চিলেকোঠার ভাঙ্গা ঘর ২ পর্ব-১২

0
334

#চিলেকোঠার_ভাঙ্গা_ঘর
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_১২
#ফিজা_সিদ্দিকী

“লং ড্রাইভে বেরিয়েছ নাকি রেসিং কম্পিটিশন? স্পিড এতো বেশি রাখার কোনো মানে হয়?”

শ্রেষ্ঠার কপট রাগী মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দেয় আরাধ্য। শ্রেষ্ঠার রাগ বাড়ে। বিগত ত্রিশ মিনিট ধরে তারা চুপচাপ বসে আছে পাশাপাশি। না আরাধ্য আগ বাড়িয়ে কিছু বলছে আর না তাকে কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছে।

“আরাধ্য, গাড়ি থামাও।”

থমথমে কণ্ঠ শ্রেষ্ঠার। আরাধ্য এবার যেনো খানিকটা শব্দ করেই হেসে উঠলো। এই অসময়ে তার এহেন হাসি দেখে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালো শ্রেষ্ঠা। আজকে যেনো একদম অন্যরকম লাগছে তাকে। একেবারে উন্মাদ, পাগলপ্রায়, ছন্নছাড়া যার হাবভাব। কোনো কারণ ছাড়াই হুট করে খানিকটা ভয় লাগছে শ্রেষ্ঠার। পর পর ঘটে যাওয়া সব ঘটনা কেমন যেনো গোলমেলে ঠেকছে। অকারনেই শুকনো ঢোক গিলে আরাধ্যর কাঁধে হাত রাখতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আরাধ্য। আরাধ্যর চোখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে সে। গাঢ় লাল ফোলা ফোলা চোখ। অথচ শীতল, শুনশান তার হাবভাব। এতক্ষণের দমিয়ে রাখা ভয়টা এতক্ষণে মাথা চাগাড় দিয়ে উঠলো। চকিতে হাত সরিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কিছু বলে ওঠার আগেই ভেসে আসে অপর পাশের মানুষটার গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

“জীবনের মতো গাড়িও আজ নিয়ন্ত্রণহীন। পথ ভুলে গেছে থামার।”

“মানে?”

কৌতুহলে উদ্ভূত শ্রেষ্ঠার বিচলিত চেহারা দেখে খিলখিল করে পাগলের মতো হেসে উঠলো আরাধ্য। অতঃপর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,

“ভয় পাচ্ছো নাকি?”

“ভয় পাবো কেনো? ভয় পাওয়ার কিছু তো দেখছি না। তবে তোমাকে বেশ অস্বাভাবিক লাগছে।”

“স্বাভাবিক আর থাকতে দিলে কই?”

“দেখো আরাধ্য, আমি বেশ কিছুদিন ধরে সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগছিলাম। তোমার কাছে সময় চেয়ে নিয়েছিলাম নিজেকে সামলানোর। আর আজ বোধহয় সেই সময় ফুরিয়েছে। আমি আমাদের থেমে যাওয়া সম্পর্কটাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে চাই।”

“আসলেই বোধহয় সময় ফুরিয়েছে। তবে সেটা আমাদের জীবনের।”

“কিসব আবোল তাবোল বলছো তুমি আরাধ্য? মাথা ঠিক আছে তোমার?”

“সজ্ঞানে আছি। চলো মৃত্যুর আগে কিছু সত্যি জেনে নেওয়া যাক। সেই সাথে জানিয়ে দেওয়া যাক অজানা কিছু ঘটনা কিংবা কাহিনী যাই। এই যে গাড়িতে তুমি বসে আছো আমার পাশাপশি সিটে, এই গাড়ির ব্রেক ফেইল। আর যে রাস্তা দিয়ে আমরা যাচ্ছি চারিদিকে তাকিয়ে দেখো একদিকে উঁচু পাহাড়ের পাথর আর একদিকে খাদ।”

আরাধ্যর কথা শুনে আঁতকে উঠে বাইরে তাকালো শ্রেষ্ঠা। এতক্ষন নিজের চিন্তায় বিভোর থাকার ফলে এসব কিছুই খেয়াল করেনি সে। আরাধ্যর প্রতিটা কথা হুবহু সঠিক। গতিশীল গাড়ি কোনোভাবে যদি ডানপাশের পাথরে ধাক্কা লাগে, তবে ছিটকে সোজা গিয়ে পড়বে খাদে। আবার বামপাশে গেলেও সোজা পড়বে অগভীর সেই খাদে। আতঙ্কে প্রাণ ওষ্ঠাগত তার। ক্রমাগত সিক্ত জীভ দিয়ে ভিজিয়ে নিচ্ছে নিজের রুক্ষ, শুষ্ক ঠোঁট।

“কেনো এমন করলে আরাধ্য? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। ভালোবাসার দাবি নিয়ে তুমি এসেছিলে। আমি তো প্রাথমিকভাবে প্রশ্রয়ও দিইনি।”

শ্রেষ্ঠার কান্নাসিক্ত করুন কণ্ঠে শুনে ব্যঙ্গাত্মক হাসে আরাধ্য। অতঃপর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে,

“মেয়েদের প্রতি বিতৃষ্ণার সবচেয়ে বড়ো কারণ ছিলো ভাইয়ার ব্রেকআপ। মেয়েটার জন্য কতো রকম পাগলামী করতে দেখেছি তাকে। ছোটো বয়সে ভাইয়াকে দেখেছি বেধড়ক মার খেতে বাবার হাতে। এতো বড়ো ছেলে হয়েও হাউমাউ করে কান্না করতে করতে রাত পার করা দেখেছি। একটা মানুষকে কতখানি ভালোবাসলে মানুষ এমন হতে পারে আমার জানা ছিলো না সেই বয়সে। তবে শুধু ঘৃনা করতাম মেয়েটাকে। কারন তার কারণেই ভাইয়াকে এতো কষ্ট পেতে হতো। অথচ যে মেয়ের জন্য ভাইয়ার এতো লড়াই। যে মেয়েকে অল্প বয়সে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছে বলে ঘর বন্দী হয়ে এতো মার খেয়ে হয়েছে তাকে। সেই মেয়ে নির্দ্বিধায় বেছে নিলো সুখের সংসার। ভাইয়ার ভালোবাসা, ত্যাগ সবকিছুকে পাগলামির নাম দিয়ে বাড়ীর পছন্দে বড়োলোকের এক ছেলেকে বিয়ে করে নিলো।”

এটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আরাধ্য। এতক্ষনে শ্রেষ্ঠা বুঝে গেছে সার্থকের মৃত্যুর ব্যাপারে কিছুটা হলেও জেনেছে আরাধ্য। আর এসবের পিছনে থাকা মানুষটাকেও চিনে ফেলেছে। তবে সে কতটুকু আর কিভাবে জেনেছে সেটা জানে না। এতটুকু না জানা পর্যন্ত পরবর্তী ঠিক কী করা উচিৎ সিদ্বান্ত নিতে পারছে না সে। অগত্যা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই নোংরা পূরুষের জীবনকথা শুনতে হচ্ছে তাকে।

“শক্ত সামর্থ্য ভাইয়া হয়ে পরলো জীর্ণ। নানান রকম মানসিক চাপে বিধ্বস্ত। যেনো কোনোভাবে উঠে দাড়ানোর শক্তি পাচ্ছেন না। এখান থেকেই মেয়েদের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মায়। একপ্রকার অসহ্য লাগতো। স্কুল, কলেজেও মেয়েদের সবসময় এড়িয়েই চলা আমার অভ্যাসে পরিণত হলো। তবুও জীবন চলছিলো বেশ ভালই। কিন্তু হুট করে পূর্ণিমার রাত শেষ হয়ে হুট করে আমাদের জীবনে নেমে এলো ঘোর অমাবস্যা। কালো অন্ধকারে ঘনঘটা জীবন পাড়ি দিলাম, যখন বাবা মারা গেলেন হার্ট এ্যাটাক করে। ভেঙ্গে পড়া ওই মানুষটাকে সেই মুহুর্তে শক্ত সামর্থ্য হতে দেখেছিলাম। একা হাতে বড়ো ছেলে নয় বরং বাবার ভূমিকা পালন করতে দেখলাম। একদিকে বাবাকে হারিয়ে শোকাচ্ছন্ন পরিবার। অন্যদিকে ভাইয়ার পরবর্তন। বাবার বিজনেস দেখাশোনার সাথে সাথে নিজের পড়াশোনাও কন্টিনিউ করে ভাইয়া। এক কথায় বাবার পরে মাথার উপর ছাদ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই হুট করে একদিন তাকে খুঁজে পাওয়া যায়না। এরপর এরপর…”

আরাধ্যর গলা ধরে আসে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে দুই ফোঁটা জল। সেই জল মোছার কোনো চেষ্টা করলো না সে। আজ চোখের কোল ঘেঁষে গড়িয়ে পড়া জল মোছার তাগিদ নেই তার মাঝে।আজকের পর থেকে তো সমাজের মুখোমুখী হতে হবে না আর তাকে। তবে কিসের ভয়ে আর কান্নাগুলো আঁটকে রাখবে? আজ নাহয় তারা গড়িয়ে পড়ুক অবাধে।

২৬.

রুমের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারী করছে নির্ঝর। সকাল সকাল আরাধ্যর মেসেজ পেয়ে ছুটে আসে এই বাড়িতে। অথচ বাড়ির কোথাও তার দেখা নেই। অগত্যা মেসেজ অনুযায়ী রুমে গিয়ে আলমারি থেকে কাঙ্খিত জিনিসটা বের করে সে। কালো রঙের ডায়রির সাথে একটা চিঠি।

প্রিয় নির্ঝর,

বন্ধুর চেয়েও বেশি ভাই তুই আমার। বাবা মায়ের আর একটা ছেলে। কখনও ভাবিনি আজকের দিনটা আসবে আমার জীবনে। সময়ের অভাবে চেয়েও সবটা বলা হয়নি তোকে। তাই এই শেষবেলায় জানাতে হচ্ছে। আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েছি আজ। যে মানুষটাকে পাগলের মতো খুঁজে বেরিয়েছিলাম আমরা, সে আমাদের খুব কাছেই ছিল। হ্যা, শ্রেষ্ঠা খুন করেছে ভাইয়াকে। অনেকবার ভেবেছি ওকে মেরে ফেলবো। কিন্তু ওকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো বলতে পারিস? প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত মৃত্যু যন্ত্রণা সমান হবে। এর চেয়ে ভালো দুজনের একসাথে মরে যাওয়া। মাকে দেখে রাখিস। ভালো থাকিস।

চিঠিটা পড়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো নির্ঝর। শ্রেষ্ঠার জীবনের ওপিঠের কালো অধ্যায়টা কিভাবে জানলো আরাধ্য? রহস্যময়ী প্রতিটা খুনের মাস্টারমাইন্ডকে হন্যে হয়ে খুঁজতে গিয়েই এই রহস্যের জাল ভেদ করেছিলো সে। কিন্তু এসবের আসল কারণ আজও অজানা তার কাছে। তবে প্রতিটা মার্ডার কেসের ফাইলগুলো খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, শ্রেষ্ঠার খুন করা প্রতিটা মানুষই ছিলো এক একজন দাগী আসামি। এই রেকর্ডে আজ পর্যন্ত কোনো ভালো মানুষ ধরা পড়েনি। একদিক থেকে শ্রেষ্ঠা আইনের কাজে সাহায্য করেছে। আবার অপরদিক থেকে দেখতে গেলে সে নিজে আইন হাতে তুলে নিয়েছে। তবে অন্যায়কে বিনাশ করার জন্য নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়াকে সে অন্যায় মনে করে না। শ্রেষ্ঠার এই গোপন সত্যিটা জানার পর থেকেই নির্ঝর আরও বেশি ঝুঁকে পড়েছিলো তার দিকে। শ্রেষ্ঠার মতো সুন্দরী, ঠিক সুন্দরী নাহ আগুন সুন্দরী মেয়ের বুদ্ধিমত্তা আর উপস্থিত বুদ্ধি প্রশংসনীয়। সেই সাথে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর প্রবনতা। নিজের জীবনের বাজি রেখে অন্যায়ের ধ্বংস কে বা করতে পারে? এই চেষ্টাই বা কতোজন করে? সবাই তো আজকাল নিজের সুখটাই আগে দেখে।

রাতের আড়ালে লুকিয়ে রাখা নিজের আরও এক সত্তার দুর্ধর্ষ কাহিনী, এসব কিছুই অনেক বেশি আকর্ষণ করেছিলো সার্থককে। মেয়েটাকে জানতে গিয়ে, তার ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে, তাকে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে, কখন যে ভালোবেসে ফেললো তার হদিস ছিলো না নির্ঝরের। তবে যতোদিনে নিজের অনুভূতিপ্রবন হৃদয়ের উপচে পড়া ভালোবাসার কথা জানানোর সময় হয়েছিলো, ততদিনে শ্রেষ্ঠা আরাধ্যর হয়ে গেলো। গড়ে উঠলো তাদের মধ্যে ভালোবাসা নামক মিষ্টি এক সম্পর্ক। প্রথমদিকে কষ্ট পেলেও নিজেকে সামলে নেবার ক্ষমতা সার্থকের আছে। ছোটো থেকেই বেশ সংগ্রাম করে বড়ো হওয়ায় জীবনের চাওয়া পাওয়া জিনিসটা বেশ কম তার। আবার যা পায়না তা নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও ভুল পথে ছুটে যাওয়ার প্রবণতাও কম। কারন অভাবের সংসারে অপ্রাপ্তি আর না পাওয়ার হাহাকার ছিলো কানায় কানায়। কখনও সেই অপ্রাপ্তি খাবারের তো কখনো বাসস্থানের।

#চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে