চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-০২

0
2049

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-২
#আর্শিয়া_সেহের

বাস চলছে আপন‌ গতিতে। গাছপালা গুলো সব উল্টা দিকে দৌড়াচ্ছে। এই দৃশ্য রুমঝুমের খুব প্রিয়। বাসের মধ্যে সবাই চুপচাপ বসে থাকলেও চুপ করে নেই ওই পাঁচ সদস্যের বিচ্ছু বাহীনি। তাদের বকবকানি চলছে তো চলছেই। রুমঝুমের ইচ্ছে করলো ওদের কথা শোনার। তাই প্রকৃতি থেকে মুখ ফিরিয়ে ওদের কথা শোনায় মগ্ন হলো।

-“প্রান্ত ,একটা গান ধর না। জার্নি টা বোরিং লাগতেছে রে। ”
-” চল ফুট। রাত কয়টা বাজে সে খেয়াল আছে তোর ? বাসের লোক সব ঘুমাচ্ছে আর উনি আসছে গান শুনতে।”
প্রান্তর কথায় মুখ ভার করে বসলো সিন্থিয়া।
বিথী সেটা দেখে সিন্থিয়ার দিকে ফিরে বললো,
-“এটা কি গান শোনার সময় সিন্থু? এমন বাচ্চামি করিস না তো।”
ওদের এতো কথায় বিরক্ত হলো শান। ভরাট কন্ঠে বললো,
-“সবগুলো চুপ কর এবার। আর একটা কথাও বলবি তো বাস থেকে ফেলে দিবো। তোরা ভালো করেই জানিস ইন..”

শানকে শেষ করতে না দিয়ে বাকি চারজন একসাথে বলে উঠলো,
-“আমরা ভালো করেই জানি ‘ইনজামুল শাফায়াত শান’ রেগে গেলে যা ইচ্ছা করতে পারে।”
বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো চারজন। তাদের কথা শুনে রুমঝুমও মুচকি হাসলো।

রাত সাড়ে দশটার মতো বাজে। আকাশে আজও বড় একটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে তবে সেটা গতকালকের চেয়ে কিছুটা ছোট। চাঁদের আলোতে বাইরের সবকিছুই আলোকিত হয়ে আছে।
রুমঝুম চুলগুলো হাতখোপা করে সিটে গা এলিয়ে বসে আছে। মুখটা জানালার দিকে হালকা কাত করে রেখেছে। এতে করে চাঁদের আলো সরাসরি রুমঝুমের মুখে এসে পড়েছে। চাঁদের আলোতে রুমঝুমকে অপরুপা লাগছে।

সিন্থিয়া বোরিং হয়ে সিট থেকে উঠে দাঁড়ালো। চঞ্চল প্রকৃতির সিন্থিয়া এভাবে চুপচাপ জার্নি করাটা একদমই মানতে পারছে না। সে সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পেছনে থাকা যাত্রীদের দেখছে। একটা বাচ্চার দিকে নজর পড়তেই দেখলো বাচ্চাটা ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। সিন্থিয়া বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলো সাথে ফ্লাইং কিস ছুড়লো। বাচ্চাটা সাথে সাথে কান্না জুড়ে দিলো। বাচ্চাটার কান্নায় সিন্থিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। আজকালকার বাচ্চারা তো ফ্লার্ট করা পছন্দ করে তবে এটা ভিন্ন কেন? সিন্থিয়া অতশত না ভেবে অন্যদের দেখতে ব্যাস্ত হলো।

সবার দিকে চোখ বুলাতে বুলাতে সিন্থিয়ার চোখ আটকে গেলো নীল-সাদা জামা পড়া একটা মেয়ের দিকে। চাঁদের আলোতে হুরপরী মনে হচ্ছে। সিন্থিয়া মৃদু চিৎকার দিয়ে বললো,
-“সো কিউট গার্ল।”
বলেই পাশে থাকা শানকে ঠেলতে লাগলো মেয়েটাকে দেখার জন্য। শান বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,

-“চুপচাপ বস মেরি মা। মৃগী রোগ হইছে নাকি?এরকম ঠেলাঠেলি করস ক্যান?”

সিন্থিয়া চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো‌,
-“ওই মেয়েটাকে একবার দেখ দোস্ত। আরে দেখ না। ওঠ।”

সিন্থিয়ার ঠেলাঠেলিতে শান আর বসে থাকতে পারলো‌ না। সে জানে যতক্ষণ সিন্থিয়া নিজের উদ্দেশ্য পূরণে সফল না হয় ততক্ষণ এরকম করতেই থাকে।
শান একপ্রকার বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়ালো সিন্থিয়ার পাশে। সিন্থিয়ার ইশারা মতো বিরক্তিসূচক চাহনিতে তাকালো সেদিকে। একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে বুঝতে পারলো ওর একটা হার্টবিট মিস হয়েছে। আবার তাকালো সেদিকে। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোতে ভেসে বেড়াচ্ছে একটা মায়াবী মুখ।এই প্রথম নিজের মা আর বোন ছাড়া কোনো মেয়েকে অতি আপন মনে হচ্ছে তার। শান রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে পলক ফেলাটাও যেন ভুলে গেলো।

সিন্থিয়া পাশ থেকে বললো,
-“মেয়েটা সুন্দর না, বল?”
শান আনমনেই বললো,
-“চন্দ্রকন্যা দেখতে সুন্দরই হয়।”

সিন্থিয়া খিলখিল করে হেসে উঠলো।বললো,
-“আয় হায়! দি গ্রেট ইনজামুল শাফায়াত শানের কি লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট হয়ে গেলো?”

সিন্থিয়ার কথায় ঘোর কাটলো শানের। কি থেকে কি বলে ফেললো ভেবে থতমত খেয়ে গেলো সে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে কপাল কুঁচকে আমতাআমতা করে উত্তর দিলো ,
-” লাভ না ছাই। ফালতু কথা বলিস না, সিন্থু। আর এখন আমাকে একদম জ্বালাবি না বলে দিচ্ছি।”
সিটে বসতে বসতে বললো শান। মুখে এসব বললেও মনের মধ্যে উথালপাথাল শুরু হয়ে গেছে ততক্ষনে। শানের নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। কেন যে সিন্থিয়ার কথায় মেয়েটাকে দেখতে গেল। শান মনে মনে নিজেই নিজেকে বললো,
-“নো শান নো। এসব প্রেম পিরিতি কিচ্ছু না। একদম ওসব ভাববি না। ”
নিজ মনে নিজেকে কিছুক্ষণ শাসালো শান। তারপর চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিলো।
কি যন্ত্রণা!মেয়েটার মুখ চোখের পাতায়ও ভেসে উঠছে। সিন্থিয়ার জন্যই এমন হচ্ছে ভেবে সাথে সাথে চোখ খুলে রাগী দৃষ্টিতে পাশে বসা সিন্থিয়ার দিকে তাকালো শান।
কিন্তু একি! সিন্থিয়া সিটে নেই। উঁকি ঝুঁকি মেরে দেখলো সিন্থিয়া তার চন্দ্রকন্যার পাশের সিটে গিয়ে বসেছে।
বাসে তিন চারজন না উঠায় সিটগুলো ফাঁকা থেকে গেছে। মেয়েটার পাশের সিটের লোকটাও আসেনি তাই সেই সিটটাও ফাঁকা পড়ে আছে।

বিথী, প্রান্ত আর তিহান ও তাকালো সিন্থিয়ার দিকে। কি সুন্দর গল্প শুরু করে দিয়েছে মেয়েটার সাথে। তিনজনই মেয়েটাকে একপলক দেখলো। তিহান শানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-” মেয়েটা কি সিন্থুর পরিচিত?”

শান মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দিলো,
-“আরে নাহ। মেয়েটাকে দেখে ক্রাশ খাইছে সে।”
শানের কথায় তিনজনই হো হো করে হেঁসে উঠলো।

..

-“হেই, আমি সিন্থিয়া। তোমাকে আমার দারুন লেগেছে। গল্প করবে আমার সাথে?”
রুমঝুম আগেই বুঝেছে মেয়েটা বেশ কথা বলতে জানে। অবশ্য রুমঝুমও খুব একটা শান্ত মেয়ে নয়। পরিস্থিতির চাপে এখন শান্ত হয়ে আছে সে।
রুমঝুম মুচকি হেঁসে বললো,
-“করবো না কেন? তুমি গল্প শুরু করো।”

কান খাঁড়া করে রাখায় রুমঝুমের কন্ঠস্বর শানের কান অবধি পৌঁছে গেলো।কি সুন্দর রিনরিনে কন্ঠে কথা বলছে মেয়েটা। তাতে তার কি? আজব তো। একটা মেয়ের কন্ঠ শুনে এতো খুশি হওয়ার তো কিছু নেই। শান নিজে নিজেকে ধমকিয়ে কালে ইয়ারফোন গুজে নিলো। শানের এসব কাজকর্ম প্রান্ত লক্ষ্য করলো। সে ভাবছে, ছেলেটার মাথার তার ছিড়লো কখন?

সিন্থিয়া রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
-“আচ্ছা তোমার নাম কি?”
-“আশফিয়া জান্নাত রুমঝুম। ”
-“ওয়াও, দারুন নাম তো তোমার। আচ্ছা তুমি চট্টগ্রামে কোথায় যাচ্ছো?”
রুমঝুম কোনো উত্তর দিতে পারলো না। কি বলবে ও? মেয়েটা নিশ্চয়ই এরপর জিজ্ঞাসা করবে,ও কেন যাচ্ছে? বাড়ি থাকছে না কেন? এসবের কি উত্তর দেবে ও? আজ নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে।

-“তোমার মেয়ে আমাদের নাক-কান কেটে পালিয়ে গেছে আর তুমি? ওকে খোঁজার কোনো চেষ্টাই করছো না? ওকে খুঁজে এনে হাত-পা কেটে ঘরে বসিয়ে না রাখা অবধি শান্তি হচ্ছে না আমার।”

-“তোমার দায়িত্বে রেখেই তো আমি ব্যাবসার কাজটা দেখতে মোংলা গিয়েছিলাম। তুমি তাড়াহুড়ো করে আমার অনুপস্থিতিতে ওকে জোড় করে বিয়ে দিতে গিয়েছিলে । তাও আবার ওইরকম একটা লোকের সাথে। এখানে ও পালিয়ে গিয়ে ভুল কি করেছে?”

রাগে ফুঁসে উঠলো তাহমিনা বেগম। চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে রেজাউল তালুকদারের দিকে। মেয়ে পালানোর পর জরুরি তলব করে এনেছেন স্বামীকে। সে এসে পৌঁছেছে রাত দশটায়। এখন মেয়েকে খুঁজে শাস্তি দেবে তা না করে মেয়ের কাজে সায় দিচ্ছে।
তাহমিনার রাগকে আরো কয়েক ডিগ্রি বাড়াতেই যেন তার সামনে দেখা দিলো রুশান। রুশানকে দেখেই বাজখাঁই গলাই তাহমিনা বেগম বলে উঠলেন,
-“এই ছেলের জন্যই ওই মেয়ে পালাতে পেরেছে। আমি খুব ভালো করে জানি ওকে পালানোর জন্য এই হারামজাদা উষ্কানি দিয়েছে। ইচ্ছে করছে এটাকে ধরে…”
আর কিছু বলতে পারলেন না তাহমিনা বেগম।রুশান আগুনে কেরোসিন ঢালার মতন করে প্রশ্ন করলো,
-“কি ইচ্ছে করছে আম্মা?”

তাহমিনা তেড়ে যাচ্ছিলো রুশানের দিকে। রেজাউল সাহেব তাকে থামিয়ে দিলেন। শান্ত কন্ঠে বললেন,
-“এসব নিয়ে আর কোনো ঝামেলা করো না তাহু। আমি দেখছি ব্যাপারটা।”

তাহমিনা বেগম স্বামীর দিকে একপলক তাকিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের ঘরে চলে গেলেন।রুশানও নিজের রুমে চলে গেলো। রেজাউল সাহেব সোফায় বসে পড়লেন। মেয়েটার জন্মের পর থেকেই ওর সাথে অন্যায় করে চলছে তারা‌। এবার অন্তত মেয়েটাকে নিজের মতো বাঁচতে দেওয়া উচিত।

রেজাউল সাহেব ধীরগতিতে বাড়ি থেকে বের হলো। মাথার উপর বিস্তির্ণ আকাশ। আকাশের মাঝবরাবর উজ্জ্বল একটা তারা দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে অপরাধী কন্ঠে রেজাউল সাহেব বললো,
-“আমাকে ক্ষমা করে দিও, রেহনুমা। আমাদের মেয়েটাকে আমি সুস্থ, স্বাভাবিক, সুন্দর একটা জীবন দিতে পারিনি।”

বাস চট্টগ্রামে এসে পৌঁছালো প্রায় ভোরের দিকে। ভোরের আলো তখনও ফোঁটে নি। একে একে সবাই নেমে পড়েছে বাস থেকে।
বাস যেখানে থেমেছে সেখান থেকে কিছুটা দূরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে শানের বাবার পাঠানো ড্রাইভার। শান‌ আগেভাগে নেমে সবার ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে তুলছে। বাকিরাও‌ নেমে পড়েছে। শান ব্যাগ নেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আশেপাশে দেখছে তার চন্দ্রকন্যা নেমেছে কি না। কিন্তু নাহ,তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।

বাস থেকে সবার শেষে সিন্থিয়া নামছিলো। নামার সময় দেখলো‌ ড্রাইভার কেমন লোলুপ দৃষ্টিতে বাসের পেছন দিকে তাকিয়ে আছে। সিন্থিয়া মাথা ঘুরিয়ে দেখলো রুমঝুম এখনো সিটে গা এলিয়ে ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটা ওকে বলেছিলো সে দুইরাত ঘুমায়নি। তাই ওকে ঘুমাতে দিয়ে সিন্থিয়া উঠে এসেছিলো। সিন্থিয়া বাসের দরজায় দাঁড়িয়েই জোরে রুমঝুমের নাম ধরে ডেকে উঠলো।
ধড়পড়িয়ে উঠলো রুমঝুম। উঠে দেখলো পুরো বাস ফাঁকা। ড্রাইভার, কন্ট্রাকটর সবাই সিন্থিয়ার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রুমঝুম সেদিকে তোয়াক্কা না করে বললো,
-“আমরা কি চলে এসেছি?”
-“হ্যাঁ,নেমে এসো।”
রুমঝুম ব্যাগ নিয়ে সিট থেকে বের হচ্ছিলো। তখন হেল্পার ছেলেটি সিন্থিয়াকে বললো, -“আপা,সরেন।আমি নামমু।”

সিন্থিয়ার সামনেই ছেলেটা দাঁড়ানো। অগত্যা সিন্থিয়াকে নিচে নেমে দাঁড়াতে হলো। সাথে সাথেই সাঁই সাঁই করে চলে গেলো বাসটি। বাসের ভেতর থেকে রিনরিনে চিকন কন্ঠে হালকা চিৎকার ভেসে এলো।
-“বাস থামান,বাস থামান।আমি নামবো।”

সিন্থিয়া কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলো না। তখনই পেছন থেকে শানের কন্ঠ ভেসে এলো। সিন্থিয়া সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বলে উঠলো,
-“ওই বাসের মধ্যে রুমঝুম রয়েছে, শান। পশুগুলো ওকে নিয়ে গেছে রে। আমি বাঁচাতে পারিনি মেয়েটাকে।”

চলবে…….

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে