চুপিসারে ভালবাসি পর্ব-০৬

0
2205

#চুপিসারে ভালবাসি
–পর্বঃ৬
Sadia afrin nishi
_________________

পাঁচ তলা বিশিষ্ট ফ্লাটের চর্তুথ ফ্লোরের সদর দরজার সামনে দাড়িয়ে আছে নীল আর সোহা। অপেক্ষা দরজা খোলার। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হতেই এক সুন্দরী রমনী এসে দরজা খুলে দিল। অধরে তার মধুর হাসি। নীলকে দেখে সে হাসি আরও প্রগাঢ় হলো। হাসিমুখ অব্যাহত রেখেই সে বলল,

“হোয়াট এ গ্রেট সারপ্রাইজ? আসবি বলিস নি তো। তোর এই হঠাৎ আগমনে আই রিয়েলি সারপ্রাইজড। আয় ভেতরে আয়।”

নীলও মেয়েটির সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসল। ঘরের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে বলল,

“ইফাজ কই? বাড়িতে নেই?”

মেয়েটির কপালে ভাঁজ পরল কয়েকটি। হতাশ কন্ঠে বলল,

“তোর বন্ধুর তো শুধু কাজ আর কাজ। সারাদিন কাজ নিয়েই পরে থাকে।”

নীল মেয়েটির গালে আলতো করে চড় মা’রা’র মতো করে বলল,

“ডোন্ট ওয়ারি বেইবি। টেনশন নিস না। দেখবি তোর মতো আর একটা বেবি হলে তখন আর একা ফিল হবে না। দু’জনে মিলে সারাক্ষণ বউ-পুতুল খেলবি। আর রাতে যখন ইফাজ বাড়ি ফিরবে তখন ওকে তোদের মিছিমিছি রান্না করা খাবারগুলো খেতে দিবি।”

কথা শেষ করেই নীল দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগল। আর মেয়েটি রেগে গিয়ে নীলের পিঠে কয়েকটা কিল ঘুষি মে’রে দিল। সোহা নিরব দর্শকের মতো উপভোগ করছে সবটা। বেশি উপভোগ করছে নীলকে। নীলের প্রাণোচ্ছলতা তাকে ভীষণ মুগ্ধ করছে। এমন প্রাণোচ্ছল নীলকে সচরাচর দেখা যায় না। ওদের বন্ধুক্তের খুনসুটি শেষ হতেই মেয়েটির নজর পরল সোহার ওপর। সে সোহাকে ইঙ্গিত করে নীলের উদ্দেশ্য বলল,

“এই কী সে নাকি?”

নীল এক পলক দেখল সোহাকে অতঃপর মাথা চুলকে বলল,

“হুম”

মেয়েটি সোহার কাছে গিয়ে তার গাল স্পর্শ করে বলল,

“ভেরি প্রীটি। তবে ভীষণ পিচ্চি।”

নীল কিঞ্চিৎ হাসল। লজ্জামাখা হাসি। ছেলেদেরও লজ্জা পেতে আছে বুঝি? সোহাও হাসল তবে সীমিত।

___

আড্ডা বসল পুরো ড্রয়িংরুম জুড়ে। ইতোমধ্যে নীলের আরও চারজন ফ্রেন্ড এসে হাজির হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন মেয়ে বাকি তিনজন ছেলে।নীলের এই নতুন আগমনকৃত ফ্রেন্ডদের মধ্যে ছেলে তিনজন বেশ ভালোই তবে মেয়েটা একটু কেমন জানি। মেয়েটার পরনে মিনি স্কার্ট। সাজগোজও একটু ওভার স্মার্ট। মেয়েটি এসেই নীলকে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দিল সোহাকে ঘিরে। কথাগুলো ঠিক এমন, এই পিচ্চির জন্য দিওয়ানা তুই? কী আছে ওর মাঝে যা আমার মধ্যে নেই? ওর থেকে আমি কোনো অংশে কম নই তবে কেন তুই ওকে পাবার জন্য এতটা ডেস্পারেট?” এসব কথা বলার কারণ বার করতে পারল না সোহা। সে চুপচাপ মুখ বুজে সবটা বোঝার চেষ্টা করছে। অবশেষে নীলের অগ্নিদৃষ্টিতে মুখে লাগাম পড়ল মেয়েটির।

সবার কথার ধরনে সোহা বুঝতে পারল যার বাসায় তারা এসেছে তার নাম লিসা এবং তার বরের নাম ইফাজ। আর পরবর্তীতে যে চারজন এসেছে তাদের মধ্যে মেয়েটির নাম জেসি। ছেলে তিনটির নাম ইমন, আসিফ, অনিল। এরা সকলেই নীলের কলেজ ফ্রেন্ড। বন্ধুক্ত চলমান সময়েই লিসা আর ইফাজ রিলেশন করে বিয়ে করে নিয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে এটুকুই বুঝল সোহা।

আড্ডার মাঝ পথেই ইফাজ চলে এলো। ইফাজ আসাতে যেন আড্ডা টা আরও মেতে উঠেছে। ছেলেটা বেশ মজাদার। এসে থেকেই তার প্রেয়সীর অভিমান ভাঙাতে ব্যস্ত সে। এই ব্যাপারটা সোহার ভীষণ ভালো লেগেছে। সোহা ওদের থেকে বয়সে অনেক ছোট তাই সে তেমন একটা কথা বলছে না। বেশ আন-কমফোর্টেবল ফিল হচ্ছে তার। আবার এসেছে স্কুল ড্রেস পড়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে। দু পাশে দুই বিনুনি। সব মিলিয়ে পিচ্চি পিচ্চিই লাগছে তাকে। আড্ডাটা যখন বেশ জমে উঠেছে ঠিক তখনই সকলে নীলকে চেপে ধরল একটা গান গাওয়ার জন্য। নীল প্রথমে না করলেও কিছু একটা ভেবে রাজি হয়ে গেল। ইফাজ গিটার তুলে দিল নীলের হাতে। টুংটাং গিটারে সুর উঠছে সেই সাথে গান……….

“ভালবাসি হয়নি বলা তবু ভালবাসি
পাশাপাশি হয়নি চলা তবু পাশাপাশি

তোমায় নিয়ে ফুলে ফুলে
স্বপ্ন উড়াই আকাশ নীলে

তোমাতে বিভোর থাকি
আমি বারো মাস-ই”

(বাকিটুকু নিজ দ্বায়িত্বে শুনে নেবেন)

পুরো টা গানই নীল সোহার চোখে চোখ রেখে গাইল। শুরুতে সোহা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও পরে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়। সেও নীলের দৃষ্টির মাঝে হারিয়ে যায়। ভেসে যায় অজানা অনুভূতির সাগরে।

___

সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে নীল আর সোহা। আজ নীলের মনটা খুশি খুশি লাগছে। সোহা মনে মনে ভাবছে,
আসলেই মানব জাতি বরই অদ্ভুত। যে মানুষটা ফ্যামিলিতে এতটা ঔধ্যত্ব নিয়ে চলে সেই মানুষটাই বন্ধু মহলে কতটা প্রাণোচ্ছল। ফ্রেন্ড সার্কেল এমন একটা জিনিস যেখানে সবকিছু করে ফেলা যায় অনায়াসে। পৃথিবীর সব সম্পর্কের মধ্যে বন্ধুক্তের সম্পর্কের স্থানীয়ত্ব দীর্ঘকাল। সৎ সঙ্গে যেমন স্বর্গ বাস ঠিক তেমনই অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। নীল সাধারণত একদম গম্ভীর টাইপ ছেলে নয়। ফ্যামিলিতে সে সবার সঙ্গে হেসে খেলে কথা বললেও এতটা ফ্রী নয় যতটা সে তার ফ্রেন্ডদের সঙ্গে। নীল যখন ওদের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিল সোহার পিচ্চি মনটা বারংবার সেই হাসিতে ক’ত’ল হচ্ছিল। সোহার এরুপ চিন্তাধারার মাঝেই নীলের উচ্ছ্বসিত কন্ঠ,

“কেমন লাগল আজকের মুহূর্ত গুলো?”

সোহা ভাবনা থেকে বেড়িয়ে বেশ বিচক্ষণ মস্তিষ্কে উত্তর দিল,

“ভীষণ ভালো। তবে কিছু কিছু প্রশ্ন অজানা আছে?”

“কী প্রশ্ন বলে ফেল?”

“এই যেমন তোমার ফ্রেন্ড লিসা আপু আর ইফাজ ভাইয়া তাদের কী লাভ ম্যারেজ?”

“হুম । ওরা কলেজ লাইফের শুরু থেকেই রিলেশনে আছে তারপর এই সাত মাস হলো বিয়ের।”

“ওই আপু,ভাইয়া টা ভীষণ ভালো। কিন্তু ওই একটা আপু ছিল না জেসি নামে। কেমন জানি একটা। কী সব অদ্ভুত কথা বলছিল তোমায়। আচ্ছা উনি ওগুলো কেন বলল?”

নীল থতমত খেয়ে গেল। অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,

“তোকে এসব বুঝতে হবে না। এখন বাকিদের কথা বল।”

“বাকিরাও ভালো ছিল। ইমন ভাইয়াকে বেশি ভালো লেগেছে। তার জোক্স বলার ধরণটা হেব্বি।”

নীল একটু ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল,

“হুম, সবার কথাই তো বললি এবার আমারটাও বল?”

সোহা উৎফুল্ল হয়ে বলতে চাইল অনেক কিছু। নীলের হাসিমাখা রুপ,তার সুরেলা গানের গলা, তার প্রাণোচ্ছলতা সবকিছুই গভীর ভাবে রেখাপাত করেছে তার মনে। কিন্তু বলতে গিয়েও কিছু কথা রয়ে গেল অজানা। অন্তঃকরণের গরাদে আটকে চাপা পড়ে রইল। সোহা মনের সমস্ত আহ্লাদী চাওয়াকে অগ্রাহ্য করে শুধু বলল,

“তুমি ভীষণ খারাপ, খুব খারাপ। তোমার নামের আমার কাছে একটাই সংজ্ঞা “নিষ্ঠুর”। তুমি ভীষণ রকম নিষ্ঠুর। ভীষণ রকম।”

সোহা থামল। নীল অবাক হলো। পথ চলতে চলতে তার ফের প্রশ্ন,

“কেন কী করেছি আমি? যার জন্য এতটা কঠিন অপবাদ নিতে হচ্ছে?”

সোহা কিছুটা দমে গেল। নিভু নিভু কন্ঠে বলল,

“ঠিক বুঝবে একদিন। কিন্তু সেদিন আর আমি থাকব না হারিয়ে যাব বহু দুরে।”

স্বজোরে বাইকের ব্রেক কষায় টাল সামলাতে অক্ষম হলো সোহা। এক হাতে খামচে ধরল নীলের শার্টের পেছন দিকটা। চোখ বন্ধ করে নিল। নীলের সেদিকে খেয়াল নেই। রাগে কপালের রগগুলো ফুলে উঠেছে। চোখ মুখ রক্তবর্ণ। তার গম্ভীর কণ্ঠে কেঁপে উঠল সোহা। ভয়টা আরও দ্বিগুণ হলো।

“বাইক থেকে নেমে পড়।”

সোহা চোখ তুলে চাইল। বাড়িতে পৌঁছে গেছে। সে এক মুহুর্ত সময় অতিবাহিত না করে ঝটপট নেমে পড়ল। নীলের মুখের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল। নীলের দৃষ্টি সোজাসুজি। ভুলেও সোহার দিকে ফিরছে না। সোহা অনেক কষ্টে কিছুটা সাহস সঞ্চার করে বলল,

“আমি কী কিছু ভুল……”

দেখা যাচ্ছে পুরো কথা শেষ করার আগেই নীল বাইকে স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। একটানে মিলিয়ে গেছে অদুরে। সোহা দাড়িয়ে দেখল নীলের চলে যাওয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত বাইকটি দেখা গেল সে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল সেদিকে। সে কী এমন বলেছে যার জন্য এতটা রেগে যেতে হবে? আশ্চর্য….

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে