সেটাই বড় ব্যাপার! আমি তো রীতিমতো বাকরুদ্ধ ।’

-‘হয়েছে। আর কিছু বলার বাকি আছে?’ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল ছেলেটা।

-‘হুম। আছে তো। ভাইয়ার সাথে দেখা করবে না?’

-‘না।’

-‘কেন?’

-‘কি দরকার? এত বছর পরে !’

-‘এসব কি বলো? চলো তুমি আমার সাথে।’

-‘নাহ।’

-‘আচ্ছা তুমি এখানে কেন?-

-‘কাজে এসেছি।’

-‘আমার ক্যাম্পাসে তোমার কি কাজ?’

-‘কেন? এই ক্যাম্পাস কি তোর নামে রেজিস্ট্রি করা যে আমরা কেউ আসতে পারব না?’

-‘ওফফো। আমি কি তাই বলেছি?’

-‘আকারে ইঙ্গিতে তো তাই বুঝাচ্ছে।’

-‘আচ্ছা বাদ দাও। কেন এসেছ ? বলো।’

-‘নীরাকে নিতে এসেছি। ফুফু জোর করেই পাঠালেন।’

-‘খুব ভালো করেছে। নয়তো তোমাকে দেখতেই পেতাম না।’

-‘আচ্ছা এবার বাসায় যা।’

-‘তুমি যাবে না?’

-‘নাহ। আর কোনো প্রশ্ন নয়।’

-‘কেন, রাদিদ ভাইয়া? কেন?’

-‘বললাম না। আর কোনো প্রশ্ন নয়।’

-‘তুমি খুব খারাপ। অতল ভাইয়াও খুব খারাপ। তোমরা দুজনেই আমাকে না জানিয়ে চলে গিয়েছিলে। আমি তোমাদের সাথে খুব রাগ করেছি। খুব!’

অতলের কথা শুনে রাদিদের কেমন যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। বহ্নির সম্পূর্ণ কথা বুঝে উঠতেই তার খেয়াল হলো তবে কি অতলও চলে গিয়েছিল সেই ঘটনার পর! বহ্নি তখন তার থেকে হেঁটে অনেকটা দূর চলে গিয়েছিল । রাদিদ দৌড়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,’অতল চলে গিয়েছিল মানে?’

-‘তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।’

-‘এত্ত রাগ?’

-‘রাগ কি শুধু তোমরা করতে পারো? আমি পারি না?’

-‘তা পারবি না কেন? আচ্ছা চল , সামনের রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।’

-‘তোমার সাথে কোথাও যাব না।’

-‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তো এমনিতেই চলে যাচ্ছি আজ।’ রাদিদ হাত নাড়াতে নাড়াতে বলল,’ বাই।’

বহ্নি কিছু না বলেই চলে গেল। রাদিদ শুধু তাকিয়ে দেখছিল পিচ্চিটাকে। কত বড় হয়ে গেছে। আগের চাইতে অনেক সুন্দর হয়েছে। কিন্তু অভিমান, রাগ সব আগের মতোই আছে। কিচ্ছু পরিবর্তন হয়নি।ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রাদিদ।
______________________

নীরা তার বন্ধুদের বিদায় দিয়ে রাদিদের পেছন থেকেই বলে উঠল,’তুমি বহ্নি আপুকে চেনো?’

রাদিদ নীরার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই নীরা কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,’ইনিই কি সেই বহ্নি?’

রাদিদ তার মাথা দুলাল। নীরা একেবারে প্রশস্ত হেসে বলল,’ভাগ্যিস আজ আম্মু তোমাকে জোর করেই আমাকে নিতে পাঠিয়েছে। নয়তো জানতেই পারতাম না আমার এই রাদিদ ভাইয়ার ঘুম কেড়ে নেওয়া রাজকন্যা, এই কিউট আপুটা।’

একটু থেমে নীরা আবার বলল,’হুররে! ভাইয়া আজ কিন্তু ট্রিট চাই তোমার কাছ থেকে। আজ সেলিব্রেশন হবে।’

রাদিদ অবাক হয়ে অবিশ্বাসের সুরে বলল,’এখানে ট্রিট দেবার মতো কী হয়েছে?’

‘হয়েছে। হয়েছে। অনেক কিছু হয়েছে। অনেক কিছু সামনে হবে। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ।’ নীরা স্মিত হেসে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বলল।

‘তুইও না। একদম পাগলাটেই থেকে গেলি।’ তারপর আত্মবিশ্বাসের সুরে বলল, ‘যার কথা বলছিস সে যেমন তেমন মেয়ে না। ও সম্পূর্ণ ভিন্ন। একদম আলাদা।’

‘আরে আমার রাদু ভাইয়া । আলাদা বলেই তো তোমার ঘুম কেড়ে নিতে পেরেছে। নয়তো কি পারত?’ নীরা তার হাতের ছাতাটা খুলতে খুলতে বলল।

‘এসব কি? আমার পুরো নাম রাদিদ ইবনে ইফতেখার। রাদু কি? হ্যাঁ?’ রাদিদ প্রচণ্ড রাগ দেখিয়ে বলল।

‘স্যরি! রাদু ভাইয়া। ওহ স্যরি রাদিদ ভাইয়া । আমি একদম অতি পরিমাণে দুঃখিত।’ নীরা ঠোঁট উল্টে আদুরে ভঙ্গিতে বলল।

নীরাকে এরকম বাচ্চাদের মতো আচরণ করতে দেখে রাদিদ হেসে ফেলল। তারপর বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। চল এবার।’

‘ট্রিট কি পাচ্ছি তাহলে?’ নীরা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল।

রাদিদ থমথমে মুখ করে গম্ভীরভাবে বলল, ‘কোনো ট্রিট পাবি না। টাকা উড়ানোর স্বভাব তোদের আর গেল না। যারা কষ্ট করে টাকা উপার্জন করে কেবল তারাই জানে এর পেছনে কতটুকু শ্রম দিতে হয়। একটা ভাতের দানার কতটুকু মূল্য তা কেবল একটা পথশিশুকে দেখলেই বুঝবি অথবা তাদের দেখলে বুঝবি যারা ঠিকমতো একবেলা খাবার ও খেতে পায় না।’

রাদিদের এমন জ্ঞানগর্ভ ভাষণ নীরার চিন্তা জগতে কোনো প্রতিফলন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। সে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আবারও বলল, ‘দেখ তুমি কিন্তু একদম ট্রিট দিতে চাও না? এত কিপ্টুস কেন তুমি?’

‘একটু আগে কী বললাম?’ রাদিদ সরু চোখে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল, ‘এতক্ষণ যা বললাম তা বুঝলে এর পরের প্রশ্ন আর তোকে করতে হতো না। জীবন মানুষকে অনেককিছু শিখিয়ে দেয়। আমাকে দেখেও কি বুঝতে পারিস না?’

নীরা আহত কণ্ঠে বলল,’মাঝেমধ্যে একটু মজা করলে খুব একটা ক্ষতিও হয় না। সেটা তুমি ভুলে গেছ।’

রাদিদ জানে আর কিছু বলে কোনো কাজ হবে না। তাই সে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘চল, এবার যাওয়া যাক।’

_____________

আজকের পর্বে প্রশ্ন থাকছে পাঁচটি:

১. কে কে রাদিদকে অতল ভেবেছিলেন?
২. রাদিদের পরিবর্তনের পেছনের কারণ কী হতে পারে?
৩. রাদিদের এত্ত জ্ঞানগর্ভ ভাষণ আপনার কেমন লেগেছে?
৪. নীরাকে কেমন লেগেছে?
৫. শিহরণের বহ্নিকে নানান নামে ডাকাটা কেমন লেগেছে?

____________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে