চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর ২ পর্ব-১১

0
338

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১১
#ফিজা_সিদ্দিকী

সম্পর্কের টানাপোড়নে দুটো মানুষ এমনভাবে আঁটকা পড়েছে, যা ছিন্ন করার সাধ্য কারোর নেই। অথচ তারা চেয়েছিল একটু ভালো থাকতে। একসাথে একে অপরের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িয়ে জীবনের বাকি সময়টায় পাড়ি দিতে। অথচ ভাগ্যের লিখন কি তা জানার সাধ্য কারোর নেই।

সুখ আসে যাওয়ার তরে। আর দুঃখ আসে জরা জীর্ণ, বেদনার সাথে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলে। আমরা যতোই আঁকড়ে ধরতে চাই না কেনো সুখ তবুও ক্ষণস্থায়ী। আর দুঃখ দীর্ঘকায়। অথচ তবুও ওই ক্ষণস্থায়ী সুখের জন্যই আমাদের বেঁচে থাকা। এতো কষ্ট, ক্লেশ সহ্য করা।

সময়ের স্রোতে বাড়তে থাকা অসহনীয় দ্বিধা দ্বন্দ আর দূরত্বের অদৃশ্য দেয়াল টপকে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে সেদিন শ্রেষ্ঠার কাছে গিয়েছিলো আরাধ্য। তীব্র ভালোবাসার কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছিলো ক্ষণিকের রাগ অভিমানের অস্তিত্ব। সমস্ত দ্বিধা, সংকোচ দূরে ঠেলে আবারও সেই দরজার চৌকাঠে উপস্থিত হয়েছিলো আরাধ্য, যেখান থেকে অপমান হয়ে ফিরে গিয়েছিলো সে। এ জীবনে তার অপরাধ কী সে জানে না। শুধু এটুকু জানে শ্রেষ্ঠাবিহীন একটা জীবন বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই কারণে যদি তাকে বেহায়া হতে হয়, সে প্রস্তুত। কিন্তু তার সমস্ত মনোবল, ভালোবাসা এক লহমায় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় শ্রেষ্ঠার বুক শেলফ থেকে পাওয়া সেই ডায়রির প্রথম পাতা উল্টাতেই। সার্থকের একটা ফটোতে খুব সুন্দর করে মার্কার দিয়ে ক্রস করা। ব্যাস এটুকু দেখেই দুনিয়া থমকে যায় তার। এলোমেলো হয়ে যায় এতদিনের ভালোবাসা, বিশ্বাসে গড়ে তোলা সম্পর্কের নিবিড় স্তম্ভ। শরীরের চামড়া ভেদ করে কেউ যেনো ছুরি চালাচ্ছে অনবরত তার বুকে। সারা শরীর অসহনীয় ব্যথায় বশ হয়ে যাচ্ছে। এতোখানি বিস্ময় বোধহয় এতো বছরের জীবনে কখনো হয়ে ওঠা হয়নি তার। দূরত্ব ঘুঁচাতে গিয়ে আরও খানিকটা দূরত্বের জোগাড় হলো দুজনের মাঝে।

২৪.

বিগত কয়েকদিনের অফিসের কাজে ফুরসৎ পাওয়ার মতো সময় হয়ে ওঠেনি আরাধ্যর। সেদিন বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে শ্রেষ্ঠার ডায়রিটা নিয়ে এসেছিলো সাথে। অথচ সেই ঘটনার সপ্তাহ পেরিয়েছে। এরপর সারাদিন অফিসের মিটিং, ক্লায়েন্ট অ্যাটেন্ড আর বিদেশি কিছু প্রজেক্টের কাজ এমনভাবে ফেঁসে গিয়েছিলো যে ডায়রির কথা বেমালুম ভুলে গেলো। সকাল সকাল বেরিয়ে আবার রাত করে বাড়ি ফেরা। ফোনটাও হাতে নেওয়ার মতো সময় হতো না সেভাবে। এতো এতো ব্যস্ততার অবসান ঘটিয়ে আজ থেকে ফ্রী সে। আপাতত একটা সপ্তাহ সে একেবারেই ফ্রী। মাঝে বেশ কয়েকবার শ্রেষ্ঠা কল দিলেও ঠিক মতো কথা হয়নি দুজনের। ফলস্বরূপ সেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে অনেকখানি। নিজের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে অদৃশ্য এক বদ্ধপরিকর দেওয়াল দ্বারা।

বিকাল থেকেই আকাশে গুমোট ভাব। কেমন যেনো নীরবতায় আচ্ছন্ন চারপাশ। ঠিক যেমন ঝড় ওঠার পূর্বের নীরবতা। বাতাসে কেমন যেনো হাহাকারের রেশ। আরাধ্য উশখুশ করছে। অস্থির পায়ে পায়চারী করছে রুমের মধ্যে। ডায়রিটা খোলার সাহস পাচ্ছে না সে। মন বলছে অপ্রিয়র থেকেও অতি অপ্রিয় জিনিস আছে সেখানে। ঠোঁট গোল করে জোরে জোরে শ্বাস ছাড়লো বার কয়েক। অতঃপর বেডের পাশের টেবিলে অবহেলায় পড়ে থাকা কফির কাপে চুমুক দেওয়ার বদলে ঢক ঢক করে এক নিঃশ্বাসে গিলে ফেললো পুরোটা। আশ্চর্য্যের বিষয় হলো অস্থিরতার তীব্রতায় ধোঁয়া ওঠা কফির উষ্ণতার হদিস পেলো না সে। কেমন যেনো দমবন্ধ লাগছে। অতঃপর ব্যালকনির দরজা খুলে খোলা বাতাস টেনে নেওয়ার চেষ্টা করলো। খানিকটা শান্ত লাগলো এবার বোধহয়। তবে অস্থিরতা কমার নাম নেই।

সন্ধ্যার আগেই সন্ধ্যা নেমেছে প্রকৃতিতে। হালকা শীতের দিনেও আকাশে গুমোট ভাবের জন্য কেমন ঊষ্ণ ঊষ্ণ ভাব। আরাধ্য ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সময় চারটে বেজে পনেরো। অথচ আকাশ অন্ধকার। আকাশের বুকেও কী তবে মেঘ জমেছে? অন্ধকার নেমেছে তার জীবনেও? ঠিক যেমন আরাধ্যর হচ্ছে!

বড়ো বড়ো কয়েকটা দম নিয়ে সাহস সঞ্চয় করলো আরাধ্য। অতঃপর ধীরে ধীরে খুলে ফেললো ‘প্রতিশোধ’ নামক ডায়রিটা। সার্থকের ছবির নিচে বড়ো বড়ো করে লেখা তার মৃত্যুর ডেট। সার্থকের লাশ পাওয়া গিয়েছিলো তার মৃত্যুর পাঁচদিন পর। সেই মর্মান্তিক দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলে ধৈর্য্যশীল, শান্ত স্বভাবের আরাধ্যও অশান্ত হয়ে পড়ে। শরীর হিম হয়ে আসে। এতোখানি নৃশংসভাবে কেউ কাওকে আঘাত করতে পারে, প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের মৃতদেহ দেহ দেখার আগে জানাই ছিলো না তার। পুরো মুখে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন। বেশ ধারালো কোনো ছুরি দ্বারা বেশ নকশা করে আঁকা কোনো কারুকাজ যেনো। বুকের মাঝে আড়াআড়ি ভাবে গভীর ক্ষত বেশ কিছু। মাংসপেশী পচে গিয়ে তার রূপ ধারণ করেছিলো বিভিৎস। শরীরের বিভিন্ন অংশ পচে গিয়ে চামড়ার সাথে শিরা ফেটে যাওয়ার মতো দৃশ্য দেখে শরীর শিউরে উঠছিলো। পুলিশ নিজেও হতভম্বের মতো তাকিয়ে ছিলো লাশের দিকে কয়েকক্ষণ। লাশ চেনার কোনো উপায় নেই। লাশের কাছ থেকে পাওয়া জিনিসপত্র দেখে তাকে শনাক্ত করার জন্য ডাক পড়েছিলো আরাধ্যর। কাঁপা কাঁপা পায়ে রুমে ঢোকার আগে আরাধ্য বার বার করে চাইছিলো এটা যেনো তার বড়ো ভাই না হয়। সার্থককে ভীষণ ভালোবাসে আরাধ্য। বাবা চলে যাওয়ার পর এই মানুষটাই বটগাছের মতো ছায়া দিয়েছিলো মা আর তাকে। অথচ এই মানুষটাকে এভাবে এই অবস্থায় দেখে নিজের মধ্যে ছিলো সে না। সকলের সামনেই হাঁটু মুড়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো। মনের ভেতর জ্বলতে থাকা ক্রোধের আগুনে তুষ দেওয়ার কাজ করেছিলো ফরেন্সিক রিপোর্ট। প্রাথমিকভাবে এটাকে এক্সিডেন্ট বলে মেনে নেওয়া হলেও ক্ষতগুলো অস্বাভাবিক ছিলো। ফলস্বরূপ লাশ পাঠানো হয় পোস্টমর্টেম করার জন্য।

সার্থকের মৃত্যু প্রী প্ল্যানড খুন। ব্যপারটা আগে থেকেই জানতো আরাধ্য। তবে এই ডায়রি আর তার মালিকানায় থাকা মানুষটাই যে সেই খুনি, সেটা কল্পনাতীত ছিলো তার কাছে। ভেতরটা ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে যেনো। এতো যন্ত্রণা! তার যে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে! এতোগুলো বছর যে মানুষটাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিলো সে, তার এতো কাছে ছিলো তার অবস্থান! শুধু কাছে নয়, বরং তার অন্তর জুড়ে ছিল সে। সেই মানুষটাকে ঘিরে সাজিয়েছিল অজানা ভবিষ্যতের অসংখ্য চিত্র। থম মেরে বসে রইলো আরাধ্য। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো কতো শত মানুষের চেহারা। রহস্যময় খুনের সব ঘটনা। যা নিয়ে এতোদিন মাথা ঘামায়নি, আজ সবকিছুই তার চোখের সামনে পরিষ্কার। চাইলেও ঘৃনা করতে পারছে না সে শ্রেষ্ঠাকে। তবে মনের মাঝে সৃষ্টি হওয়া এক বিতৃষ্ণার তিক্ত সুর ভেতরটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কেউ যেনো আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে তার শরীরে। দাউ দাউ করে জ্বলছে তার পুরো শরীর। হতভম্ভ, হতবুদ্ধি হয়ে সেই যে ব্যালকনিতে বসেছিলো আরাধ্য, ওভাবেই কখন যে রাত পেরিয়ে গেলো ইয়াত্তা নেই। ভোরের আজান কানে ভেসে আসতেই ঘোর কাটে তার। চোখ দুটো জ্বলছে ভীষণ। টুপ করে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে। তাচ্ছিল্যকর হাসি দিয়ে সেই জলটুকু মুছে ফেলতেই ঘটলো আরও কয়েক ফোঁটা জলের আনাগোনা। তপ্ত শ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে গিয়ে লম্বা শাওয়ার নিয়ে নামাজে দাড়ালো সে। আজ অনেকগুলো দিন পর নামাজ আদায় করতে ভীষণ ইচ্ছে করছে আরাধ্যর। মনের মাঝে ঘটতে থাকা তোলপাড় বাইরের ঝোড়ো হাওয়ার চেয়েও উন্মাদ। সারারাত ঝোড়ো হাওয়ার সাথে সাথে বৃষ্টিও হয়েছে খানিক। অথচ এসবের কিছুই টের পায়নি সে।

২৫.

হাইওয়ের রাস্তা ধরে শো শো শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে একটা ধূসর রঙের গাড়ি। ভেতরে পিনপতন নীরবতা। শ্রেষ্ঠা আড়চোখে তাকাচ্ছে আরাধ্যর দিকে। তার চোখমুখ লাল। নির্ঘুম, ক্লান্ত চেহারায় কী যেনো একটা খেলা করছে। হুট করে সকালে শ্রেষ্ঠাকে মেসেজ দিয়ে একসাথে লং ড্রাইভে যাওয়ার আবদার জানায় আরাধ্য। সেই সাথে ক্রমে বাড়তে থাকা তাদের মাঝের দূরত্বের একটা মীমাংসা প্রয়োজন। শ্রেষ্ঠা এতগুলো দিন মিলিয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছে অনেকখানি। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরাধ্যকে আর এড়িয়ে চলবে না সে। তাদের সম্পর্কটা এবার স্বাভাবিক করা উচিৎ। আর যাইহোক সার্থকের ভুলের শাস্তি তো আরাধ্যকে দেওয়া যায়না। আর আরাধ্য সার্থকের ভাই হলেও দুজনের চরিত্রের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ। এক কথায় দুজনকে দুই প্রান্তের মানুষ বলে মনে হয়, এতোখানি ফারাক। সব মিলিয়ে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ে একসাথে নতুন করে জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আদৌ কি নতুন করে কিছু গুছিয়ে উঠতে পারবে তারা? নাকি এই শুনশান নীরবতা বড়ো কোনো ঝড়ের সংকেত!

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে