চুপিসারে ভালবাসি পর্ব-০৭

0
2203

#চুপিসারে ভালবাসি
–পর্বঃ৭
Sadia afrin nishi
_________________

সোহার মনটা ভীষণ ছটফট করছে। কোনো কাজে মন লাগছে না। শুধু নীলকে ঘিরে ভাবনার সূচনা হচ্ছে। বর্তমান সময়ে স্মার্ট ফোন ইউজার নেই এ কথাটি বিরল। প্রায় সকলেই এই ফোনের অধিকারি। সোহার কাছেও একটি আছে তবে সেটা খুব একটা কাজে আসে না। সোহার ফোনের প্রতি তেমন একটা আসক্তি নেই বললেই চলে। তবে আজ এই ফোনটার ভীষণ প্রয়োজন তার জীবনে। ফোনের স্কিনে ভাসমান একটা নম্বরে ডায়াল করার প্রবল ইচ্ছে জাগছে তার মনে। কিন্তু সাহসে কুলচ্ছে না। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে নিজে থেকেই সোহার ফোনটা বেজে উঠল। আচমকা ধুক করে উঠল সোহার বুক। স্কিনে সোহার বড় মামির নম্বর টা ভাসছে। অজানা ভয়ে বুকটা ধক করে উঠল সোহার। নীলের যেই রাগ বাড়িতে গিয়ে আবার কোনো কান্ড বাধিয়ে বসল না তো ? চটজলদি ফোনটা রিসিভ করল সোহা। ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“কী হয়েছে বড় মামনি? গুরুতর কিছু?”

নীলের মা আশ্চর্য হয়ে যায় সোহার এমন ব্যবহারে। পরক্ষণেই হেসে দিয়ে বলেন,

“নাহ আম্মা তেমন কিছু না। তোর মায়ের ফোনে কল দিয়েছিলাম রিসিভ করে নি এজন্য তোর নম্বরে দিলাম। তোর মায়ের সঙ্গে একটু কথা আছে। ফোনটা তোর মাকে দে তো?”

সোহার মন তবুও আশঙ্কায়। সে দ্রুত ছুটে মায়ের ঘরে চলে যায়। মালিহা আহমেদ তখন ওয়াশরুমে। সোহা বাহিরে থেকে ডাক দিতে যাবে তার আগেই তার মা বেড়িয়ে আসে। সোহাকে দেখে তিনি বলেন,

“কী হয়েছে কিছু বলবি?”

সোহা তার ফোনটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

“বড় মামনি। নাও কথা বলো।”

মালিহা আহমেদ ফোনটা নিয়ে সালাম দেয় নীলের মাকে। তারপর কিছুক্ষণ তাদের মধ্যে কথপোকথন চলে। ওপাশের কোনো কথাই সোহা শুনতে পায় না। কথা শেষ হতেই সোহা আগ্রহের সহিত তার মাকে জিজ্ঞেস করে,

“কী হয়েছে মা? বড় মামনি কী বলল?”

“কাল ওই বাড়িতে যেতে চলেছে। গ্রাম থেকে সূর্যের নানাবাড়ির লোক আসবে। তাই আমাদেরকেও যেতে বলেছে। সকলে মিলে একসঙ্গে সময় কাটানো যাবে।”

সোহা একটু খুশি হলো। নীলের রাগ ভাঙানোর একটা সুযোগ তার জন্য অপেক্ষা করছে। খুশি মনে নিজের রুমে চলে গেল সে।

___

সোহার বাবা রিফাত আহমেদ ব্যবসায়ীক কাজে চিটাগং আছেন। আজ তার ফেরার কথা থাকলেও ফিরতে আরও দুদিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন। তাই মালিহা আহমেদ শুধু সোহাকে নিয়েই বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

গাড়িতে বসে বাহিরের পরিবেশ অবলোকন করছে সোহা। মনটা বারংবার খুশিতে নেচে নেচে উঠছে তার। কী সুন্দর আমাদের চারপাশের প্রকৃতি। ঝিলের পাড়ের সারি বাঁধা গাছগুলো বেশি আকর্ষণীয় সোহার নজরে। প্রায় দেড় ঘন্টা পর নীলদের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছায় তারা।

বাড়িতে ঢুকতেই সকলে ছুটে আসে তাদের আপ্যায়ন করতে। এ বাড়িতে তাদের যত্নের কোনো কমতি নেই। সোহা তার মামিদের সঙ্গে ভীষণ ফ্রী। বিশেষ করে তার ছোট মামি অর্থাৎ সূর্যের মায়ের সঙ্গে। সোহা সোজা তার ছোট মামির সঙ্গে আড্ডা দিতে তার মামির ঘরে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ আলাপ করার পর হঠাৎই সে বলে উপর,

“আচ্ছা ছোট মামনি নীলাদ্রি দা কোথায়? তাকে তো দেখতে পাচ্ছি না।”

“নীল তো সূর্যের সঙ্গে গেছে আমার বাবার বাড়ির লোকদের ট্রেন থেকে নিয়ে আসতে।”

“আসবে কখন?”

“এইতো খুব শীঘ্রই চলে আসবে।”

সোহার মনটা একটু খারাপ হলো তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করে আবার মামির সঙ্গে আড্ডা জুড়লো।

___

নীলের বাড়ি ফেরার খবর পাওয়া মাত্রই ছুট্টে সে ঘরে চলে গেল সোহা। নীল তখন গায়ের শার্ট খুলে সবে মাত্র বিছানায় শরীর ছুঁয়িয়েছে। সোহা ভেতরে ঢুকতে গিয়েও ঢুকল না। দরজার বাহির থেকে উঁকি মে’রে দেখল নীলের অবস্থান। নীলের উন্মুক্ত বক্ষ চোখে পড়তেই লজ্জায় কুকিয়ে গেল সে। উল্টো দিকে ফিরে দ্রুত সেখান থেকে পদার্পণ করতে চাইল। কিন্তু তার আগেই ভেতর থেকে ভেসে এলো এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর,

“ভেতর আয়।”

সোহা থমকে দাড়ালো। ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করল। মাথা নিচু করে দু-হাতের আঙুল মোচড়াতে ব্যস্ত সে। নীল মলিন কন্ঠে শুধালো,

“উঁকি মা’রছিলি কেন?”

সোহা আমতা আমতা কন্ঠে বলল,

“ক কই না নাতো…”

“আমি কী তবে ভুল দেখলাম?”

“ক কক কী জ জানি…”

“কেন এসেছিস বল?”

“সরি.. ”

“কেন?”

“কাল আপনাকে ওই কথাটা বলা হয়তো আমার উচিত হয়নি। বিশ্বাস করুন আমি ইচ্ছে করে বলিনি। এমনিতেই মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। আচ্ছা ওই সামান্য কথায় এতো রেগে যাওয়ার কী আছে?”

নীল চোখ মেলে দেখলো সোহার দিকে। সোহার দৃষ্টিও নীলের চোখে আবদ্ধ। নীল নম্র কন্ঠে বলল,

“সত্যিই কী কিছু নেই ওই কথায়?”

সোহা বলল,

“কোন কথায়?”

“তুইও বুঝবি একদিন কিন্তু সেদিন আমিও আর থাকব না। হারিয়ে যাব বহুদূরে।”

সোহার বুকটা ধক করে উঠল নিমেষেই। এবার সে বুঝতে পারছে কতটা ভুল কথা সে বলেছিল।এই কথার মর্মার্থ কতটা ভয়াবহ। নীল তার কথা তাকেই ফিরিয়ে দিল। সোহা কিছু বলল না। এক পা এক পা করে পেছতে পেছতে এক সময় দৌড়ে চলে গেল। নীল দেখল সেই যাওয়া। মনে মনে কিঞ্চিৎ হাসল। তাচ্ছিল্যের হাসি নাকি খুশির হাসি সেটা বোঝা গেল না।

___

নীলের সঙ্গে এক সুন্দরী রমনীকে লেপ্টে থাকতে দেখে সোহার দুনিয়া যেন থমকে গেল। এটা কী দেখছে সে। দরজার আড়ালে দাড়িয়ে এমন কিছু দেখতে হবে কখনো কল্পনাতেও আনে নি সে। সোহার চোখ জোড়া জলে টলমল। হাত পা কাঁপছে অবিরত। ইচ্ছে করছে ছুট্টে চলে যেতে এখান থেকে কিন্তু পারছে না। পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। মাথাটা ঘুরছে ভীষণ। ধীরে ধীরে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে তার। অতঃপর সোহার নিস্তেজ শরীর ঢলে পড়ে মেঝেতে।

ঠাস করে কিছু পড়ার শব্দে চমকে ওঠে নীল আর রিয়া। ছিটকে সরে যায় রিয়া নীলের থেকে। নীল রিয়ার দিকে তাকিয়ে বিরক্তিকর নিশ্বাস ফেলে দরজার দিকে অগ্রসর হয়। দরজার কাছে গিয়ে বড়সড় রকমের ধাক্কা খায় নীল। সোহা এখানে এভাবে পড়ে আছে কেন? তার চেয়ে বড় কথা সোহা কী কিছু দেখেছে নাকি? ওহ সীট, বলে দ্রুত সোহার কাছে গেল নীল। সোহার মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিল। সোহার চোখ বেয়ে পানি পড়েছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। নীলের আর বুঝতে বাকি রইল না তার আশঙ্কাই ঠিক। নীল অস্ফুটস্বরে বলল,

“এখন কী হবে? কী করব আমি? কী করে মানাবো সোহাকে?”

অজানা ভয়ে দুরুদুরু করছে নীলের অন্তঃস্থল। সে বার কয়েক সোহার গাল ধরে ডেকেছে কিন্তু সোহা কোনো রেসপন্স করে নি। অগত্যা দ্রুত কোলে তুলে নিল নীল সোহাকে। সামনে অগ্রসর হতে হতে তার একটাই ভাবনা, “বুঝবি তো আমায় গোলাপরানি?”

পেছন থেকে নীল সোহাকে এতটা ক্লোজ দেখে দাঁত কিড়মিড়িয়ে নিজের রাগকে সংবরণ করার বৃথা চেষ্টা করছে অন্যকেউ।

___

ডক্টর ইনজেকশন পুশ করে জ্ঞান ফেরাল সোহার।মস্তিষ্কে অতিরিক্ত চাপের ফলে এমনটা হয়েছে। অধিক কষ্ট, ভয়, অভিমান, রাগ সবকিছু একত্রে জেঁকে বসেছে তার মনে। যার ফলস্বরূপ এই অবস্থা। নীল নিজেকেই সোহার এমন অবস্থার জন্য দায়ী মনে করছে।ভেতরে ভেতরে অপরাধ বোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে।
সকলে উদ্বীগ্ন হয়ে বসে আছে। অপেক্ষা সোহার জ্ঞান ফেরার। সোহা কী দেখে ভয়,কষ্ট পেয়েছে কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না।

কিয়ৎক্ষণ পরেই জ্ঞান ফেরে সোহার। সকলে উগ্রীব হয়ে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে তাকে। সোহার কারো কথায় মন নেই। তার চোখ জোড়া আটকে আছে দরজার কাছে দাড়ানো ছেলেটির দুই চোখের ভাঁজে। চোখে চোখে কথা হচ্ছে অনেক। সে কথা কেউ শুনছে না। ছেলেটির চোখে অসহায়ত্বের ছাপ আর মেয়েটির চোখে ঘৃণার ছাপ। সোহার ছোট্ট মনে সবে মাত্র নীলকে নিয়ে গড়ে ওঠা অনুভূতির পাহাড় ভেঙে গুড়িয়ে গেছে এক নিমেষে। এখন শুধু সেই মন থেকে একটা কথার প্রতিধ্বনি চলছে,,,”প্রতারক”

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে