ছোঁয়ার শিহরণ ২য় খন্ড পর্ব-০১

0
3406

#ছোঁয়ার_শিহরণ_২য়_খন্ড
#ফাতিমা_আক্তার_অদ্রি

পর্ব-০১

কাক ডাকা ভোর। পাখির কিচিরিচির শব্দে স্নিগ্ধ সকালটা মুখরিত হয়ে আছে। জানালার ফাঁক গেলে সকালের মিষ্টি রোদ্দুর ঢুকে পড়েছে ছোঁয়ার বেডরুমে। মিষ্টি রোদের রুপালি আলো ছোঁয়ার স্নিগ্ধ মুখের উপর পড়েছে। ছোঁয়া ডান হাত দিয়েই চোখ ঢাকল। চোখ বুজেই রইল। তার আজ ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না।মনে হচ্ছে খুব তৃপ্তির ঘুম দিয়েছে সে। বহুকাল পরে, বহু সময়ের ব্যবধানে। চরিদিকের ভোরের মিষ্টি রোদ, পাখির কিচিরমিচির , স্নিগ্ধ সকাল সবকিছু অনুভব করতে পারছে সে। তার অবচেতন মন চাইছে সেই স্নিগ্ধ ভোর উপভোগ করতে কিন্তু দু’চোখ অতৃপ্ত ঘুমের জন্য, ঘুম রাজ্যে বিচরণের জন্য!

সকালের শিশির ভেজা ঘাসের উপর পাদদেশ ফেলে হাঁটার লোভ সামলাতে না পেরে ছোঁয়া এক লাফে ঘুম থেকে উঠে পড়ল। তার সিল্কি চুল অবিন্যস্ত হয়ে আছে। মুখমণ্ডল যেন বসন্তের গাছপালার নব পল্লবে সজ্জিত সতেজতায় ভরপুর। তার গায়ে পড়া একটা খয়েরি রঙের কুর্তি আর একটা ব্লু কালারের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। সমস্ত অ্যাটায়ারে ছোঁয়াকে বড়ই স্নিগ্ধ মনে হচ্ছে। ছোঁয়া দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পড়ল তার ছোট্ট অথচ খুব প্রিয় কাজটি করতে।

ছোঁয়া সাবধানে পা ফেলছে শিশিরভেজা ঘাসের উপর। কী স্নিগ্ধ সেই অনুভূতি ! বিশুদ্ধতায় ভরা বাতাস বইছে । ছোঁয়ার গায়ে আঁচড় কাটছে সকালের সেই স্নিগ্ধ বাতাস। সূর্যের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখতেই মনে এক প্রশান্তি অনুভব হচ্ছে। চারদিকের গাছের চিকন ডালগুলো নড়ছে মৃদু, পাতাগুলো যেন হাসছে। ছোঁয়ার জন্য এই এক নতুন ভোর। সে সেই সব পাতার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল। বাতাসে ভেসে ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে। ছোঁয়া চোখ বুজে বাহু প্রসারিত করে নিঃশ্বাস ভরে নিচ্ছে সেই মিষ্টি ঘ্রাণ।

‘ছোঁয়া, মামুণি। তাড়াতাড়ি এসো, নাশতা খেতে।’ ফাহমিদা বেগমের নরম অথচ উঁচু কণ্ঠের ডাকে ছোঁয়া চোখ খুলল। ফাহমিদা বেগম ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিলেন। ছোঁয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল।

ফাহমিদা বেগম এবার কপট রেগে বললেন,’কী হলো? এভাবেই হাসতে থাকলে হবে? অফিস যেতে হবে না?’

ছোঁয়া প্রশস্ত হেসে বলল,’এখনো অনেক সময় আছে। থাকতে দাও না আরো একটু সময় প্রকৃতির কাছে।’

‘এখন ঘড়িতে সাতটা বাজে। শপে যাবি, তারপর আবার অফিসে যাবি। কাজ কি কম বলতো?’ ফাহমিদা বেগম চিন্তিত স্বরে বললেন।

‘মা, তোমাকে এসব নিয়ে একদম ভাবতে হবে না। আমি সব সামলে নেব।’ ছোঁয়ার কণ্ঠে দৃঢ়তা।

ফাহমিদা বেগম ডান হাত দিয়ে কপাল চাপড়ালেন। তারপর হতাশ গলায় বললেন,’হায়! কপাল। এই মেয়ে আমার কথা কবে শুনবে কে জানে!’

‘আচ্ছা , মা। আসছি।’ ছোঁয়া পরাস্ত ভঙ্গিতে বলল।

ছোঁয়া আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। দ্রুত পায়ে নিজ রুমে গেল। তারপর ওয়াশরুমে ঢুকে লম্বা শাওয়ার নিল। তারপর দ্রুত ইউনিফর্ম পরে নিল। চুলটা ছেড়ে দিল। সামনে কয়েক গোছা ছোট চুল ছড়িয়ে আছে কপালের দিকে। ঠোঁটে হালকা বাদামি লিপস্টিক পরলো। কানে এক জোড়া ছোট স্টোনের কানের দুল পরলো। বাম হাতে পরলো তার রিস্ট ওয়াচ। আর অপর হাতে একটা গোল্ডেন ব্রেসলেট। মুখে হালকা হোয়াইট টোন পাউডার দিলো। এছাড়া আর কোনো প্রসাধন নেই। তবুও তাকে দেখতে একদম প্রিন্সেসের মতো মনে হচ্ছে।

ছোঁয়া তার হাত ব্যাগ আর ল্যাপটপ নিয়ে ডাইনিং এ এসে বসল। ফাহমিদা বেগম আজ তার জন্য নিজ হাতে নাশতা বানিয়েছেন। ছোঁয়া এখন খুব স্বাস্থ্য সচেতন । ফ্যাট যুক্ত খাবার বরাবরই সে এড়িয়ে চলে। তবে বাসায় তার এসব ডায়েট চলে না। ফাহমিদা বেগম প্রায় সময় তার জন্য নানান নাশতা ও রিচ ফুড বানান ঘরে। ছোঁয়া নিষেধ করলেও শুনেন না। তার উপর জোর করেই ছোঁয়াকে খাওয়ান। এই মুহূর্তেও টেবিল জুড়ে নানান নাশতার ছড়াছড়ি । অরেঞ্জ জুস, ব্রেড অ্যান্ড বাটার, টোস্ট, নুডলস, স্যুপ, পায়েস আরো নাম না জানা খাবার। এতসব খাবার ফাহমিদা বেগম টেবিলে এনে রাখতেই ছোঁয়ার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল।

সে মুখে এক রাশ বিরক্তি এনে বলল,’মা, তোমাকে কতবার বলেছি এত্ত খাবার না বানাতে! তুমি আমার কথা একদম শুনো না।’

ফাহমিদা বেগম আহ্লাদিত কণ্ঠে বললেন,’তোর জন্যেই তো বানালাম। সব খেতে হবে তোকে। না খেলে আমি কিন্তু খুব রাগ করব। আর না খেয়ে খেয়ে কেমন পাতলা হয়ে যাচ্ছিস সেই খবর কি আছে?’

ছোঁয়া প্রচণ্ড অবাক হলো। ফাহমিদা বেগমের সামনে সটান দাঁড়িয়ে বিস্মিত স্বরে সে বলল,’আমাকে এখন একটু ভালো করে দেখ তো। আমার ওয়েট ৫০ কেজি। হাইট ৫ ফিট ৩ ইঞ্চি। তারপরেও তুমি বলবে আমি পাতলা? কত্ত মোটা হয়ে যাচ্ছি, মা। সব তোমার জন্য। তুমি উল্টাপাল্টা সব খাবার খাইয়ে খাইয়ে আমাকে মোটু বানাচ্ছ। তখন দেখবে কিছুদিন পর আমার ওয়েট হবে ৮০ কেজি। সেদিন দূরে নাই বলে দিলাম যেদিন মোটু বলে আমাকে রিজেক্ট করা হবে! আর তখন আমার জন্য পাত্র খুঁজেই পাবে না। এখন থেকেই তো তুমি পাগল প্রায় হয়ে যাচ্ছ পাত্র খুঁজতে খুঁজতে ।’

ফাহমিদা বেগম প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন,’হয়েছে, আর এত পাকনামো করতে হবে না। খেতে বলেছি খাও। এসব কিছু যে তোমার খাবার না খাওয়ার পাঁয়তারা তা আমি খুব ভালোই বুঝতে পারছি।’

ছোঁয়া অসহায় মুখ করে তাকাল ফাহমিদা বেগমের দিকে। ফাহমিদা বেগম সেই দৃষ্টি সহাস্যে উপেক্ষা করে ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,’আচ্ছা শুধু আজকে খা। কাল থেকে আর খেতে হবে না।’

ছোঁয়া হতাশ গলায় বলল,’এই একটা কথা তুমি কতবার বলেছ হিসেব আছে?’

ফাহমিদা বেগম প্রত্যুত্তরে শুধু হাসলেন। ছোঁয়াও হাসল। তারপর দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরল এক অকৃত্রিম ভালোবাসার বন্ধনে।

সমস্ত হাসি ছাপিয়ে ফাহমিদা বেগমের কপালে পড়ল এক চিন্তার ভাজ। অতীতের কোনো এক বিভীষিকাময় ক্ষণের কথা হয়তো মনে পড়ে গেছে তার। কে জানে! মানুষ কখন কী ভাবে আর কখন কী করে!

____________________

একটা ব্ল্যাক পাজেরো এসে থামল ঠিক মিডিয়াম আকারের আকর্ষণীয় এক শপের সামনে। শপের কাঁচের দেয়াল ভেদ করে দেখা যাচ্ছে এক প্রাণবন্ত হাস্যোজ্জ্বল সতেজতায় ভরপুর তরুণীর চেহারা। যেই চেহারায় নেই কোনো ক্লান্তি, নেই উদ্বেগ কিংবা কোনো উৎকন্ঠা । তরুণীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন যুবক। বয়সে সেই তরুণীর সমবয়সী হবে হয়তোবা বছর খানেক বেশি হবে। গাড়ির কাঁচ না নামিয়েই সেই তরুণীর সমস্ত কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করছে গাড়িটির ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটি। তার ঠিক পাশের সিটে বসা একজন রূপবতী, অতি সুন্দরী তরুণী অধৈর্য গলায় বলল,’আনবিলিভেবল! তুমি এভাবে কি বসেই থাকবে?’

নিরুত্তর সেই মানুষটি । সুন্দরী তরুণীর কথার উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করল না ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটি। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ শপের ভিতরের সেই হাস্যোজ্জ্বল তরুণীর দিকে। সে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। স্টিয়ারিং খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে হাত দিয়ে।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির সমস্ত অ্যাটায়ার জহুরি চোখে পরখ করছে সে। সেই তরুণ খুব হাসি হাসি মুখ করে কথা বলছে। যেন খুব করে ভাব জমাতে চাইছে হাস্যোজ্জ্বল তরুণীর সাথে। তরুণীও থেকে থেকে মৃদু হাসছে। একটু আধটু কথাও বলছে। মাঝেমধ্যে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিচ্ছে। আর তা দেখেই ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটির ক্রোধ উপচে পড়ছে স্টিয়ারিং এর উপর।

তার পাশের তরুণী পুনরায় ব্যস্ত গলায় বলল,’তুমি এই ভাবে কী দেখছ?’

মানুষটি এবারও নিরুত্তর। পাশের তরুণী কাঁধ ধরে একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিতেই সেই মানুষটি গম্ভীর কণ্ঠে বলল,’হুয়াট দ্যা হেল, মান্নাত! ক্যান্ট ইউ কিপ প্যাশেন্স ফর জাস্ট অ্যা হোয়াইল?’

‘তুমি চিৎকার করছ কেন? আমি তো খুব সাধারণ একটা প্রশ্ন করেছি মাত্র।’ মান্নাত এটুকু বলে একটু চুপ থেকে আবার বলল,’আমি এই ধরনের ব্যাবহার তোমার কাছ থেকে আশা করিনি।’

‘স্যরি, মান্নাত! আই ওয়াজ আউট অব মাই মাইন্ড ।’

‘আই নিড টু গো। নাউ।’ মান্নাত চেঁচিয়ে উঁচু কণ্ঠে বলল।

মানুষটির প্রচণ্ড রাগ হলো। এভাবে রাস্তাঘাটে চিৎকার , চেঁচামেচি করার কোনো মানে নেই। তাই শান্ত স্বরে বলল, ‘ওকে। দ্যান ইউ ক্যান লিভ।’

‘আমি আন্টিকে বলব তোমার আজকের আচরণ সম্পর্কে ।’ প্রচণ্ড রাগান্বিত কণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল মান্নাত।

‘এজ ইওর উইশ।’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে এক হাত স্টিয়ারিংয়ে রেখে অপর হাত প্রসারিত করে বলল মানুষটি।

________________

আজকের পর্বে আপনাদের জন্য প্রশ্ন থাকছে তিনটি:

১. ফাহমিদা বেগম এত্ত সুইট হবার পেছনে কারণ কী হতে পারে?
২. মান্নাতের সাথের ছেলেটা কে?
৩. আজকের পর্বের চরিত্রের প্রেজেন্টেশন কেমন লেগেছে এবং প্রকৃতির বর্ণনা আপনার মনকে ঠিক কতটুকু ছুঁয়েছে?

_________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে