চেয়েছিলাম তো তোমাকেই পর্ব-০১

0
3315

গল্প:#চেয়েছিলাম_তো_তোমাকেই
লেখিকা:#সুরভী_আক্তার
#পর্ব:০১

“পিঠ পর্যন্ত চুল, নেইলপলিশ ছাড়া নখ আর পেন্সিলকে ছেলেদের মত কানে গুঁজে তুই কি নিজেকে by any chance ছেলে প্রমাণ করতে চাচ্ছিস? আমার কিন্তু অমন হাফ মেয়ে পছন্দ না”

নিরব ভাইয়ার কথায় পিছনে ফিরে তার দিকে এক নজর তাকিয়ে নিজের দিকে একবার তাকালাম।সব তো ঠিকই আছে! তারপর তার দিকে তাকিয়ে বললাম

“কেন ভাইয়া, মেয়েদের কি পিঠ পর্যন্ত চুল থাকে না?নাকি সবাই তোমার বিশ্ব সুন্দরী গার্লফ্রেন্ড এর মত কোমর পর্যন্ত চুলের অধিকারী?নাকি তার মত ময়দা সুন্দরী যে সারাক্ষণ নেইলপলিশ লাগিয়ে মুখে ময়দা লাগিয়ে ঘুরতে হবে?
আর বাকি রইল পেন্সিল কানে গুজার কথাটা,সেটা তো স্কেচ বানাচ্ছিলাম তাই!
আর তোমার অমন মেয়ে পছন্দ নাতো আমি কি করব? কোন নতুন কথা বলার থাকলে বলো নয়ত যাও!”

আমার কথা শুনে নিরব ভাইয়া রেগেমেগে চলে গেল।আমি জানি সে এখানে বিয়েটা ভাঙাতে এসেছিল কিন্তু আমি তো এত সহজে তাকে ছাড়ছি না। আচ্ছা বিস্তারিত বলি-

আমার নাম হচ্ছে অথৈ জাহান নীরা। আব্বুর নাম ইসনাথ জাহান যিনি পেশায় ব্যবসায়ী আর আম্মু নীলিমা জাহান একজন গৃহিণী।

আমার জন্মস্থান সিলেট আর এখন বর্তমান থাকি মিরপুর। আমার আম্মুর কাছ থেকে জানতে পারি ব্যবসার কাজে আব্বুর সিলেট যেতে হয়েছিল আর তখন ২-৩ বছরের মতো তারা ওখানেই ছিল কিন্তু দুজনের জন্মস্থান ই আসলে মিরপুর।

তো কাজ শেষে আম্মুরা মিরপুর ব্যক করে তখন আম্মুর এক বান্ধবীর সাথে তার আবারো দেখা হয়।

কলেজ লাইফের ফ্রেন্ডস ছিল তারা আর আম্মুর সেই বান্ধবীর বিয়ে আম্মুর বিয়ের বছর দুয়েক আগেই হয়েছিল।আর নিরব ভাইয়া তাদেরই সন্তান।

কলেজ লাইফের ফ্রেন্ডস হওয়ায় তাদের দেখাটা অনেক দিন পরেই হয়েছিল।তাই পেটের অনেক কথাও জমেছিল।

তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল যখন তারা এখানে থাকবেই তাহলে নিরব ভাইয়াদের বাড়ির আশপাশে বাড়ি নিলেই হয় এতে করে তাদের প্রায়শই দেখা হবে আর বন্ধুত্বটাও বজায় থাকবে।

তারপর আমরা মিরপুরেই নিরব ভাইয়াদের বাসার কিছুটা দুরত্বে বাসা ভাড়া নিই আর বর্তমান এখানেই আছি।

নিরব ভাইয়া আমার ৪ বছরের বড়। আমার বয়স ২০ হতে চললো আর সে জবের জন্য ট্রাই করছে।

নিরব ভাইয়াকে আমি অনেক আগে থেকেই পছন্দ করি তবে কখনো বলা হয় নি।বলা হয় নি বলতে কখনো বলিনি বা বলার চেষ্টাও করি নি।

কারণ আমি তাকে পছন্দ করলেও সে আমাকে পছন্দ করে না।তার উপর আবার তার প্রাণপ্রিয় গার্লফ্রেন্ড আছে যাকে সে তার জানের মত ভালোবাসে।

এই নিজ হাত দিয়েই তাকে কত গিফট দিলাম, তার হিসেব নেই।

পাড়ায় আমাকে আর নিরব ভাইয়াকে দেখে কেউ কখনো খারাপ মন্তব্য করেনি।সকলেই আমাদের বন্ধু হিসেবেই জানে।

বুড়ো থেকে জোয়ান সবাই এটাই বিশ্বাস করে।

আর নিরব ভাইয়া ছেলে হিসেবে বেশ।যেমন আছে রূপ তেমনি গুণ।
সব মেয়ের স্বপ্নের রাজকুমারও বলা চলে।তবে মেয়েদের সাথে তার খাতির কম আর পাড়ায় যদি মানুষ জানে তার একটা গার্লফ্রেন্ড আছে তাহলে সেটা কানেমুখে ছড়িয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না তাই গিফট আইটেম গুলো আমিই নাহার (নিরব ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড) আপুকে দিয়ে গেছি।

রং বেরঙের পেপার দিয়ে মোড়ানো বাক্সগুলো দেখলেই মনটা ভরে যেত তবে মন খারাপের বিষয়টা ছিল সেটা অন্যজনের জন্য জমানো ভালোবাসা ছিল।
আমার জন্য না।

আমার যখন ১৯ বছর ছিল তখন কিভাবে যেন আর কি মনে করে যেন নিরব ভাইয়া আমার বার্থডে এরেন্জ করেছিল। সেই বার্থডে আমার জন্য বেস্ট ছিল।

তো তখনই আমরা হাসি মজা করতে করতে নিরব ভাইয়া আমার মুখে কেক লাগিয়ে দিয়েছিল।সেটা ধুতেই ওয়াশরুম গিয়েছিলাম।ওয়াশরুম ছিল আম্মু আব্বুর ঘরের পাশেই।
তখন ওই ঘর থেকে ওদের কথোকথন আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। যেহেতু ওরা প্রায়শই যেকোন বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করে দেয় সেহেতু আমিও চুপচাপ মুখে পানি দিচ্ছিলাম কিন্তু হঠাৎই আন্টির মুখে নিরব ভাইয়ার নাম শুনতে পাই আর নিরব ভাইয়া বিষয়ক সব জিনিসেই আমার ইন্টারেস্ট আছে তাই আমি আরেকটু দেয়ালের দিকে সরে ভালোমত শোনার চেষ্টা করলাম যে আসলে তারা বলছে টা কি?
তখন আন্টিকে বলতে শুনেছিলাম তিনি নাকি এর পরের বছরই আমাকে তার বাড়ির বউ করে নিতে চান।
যদিও নিরব ভাইয়ার জব নেই তবুও তার রেজাল্ট অনেক ভালো।জব পেতে বিশেষ কোন সমস্যা হবে না।

প্রথমে ঘরোয়া ভাবে বিয়ে দিয়ে তারপর ভাইয়া জব পেলেই একটা ছোট খাটো অনুষ্ঠান করা হবে। অবশ্য অনুষ্ঠানে আমার বিশেষ কিছু এসে যায় না।

সেদিন আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম যা কোন অনুষ্ঠানের থেকে কম ছিল না।
প্রায় একবছর পর্যন্ত সেই খুশি আমি নিজের মধ্যে সিমাবদ্ধ রেখেছি।
এটা জানা সত্ত্বেও নাহার আপুকে গিফট দিয়ে গেছি।
সেই টাইম টাই অনেক রাগ লাগত নিরব ভাইয়ার ওপর। আমাকে সে ছোট থেকে চিনে কিন্তু আমার প্রতি তার কোন ফিলিংস ই জাগলো না।

অবশ্য আমরা প্রায় এমন কাউকে ভালোবাসি তারা আমাদের ভালোবাসার মূল্য দেয় না।এতে অবশ্য কারো দোষও দেওয়া যায় না কারণ ফিলিংস তো আর জোর করে আনা যায় না।

এইযে আমি নিরব ভাইয়াকে ভালোবাসি সে হয়ত বুঝে নি কখনো আর নিরব ভাইয়া যে নাহার আপুকে ভালোবাসে নাহার আপু শুধু নিরব ভাইয়াকে টাইম পাস হিসেবে ইউস করে এটা সে বুঝে না‌।

যদি নাহার আপু ভালো হত তাহলে কখনোই আমি ওদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হ্তাম না। কারণ ভালোবাসা মানেই ত্যাগ।কিংবা ভালোবাসার কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই।সেটা যে যেরকম মনে করে।

বলা হয়,ভালোবাসা নাকি অন্ধ হয় তাই নাহার আপুকে নিরব ভাইয়া এতই ভালোবাসে যে তার সম্পর্কে কেউ কোন কথা বললে গায়ে হাত তুলতেও দু বার ভাবে না।

আমার গায়েও হয়ত হাত তুলত তবে মেয়ে বলেই হয়ত ছাড়া পেয়েছি কিংবা গায়ে হাত তুললেই হয়ত আন্টির কাছে জবাবদিহি করতে হতো তাই।
কিন্তু বাসায় গিয়ে নিশ্চয়ই ভাংচুর করবে বা আমার সাথে কথাও বলবে না দুই একদিন।

আমার ভয় হতো যে নিরব ভাইয়া যদি আমাকে বিয়ে করতে না চায় তখন আমি কি করব?
কিন্তু মনে একটা আশাও ছিল যে নিরব ভাইয়া আর যাই করুক অন্তত তার মায়ের কথা ফেলবে না।আর তাই হয়েছে। মায়ের কথা না ফেললেও সে আমাকে বিয়েটা করতে মানা করছে।তার ধারণা আমি না বললেই বিয়েটা হবে না আর সে বেঁচে যাবে কিন্তু আমি তো তা হতে দিব না।

আমাদের বিয়ের ব্যপারটা এক মাস হলো নিরব ভাইয়া জেনেছে।আর তখন থেকেই নানা বাহানায় আমাকে প্রত্যখ্যান করতে থাকে। অন্য মেয়েদের সাথে তুলনা করতে থাকে।
আজও সেইজন্যই এসেছিল। Indirectly আমাকে বিয়েতে “না”বলতে বলছে সে।

আমাকে এটা বুঝাচ্ছে সে যে”আমার মত মেয়ে”সে পছন্দ করে না।

এখন তো বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহই রয়েছে।এর মধ্যে যে কি না কি করবে আল্লাহই জানে।

__________
পাঁচদিন পার হয়ে গেছে।এরপর ভাইয়ার সাথে আমার আর দেখা হয় নি।কলও করেছিলাম কিন্তু রিসিভ করেনি।করবেই বা কেন?

আমি যে এখন তার কাছে জল্লাদের মত!
যে তার ভালোবাসা তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে।রাগটাও কি স্বাভাবিক নয়?

আজ অনেক অস্থির অস্থির লাগছে তাই ওদের বাসায় যাব ঠিক করলাম।

আম্মু কখনোই আমাকে ভাইয়াদের বাসায় যেতে মানা করে নি,আজও করল না তবে জলদি ফিরতে বলল। কেনাকাটা করতে হবে নাকি।বিষয়টা আমার কাছে সবসময়ের মতই বিরক্তিকর।

আজ পাঁচ মিনিটের রাস্তাও কেমন জানি পার হচ্ছে না।ভয় হচ্ছে এটা ভেবে যে আমাকে দেখে তার রিয়েকশন কি হবে?

যদি উল্টাপাল্টা কিছু আচরণ করে?

বাসায় গিয়ে বেল দুই বার দিতেই নিরব ভাইয়া এসে খুলে দিল।তার চোখ মুখ কেমন যেন শুকিয়ে গিয়েছে।
দেখে খারাপ লাগলো তবে আমি তাকে হারাতে চাই না।জানি বিষয়টা স্বার্থপরের মতো তবুও আমি তাকে হারাতে চাই না।

আমাকে দেখেই ভাইয়া আবার দরজা লাগাতে নিতেই আমি দরজায় হাত দিয়ে ফেললাম।

তাই ও দরজা লাগাতে পারলো না কিন্তু আমাকে রেখেই নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।

আমি তাড়াতাড়ি দরজাটা লাগিয়ে তার পিছন পিছন এসে তার ঘরে চলে এলাম।

সে বিছানায় চোখ বন্ধ করে বসল।আমি কি বলব বুঝলাম না কিন্তু কথা তো শুরু করতেই হবে

“আন্টি কই?”

“শপিং গেছে”

“ওও, তোমার মুখ‌ এমন দেখাচ্ছে কেন?”

“কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিবি না একদম! তুই জানিস না কার জন্য আর কি কারণে আমার এই অবস্থা?”

“ভাইয়া তুমি কেন আমার সাথে এরকম করছ?”

“ভাইয়া বলবি না একদম।সম্পর্ক গুলোও লজ্জা পাবে। তোকে তো বন্ধুর চোখে দেখতাম আমি আর সেই তুই ই আমার পিঠে ছুরি বসালি।জানতিস না তুই আমি নাহারকে কতটা চাই?
তার জন্য প্রত্যেকটা রাত জেগে পড়েছি। রেজাল্ট ভালো করেছি। নিজেকে যোগ্য করে তুলছি যাতে ওর বাবা মা কোন দিক দিয়েই বলতে না পারে”আরে এই ছেলেটা তো আমার মেয়ের যোগ্যই না”বাট এট লাস্ট তুই কি করলি?”

“বিশ্বাস করো, নাহার আপু তোমাকে ভালোবাসে না!তার অন্য ছেলেদের সাথেও রিলেশন আছে।যদি তার সাথে বিয়ে করো তাহলে তোমার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে…..”

আমার সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার আগেই নিরব ভাইয়া আমার গালে চড় বসিয়ে দিলেন।
ঐযে বলেছিলাম নাহার আপুর ব্যাপারে কেউ বললে গায়ে হাত তুলতেও দু বার ভাবে না,সেটাই।

চড় খেয়ে আমার পুরা গা কাঁপতে লাগলো,রাগে।
তার এসব কাজে কি সত্যটা পাল্টে যাবে?

ভালোবাসি বলে আত্মসম্মান নেই নাকি। সেই আত্মসম্মান ই এই মুহূর্তে আমার কাছে ভালোবাসার থেকে বড় লাগছে কারন যে নিজেকে সম্মান দেয় না তাকে মানুষ কি সম্মান দিবে।

সেই থেকেই জবাব দিলাম”তুমি এই বিয়ে করতে চাও না তাইনা? তাহলে আমিও আর জোর করব না। তুমি মুক্ত।

আর এইযে মুখ শুকনো রেখেছ সেটা আর শুকনো রেখ না। তোমার ফেস ব্রাইটনেস কমে যাবে তখন আবার নাহার আপুর সাথে ডেট এ যাবা কিভাবে?

তোমার আন্টিকে কিছু বলতে হবে না।যা বলার বা বুঝানোর আমি করে দিব।পারলে তোমার বিয়েটাও করিয়ে দিব। ভালো থেকো।”

এটা বলার পর আর দাঁড়ালাম না সেখানে। আমার যে কোন অধিকারও নেই সেখানে থাকার।

যা ও একটা আশা ছিল সেভাবে হয়ত বিয়েটা হত। তবে আমার প্রাণবন্ত নিরবকে আমি পেতাম না।তাই নিজ হাতেই সব টা শেষ করে দিলাম।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে