গ্যাসবেলুন পর্ব-১০

0
1000

#গ্যাসবেলুন
#পর্ব_১০
লেখাঃ Nobonita Ferdows
.
“ব্লাউজের পিঠ এতদুর পর্যন্ত খোলা কেনো? আসার থেকে তো দিনরাত এলোচুলে লাফায় বেড়াইতে দেখলাম, আজকে আবার খোঁপা? রাস্তার লোকদের ধবধব সাদা পিঠ দেখানোর শখ হইছে?” দাঁতমুখ খিঁচিয়ে হড়বড় করে বললো অরূপ।
.
অরণী এমন কিছুর জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলোনা। হতণম্ব হয়ে অরূপের দিকে তাকিয়ে আছে সে, কথা বলার শক্তিটা পর্যন্ত নেই তার। চোখের কোণায় পানি এসে গিয়েছে তার।
.
অরূপ অরণীর চুলের কাটা টা অরণীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে রিকশা ডাকলো। রিকশায় উঠে বসে অরণীর দিকে তাকিয়ে বললো, “উঠে পড়ুন!”
.
অরণী স্বাভাবিক গলায় বললো, “আমি যাবোনা কোথাও!”
.
অরূপ চোখ কটমট করে তাকিয়ে বললো, “কি বললেন?”
.
“আমি আপনার সাথে কোথাও যাবোনা!”
.
“কথা বাড়াবেন না। নাহলে আপনাকে পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে রিকশায় বসাবো!”
.
অরণী কঠিন মুখে রোবটের মতো উঠে বসলো রিকশায়।
.
“মামা, মগবাজার যাবো!”
.
অরণী বুঝতে পারলোনা বাইক থাকতে অরূপ তাকে নিয়ে রিকশায় কেনো উঠলো। মগবাজারে কেনো যাচ্ছে তারা? সে কি প্রশ্ন করবে? অবশ্য করলেও ব্যাঙ্গাত্মক কোনো উত্তরই পাবে!
.
“মগবাজার কেনো যাচ্ছি আমরা?”
.
“বিয়ে করতে!”
.
অরণী তাজ্জব হয়ে বললো, “জি?”
.
“আপনার এত কৌতুহল কেনো? সঙ্গে যাচ্ছেন, এখন চুপচাপ বসে থাকুন!”
.
অরণীর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। কিন্তু সে কিছুই বলতে পাচ্ছেনা৷ এই ছেলেটার ওপর রাগ দেখানোর অধিকার কি তার আছে?
.
“আপনার বাবাকে যদি এখন আমি ফোন করে বলি যে আমি আপনাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি, উনি কি করবেন?”
.
অরণী ভ্রু কুঁচকে বললো, “আপনার মাথা কি পুরোপুরি খারাপ?”
.
“না। এখনো হয়নি। তবে, হবে মনে হচ্ছে!”
.
অরণী বিরক্তমুখে বাইরের দিকে তাকালো। বাইরে ফোটা ফোটা বৃষ্টি পড়ছে৷ শ্রাবণ মাসে ঝুমঝুমান্তি বৃষ্টি হয়না, টিপটিপ বৃষ্টি হয়!
.
“আচ্ছা অরণী, তুমি কখনো ঝুম বৃষ্টিতে রাস্তার পাশে টঙ্গে দাঁড়িয়ে গরম গরম সিঙ্গারা আর চা খেয়েছো?”
.
“না!”
.
“আজ খাবে?”
.
“সিঙ্গারা আর চা নাহয় খাওয়া যাবে! কিন্তু ঝুমবৃষ্টিতে না, এমন টিপটিপ বৃষ্টিতে খেতে হবে!”
.
“ঝুমবৃষ্টি হবে। আর ঘন্টা দুয়েক এর মাঝেই তুমুল বৃষ্টি নামবে, কুত্তা-বিড়াল বৃষ্টি নামবে।”
.
“কি বৃষ্টি নামবে?” চোখ কুঁচকে অরণী প্রশ্ন করলো।
.
“কুকুর-বিড়াল বৃষ্টি; rain cats & dogs! মানে মুষলধারার বৃষ্টি।”
.
অরণী হেসে ফেললো। সে হঠাত হাসি থামিয়ে খেয়াল করলো অরূপ এতক্ষণ ধরে তাকে তুমি করে সম্বোধন করছে। অথচ তার একমুহূর্তের জন্যেও মনে হয়নি, তাদের মধ্যে সম্পর্কটা এতটাও কাছের হয়ে ওঠেনি!
.
“মামা, সামনে বায়ে সাইড করেন!”
.
রিকশা থামলো মগবাজার কাজি অফিসের সামনে। অরূপ ভাড়া মিটিয়ে অরণীর হাত ধরে বললো, “চলো!”
.
“এখানে কেনো?”
.
“বললাম না, বিয়ে করতে!”
.
“আপনি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন?”
.
“তুমি যা মনে করো!”
.
অরূপ কাজি অফিসে ঢুকতে ধরে থমকে দাঁড়ালো!
.
“আচ্ছা শুনো, এক কাজ করো, তোমার বাবাকে একটা ফোন করো!”
.
“বাবাকে? কেনো?”
.
“আরে, ওনাকে জানাতে হবেনা, যে আজ আমাদের বিয়ে?”
.
অরণী কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, “আপনি কি বলছেন না বলছেন, আমি কিচ্ছু বুঝতে পারতিছিনা! আপনি আমার সাথে এমন মজা কেনো করছেন, বলুন তো? আর কত কাঁদাবেন আমাকে?”
.
“এমনে এখানে দাঁড়ায় কান্দিয়ো না দয়া করে! লোকজন তো আমাকে কিডন্যাপার মনে করে পিটাবে ধরে!”
.
অরণী ছলছল চোখে অরূপের দিকে তাকিয়ে আছে।
“আচ্ছা থাক, তোমাকে বলতে হবেনা। বিয়ের পর দুজনে একসাথে গিয়ে বলে আসবো! তারচেয়ে বরং রেহেনা বেগমকে একটা ফোন করে জানিয়ে দেই যে আমরা বিয়ে করছি। ভদ্রমহিলার অনেকদিনের চেপে রাখা কষ্ট তাতে যদি একটু কমে!”
.
অরণী বিস্মিত হয়ে বললো, “রেহেনা বেগম কে?”
.
“ছি ছি ছি অরণী! তুমি তোমার শাশুড়ী মায়ের নাম মুখে নিয়ে ফেললে! এতো বউমা জাতির কলঙ্ক!”
.
অরূপ পকেট থেকে ফোনটা বের করে তার মায়ের নম্বর ডায়াল করলো৷ একবার রিং হতেই তিনি ফোন ধরলেন!
“হ্যালো, আম্মা! শুনো, আমি আজরাতে বাসায় ফিরবোনা। কালসকালে বরণডালা সাজিয়ে রাখিয়ো। তোমার জন্য চাকরানী নিয়েই বাসায় ঢুকবো! তোমাকে আর একা একা সংসারের হাল টানতে হবেনা!”
.
রেহেনা বেগম ফোনের অপরপাশ থেকে কি বললেন, অরণী শুনতে পেলোনা! অরূপ আর কিছু বললোনা, খট করে ফোনের লাইন কেটে দিয়ে আবার অরণীর হাত ধরে কাজি অফিসের ভিতরে ঢুকলো।
.
.
অরণীর সাথে অরূপের বিয়েটা হয়ে গেলো হঠাত করেই, আকস্মিকভাবে কিংবা পরিকল্পনামাফিকভাবেই। বিয়ের সাক্ষী হিসেবে দুজনের একজন হলো সাদিক, অরণীর স্কুলফ্রেন্ড! অরূপ অরণীকে না জানিয়েই আজ সকালেই সাদিকের সাথে যোগাযোগ করে; সে নিজেই অরণীর পক্ষের সাক্ষী হতে রাজি হয়! আরেকজন সাক্ষী হলো সিন আপা, অরূপের চাচাতো বোন। তিনি গতকালই ঢাকায় এসেছেন। তার শ্বশুড়ের একটা বিশাল ভিটা আছে ঢাকায়, আপাতত সে সেখানেই উঠেছিলো। কিন্তু সকাল সকাল ছোটভাইয়ের ফোনের জরুরী তলব পেয়ে অরণী-অরূপের বিয়ের সাক্ষী হতে চলে এসেছেন!
.
অরণী এখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা, তার বিয়েটা এভাবে হয়ে গেলো! সে এখনো বাবাকে কিছু জানাতে পারেনি! বাবা জানতে পারলে কি করবেন, সে ভাবতে পারছেনা!
.
সিন আপু রেজিষ্ট্রেশনের কাজের পরপরই চলে গেলেন। অরূপ অরণীকে নিয়ে কাজি অফিস থেকে বের হলো। অরণী এতক্ষণ ধরে কবুল ছাড়া আর কোনো কথাই বলতে পারেনি। সে কবুলও বলেছে পুরোপুরি ঘোরের মধ্যে।
.
অরণীরা কাজি অফিস থেকে বেরোনোর পরপরই মুষলধারার বৃষ্টি শুরু হলো। অরূপের ভাষায় কুকুর-বিড়াল বৃষ্টি নেমে এলো। অরূপ অরণীর হাত এখনো ধরে আছে। একমুহূর্তের জন্যেও সে অরণীর হাতটা ছেড়ে দেয়নি!
.
“চা খাবেন?”
.
“আপনি তখন থেকে আপনি থেকে তুমি হয়ে আবার আপনিতে ফিরে যাচ্ছেন! মানুষকে কনফিউশানে ফেলা কি আপনার জন্মগত অভ্যাস?”
.
“সামনে একটা হোটেল আছে। হেব্বি সিঙ্গাড়া বানায়৷ সিঙ্গারা সাইজে তেমন বড় না, কিন্তু খেতে অমৃত! একবার খেলে আর কোনোদিন ভুলতে পারবিনা!”
.
অরণী চমকে গিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালো অরূপের দিকে।
.
“নিজের বউকে আমি যা ইচ্ছে ডাকবো, তুই বলার কে?”
.
অরণী হেসে ফেললো। অরূপের মুখে তুই তোকারি শুনতে তার খারাপ লাগছেনা!
.
অরূপ অরণীর হাত ধরে বৃষ্টিতে নেমে গেলো। দুজনে হেঁটে এসে হোটেলের সামনে দাঁড়ালো। এতটুকু পথ হেঁটে আসতে গিয়ে, অরণী অরূপ দুজনেই ভিজে একাকার হয়েছে। অরূপের কালো পাঞ্জাবি ভিজে লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। অরণী এতক্ষণে খেয়াল করলো, অরূপ তার সাথে মিলিয়ে কালো পাঞ্জাবি পড়েছে! আশ্চর্য! সে আগে খেয়াল করেনি কেনো!
.
অরণী জীবনে প্রথমবারের মতো এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তার পাশে রাত নয়টায় দাঁড়িয়ে সিঙ্গারা আর চা খেলো। আজকের দিনটা এমন হবে কে জানতো! অরণী মন্ত্রমুগ্ধের মতো অরূপের দিকে তাকিয়ে আছে। অরূপও তার দিকে তাকিয়ে আছে! কারো চোখের পলক পড়ছেনা! কার চোখের পলক আগে পড়বে?
.
অরণী হেরে গেলো। তার চোখে পানি এসে গিয়েছে। চোখে পানি নিয়ে পলকহীন তাকিয়ে থাকা যায়না!
.
“আচ্ছা, বিয়েতো হয়ে গেলো! বাসর কোথায় করা যায় বলোতো?”
.
অরণী চোখ বড়বড় করে তাকালো অরূপের দিকে!
“এভাবে বিয়ে করার কি দরকার ছিলো, অরূপ? আমাদের পরিবার তো অমত দিতোনা আমাদের বিয়েতে!”
.
“অতটাকা খরচ করে লোকজন খাইয়ে বিয়ে করার কি দরকার? একটা সামান্য ব্যাপারে এতটাকা পয়সা খরচ করার কোনো দরকার আছে?”
.
“বিয়ে মোটেও কোনো সামান্য ব্যাপার না!” অভিমানী স্বরে বললো অরণী!
.
“তোমার কি কম্যুনিটি সেন্টারে বিয়ে হলোনা বলে আফসোস হচ্ছে?”
.
“প্রত্যেকটা মেয়েরই বিয়ের দিন লাল বেনারসী পড়ে বউ সাজার স্বপ্ন থাকে, আপনি তো আমার সেই আশায় পুরো পানি ঢেলে দিলেন!”
.
“বিয়ের দিন পুতুল সেজে স্টেজে বসে থাকার চেয়ে রাতের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে বৃষ্টিতে ভিজে গরম গরম সিঙ্গারা আর চা খাওয়ার অভিজ্ঞতা কি বেশি সুন্দর না?”
.
অরণী চুপ করে থাকলো! আসলেই তার জীবনের অসম্ভব সুন্দর কিছু মুহূর্তের মধ্যে এটা একটা!
.
অরূপ চা শেষ করে বললো, “চলো!”
.
“কোথায়?”
.
“আরে, রাত বেড়ে যাচ্ছে! এরপর তো বাসর মিস করে ফেলবো!”
.
“এমন ভাব করছেন যেনো বাড়িতে আপনার জন্য ফুল দিয়ে বিছানা সাজিয়ে রাখা আছে!” মুখে ভেংচি কেটে বললো অরণী!
.
“বাহ! তোমার তো খুব বুদ্ধি! কি সুন্দর বুঝে ফেলেছো!”
.
অরণী বোকার মতো তাকিয়ে বললো, “কি বুঝে ফেলেছি?”
.
“উফফ! বড্ড বেশি প্রশ্ন করে মেয়েটা! চলো তো!”
.
এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে রিকশা পাওয়া সমস্যা হয়ে গেলো! অরূপ অনেক খুঁজে একটা রিকশা পেলো! রিকশাওয়ালা জমিদারী ভাব নিয়ে রিকশার সিটে বসে বললো, “দেড়শ টেহা দেওন লাগবো!”
.
“কত টাকা?”
অরূপ চোখ কপালে তুলে বললো, “চল্লিশ টাকার ভাড়া দেড়শো টাকা চাচ্ছেন? রাস্তা চিনেন আপনি?”
.
রিকশাওয়ালা আগের চেয়ে বেশি ভাব নিয়ে বললো, “গেলে চলেন, না গেলে নাই!”
.
রিকশাওয়ালা প্যাডেলে চাপ দিতেই অরূপ চেঁচিয়ে উঠলো, “থামেন থামেন! ঝড় বাদলার দিনে রাস্তায় যানবাহন কম বলে ভালো সুযোগ পেয়ে গেলেন! অরণী উঠো!”
.
অরণী উঠে বসলো! অরূপ অরণীর গা ঘেষে উঠে বসলো! অরণী আচমকা কি মনে করে অরূপের কপালে হাত দিয়ে বললো, “একি! আপনার গা তো জ্বরে পুরে যাচ্ছে! জ্বর কখন এলো?”
.
“সকাল থেকেই একটু খারাপ লাগছিলো! ও কিছুনা! সেরে যাবে!”
.
“সেরে যাবে মানে? সকাল থেকে খারাপ লাগলে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজলেন কেনো আপনি? ইসস… কতক্ষণ থেকে ভিজা পাঞ্জাবিটা গায়ে আছে! জ্বর কতটা বেড়েছে, আপনার ধারণা আছে?”
.
অরূপ ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতো হাসলো। তারপর হঠাত অরণীর কাঁধে মাথা দিয়ে অরণীর কোমড় জড়িয়ে বিড়বিড় করে বললো, “অরণী…. অরু…. ভালোবাসি!”
.
অরণী চিন্তায় পড়ে গেলো! অরূপের জ্বর ক্রমশ বেড়েই চলেছে! আর কতক্ষণ যে লাগবে বাড়ি ফিরতে!
.
.
চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে