চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর ২ পর্ব-১০

0
335

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১০
#ফিজা_সিদ্দিকী

সার্থক আহসান রুদ্র। নামটুকু দেখেই আতঙ্কে, উত্তেজনায় শরীরের আদ্যোপান্ত জুড়ে অদ্ভুত এক আলোড়নের রেশ ছড়িয়ে পড়ে। অদ্ভুতভাবে ঘামতে থাকে আরাধ্যর শরীর। শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ে শিহরণ। তিক্ত অথচ বিস্ময়কর অনুভূতিরা রক্তের চেয়েও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেহ প্রান্তে। নির্বাক, হতবুদ্ধি আরাধ্য নিজেকে ক্ষণিক সময়ের জন্য সামলাতে ব্যর্থ হয়ে ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে। তার মন বলছে বিষের চেয়েও বিষাক্ত কিছুর সাক্ষী হতে চলেছে সে। অস্বস্তিতে দরদর করে ঘামছে শরীর।

“আরাধ্য!”

শ্রেষ্ঠার কণ্ঠ শুনে আচমকা কেঁপে ওঠে আরাধ্য। ধ্যান জ্ঞান ভুলে শুন্য দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। মাথায় উপর ফ্যান ঘুরছে আপন গতিতে। তবুও ঘামে জুবুথুবু অবস্থায় আরাধ্যকে দেখে ভ্রু কুঁচকে সন্ধিহান চোখে তাকায় সে। আচমকা ভোল পাল্টে যাওয়ার মতো কোনো কারণ না খুঁজে পেয়ে সে এগিয়ে যায় আরাধ্যর কাছে।

বেশ কিছুদিন ধরে চলতে থাকা অন্তর্মুখী যুদ্ধের একটা মীমাংসা প্রয়োজন। মূলত এ কারণেই আজ আরাধ্যর এই বাড়ীতে আসা। শ্রেষ্ঠার মুখোমুখী হওয়া। সেদিন বিধ্বস্ত অবস্থায় শ্রেষ্ঠাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এক মুহুর্তের জন্যও সস্তি পায়নি আরাধ্য। ফলস্বরূপ বাড়ী পৌঁছেই কল করে শ্রেষ্ঠাকে। অথচ দুপুর গড়িয়ে বিকাল, বিকাল গড়িয়ে রাত হয়ে গেলেও ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। যেনো ওপাশের মানুষটা ইচ্ছে করেই তার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে না। অথচ দুজনের মাঝে এহেন আচরণের যৌক্তিক কোনো ঘটনাই ঘটেনি। চিন্তায় পুরোটা রাত নির্ঘুম কেটেছে তার। সকাল হওয়ার সাথে সাথেই শ্রেষ্ঠার ফ্ল্যাটের সামনে এসে সমানে কলিং বেল বাজালেও গেট খুললো না কেউই। সারারাত নির্ঘুম থাকার ফলে আরাধ্যর চোখ দুটো লাল টকটকে। ফুলেছেও কিছুটা। সেই সাথে জ্বলছে ভীষণ। উস্কখুস্ক চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। কেনো যেনো ছন্নছাড়া, সর্বহারা এক দুর্বিষহ জীবন সত্তার প্রলেপ পুরোটা জুড়ে। খানিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও কেউ দরজা খুললো না। তবে সেই মুহুর্তে টুং শব্দে বেজে উঠলো আরাধ্যর ফোনের মেসেজ টোন। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা মাত্র কয়েকটা বাক্য।

“স্রোতে ভেসে গিয়ে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো বোধহয় ঠিক হয়না সবসময়। জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে হয় ভেবে চিন্তে। আমি আমার ভাবনার সময় চাই। ততোদিন কোনোরূপ যোগাযোগ কিংবা হস্তক্ষেপ চাইছি না। ব্যবহার প্রেক্ষিতে এটা বোধহয় বুঝে যাওয়া উচিৎ ছিলো।”

হতবাক দৃষ্টিতে আরাধ্য তাকায় বন্ধ দরকার দিকে। কেমন যেনো পাগল পাগল লাগছে তার। হুট করে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই মস্তিকে প্রবেশ করছে না যেনো। কী ঘটছে, কেনো ঘটছে কোনো সমীকরণই মেলাতে পারছে না সে। পুরোটা মেসেজের শেষ লাইনটাই শুধু বারংবার আঘাত হানছে মস্তিষ্কে। সেই সাথে মনের মাঝে চলছে তীব্র আলোড়ন। চলে যেতে গিয়েও সেদিন একবার শুধু পিছু ফিরে তাকিয়েছিল সেই বন্ধ দরজার দিকে। এরপর আর ফেরেনি এই মুখে। যতোই কষ্ট হোক না কেনো একটা বারের জন্যও ফেরেনি সে। তবে মাঝে মাঝেই ফোনে ডায়াল করতে গিয়েও কেটে দিয়েছে শ্রেষ্ঠার নম্বর। কেনো যেনো মন সায় দেয়নি তার। সেদিনের প্রতিটা কথার মাঝে সূক্ষ্মভাবে অপমানের তীর ছুঁড়ে দিয়েছিলো যেনো শ্রেষ্ঠা।

একটা মানুষের এতখানি ভালোবাসার বিপরীতেও এতটা অগ্রাহ্য করার মতো ব্যবহার কী আসলেই সহনীয়? সেও তো মানুষ। রাগ, অভিমান, জেদ, ইগো, আত্মসম্মানবোধ, সবই আছে তার মাঝে। কষ্ট তো তারও হয়। ভালোবাসা তো অন্যায় নয়। আবার সেটা সামনের মানুষটার সামনে প্রকাশ করাটাও কোনো অন্যায় কাজ নয়। কিন্তু যদি সেই ভালোবাসার দাবি নিয়ে সে বিরক্ত করতো, তবে হয়তো সেটা অন্যায় হতো। অন্যায় হতো অপর পক্ষের মানুষটার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার সামনে বারংবার ভালোবাসা জাহির করা। কিন্তু তাদের সম্পর্ক তো এমন নয়! এমনকি শ্রেষ্ঠা নিজেই স্বীকার করেছে তার ভালোবাসা। স্বীকৃতি দিতে চেয়েছে তাদের নামহীন সম্পর্কের। তবে কিসের এত অবহেলা? নাকি শুধু রূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ্য মানুষ মনে করে তাকে এহেন অপমানাত্বক কথা শোনাতে পারছে?

দুটো সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে। আরাধ্য নিজের মতো জীবনযাপনের চেষ্টায় ভীষণভাবে ব্যস্ত। এহেন সময় হুট করেই কল আসে শ্রেষ্ঠার। গুরুতর মিটিং চলাকালীন সময়ে আসা ফোনটা অগ্রাহ্য করতে বাধ্য হয় আরাধ্য। ত্রিশ মিনিট সময়ের মাঝে মোট দুইবার কল করেছে শ্রেষ্ঠা। মিটিং রুম থেকে বের হয়ে বাকি কাগজপত্র রেডি করতে করতে দুই ঘণ্টা পেরিয়েছে। এর মাঝে আর কোনো কল না আসায় শ্রেষ্ঠার ব্যপারটা একেবারেই ভুলতে বসেছিলো সে। ফাইল রেডি করে জরুরি এক কল করার প্রেক্ষিতে ফোন উঠিয়ে হাতে নিতেই আরাধ্যর আচমকা মনে পড়ে শ্রেষ্ঠার কথা। ঘড়ির কাঁটা তখন তিনটে বেজে পঁচিশ। তৎক্ষণাৎ কল ব্যাক করে আরাধ্য। বিনয়ী ভঙ্গিমায় হ্যালো বলার সাথে সাথে ওপাশ থেকে ভেসে আসে তাচ্ছিল্যকর এক কণ্ঠস্বর।

“ডেটে ছিলে বুঝি? খুব বেশি ডিস্টার্ব করিনি তো? উম করেছি মনে হয়। আই অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি।”

“এগুলো কেমন ধরনের কথা শ্রেষ্ঠা? আগে তো এভাবে কথা বলতে না আমার সাথে? তোমার কথা বলার ভঙ্গি কেমন বিশ্রী রকম লাগছে। কী হয়েছে তোমার?”

ফোনের ওপারে সশব্দে হাঁসে শ্রেষ্ঠা। একেবারে অট্টহাসি যাকে বলে। অতঃপর হাসতে হাসতেই নিজেকে কোনরকম কন্ট্রোল করে বলে,

“আই সি। আই সি মিষ্টার আরাধ্য খান। আমাকে তো এখন বিশ্রী লাগবেই। এটা একেবারেই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিছুদিন পর রেডিকিউলাস বলবেন। এরপর…”

আর কথা বলতে পারলো না শ্রেষ্ঠা। হো হো করে হেঁসে উঠলো সে। আরাধ্যর কেনো যেনো মনে হচ্ছে শ্রেষ্ঠা আদৌ হাসছে না। করোর হাসি এতো করুন হয় বুঝি? কারোর হাসির শব্দে বুকে চিনচিন ব্যথা হয় বুঝি? কেনো যেনো তার মনে হচ্ছে জীবনের সমস্ত তিক্ততা সে ব্যক্ত করছে এই হাসির মাধ্যমে। শব্দটা হাসির হলেও আদতে সে কাঁদছে। মুখে হাসি থাকলেও তার চোখে জল টলটলে। তবে কী আসলেই কাঁদছে শ্রেষ্ঠা। কোনো কারণে কষ্ট পেয়েছে সে? কে দিলো তাকে এই কষ্ট? সে নিজে নয় তো? কিন্তু কষ্ট দেওয়ার মতো কোনো কাজ কি আদৌ সে করেছে?

“শ্রেষ্ঠা”

কথার ভঙ্গিমা শান্ত। শীতল তার কণ্ঠস্বর। এটুকু একটা কথায় কী যেনো ছিলো। থেমে গেলো শ্রেষ্ঠার হাসি। কিছু সময় নীরবতা। এরপর হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। সেই কান্নার শব্দ যে মুখ চেপে ধরে নিবারণ করার চেষ্টা করছে কিংবা গিলে ফেলতে চাইছে তা বুঝতে এক মুহুর্তও দেরি হলো না আরাধ্যর। তাই আর সময় অপচয় না করে কথা বলতে বলতেই সে বেরিয়ে পড়লো শ্রেষ্ঠার বাড়ির উদ্দেশ্যে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নিলো সময়। চারটে বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। শ্রেয়ার স্কুল ছুটির সময় হয়েছে। অতঃপর কাউকে একটা মেসেজ করে বলে দিলো শ্রেয়াকে স্কুল থেকে ড্রপ করার জন্য। সেইসাথে আজকের পুরো বিকেলটা যেনো তাকে নিয়ে পার্কে ঘুরে বেড়ায় সে, এমন নির্দেশনা ও দিলো।

“তোমরা সবাই এক আরাধ্য। আমি কেনো চিনতে পারলাম না। কেনো বলো? কেনো এলে আমার জীবনে তুমি? এভাবে বাঁচতে যে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আমি সাধারন চিন্তা করতে পারছি না কিছু। সবসময় যেনো কোনো আতঙ্কের মধ্যে বাঁচছি। এ জীবনে আমার নিস্তার কী তবে নেই আর? আই অ্যাম ফেডেড আপ।”

“দরজা খোলো।”

এতোখানি আবেগী কথার বিপরীতে এহেন উত্তর আশা করেনি শ্রেষ্ঠা। সেই সাথে হুট করে এমন কথা শুনে খানিকটা সময়ের জন্য হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলো সে। অতঃপর মস্তিক সাড়া দিতেই বুঝতে দেরি হয় না যে আরাধ্য দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। বিনা বাক্য ব্যয়ে হলরুম পার হয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় সে। মুখোমুখী হয় দুজনে। দুজনের কানেই চেপে ধরা মুঠোফোন। দরজার দুই পাশের মানুষটাই বিধ্বস্ত। কেমন যেনো ছন্নছাড়া। এই কয়েকদিনেই শ্রেষ্ঠার উজ্জ্বল চেহারার খেই হারিয়ে গেছে যেনো। কেমন বিবর্ণ, ফ্যাকাশে লাগছে তাকে। কী ভীষণ রকমের হাড় হিম করা থমথমে।

#চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে