গ্যাসবেলুন পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
1370

#গ্যাসবেলুন
#সর্বশেষ_ও_১১শ_পর্ব
লেখাঃ Nobonita Ferdows
.
অরূপ অরণীর কাঁধে ওপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ছিলো. অরণী বৃষ্টির ঝাপটা থেকে অরূপকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে; বৃথা চেষ্টা। দুজনেই ভিজে একাকার হয়ে গেছে।
.
অরূপ চোখখুলে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো, “মামা, বায়ে নিবেন!”
.
রিকশাওয়ালা বিরক্তমুখে পিছনে ফিরে বললো, “যাবেন কই আপনেরা?”
.
“আগামসি লেন যাবো!”
.
রিকশাওয়ালা মহাবিরক্ত হয়ে রিকশা আচমকা থামিয়ে বললো, “আপনে ঠিক করলেন এক জায়গা, এখন কইতাছেন আগামাসি লেন যাইবেন! আমি যাবোনা আপনাদের লইয়া! আপনে ভাড়া দিয়া নাইমা পড়েন!”
.
অরূপ অরণীর কাধ থেকে মাথা তুলে বললো, “আরে মামা, ঝামেলা কইরেন না! আপনে যত চান, তত ভাড়াই দিবো৷ চলেন!”
.
রিকশাওয়ালার ইচ্ছাভাড়ার প্রস্তাব শুনে কিছুটা মন গললো। রিকশায় প্যাডেল চালিয়ে বামে মোড় নিলো!
.
অরণী হকচকিয়ে গিয়ে বললো, “আমরা কোথায় যাচ্ছি, অরূপ? আমাদের বাড়ি তো এদিকে না! আগামসি লেনে কেনো যাচ্ছি আমরা?”
.
“বলছিনা, বেশি বকবক করবা না! চুপচাপ বসে থাকো! আজকে আমি যা চাইবো তাই হবে! তুমি আমাকে আটকাবা না!”
.
“অরূপ, তোমার জ্বর আসছে! এসময় ঘোরাঘুরি করার কি দরকার?”
.
“উফফ… বড্ড জ্বালাও তুমি। আমার বৃষ্টিতে ভিজলে অমন একটু জ্বর আসেই৷ এক-দেড় ঘন্টার মধ্যেই জ্বর নেমে যাবে!”
.
“এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে, অরূপ! আমরা এক্ষুণি বাসায় যাবো, তুমি কোনো কথা বলবা না! মা….”
.
অরণী রিকশাওয়ালাকে রিকশা ঘুরায় নিতে বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু বলতে পারলোনা! অরূপ তার মুখ চেপে ধরেছে; বামহাতে মুখ চেপে ধরে ঘোরগ্রস্ত চোখে অরণীর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে! এই চোখে এর আগে কখনো সে এভাবে তাকিয়ে থাকতে পারেনি, চোখে চোখ রাখার সাহস হয়ে ওঠেনি; কিংবা এইচোখের বিশালতায় ডুবে মরার ভয়ে তাকাতে পারেনি!
.
চক্ষুকোটরের আকর্ষণে কিংবা মনোজগতের অজানা উন্মাদনায় অরূপ অরণীর ভেজা কোমর চেপে ধরলো! তারপর টেনে নিয়ে একদম কাছে নিয়ে আসলো! অরূপ অনেক আগেই অরণীর মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে দিয়েছে। তবুও অরণী কোনো কথা বলতে পারলোনা! অরূপের এহেন চাহনী তার বাকশক্তিতে নিজের কব্জার বাইরে নিয়ে ফেলেছে! অরণী অরূপের শরীরের ভিতরে ডুবে গেলো! অরণী চোখবন্ধ করে মাথানিচু করে ফেলেছে! অরূপ একহাতে অরণীর থুতনি ধরে মুখ তুলে ধরলো! সেখানে কি প্রবল তৃষ্ণায় থরথর করে কাঁপছে তার ঠোঁট। অরূপ তার একজোড়া ওষ্ঠ তৃষ্ণার্ত একজোড়া ওষ্ঠে ডুবিয়ে দিলো। ঝড়ো হাওয়ায় মাতম লেগেছে! বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মাতাল হয়ে গিয়েছে! সেই প্রবল বৃষ্টির মাতাল রাতে দুই মাতাল হৃদয় নতুন কোনো গল্পের আহ্বানে যেনো দুজনে দুজনার পরিপূর্ণতার অংশ হলো!
.
.
অরণীরা এসে দাঁড়ালো একতলা কাঠের বাড়িটা সামনে! বাড়ির বিরাট লোহার গেট পেড়িয়ে সোজা রাস্তা গিয়ে বাড়ির সদর দরজায় ঠেকেছে! বাড়িটা জানালাগুলো বেশ বড় বড়! বাড়ির সামনে খুব যত্ন করে নানা ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে! অরণী কড়া বেলিফুলের গন্ধ পাচ্ছে! পিছনদিকে আম, কাঠাল, লিচুর গাছ দিয়ে ভরা! বাড়ির সামনে টানা বারান্দার উপরে হলুদ রঙ্গের তিনটে বাতি জ্বলছে! তবে বাড়ির নামটা অদ্ভুত; “রাধাচূড়া”
বাড়িটায় কোনো রাধাচূড়ার গাছ নেই! অথচ বাড়ির নাম রাধাচূড়া দিয়ে রেখেছে!
.
“অরূপ এটা কার বাসা?”
.
“সিন আপার শ্বশুরের ভিটা! আপা সন্ধ্যাতেই দুলাভাইকে নিয়ে বাসায় চলে গেছেন! বাসাটা ফাঁকা এখন! শুধু একজন কেয়ারটেকার আছেন.. আপা আমাদের বাসরের ব্যবস্থা এখানেই করেছেন!”
.
“এসবের কি দরকার ছিলো? আমরা বাড়িতে গেলেই পারতাম! আন্টি-আঙ্কেল, ফুপু, সবাই টেনশন করতিছে হয়তো!”
.
“আঙ্কেল আন্টি কারা?”
.
“কারা মানে? তোমার বাবা মা!”
.
“আমার বাবা-মা তোমার কে হয়? মা-বাবা বলার অভ্যাস করো! আর এখানে বাসর না করলে পালিয়ে বিয়ে করার মজাটাই তো হতোনা! বাড়িতে গেলে সবাই মেনেই নিবে! তখন আর ইন্টারেস্টিং কিছু হতোনা! আর বাসার কারো টেনশন করারও তো কোনো কারণ নেই! এতক্ষণে সবাই জেনো গেছে, আমাদের বিয়ের কথা! মা ফোনও করেছিলো, আমি ধরিনি!”
.
অরণী চোখ কপালে তুলে বললো, “কি বলো? কিভাবে?”
.
“তোমার কি মনে হয়, আপা বাসায় গিয়ে সবকথা পেটের মধ্যে চেপে বসে আছে?”
.
অরণী চিন্তিত মুখে অরূপের দিকে তাকালো!
.
“এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে, নাকি ভেতরে যাবে?”
.
সিন আপা সবকিছু সাজিয়ে রেখে গিয়েছেন। একজন কেয়ারটেকারকে বলে গিয়েছেন, ভালোমতো যত্নআত্নি করতে! অরূপ-অরণীর জন্য নতুন পাঞ্জাবি-শাড়ি রেখে, দুজনার জন্য সাত-আটরকমের পদ রান্না করে টেবিলে ঢেকে রেখে গিয়েছেন! অরূপ ঘরে গিয়ে অফহোয়াইট রঙের পাতলা, সুতি পাঞ্জাবিটা আর তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো। অরণী ঘরের দরজা লাগিয়ে, বাথরুমের ছিটকিনি বাইরে থেকে লাগিয়ে ঘরেই ভেজা শাড়ি বদলে সিন আপার রাখা শাড়িটা পড়ে নিলো। অরণীর শাড়ি পড়া হতে না হতেই বাথরুমের ভিতর থেকে ধমাধম ধাক্কা পড়তে থাকলো। অরণী দরজা খুলতে আর একসেকেন্ড দেরী করলে অরূপ বুঝি দরজা ভেঙ্গেই ঘরে ঢুকে পড়তো!
.
“আরে খুলছিলাম তো। অস্থির হওয়ার কি ছিলো?”
.
অরূপ বাথরুম থেকে হুড়মুড়ি করে বেড়িয়েই অরণীর কোমর চেপে টেনে ধরে তার চোখের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “আমারই বউ শাড়ি বদলাবে, তার জন্য আমারই ঘরে ঢোকা বারণ? সাহস তো কম না তোর!”
.
অরূপ হঠাত খেয়াল করে বললো, “এই ব্লাউজের গলা এতো বড় কেনো? বাইরে যাস পিঠখোলা রেখে, আর আমার সামনে সব ঢাকা? বাসরে এতসেজেগুজে কে থাকে? যা সব খুলে আয়!”
.
অরণী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে অরূপের দিকে! অরূপ হঠাত অরণীকে ছেড়ে দিয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে বললো, “চমকালে তো তোমাকে ভালোই লাগে দেখতে! প্রথম দিন থেকে এই হতভম্ব দৃষ্টি দেখাতে দেখাতেই তো পটিয়ে ফেললা আমাকে!”
.
অরণী বাচ্চা মেয়েদের মতো মুখ গোমড়া করে বললো, “আর আপনিইতো হাসি দেখাতে দেখাতে ডুবায় ফেললেন আমাকে!”
.
“আমার হাসি আগে কখন দেখলা তুমি?”
.
“ওই যে অ্যালবামের ছবিগুলোতে শ্রেমা আপার সাথে….”
অরূপের মুখ চুপসে গেলো। অরণী সেটা খেয়াল করেই কথা বলতে বলতে থেমে গেলো!
.
“আমি কি মন খারাপ করিয়ে দিলাম তোমার?”
.
অরূপ গম্ভীর কন্ঠে বললো, “না! আপা, নিচে খাবার দিয়ে গিয়েছে! তুমি খেয়ে আসো!”
.
“তুমি খাবেনা?”
.
“না!”
.
অরূপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো! অরণী অরূপের পায়ের কাছে গিয়ে বসতে বসতে বললো, “আচ্ছা! ভুল হয়ে গিয়েছে! স্যরি!”
.
“অরণী, শ্রেমার কথা আমি আর কখনো শুনতে চাইনা! শ্রেমা বলে কারো কথা আমি আর মনে রাখতে চাইনা! মাধূর্য তোমার আর আমার সন্তান! মাধূর্য এটাই জানবে, আর তুমি আমিও এটাই জানবো!”
.
“তুমি চাইলেই ভুলতে পারবে?”
.
অরূপ চোখ বন্ধ করে চুপ করে থাকলো!
.
“অরূপ যা হয়েছে, সবকিছুকে স্বাভাবিকভাবে নাও, তাহলে দেখবা, আর খারাপ লাগছেনা! শ্রেমা আপা যেটা করেছে, সেটা অন্যায়! একসয় তো তিনি তোমাদের ভালো রেখেছিলে.. কিন্তু সে তোমার, মাধূর্যের জীবনে এখনোও থাকলে, তোমরা কেউ ভালো থাকতে পারতেনা! শ্রেমা আপার ভালোলাগাটা অন্য কোথাও ছিলো। তুমি ওনাকে ক্ষমা করে দাও! উনি যার সাথে আছে, তার সাথেই ভালো থাকুক!”
.
অরূপ বিছানায় উঠে বসতে বসতে থমথমে গলায় বললো, “তুমি আমার সাথে ভালো থাকবে, অরণী? হঠাত যদি কখনো মনে হয়, মাধূর্যের সাথে, আমার সাথে, অন্যকেউ একসময় জড়িয়ে ছিলো?”
.
“অতীতে কি ছিলো, তা নিয়ে আমার কোনো যায় আসেনা, অরূপ! তখন তো আমি ছিলাম না! কিন্তু এখন আমি আছি! আর আমার অস্তিত্ব হয়ে তুমি আছো, মাধূর্য আছে! মাধূর্য আমারই মেয়ে, আমারই অংশ, আমার মনের সবচেয়ে বড় একটা অংশ!”
.
.
.
অরণীরা বাড়ি ফিরার জন্য পরদিন সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লো! অরূপ রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাত রিকশা থামিয়ে বারোটা গ্যাসবেলুন কিনলো! রিকশায় উঠে অরণীর হাতে দিয়ে বললো, “আমাদের বাড়িতে প্রথম আসার দিন তো একটা বেলুন হাতছাড়া করে ফেলেছিলা। আজ দেখি কয়টা সামলাতে পারো! তুমি যা ধিঙি মেয়ে, একটা সামলানো মানেই বিশাল ব্যাপার!”
.
অরণী ভেঙচি কেটে বেলুনগুলো হাতে নিয়ে হাসি হাসি মুখে উপরে বেলুনগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমার মতো অগোছালো একটা ছেলেকে সামলানোর দায়িত্ব নিয়ে ফেললাম, এরপরেও বলবা, গ্যাসবেলুনের সুতা সামলাতে পারবোনা আমি?”
.
“আচ্ছা, যদি বারোটাই সামলায় নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে পারো, তাহলে মানবো, তুমি আমাকে সামলায় রাখতে পারবা!”
.
“বাজি ধরতিছো?” ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো অরণী!
.
“তেমনটাই মনে করো!”
.
.
অরণীরা যখন বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো, তখন বাড়ির প্রায় সবাই উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে! আতাহার সাহেবও এসেছেন! বোধহয় সবাই তাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলো! রিকশায় ওঠার পর অরূপ বাড়িতে ফোন করে জানিয়েছিলো যে তারা ফিরছে!
অরণী বাড়ির গেট পেরিয়ে ঢুকতেই মাধূর্য মা মা করে ছুটে এলো! এতগুলো বেলুন দেখে চোখ বড় বড় করো মাথা উচিয়ে তাকিয়ে আছে মাধূর্য। অরণী গ্যাসবেলুনের লম্বা সুতাগুলো মাধূর্যের হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বললো, “শক্ত করে ধরো মা! নাহলে উড়ে যাবে!”
.
মাধূর্য বাধ্য মেয়ের মতো বেলুনগুলো ধরে নিয়ে “বুবু, বুবু, দেতো, তত বেউন” বলতে বলতে পিছনে ঘুরে রেহেনা বেগমের দিকে ছুটে যাচ্ছিলো! দুই হাতে বেলুনগুলো ঠিক করে ধরতে গিয়ে একটা বেলুন হাতছাড়া হয়ে ফুস করে উড়ে গেলো! মাধূর্য থেমে গিয়ে কাঁদোকাঁদো চেহারায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো!
.
অরূপ হেসে ফেলে বললো, “দেখতে হবেনা, কার মেয়ে? শেষ পর্যন্ত হাতে এগারোটা বেলুনই থাকলো!”
.
অরূপের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো! রেহেনা বেগম মুগ্ধচোখে ছেলে আর ছেলের বউমার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকালেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে করে বললেন, “হে সৃষ্টিকর্তা, ওদের সুখী করো! এই সুখমিলন যেনো আজীবন স্থায়ী থাকে, তুমি দেখো!”
.
.
((সমাপ্ত))

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে