চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-০৪

0
1859

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-৪
#আর্শিয়া_সেহের

আলোয় ঝলমল করছে প্রকৃতি। রৌদ্রের তেজ খুব একটা নেই। প্রকৃতিতে কোলাহল বেড়ে গেছে।
শান চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে রুমঝুমের দিকে বার কয়েক দেখেছে। মেয়েটাকে যত দেখছে ততই ওর ভালো লাগছে। তবে কি ও প্রেমে পরছে?
উহু, উহু,মোটেও প্রেমে পরা যাবে না। প্রেম সাংঘাতিক খারাপ জিনিস।

শান নিজের মনকে বোঝাতে বোঝাতেই বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছালো। রুমঝুম তড়িঘড়ি করে নামলো‌ গাড়ি থেকে। ব্যাগটা নামিয়ে শানকে ধন্যবাদ দিতে যাবে তার আগেই শান গাড়ি নিয়ে সাঁই করে চলে গেলো। রুমঝুম হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। শানের ভাব দেখে ওর শরীর জ্বলে যাচ্ছে। একটা ধন্যবাদ দেওয়ার সুযোগও দিলো না। হুহ।

ফোন বের করে মেঘার নাম্বারে কল করতে যাবে তার আগেই মেঘা চলে এলো। রাগী কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
-“তোর‌ বাস ভোরে পৌঁছেছে। তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”
রুমঝুমের মুখটা শুকিয়ে উঠলো। মিনমিন করে বললো,
-“গাড়ি ঠিক কর তারপর বলছি।”
মেঘা কথা না বাড়িয়ে গাড়ি ঠিক করলো। বাসস্ট্যান্ড থেকে মেঘার বাড়িতে যেতে প্রায় এক ঘন্টা সময় লাগে।

গাড়িতে বসে মেঘা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো রুমঝুমের দিকে। রুমঝুম হেঁসে দিলো।বললো,
-“আজকের টা শুনবি নাকি আমার বাড়ি ছাড়ার কারনসহ সব বলবো?”

মেঘা নড়েচড়ে বসে বললো,
-“সব শুনবো। সব বল ।”
রুমঝুম রয়ে সয়ে একে একে সবকিছু বললো। সকালের ঘটনা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললো রুমঝুম। মেঘাও কেঁদে দিলো। ওই মানুষগুলো না থাকলে আজ রুমঝুমের সাথে কি হতো সেটা ভেবেই ওর শরীর শিউরে উঠলো।

রুমঝুম চোখ মুছলো। ওর আর আগের মতো ভয় লাগছে না। সিন্থিয়ার কথাগুলো ম্যাজিকের মতো কাজ করেছে। রুমঝুম এখন কাঁদলেও ভেঙে পড়ছে না‌। বেশ সাহস সাহস অনুভুত হচ্ছে।
-“আর কতক্ষন লাগবে ,মেঘা?”
-“এইতো চলে এসেছি। আর দুই তিন মিনিট লাগবে।”

রুমঝুম বাইরে তাকালো। সুন্দর একটা জায়গা। চট্টগ্রাম আসলেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। রুমঝুম মেঘার হাত ধরে বাচ্চাদের মতো বললো,
-“আমাকে সুন্দর জায়গা গুলোতে ঘুরতে নিয়ে যাবি সময় করে ? বল বল।”
মেঘা হেঁসে ফেললো। বললো ,
-“নিয়ে যাবো ।এখন নাম। চলে এসেছি।”

দুজন গাড়ি থেকে নামলো। রুমঝুম তাকিয়ে দেখলো ছোট খাট ছিমছাম গড়নের বেশ সুন্দর একটা বাড়ি। বাড়ির পিছন দিকে সারি সারি লম্বা লম্বা গাছ । বাড়িটা দেখেই রুমঝুমের খুব পছন্দ হলো।
বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে মেঘাকে প্রশ্ন করলো,
-“আমার জন্য থাকার জায়গা খুঁজতে বলেছিলাম সেটা কতদূর?”
-“আগে বাড়িতে চল। ওটা পরে দেখবো।”

বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথেই মেঘার মা মাহেরা খাতুন এসে জড়িয়ে ধরলো রুমঝুমকে।
-“কেমন আছিস, ঝুম? কতদিন পর তোকে দেখলাম।”
-“ভালো‌ আছি আন্টি। তোমরা সবাই কেমন আছো?”
-“আমরাও ভালো আছি। যা ঘরে গিয়ে রেস্ট নে। মেঘা,মিলির রুমটা খুলে দে ঝুম কে।”
-“আচ্ছা মা। ঝুম চল।”

দুজনই ঘরে দিকে হাঁটা ধরলো। হঠাৎ করেই কোথা থেকে সামনে এসে দাঁড়ালো মেঘার ভাই মেহেদী।
মেহেদীকে দেখেই রুমঝুম একগাল হেঁসে বলো,
-“কেমন আছো, মেহেদী ভাইয়া?”
রুমঝুমের মুখে ভাইয়া ডাক শুনলেই মেহেদীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। মেয়েটা এমন ভাবে ভাইয়া ডাকে যেন ওর নিজের ভাইকেই ডাকছে।

জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে মেহেদী বললো,
-“ভালো আছি রুমঝুম। তুমি যাও রেস্ট নাও।”
রুমঝুম বেশ অবাক হলো। সবাই‌ এমন আচরণ করছে যেন ওর এখানে আসা,থাকা একদমই স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে ব্যাপারটাকে তেমন পাত্তা দিলো না। আজ রাতেই মেঘার সাথে তার বাসা ঠিক করা, কয়েকটা টিউশন জোগাড় করা এসব নিয়ে সিরিয়াসলি কথা বলতে হবে । রুমঝুম গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো ।শরীরটা বেশ ক্লান্ত লাগছে ওর।

-“রুশান , এদিকে আয়।কথা আছে তোর সাথে।”
-“হ্যাঁ বলো মা। একটু তাড়াতাড়ি বলো , আমাকে কলেজে যেতে হবে।”
-“ইদানিং আমার সামনে একটু বেশিই ব্যস্ততা দেখাস মনে হচ্ছে। ওই মেয়েটার জন্য আমার সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করছিস তুই?”
-“ওই মেয়েটা, ওই মেয়েটা কি মা? ও আমার আপু হয়। আমার একই পিতার ঔরসে জন্মেছি। বারবার আপুকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলবে না।”

ছেলের কথায় তাহমিনা বেগমের শরীর জ্বলে উঠলো। ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে এখানে পুঁতে দিতে। তবে সে এটা কখনোই পারবে না। নিজের আদরের একমাত্র ছেলে বলে কথা।
যাই হোক, এখন ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে তাকে। গলার স্বরটা নরম করে বললো,
-“শোন না বাবা,তুই জানিস ঝুম কোথায় আছে?”

রুশান ভ্রু কুঁচকে তাকালো তার মায়ের দিকে। হঠাৎ রুমঝুমের কথা এতো নরম সুরে জানতে চাচ্ছে কেন? ডাল মে জারুর কুচ কালা হ্যায়।
রুশান‌ একটু চুপ থেকে বললো,
-“আমি জানি না আপু কোথায় আছে। আর কিছু বলবা?”

তাহমিনা বেগমের রাগ তরতর করে বাড়ছে। তবুও নিজেকে সংযত করে প্রশ্ন করলো,
-“আচ্ছা রুমঝুমের নাম্বার তো আছে তোর কাছে।সেটা দে।”
-“আপুর যে নাম্বারটা আমার কাছে আছে সেটা বন্ধ। আমার লেট হয়ে যাচ্ছে। আমি গেলাম।”
বলেই একছুটে বেরিয়ে গেলো রুশান। সে যথেষ্ঠ বুদ্ধিমান ছেলে। তার মা কি করতে চাইছে সেটা একটু হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে সে।

কলেজ মাঠে বসে রুমঝুমকে ফোন করলো রুশান। রুমঝুম তখন বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙলো রুমঝুমের। ঘুমু ঘুমু চোখে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো রুশানের নাম্বার। ফোন রিসিভ করে চোখ বন্ধ করেই কানে ধরলো ফোনটা। ওপাশ দিয়ে শব্দ এলো,
-“হ্যালো আপু।কেমন আছো?”

রুমঝুম চোখ বুজেই মুচকি হাসলো। বললো,
-“ভালো আছি পিচ্চি। তুই কেমন আছিস?”
রুশান‌ শব্দ করে হেঁসে উঠলো।
-“কে পিচ্চি সেটা এখন ভয়েস শুনলেই মানুষ বুঝতো। তুমি ঘুম জড়ানো কন্ঠে কথা বললে একদম বাচ্চা বাচ্চা লাগে হাহাহা।”
-“এই চুপ।হাসবি না।বিচ্চু কোথাকার।”

রুশান‌ আবারও হাসলো। রুমঝুম বিছানায় উঠে বসতে বসতে বললো,
-“কি করছিস?”
-“এইতো কলেজে বসে আছি। বাড়িতে থাকলে মা সারাক্ষণ জেরা করতে থাকে। ভাল্লাগে না।”
-“আহারে। আমার জন্য ভাইটার খুব ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।”
-“তেমন‌ কিছু না আপু। আজ তো তোমার নাম্বার চাচ্চিলো আমার কাছে।”
-“আমার নাম্বার কেন?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো‌ রুমঝুম।

-“আমি ঠিক জানিনা। আচ্ছা শুনো আপু?”
-“হুম বল।”
-“তুমি নাম্বারটা চেন্জ করে ফেলো। মানে বুঝোইতো এখন কতোভাবেই মানুষকে খুঁজে বের করা যায়। তাছাড়া ওই আরমান লোকটাকে একদমই সুবিধার মনে হয় না আমার।বেশ পাওয়ারফুল আছে লোকটা।”

রুমঝুমের হঠাৎ বেশ ভয় লেগে উঠলো। নিচু স্বরে বললো,
-“ঠিকই বলেছিস তুই। আমি আগে এসব ভাবিনি রে ভাই। নাম্বার আজ বিকেলেই চেন্জ করে ফেলবো। নতুন নাম্বার দিয়ে সবার প্রথম তোকেই এসএমএস করবো।”
রুশান‌ তৃপ্তির হাসি হাসলো। এরকম একটা মেয়েকে ওর মা কিভাবে দূরে ঠেলে রাখে ও বুঝতে পারে না।

রুশানের কোনো উত্তর না পেয়ে রুমঝুম বললো,
-“আচ্ছা ভাই,এখন তাহলে রাখি।”
-“আপু শুনো,আরেকটা কথা ছিলো।”
-“হ্যাঁ বল।কি কথা?”
-“আমি নিজেও যদি কখনো ফোন করে তোমাকে জিজ্ঞেস করি তুমি কোথায় আছো , তুমি উত্তর করবে না। আই রিপিট, তুমি ভুল করেও উত্তর দিবে না। আশা করি আমি কেন এটা বললাম তুমি বুঝেছো। রাখছি আপু।”
রুশান ফোন কাঁটার পর বেশ কিছুক্ষণ রুমঝুম থম মেরে পড়ে ছিলো। রুশানের কথার মানে খুঁজে পেয়েই ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো তার। ছেলেটা দিনদিন বেশ বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে।

দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে বারোটা বাজে। রুমঝুম ফ্রেশ হয়ে রুমের বাইরে এলো। মেঘা আর মাহেরা খাতুন মিলে রান্না করছে। রুমঝুম তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
-“কিরে ঝুম, এতো তাড়াতাড়ি উঠে পড়লি কেন?”
-“রুশান কল করেছিলো তাই। আচ্ছা শোন মেঘা, বিকেলে একটু বের হবি আমার সাথে? কিছু দরকার ছিলো। ”

মেঘার উত্তর দেওয়ার আগেই মাহেরা খাতুন বলে উঠলেন,
-“কেন বের হবে না? ওর কি বাড়িতে কাজ আছে কোনো? দুজন বের হয়ে ঘুরে আসিস। তোরও একটু ভালো লাগবে।”
মাহেরা খাতুনের কথায় মাথা নিচু করে হাসলো রুমঝুম। আশেপাশে মেহেদীকে না দেখে বললো,
-“মেহেদী ভাইয়া কোথায়? তাকে দেখছি না তো।”
-“আরে তুই তো জানিস না। দুমাস আগেই আমার ভার্সিটিতে ভাইয়ার চাকরি হয়েছে।সে এখন টিচার বুঝলি? ফিরতে বিকেল হবে।”
রুমঝুম বিষ্ময়ে হা করে তাকিয়ে রইলো।তারপর হুট করে চেঁচিয়ে বললো,
-“তাহলে তো আজকে মেহেদী ভাইয়ার কাছ থেকে ট্রিট নিবো। কি মজা।”
-“তোর উছিলায় আমিও আরেকবার পাবো তাহলে।”
-“ইশশ তোরে কেন দিবে? আমি একা নিবো।”
-“হ্যাঁ হ্যাঁ তুই একা নিবি আর আমি তো বসে বসে আঙ্গুল চুষবো।”

রুমঝুম আর মেঘার ঝগড়া শুনে মুচকি মুচকি হাসছে মাহেরা খাতুন। আগে যখন মিলি ছিলো তখনও দুইবোন সারাক্ষণ এমন ঝগড়াঝাঁটি করতেই থাকতো। মিলির বিয়ে হওয়ার পর থেকে বাড়িটা কেমন নিরব হয়ে গেছে। মেয়েটাকে নিয়ে তার স্বামী বিয়ের পর পরই ডেনমার্কে পাড়ি জমিয়েছে। কবে দেশে আসবে কে জানে?
রুমঝুম আসায় বহুদিন পর বাড়িটাতে যেন প্রান ফিরেছে। বেশ শান্তি লাগছে মাহেরা খাতুনের মনে আজ।

….

-“কি ব্যাপার বলতো বিথী? শানের কোনো খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না। কত করে বললাম একটার মধ্যে ভার্সিটিতে আসতে অথচ তার কোনো পাত্তাই নেই।”
তিহানের কথা শুনে বিথী বললো,
-“তুমি যেখানে,আমি সেখানে ।তবে আমি কি করে জানবো?”
প্রান্ত গিটারে টুংটাং করতে করতে বললো,
-“সেই সকালে মেয়েটাকে নিয়ে বের হওয়ার পর থেকেই তো সে লাপাত্তা।”
বিথী সিন্থিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এই সিন্থু ,তুই জানিস নাকি ও কোথায়? ফোনেও তো পাচ্ছিনা ওকে।”

সিন্থিয়ার কোনো হেলদোল না দেখে তিনজনই ফিরলো সিন্থিয়ার দিকে। দেখলো সিন্থিয়া একদৃষ্টিতে হা করে কোথাও তাকিয়ে আছে। তিনজনই সিন্থিয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো। দেখলো মেহেদী স্যার ক্যাম্পাসের এক কোনে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। সেদিকেই তাকিয়ে আছে সিন্থিয়া।

প্রান্ত বিরবির করে বললো,
-“সারাজীবন শুধু দেখেই যা ।”

চলবে……….

(রি-চেক দেওয়া হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে