খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
171

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২৫
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

রজনীর আঁধার কেটে গিয়ে প্রভাতের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিটি মানুষ নিদ্রা দেশে তলিয়ে আছে। নির্ঘুম রজনী পার করেছে মুনতাসিম। অদ্ভুত ভাবে বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রনায় সারারাত ছটফট করেছে। তার মানতেই কষ্ট হচ্ছে মেহেভীন তাকে বিশ্বাস করে না। সে শক্ত মনের অধিকারী জন্যই হয়তো নিজেকে সামনে নিয়েছে। ভাগ্যিস ভেতরের খবর কেউ দেখতে পায় না। তাহলে সবাই এতক্ষণে মুনতাসিমের জন্য আকুল হয়ে উঠত। ভেতরটা রক্তাক্ত করে দিয়ে চলে গিয়েছে মেয়েটা। বেহায়া মন শুনেনি মেয়েটাকে বোঝানার জন্য আরো একবার চেষ্টা করেছিল। যার পরিনাম সে এখন প্রেয়সীর ব্লক লিস্টে। সারারাত না ঘুমানোর ফলে আঁখিযুগল রক্তিম ধারণ করেছে। প্রয়োজনের তুলনায় চোখ ফুলেছেও বেশ। বেলকনির গ্রীল ধরে আকাশ পাশে চেয়ে আছে মুনতাসিম। মুখ দিয়ে অস্ফুত স্বরে বেড়িয়ে আসলো,

–আপনি আমার মুখ দেখতে চান না। আমিও আপনার সামনে যাব না। ভালোবাসলেই যে তাকে পেতে হবে। তার কোনো মনে নেই। সব পেয়ে গেলে আক্ষেপ ফুরিয়ে যাবে। আক্ষেপ করার জন্য হলে-ও আমি আপনার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করব। নিজের সক্রিয়তা কতটুকু বজায় রাখতে পারব। তা আমি জানি না তবে আপনি আমার সামনে আসলে, আমি সবকিছু ভুলে আপনাতেই মিশে যাই। ভুলে যাই সব অভিমান অভিযোগ। আপনি মানুষটা আল্লাহ তৈরি নিখুঁত সুন্দর মানবী। আমার অভিমান গুলোও আপনার প্রেম পড়তে বাধ্য হয়৷ সেখানে আমি তো তুচ্ছ মানব। কথা গুলো আনমনে ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো।

মাত্র দুই ঘন্টা ঘুমিয়েছিল মুনতাসিম। তখনই মুঠোফোনটা শব্দ করে বেজে উঠে। বিরক্তিতে মুখশ্রী কুঁচকে এল তার৷ সে নিদ্রা মিশ্রিত কণ্ঠে ফোন তুলল। ওপর পাশ থেকে তাইয়ানের চিন্তিত কণ্ঠ স্বর ভেসে এল। মুনতাসিম তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–কে সে? তাড়াতাড়ি আমাকে তার নাম বলো না হলে ফলাফল ভালো হবে না, বলে দিলাম।

–তাহিয়া ম্যাডাম এসব করেছেন। শুধু তাই নয় আপনাকে নিজের স্বামী বলে পরিচয় দিয়েছে। সে আরো বলেছে সে দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আপনি তাকে নিয়মিত মা’রধর করেন। সে মেহেভীন ম্যাডামকে আপনার জীবন থেকে দূরে সরে যেতে বলছে। তাছাড়া মেহেভীন ম্যাডাম… তাইয়ানের কথা শেষ হবার আগেই মুনতাসিম কল কেটে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে ফুরফুরে মেজাজে ড্রয়িং রুমে আসলো। সেখানে সকাল সকাল চায়ের আড্ডা জমেছে বেশ। মুনতাসিম আয়েশী ভঙ্গিতে সোফায় গিয়ে, তার ফুপির পাশে গিয়ে বসলো। কিছুটা লাজুক মুখশ্রী করে বলল,

–আমাকে তোমার কেমন লাগে ফুপি? মুনতাসিমকে কখনো পরিবারের আড্ডায় বসতে দেখা যায় না। মুনতাসিমকে দেখে সবাই বিস্ময় নয়নে তার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুহুর্তের মধ্যে পরিবেশ শীতল হয়ে উঠল। নিস্তব্ধতার রাজত্ব চলছে চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি কোণায়। এ যেন ঝড় আসার পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছে। সবাইকে শীতল হয়ে যেতে দেখে সুফিয়া চৌধুরীর মুখে ভাঁজ পড়ল। সে আনন্দিত হয়ে মুনতাসিমকে বলল,

–তোর মতো ছেলে যার ঘরে হবে। সে তো ভাগ্যবতী রে। তোর মতো হীরাকে অপছন্দ করার কোনো কারন আছে। এতদিন পর বুঝি ফুপির কথা মনে পড়ল। সে কবে এসেছি। সারাদিন বাসায় থাকিস না। রাতে কোনোরকম আসিস। ভোর হবার সাথে সাথে তোর খোঁজ পাওয়া যায় না। তুই আমাকে আগে কতটা ভালোবাসতি রে মুনতাসিম। এখন কি ফুপিকে আর ভালো লাগে না।

–আমি এত সহজে আমার ফুপিকে ভুলতে পারি। আমি আমার ফুপির শখের ফুলদানিটা ভেঙে ফেলে দিয়েছিলাম। শাস্তি স্বরুপ শীতের দিনে কনকনে ঠান্ডা পানিতে দুই ঘন্টাটা ডুবে থাকতে হয়েছিল। ছোট্ট মুনতাসিমের সহ্য ক্ষমতা কম ছিল। মা টাও ছিল না। এই সুযোগটা হাতিয়ে নিলেন। আমার মাকে আল্লাহ নিয়ে গিয়েছেন তার কাছে। এই সুযোগ হাত ছাড়া করা যায়। সেদিন আমি পানিতেই জ্ঞান হারালাম। ভাগ্য সহায়ক ছিল বলেই আব্বা আমায় খুঁজতে এসে পেয়ে যায়। তারপর দু’দিন আমার কোনো জ্ঞান ছিল না। পনেরো দিন হসপিটালের বেডে থাকতে হয়েছে। কত রাত যন্ত্রনায় ছটফট করেছি। মা মা করে ডেকেছি। ছোট্ট মুনতাসিমের পাশে কেউ ছিল না৷ আদরের সন্তানের জন্য সেদিন আব্বাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছি। সেদিনই উপলব্ধি করেছিলাম। যার মা নেই তার কেউ নেই কেউ না। একটু ভুল হলেই আপনার চড়,বিশ্রী ভাষায় গালি, আমার নামে সৎ মায়ের কাছে বি’ষ ঢালা সবকিছুই দেখেছি। এত ভালোবাসা কি এত সহজেই ভুলে যাওয়া যায় ফুপি। মনে নেই দুধের সাথে বি’ষ মিশিয়ে মা’র’তে চেয়েছিলেন। সেইদিনের ভালোবাসা আমি কখনোই ভুলব না। সেদিনের কথা মনে হলে আনন্দে আমার ভেতরটা ছটফট করে। মুনতাসিমের কথায় সুফিয়া চৌধুরীর সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। অতীতে করা পাপ গুনো যত্ন সহকারে মুনতাসিম তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটার মধ্যে দারুন প্রতিভা আছে। মিষ্টি কথায় কত সুন্দর করে অপমান দিল। সুফিয়া চৌধুরীর মুখটা দেখে মুনতাসিমের ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। পুরোনো ক্ষত যেন নতুন করে জাগ্রত হয়ে গেল। চোয়াল শক্ত করে মুখশ্রীতে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,

–আমাকে জামাই হিসেবে কেমন লাগে আপনার? মুনতাসিমের কথায় রিয়াদ চৌধুরী বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। সবার দৃষ্টি মুনতাসিমের দিকে স্থীর। সমস্ত অপমান ভুলে সুফিয়া চৌধুরীর মুখশ্রী চিকচিক করে উঠল। সে কিছুটা আদুরে কণ্ঠে বলল,

–আমি জানতাম আমার বাবা আমার মনের কথা বুঝবে। আমি তোকে শক্ত করার জন্যই ছোট বেলার বারবার তোকে আঘাতপ্রাপ্ত করেছি। এই জন্য আজ তুই এতটা শক্ত হয়েছিস। কার জন্য হয়েছিস। আমার ওপরে রাগ করেই তো হয়েছিস। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল। সে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল,

–মুনতাসিম তার মায়ের মতো হয়েছে। তার মায়ের সহ্য ক্ষমতা ছিল বলেই, এই নিকৃষ্ট পরিবারে মানুষদের সাথে কতগুলো বছর সংসার করতে পারছে। আপনিই বলুন আপনাদের মানুষদের কাতারে ধরে?

–আমি তোমার ফুপি হই ভুলে যাচ্ছ!

–সামনে আপনি আমার শাশুড়ী হতে চলেছেন। আমি কি আমার শাশুড়ীর সাথে একটু মশকরা করতে পারি না। আচ্ছা আপনি রাগ করবেন না। এখন বলুন আপনার মেয়ে কোথায়? তাকে দেখার জন্য ভেতরটা ছটফট করছে। কবে থেকে তাকে দেখিনা। তার মায়াবী মুখশ্রী দেখে পরাণটা শীতল করতে চাই। মুনতাসিমের কথায় সবার আঁখিযুগল আপনা-আপনি বড় হয়ে গেল। কিন্তু সুফিয়া চৌধুরীর মুখশ্রীতে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। যে আশা নিয়ে এতদিন বুক বেঁধে ছিল। আজ সেই আশা পূর্ণতা পেতে চলেছে। সে আঙুল দিয়ে মাশরাফির পাশের কক্ষটা দেখিয়ে বলল,

–ওখানে তাহিয়া আছে। মুনতাসিম মুহুর্তের মধ্যে লাজুক মুখশ্রী করে ফেলল। লজ্জা মাখা কণ্ঠে বলল,

–আমি যাই আপনার মেয়ের সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে আসি। রিয়াদ চৌধুরী মুনতাসিমকে বাঁধা দিতে আসলে, মুনতাসিম রক্তিম দৃষ্টিতে বাবার দিকে দৃষ্টিপাত করে। আঁখিযুগল দিয়ে তার আগুন ঝরছে। মুনতাসিম হাতের ইশারা করে দেখাল। সে তার কাজে বাঁধা সৃষ্টি করলে সে নিজেই নিজের শরীর গু’লি চালিয়ে দিবে। রিয়াদ চৌধুরী অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়লেন। একদিকে ছেলের জীবন অন্য দিকে তাহিয়ার জীবন। সে কাকে বাঁচাবে? অজানা ভয়ে বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ইতিমধ্যেই তাইয়ান রিয়াদ চৌধুরীকে সমস্ত কথা খুলে বলছে। ছেলেটা তার ভিষণ নিষ্ঠুর। মেয়েটা আবেগে বশিভূত হয়ে ভুল জায়গায় আঘাত করেছে। সে মুনতাসিমের ব্যক্তিত্বের আঘাত করেছে। মেয়েটাকে বাঁচতে দিবে না মুনতাসিম।

সূর্যের সোনালী রশ্মি মেহেভীনের মুখশ্রীতে আঁচড়ে পড়ছে। কালকে নিজেকে পাগল মনে হচ্ছিল মেহভীনের। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। অকেজো মস্তিষ্ক নিয়ে ছটফট করতে করতে নিদ্র দেশে তলিয়ে গিয়েছে। মাথাটা এখন বেশ হালকা লাগছে। ঘুম থেকে উঠলে অনুভব করা যায়। ঘুম হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। কালকে সমস্ত চিন্তায় একটা কাজও মস্তকে প্রবেশ করছিল না। মস্তিষ্ক গভীর ভাবে সজাগ হতেই কালকের সমস্ত ঘটনা মনে পড়ে গেল। নিজের অজান্তেই সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। ভেতরটা যন্ত্রনায় হুঁ হুঁ করছে। মানুষটার ব্যক্তিত্বে আঘাত করেছে সে। মানুষটা তাকে ক্ষমা করবে তো। মেহেভীন বিলম্ব করল না। দ্রুত ফোন বের করল। কোনোদিন কাউকে ফোন করার সময় তার হাত কাঁপেনি। তবে আজ কাঁপছে। অপরাধ বোধে ভেতরটা তচনচ হয়ে যাচ্ছে। দু’বার ফোন বেজে কেটে গেল। মেহেভীন চারবার ফোন করল। পাঁচ বারের বেলায় ফোনটা কেটে দিল। পরের বার ফোন করতেই মেহেভীন অনুভব করল নাম্বারটা ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। মেহেভীন সাথে সাথে মেসেজ করল। আমাকে একটা বার ক্ষমা করে সুযোগ দেওয়া যায় না৷ সত্যিটা সামনে নিয়ে আসার জন্য। মেসেজ ব্লকটাও মুহুর্তের মধ্যে হয়ে গেল। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে মেহেভীনের। এত বাজে ভাবে জ্বালা করছে মনটা। মেহেভীনকে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে, রুপা আসলো তার কক্ষে। কালকে মেহেভীন দরজা না লাগিয়েই ঘুমিয়েছিল। রুপাকে দেখে শান্ত দৃষ্টিতে একবার পরখ করে নিল মেহেভীন।

–আমি বোধহয় জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেই ফেললাম রুপা। সমস্ত শরীর যন্ত্রনায় জ্বলে যাচ্ছে আমার। মানুষটা আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না। আমার উচিত চিল৷ একটা বার ঐ মেয়েটাকে তার সামনে উপস্থিত করা। আমি নিজের কথা ভেবেছি। মানুষটাকে একটা বার বোঝার চেষ্টা করিনি। মানুষটা কালকে গ’লা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করছে, আমার সাথে একটু কথা বলার জন্য আমি স্বার্থপরের মতো তার নাম্বার ব্লক করে আরামে ঘুমিয়েছি। আল্লাহ ভালো জানেন কিভাবে মানুষটা রাত পার করেছেন। ফোন দিলাম আমার ফোনটা ধরল না রে রুপা। মানুষটা আমার জীবন থেকে চলে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচব। মেহেভীনের অসহায়ত্ব দেখে রুপার কোনো ভাবান্তর হলো না। তার মুখশ্রীতে বিরক্ত ফুটে উঠল।

–আপনি কার জন্য কষ্ট পাচ্ছেন আপা। যে মানুষটা আপনাকে ঠেকিয়েছে। আপনি যা করেছেন একদম ঠিক করেছেন। মানুষটাকে আমার একদম পছন্দ ছিল না। সেদিন ছাদে সে আমাকে অচেতন করে রেখে এসেছিল। আমি থাকলে তার সমস্যা হতো। আমাকে সরিয়ে আপনার থেকে সুযোগ নিতে চেয়েছিল। প্রথম থেকেই মানুষটার চরিত্রে সমস্যা ছিল। এমন চরিত্রহীন ছেলের জন্য এতটা কষ্ট পাবেন না। আপনার জন্য কত সুন্দর সুন্দর ছেলে পাগল। রুপার কথায় মেহেভীন মুহুর্তের জ্বলে উঠল। রক্তিম চোখে রুপার দিকে তাকিয়ে আছে। একবার রুপা বলে চেঁচিয়ে সাবধান করেছে। তবুও রুপা শুনছে না। মেহেভীন রাগান্বিত হয়ে রুপার গালে থা’প্পড় বসিয়ে দিল।

–অন্যকে খারাপ বলার তুই কে? তুই নিজের যোগ্যতা ভুলে যাস না। তুই কি করে বেড়াস সেসব আমি জানিনা মনে করেছিস। আমার সামনে মুনতাসিমকে নিয়ে বাজে কথা বললে, তোর জিভ আমি টেনে ছিঁ’ড়ে ফেলব। আমার জিনিসে বলার অধিকার শুধু আমারই। আমার জিনিস নিয়ে কথা বলার অধিকার আমি তোকে দেইনি৷ তাকে খারাপ বললেও আমি বলব৷ ভালো বললেও আমি বলব। তুই যে মুনতাসিমকে আঁড়চোখে দেখিস৷ তোর মনের অন্তরালে কি চলে। সেটা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। আমার সামনে থেকে চলে যা। না হলে তোকে আমি খু’ন করে ফেলব। রুপা অশ্রুসিক্ত নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে৷ মেহেভীন রুপাকে উপেক্ষা করে ওয়াশরুমে চলে গেল।

তাহিয়া বই পড়ছিল। মুনতাসিম এসে দরজা লাগিয়ে দিল। মুখশ্রীতে তার স্বাভাবিক ভাব ফুটে উঠেছে। মুনতাসিমকে নিজের কক্ষ দেখে রহস্যময় হাসি হেসে উঠল তাহিয়া। তা মুনতাসিমের দৃষ্টি এড়ালো না। মুনতামিস আদুরে কণ্ঠে বলল,

–বই পড়ছিস? কি বই পড়ছিস জামাইকে কিভাবে আঁচলে বাঁধতে হয়।

–বাঁধতে আর পারলাম কই। বিয়েই তো করতে পারলাম না।

–এই তুই আমার সাথে মজা করছিস৷ তোর আঁখিযুগলের সামনে তোর অর্ধাঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে। তাকে বুঝি তোর পছন্দ হচ্ছে না। আমাকে কি আর তোর পছন্দ হবে৷ কোথায় তুই কোথায় আমি। বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে পারি বল৷ মুনতাসিমের কথায় তাহিয়া আঁখিযুগল বড় বড় করে তাকলো। মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত শরীর শীতল হয়ে উঠল। সে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। মুনতাসিম তাহিয়ার কিছুটা কাছে গিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল,

–বিয়ে করেছি বহুদিন হলো। কিন্তু বাসর করা হয়নি। তাই বউয়ের সাথে শুভ কাজটা সারতে আসলাম। তোর কোনো আপত্তি নেই তো আবার৷ মুনতামিসম লাজুক ভঙ্গিতে বলল। তাহিয়ার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। গলা শুকিয়ে কাট হয়ে আসছে। মুনতাসিম কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলল,

–আমি আমার বউকে কিছু করিনি জানিস। তবুও সে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। এটা কিভাবে সম্ভব জানিস কিছু। লজ্জায় তাহিয়ার মুখশ্রী নত হয়ে আসলো। মুনতাসিম ভালো মানুষির মুখোশ ছেড়ে বের হয়ে আসলো।

–আমার কাছে আমার চরিত্র শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ছোট থেকে বড় হয়েছি। কারো সাহস হয়নি আমার চরিত্রের দাগ লাগানোর। কিন্তু তুই তো আমার চরিত্রে সোজা কলঙ্ক লাগিয়ে দিলি। তোকে শাস্তি স্বরুপ কেমন মৃ’ত্যু দিলে ভালো হয় বল তো। তুই আমার বাবার রক্তের বোনের মেয়ে। আমি তোকে কষ্ট দিয়ে মা’রতে পারি না। কেমন মৃত্যু তোর পছন্দ। আর হ্যাঁ যে কাগজ গুলো মেহেভীন কে দেখিয়েছিস। সেগুলো তাড়াতাড়ি বের করে দে। তাহিয়া থরথর করে কাঁপছে। কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না। ভয়ে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। একদম দেওয়ালের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছে তাহিয়া। মুখশ্রীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে তার।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

চৌধুরী বাড়ির প্রতিটি সদস্যের মুখশ্রীতে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সবাই সুফিয়া চৌধুরীকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তিনি সবার সব কথা শোনার পরে, রাগান্বিত হয়ে বলছে। সবাই তাকে আর তার মেয়েকে ঈর্ষা করে। সেজন্য তার কানে বি’ষ ঢালছে। রিয়াদ চৌধুরী মাশরাফিকে অনবরত ফোন দিয়েই যাচ্ছে। মাশরাফির কক্ষের মধ্যে দিয়ে আরেকটা দরজা আছে। যেটা দিয়ে পাশের কক্ষে প্রবেশ করা যায়। মাশরাফির ফোন সাইলেন্ট থাকায় সে টের পাচ্ছে না। রিয়াদ চৌধুরীর ললাটে চিন্তার ভাজ পড়েছে কয়েকটা। তা দেখে সুফিয়া চৌধুরী বিরক্ততে নিজের মুখশ্রী কুঁচকে ফেলছে।

–তুই আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না। আমি তোকে কাগজ গুলো বের করে দিতে বলছি। এভাবে সঙ্গের মত দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমি তোর কাছে আসলে ফলাফল ভালো হবে না। আমার চরিত্রে কলঙ্ক লাগানোর কত গুলো সময় পেরিয়ে গেছে। তুই যে এখনো বেঁচে আছিস। এটাই তোর ভাগ্য ভালো। মুনতাসিমের কথায় তাহিয়ার রুহু পর্যন্ত কেঁপে উঠল। এত সহজে সে ধরা পড়ে যাবে। সেটা কল্পনা ও করতে পারেনি সে। মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়েছে তার। সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তাহিয়াকে নিরব থাকতে দেখে মুনতাসিম দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

–কাগজ গুলো দিবি কি না? হ্যাঁ অথবা না।

–না দিব না। কারন আমি তোমাকে ভালোবাসি ভাইয়া। আমার ভালোবাসার মানুষকে চোখের সামনে অন্য কেউ নিবে যাবে। সেটা আমি সহ্য করব না। যেটা আমার না সেটা কারো না।

–হুট করে ভালোবাসি বলাটা উপন্যাসের গল্পেই বেশি মানায়। কাউকে ভালোবাসি বলার আগে মানুষটার ভয় সম্পর্ক জানতে হয়। মানুষটার সীমাবদ্ধতা কতটুকু সেটা জানতে হয়। তার ঘৃণা, তার হতাশা, তার অপ্রাপ্তি, তার ভালো লাগা না লাগা, সবকিছু সম্পর্কে জানতে হয়। মানুষটাকে গভীর ভাবে চিনতে হয়। একটা মানুষের প্রচন্ড সুখের সময়ে ভালোবাসি বলাটা যতটা সহজ। তার দুর্দিনে তাকে ভালোবাসাটা ততটাই কঠিন। তাই ভালবাসাটা মূলত দায়িত্ববোধেরই একটা বহিঃপ্রকাশ। তোর মতো বিকৃত মন মানসিকতার মেয়ে সেটা বুঝবে না।

–তুমি ঠিকিই বলেছ ভাইয়া। আমি এত সাধ্য সাধনা করে-ও তোমার মন পেলাম না। আর বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া মেয়েটা খুব সহজে পেয়ে গেল। তুমিও নির্লজ্জের মতো তার পেছনে ঘুর ঘুর করলে। আমি বেশ করেছি তাকে মিথ্যে কথা বলেছি। কোথায় গেল তার এত ভালোবাসা? নিজের প্রিয়তমকে এতটুকু ভরসা করতে পারলো না। তুমি দুই বাচ্চার বাপ হয়ে গেলে-ও আমি তোমাকে বিয়ে করতে রাজি আছি।

–ঠিক এখানেই তার আর তোর পার্থক্য। তুই মেয়ে হয়েও একটা মেয়ের সংসার ভাঙার জন্য প্রস্তুত আছিস। কিন্তু সে একটা সুন্দর সাজানো সংসার নষ্ট করতে চাইনি বলেই, বুকে পাথর চাপা দিয়ে দূরে সরে গিয়েছে। এজন্য সে আমার চোখে প্রিয়জন আর তুই আমার চোখে কালনাগিনী। মুনতাসিমের কথায় মুহুর্তের মধ্যে তাহিয়ার ভয় হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ক্রোধে সমস্ত শরীর জ্বলে উঠল। সে চিৎকার করে বলে উঠল,

–তার মতো বা’জারের মেয়েদেরই তোমাদের মতো ছেলেরা পছন্দ করে। আমার মতো ভালো মেয়েদের তোমাদের চোখেই পড়েনা। আমার মতো মেয়েরা তাদের মতো জামা…কথা গুলো শেষ হবার আগেই মুনতাসিম সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে তাহিয়ার গ’লা চে’পে ধরলো। মুনতাসিমের রক্তাক্ত আঁখিযুগল খুব কাছ থেকে দেখে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল তার। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ছুটাছুটি পর্যন্ত করতে পারছে না সে, এতটা শক্ত করে মুনতাসিম তাকে ধরেছে। বলিষ্ঠ দেহের যুবকের সাথে এত ছোট একটা শরীর যুদ্ধ করতে পারে। একটু পরেই তাহিয়ার মুখ দিয়ে গলগল করে র’ক্ত বের হয়ে আসতে শুরু করল। এই মেয়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হলে তবেই সে এই মেয়েকে ছাড়বে। তাহিয়ার শরীরটা নিস্তেজ হতে শুরু করেছে। বাঁচার জন্য যতটুকু শরীর নড়ছিল তার ধীর গতিতে নেমে আসছে। প্রচন্ড কাশি আসতে চাইছে। গলা চেপে ধরে রাখার জন্য ঠিকমতো কাশতেও পারছে না। মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দেওয়াতে মুনতাসিমের হাত খুবই দক্ষ। তা তাহিয়া মৃত্যু কাছাকাছি গিয়ে উপলব্ধি করতে পারছে। আঁখিযুগল ছোট হয়ে আসতে শুরু করেছে। তখনই কক্ষের মধ্যে রিয়াদ চৌধুরী আর আয়মান প্রবেশ করল। দ্রুত মুনতাসিমের হাত থেকে তাহিয়াকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। বাবাকে আঘাত করবে না বিধায় মুনতাসিমের হাতটা আলগা হয়ে আসলো। তখনই আয়মান তাহিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিল। সমস্ত শরীর নেতিয়ে গিয়েছে তাহিয়ার। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি বহু আগেই হারিয়েছে সে। শরীরের সমস্ত ভর আয়মানের ওপরে ছেড়ে দিয়েছে। মুনতাসিম শান্ত দৃষ্টিতে তাহিয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। রিয়াদ চৌধুরীর থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে তাহিয়ার দুই গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

–এ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিস। পরের বার কিছু বলার আগে সাবধানে বলবি। আল্লাহর কসম এর পরের বার তোকে বাঁচতে দিব না। কথা গুলো বলেই ক’ষে একটা থা’প্প’ড় বসিয়ে দিল। মুনতাসিমের ক্রোধে কাছে আয়মানও হার মেনে গেল। মুনতাসিমের শক্ত হাতের প্রহার সামলাতে না পেরে ফ্লোরে পড়ে গেল তাহিয়া। তবুও আয়মান তাহিয়াকে ধরল না। নিজের প্রাণ প্রিয় মেয়ের করুন অবস্থা দেখে শব্দ করে কেঁদে উঠলেন সুফিয়া চৌধুরী। দ্রুত তাহিয়াকে হসপিটালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো।

সকালে ফোন হাতে নিতেই কালকের সব ঘটনা আঁখিযুগলের সামনে আসতেই মেহেভীনের চোখ গুলো আপনা-আপনি বড় বড় হয়ে গেল। ছোট একটা কাহিনিকে সবাই এত বড় করে ফেলল। আজকে মেহেভীন উপলব্ধি করছে পারছে। মানুষটা আসলেই অনেক বড় মাপের মানুষ। সে ভালোবাসার মানুষ ভেবে কতটাই না তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। এতকিছুর পরে যে মানুষটা তাকে ক্ষমা করবে না। মনের অজান্তেই ভেতরটা শূন্য হয়ে গিয়েছে। মানুষটার শূন্যতায় তাকে প্রতিটি প্রহর ছটফট করতে হবে। মানুষটা কি আর ফিরবে না চেনা নীরে। কথা গুলো ভাবতেই উঠে এসে জানালর কাছে দাঁড়াল। খোলা জানালার দক্ষিণের বাড়িটা আগের ন্যায় নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। মানুষটা আর বেলকনিতে এসে দাঁড়াবে না। কেউ তার জন্য পাগলামি করবে না। কথা জালে ফাঁসিয়ে রাগিয়ে দিবে না। ভেতরটা বড্ড খালি খালি লাগছে। অপরাধবোধ ভেতরটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাসার দিকে নিষ্পলক চাহনিতে চেয়ে থাকলো মেহেভীন।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মাহতাব উদ্দিনের সামনে বসল রুপা। রুপাতে দেখে মনোমুগ্ধকর হাসি হাসলেন মাহতাব উদ্দিন। রুপা মাহতাব উদ্দিনের থেকে কাগজ গুলো নিজের হাতে নিল। এই মানুষটার ভিষণ উপকার মেহেভীন করেছে। সেজন্য কোনো সমস্যায় পড়লে, সে আঁখিযুগল বন্ধ করে মেহেভীন কাছে আসে। তার কাছে মেহেভীন ভরসার একটা বিশাল জায়গা। যেখানে অসৎ এর থেকে সৎ এর মূল্য বেশি। মাহতাব মিষ্টি হেসে বলল,

–এগুলো তুমি ম্যাডামের থেকে সাইন করিয়ে রাখবে মামনি। আমি বিকালে এসে নিয়ে যাব। আমি ম্যাডামের অফিসেই যেতাম। কিন্তু আমার বোনটা কাল রাতে স্ট্রোক করেছে। দেখতে যাব। কথা গুলো বলেই সে রুপার হাতে এক হাজার টাকা গুঁজে দিল। রুপা নিতে চাইল না। তবুও মাহতাব উদ্দিন জোর করে দিল। এটা নতুন কিছু নয়৷ এমন শতশত মানুষ তার হাতে হাজার হাজার টাকার নোট গুঁজে দিয়ে বলে, মেহেভীন যেন তাদের কাজটা দ্রুত করে দেয়৷ প্রথমে রুপা এসবে না কারলেও এখন ঝটপট নিয়ে নেয়। মাহতাব উদ্দিন চলে যেতেই রুপা কাগজের দিকে দৃষ্টিপাত করে রাখল। তারপরে টাকাটা আঁচলে বেঁধে রান্না ঘরে চলে গেল।

সকাল সকাল এমন খবর দেখে ফরিদ রহমানের মুখশ্রীতে তাচ্ছিল্য ফুরে উঠল। রাইমা বেগম গম্ভীর মুখশ্রী করে বসে আছেন। ফরিদ রহমানের আজ ভিষণ আনন্দ হচ্ছে। যে মেয়ের জন্য তার প্রেয়সী তাকে প্রহার করল। সেই মেয়েই তার মুখে চুনকালি লাগিয়ে দিল। সে অজস্র বাজে ভাষায় মেয়েকে গালি দিয়ে হাসতে হাসতে বলল,

–একটা চরিত্রহীন মেয়ের জন্ম দিয়েছ। এত অবিবাহিত ছেলের থাকা সত্বেও বিবাহিত পুরুষের সাথে নষ্টামি করে। তুমি এই মেয়ের জন্য আমাকে প্রহার করেছিলে রাইমা!

–সব সময় চোখের দেখা সঠিক হয় না। খোঁজ নিয়ে জেনেছি মুনতাসিম বিবাহিত নয়। তাহিয়া মুনতাসিমের ফুফাতো বোন। মুনতাসিমকে সে ভালোবাসে কিন্তু মুনতাসিম মেহেভীনকে ভালোবাসে। মেহেভীনকে দূরে সরানোর জন্যই মেয়েটা মিথ্যা কথা বলেছে। তোমাকে আরো একটা খারাপ খবর দেই। মেহেভীনকে বাজে কথা বলার অপরাধে মেয়েটা এখন হসপিটালে। ভালোবাসতে হলে এভাবে ভাসতে হয় বুঝলে৷ আমার নির্বোধ মেয়েটা কেন যেন খাঁটি সোনা চিনল না। খুব তাড়াতাড়ি সঠিক তথ্য সামনে চলে আসবে। তখন তোমার এসব কথা থাকবে তো। অর্ধাঙ্গিনীর কথায় ফরিদ রহমানের আঁখিযুগল বড় হয়ে আসলো। সে বিস্ময় নয়নে অর্ধাঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার প্রান প্রিয় বউটা এতটা ধুরন্ধর আর পাষাণ হয়ে গেল কিভাবে? সেটাই তিনি বুঝতে পারছেন না!

হসপিটালের কোলাহলে তাহিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। আজ সাতদিন ধরে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে সে। কণ্ঠনালি দিয়ে কোনো শব্দ বের হতে চায় না। গলাটা ভিষণ ব্যথা হয়ে আছে। জীবন বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে কিছু নরম খাবার অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে ও খেতে হয়। মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখেছে বলেই বাঁচার ইচ্ছেটা দ্বিগুণ ভাবো বেড়ে গিয়েছে। মুনতাসিম তাইয়ানকে বলে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সেদিনের ভিডিও মুছে দিয়েছে। কয়েকজন ত্যাড়ামি করেছিল। তাদের নামে সাইবার মামলা করেছিল। তারা সবাই এখন পুলিশ হেফাজতে আছে। তাহিয়ার কেবিনটা ফাঁকা হতেই মুনতাসিম আসলো তার কেবিনে। তাহিয়া খেয়ে সবেমাত্র শুয়েছিল মুনতাসিমকে দেখেই অস্থির হয়ে উঠল। তাহিয়ার নিঃশ্বাস নিতে ভিষণ কষ্ট হয়। সেজন্য অক্সিজেন মাক্স লাগিয়ে রাখা হয়েছে। মুনতাসিম এই কয়দিনে তন্ন তন্ন হয়ে খুঁজেছে কাগজ গুলো। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি। বাধ্য হয়ে তার কাছে আসতে হলো। মুনতাসিম গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,

–আমি শুধু আর একবার বলব। একবারের বেশি যদি বলতে হয়। তাহলেই আজকেই তোর জীবনের শেষ দিন। তাহিয়া কিছু বলল না৷ শুধু চুপচাপ নিজের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। তা দেখে মুনতাসিম তাহিয়ার মুখ থেকে অক্সিজেন মাক্সটা খুলে দিল। দ্রুত গতিতে তাহিয়া শ্বাস নিতে লাগলো। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে যন্ত্রনা তীব্র হতে লাগলো। সে মুনতাসিমকে ইশারা করে বলল। যে কাগজ গুলো কোথায় আছে সে বলবে। তারপরে মুনতাসিম অক্সিজেন মাক্সটা আবার পড়িয়ে দিল। তাহিয়ার কণ্ঠনালি দিয়ে যেন শব্দ বের হচ্ছে না। ভিষণ কষ্ট করে এতটুকু উচ্চারন করল, “দাদুর বাড়িতে আমার রুমে আছে কাগজ গুলো। ” তাহিয়ার কথা শেষ হবার সাথে সাথে মুনতাসিম কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। তাহিয়ার তীব্র যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতেও এক টুকরো শান্তি অনুভব করল। তার বলা মিথ্যা কথা গুলো মুনতাসিম খুব সহজেই বিশ্বাস করে নিল।

নিজের কক্ষে গম্ভীর হয়ে বসে আছে মুনতাসিম। তাইয়ান খবর নিয়ে জেনেছে। সেখানে কোনো তথ্য পায়নি। ক্রোধের আগুনে ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। সবকিছু তচনচ করে দিতে ইচ্ছে করছে। তখনই দরজায় কেউ কড়া নাড়ে, মাশরাফিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুনতাসিম বিস্মিত হলো। কিন্তু সে বাহিরে তা প্রকাশ করল না। জীবনে প্রথম মাশরাফি তার কক্ষ এল। সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–কি চাই তোমার?

–আপনার জন্য কিছু নিয়ে আসছিলাম।

–তোমার কিছু প্রয়োজন নেই আমার।

–এগুলো আপনার কাজে দিবে। ভয় পাবেন না মায়ের কথা শুনে ক্ষতি করতে আসিনি। কথা গুলো বলেই কিছু কাগজ মুনতাসিমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। মুনতাসিম কাগজ গুলোর দিকে বিস্ময় নয়নে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করল। ললাটের দু’টো রগ ফুলে উঠেছে। কর্ণের পাশ দিয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। মুনতাসিমকে এতটা উত্তপ্ত দেখে তাইয়ান দরজা কাছে এসে স্থির হয়ে গেল।

চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছে। তখনই উজ্জল শ্যাম বর্ণের এক রমনী কক্ষে প্রবেশ করে। সমস্ত কক্ষ জুড়ে নিস্তব্ধতা রাজত্ব করছে। কক্ষের ভেতর থেকে ম’দের বিশ্রী গন্ধ নাসারন্ধ্রে এসে ঠেকছে। রমনী বিরক্ত হয়ে বলল,

–আপনি কোথায়? আপনার কথা মতো দলিলে সাইন করে নিয়ে আসছি। তখনই মাঝ বয়সী একজন পুরুষ বের হয়ে আসেন। রক্তিম চোখে রমনীর দিকে দৃষ্টিপাত করেন। রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমি চারটা দলিল সাইন করাতে বলেছি। এখানে মাত্র একটা দলিল আছে।

–আপনি যেভাবে বলছেন। যেন মেহেভীন ম্যাডামকে দিয়ে অবৈধ দলিল সাইন কারনোটা পানির মতো সহজ। যেটা আপনি দেড় বছরে করতে পারলেন না। সেটা আমি আট মাসে করে দেখিয়েছি। আমি কৌশল জেনে গিয়েছি। এখন শুধু সাইন করানোর পালা৷ ম্যাডাম দেখে দেখে কাগজে সাইন করেন। যে কাগজ গুলো আমার কাছে আসে, সেগুলো ম্যাডাম শেষ আর প্রথমের পেজ গুলো দেখে। এই সুযোগ টাকে কাজে লাগিয়ে মধ্যের পেজে কাগজটা ঢুকিয়ে সাইন করিয়ে নিয়েছি। আমি না থাকলে আপনার কি হবে ভাবুন। তাই অযথা মেজাজ দেখাবেন না। ফলাফল ভালো হবে না। কথা গুলো বলেই চলে গেল রমণী। যুবকের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। সে রক্তিম চোখে রমণীর যাওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_২৭
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

কাঁধে কারো কোমল হাতের স্পর্শ পেতেই মেহেভীনের দৃষ্টি তার দিকে দৃষ্টিপাত করল। রুপা মলিন মুখশ্রীতে মেহভীনের দিকে চেয়ে আছে। মেয়েটার চোখ দু’টি ভিষণ সুন্দর। যে কেউ তার মায়াবী চোখের প্রেম পড়তে বাধ্য হবে। এতটা নিখুঁত ভাবে মহান আল্লাহ তায়ালা রুপার আঁখিযুগল তৈরি করেছেন। রুপার মলিন মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে মেহেভীনের ভিষণ মায়া হলো। মেয়েটা তার খারাপ সময়ে ছায়ার মতো পাশে থেকেছে। আর সে কি-না মেয়েটার সাথে জঘন্যতম ব্যবহার করল। মেহেভীন রুপার গালে আলতো ভাবে স্পর্শ করে বলল,

–আপার ওপরে রাগ করেছিস? মেহেভীনের কথায় রুপার আঁখিযুগল বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। সে অশ্রুসিক্ত নয়নে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে, দুই পাশে মাথা ঘুরিয়ে বোঝাল না। সে মেহেভীনের ওপরে রাগ করেনি। মেহেভীন আদুরে হাতে রুপার চোখের অশ্রুকণা গুলো মুছিয়ে দিল। রুপা দৃষ্টি নত করে দাঁড়িয়ে আছে। মেহেভীন রুপাকে উদ্দেশ্য করে কোমল কণ্ঠে বলল,

–তুই কাঁদিস না রুপা। তুই কাঁদলে আমি ভিষণ কষ্ট পাই। কতটা অসহায় অবস্থায় তোকে পেয়েছিলাম। এত গুলো দিন ধরে তোকে তিলে তিলে নিজের মন মতো গড়ে নিয়েছি। নিজের বোনের থেকে কম কিছু ভাবিনা তোকে। বোন হয়ে নিজের বোনাকে আঘাতপ্রাপ্ত করেছি। বল আমার কি শাস্তি হওয়া দরকার?

–আমি আপনার কথায় কষ্ট পাইনি আপা। আমি জানি আপনার মনের অবস্থা ভালো ছিল না। আপনার কোনো দোষ নেই। ভুলটা আমারই ছিল। আমি সবকিছু না জেনে শুনে আপনাকে আঘাত করেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন আপা। আপনি আমার সাথে কথা বলছেন না। আমার ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে আপা। আমি একটা কথাও বলব না। তবুও আপনি আমার সাথে আগের মতো কথা বলুন। রুপার কথায় মেহেভীনের বুকটা ভারি হয়ে আসতে লাগলো। সে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রুপায় মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

–এসব নিয়ে ভাবিস না। আমার কাজে যেতে হবে। টেবিলে খাবার তৈরি কর। আমি আসছি। কথা গুলো বলেই কক্ষে এসে জামা বের করতে লাগলো। রুপা কোনো কথা না বলে কক্ষ থেকে বের হয়ে চলে গেল।

মুনতাসিম গভীর ভাবে কাগজ গুলোকে পর্যবেক্ষণ করছে। তাইয়ান উৎসুক দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তখনই মুনতাসিম তাইয়ানের দিকে কাগজ গুলো এগিয়ে দিল। তাইয়ান কাগজ গুলো হাতে নিতেই মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–ভালো করে দেখে বলবে সাইন টা কার? তাইয়ান নিখুঁত ভাবে কাগজ গুলো পর্যবেক্ষণ করে নিল। আঁখিযুগল আপনা-আপনি বড় হয়ে গেল। সে বিস্ময় নয়নে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

–স্যার আপনি বিয়ে করেছেন?

–তাইয়ান আমি তোমাকে সাইনটা দেখতে বলেছি। কে বিয়ে করেছে সেটা দেখতে বলিনি। তুমি যদি দেখতে না পারো। তাহলে আরিয়ানকে পাঠিয়ে দাও। আমি আরিয়ানকে দিয়ে দেখিয়ে নিচ্ছি।

–স্যরি স্যার আর কোনোদিন আপনার অপছন্দের কাজ করব না। সাইনটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সাইনটা আপনার। কিন্তু আপনি আমাকে আপনার সাইন দেখাচ্ছেন কেন?

–সাইনটা ভালো করে দেখ সাইনের গভীরতার মাঝে ডুবে যাও। তবুও এই সাইনের রহস্য তুমি উন্মোচন করো।

–স্যার আপনি নিজের সাইন চিনেন না?

–এতদিন আমার সাথে থেকে আমার সাইনই চিনলে না! তাহলে আমাকে কি ভালোবাসলে তাইয়ান?

–আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন স্যার। এটা আপনারই সাইন।

–তুমি শিওর?

–জি স্যার।

–এখন তুমি আসতে পারো। আমি তোমার সাথে পরে কথা বলব। তাইয়ান বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করল। মুনতাসিমও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা তার সাইন নয়। এতটা নির্ভুল ভাবে কে তার সাইন নকল করল। সেটাই মস্তিষ্কে আসছে না। মুনতাসিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পার্টি অফিসে যাওয়ার জন্য বেড়িয়ে পড়লো।

মেহেভীন খাবার খাচ্ছিল। এমন সময় রুপা মাহতাব উদ্দিনের দিয়ে যাওয়া কাগজটা মেহেভীনের সামনে রাখল। মেহেভীন পানি মুখের সামনে ধরে বলল,

–এটা কিসের কাগজ রুপা?

–আপনি পড়ে দেখেন আপা। ঐ যে মাহতাব উদ্দিন আছে না। যার জমির মিমাংসা আপনি করে দিয়ে ছিলেন৷ সে সকালে এসেছিল। তার বোন স্ট্রোক করেছেন। সেজন্য উনি অপেক্ষা করতে পারেননি। আপনাকে দেখে শুনে সাইন করতে বলেছেন। উনি বিকালে এসে কাগজ গুলো নিয়ে যাবেন৷ রুপার কথায় মেহেভীন কাগজ গুলো পড়তে লাগলো। তিনটা পেজ দেখেই বুঝতে পারল৷ এটা কোন জমির কাগজ সে রুপাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–এটা দিঘির পাশের জমি টার কাগজ জমিটা ভিষণ সুন্দর। তোর অনেক পছন্দের জমি ছিল তাই না রুপা। আল্লাহ যদি আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। আমি একদিন কোনো এক দিঘির পাশে তোকে বাড়ি করে দিব। মেহেভীনের কথায় রুপা মনোমুগ্ধকর করে হাসি হাসলো। মেহেভীন কাগজ গুলোতে সাইন করে দিয়ে চলে গেল।

প্রভাতের আলো নিভে গিয়ে চারদিক আঁধারে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। এই কয়দিনে প্রানবন্ত চৌধুরী বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। আগের মতো আনন্দ করতে যেন সবাই ভুলে গিয়েছে। প্রতিটি মানুষের মধ্যে নিস্তব্ধতা রাজত্ব করছে। ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। তখনই মুনতাসিম বাসার মধ্যে প্রবেশ করে। ভেতরটা একদম চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। ভেতরটা জানে কতটা অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায়। তার শত্রুরা যদি তার মনের খবর জানতো। তাহলে দূর থেকে আঘাত না করে কথার আঘাতে ধরণীরর বুক থেকে তাকে মুছে ফেলত। কাগজ গুলো তদন্তের জন্য পাঠিয়েছে মুনতাসিম। আজ নিজের কক্ষে যেতে ইচ্ছে করল না। যখন সব দুঃখ কষ্ট সহ্য সমী পেরিয়ে যায়। তখনই সে বাবার কাছে চলে আসে। এই মানুষ টার মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই জীবনের অর্ধেক দুঃখ কমে যায়। আরো কয়টা দিন বেশি বাঁচতে ইচ্ছে করে। মুনতাসিমকে নিজের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, রিয়াদ চৌধুরী খবরের কাগজ রেখে ছেলের দিকে মনযোগ দিলেন। মুনতাসিম ক্লান্ত শরীরে বাবার পাশে এসে বসল। কোমল কণ্ঠে বলল,

–আজ রাতে আমি আপনার সাথে ঘুমোতে পারি?

–অনুমতি নেওয়ার কি আছে! তুমি চাইলে আমার সাথে প্রতিদিন ঘুমোতে পারো।

–আপনার বউয়ের কোনো সমস্যা হবে না?

–সে তোমার মা হয়।

–আমার মা ম’রে গিয়েছে। যাকে তাকে আমার মায়ের সাথে তুলনা দিবেন না৷ রিয়াদ চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ছেলেকে রাগানো উচিৎ হবে না। হঠাৎ কি এমন হলো যে ছেলেটার বুক এতটা ভারি হয়ে গেল। এত শক্ত একটা মানুষ যখন ভেঙে পড়ে। তখন রিয়াদ চৌধুরীর বুকটা হাহাকার করে উঠে। সে কোনো কথা না বলে, গম্ভীর হবার ভান ধরে চশমা খুলে শুয়ে পড়লেন। মুনতাসিম কোনো কথা না বলে বিছানায় উঠে বাবার এক হাতের ওপরে মাথা রেখে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আঁখিযুগল বন্ধ করে রাখল। মুনতাসিম ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে মানুষটার দম নিতে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। না চাইতেও রিয়াদ চৌধুরী আঁখিযুগলের কোণে অশ্রুকণা চলে আসলো। সে নরম কণ্ঠে বলল,

–তোমার কি হয়েছে? আমারে বলা যাবে?

–কিছু হয়নি আব্বু। বরাবরের মতোই হতাশ হলেন রিয়াদ চৌধুরী। ছেলের পেটে বো’মা মারলেও নিজের দুর্বলতার কথা কারো সাথে শেয়ার করবে না। ঠিক তার মায়ের মতো গুন পেয়েছে। তাকে ভেতর থেকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলা গেলে-ও তা বাহিরে প্রকাশ পায় না। সেজন্য লোকে ভাবে তার কোনো দুঃখ নেই। সে সর্বদা সুখী মানুষ। তার কখনো কষ্ট হয় না। লোকে কি জানে না। সে রোজ দুঃখ মেশানো হাসিতে মগ্ন থাকে। ভেতরটা রক্তাক্ত হয়ে আছে। ক্ষতটা শুকানোর বদলে দিন দিন তাজা হয়ে উঠছে। রিয়াদ চৌধুরী ছেলের চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তিনি কিছুটা হাত বাড়িয়ে ছেলেকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আসলেন। পরম যত্ন সহকারে ছেলের ললাটে চুমু দিলেন। বাবা ছেলের এমন আদুরে দৃশ্য দেখে মনের অজান্তেই সাহেলা চৌধুরীর মুখশ্রীতে হাসি ফুটে উঠল। ঘুমানোর জন্য নিজের কক্ষে আসতেই মুনতাসিমকে দেখে দরজা কাছে দাঁড়িয়ে যায়। সে বাবা ছেলেকে বিরক্ত না করেই দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেল। সারাদিন এই ছেলেটার সাথে সে যুদ্ধ করে। ছেলেটা যখন শান্ত হয়ে যায়। তখন না চাইতেও মুনতাসিমের জন্য তার বুকের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে উঠে।

শেহনাজ ফোন কথা বলছিল। তখন সাহেলা চৌধুরী আসে তার কক্ষে। মাকে দেখে মুখশ্রী কুঁচকে যায় তার। যখন সে শুনলো সাহেলা চৌধুরী তার সাথে ঘুমাবে। তখনই শেহনাজের মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। সে গম্ভীর মুখশ্রী করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।

রজনীর মধ্য প্রহরে ছাদ থেকে কারো বাক্য কর্ণকুহরে আসতেই তাইয়ান সেদিকে মনোযোগ প্রদান করল। সে স্পষ্ট ভাবে অনুভব করতে পারছে কণ্ঠটা কার। সে খুব নিখুঁত ভাবে মুনতাসিমের সব খবর পাচার করছে। কিভাবে মুনতাসিমকে ধরনীর বুক থেকে মুছে ফেলা যায়। সেই পরিকল্পনা চলছে। পর মানুষ শত্রুতা করলে সেখানে সাহস সঞ্চয় করে তাদের সাথে যুদ্ধ করা যায়। কিন্তু ঘরের মানুষ যখন শত্রুতা শুরু করে দেয়। তখন অর্ধেক জীবন আগেই ম’রে যায়। যতটুকু বেঁচে থাকে কাছের মানুষের আসল রুপ সামনে আসার পর সেটুকু ও ম’রে যায়। তার শরীরে নিঃশ্বাস থাকা অবস্থায় মুনতাসিমের কোনো ক্ষতি সে করতে দিবে না। সে বড় বড় পা ফেলে ছাদে প্রবেশ করল। তাইয়ানকে দেখেই মানুষটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে বিস্ময় কণ্ঠে বলল,

–তুমি এখানে কি করছ?

–একই প্রশ্ন আমিও তোমাকে করতে পারি।

–সামান্য একজন গার্ড হয়ে আমার মুখে মুখে কথা বলছ?

–যেখানে আমাকে স্যারকে রক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে স্যারের ক্ষতি দেখলে আমি কথা বলবই। তোমার কোনো অধিকার নেই। আমার সাথে এভাবে কথা বলার। তুমি নিজেও জানো না। আমি চাইলে তোমার কি কি করতে পারি। তাইয়ানের কথায় মানুষটা জ্বলে উঠল। সে বজ্রকণ্ঠে বলল,

–তোমাকে একদম জ্যা’ন্ত পু’তে ফেলবো। কেউ টের পাবে না। আমার সাথে লাগতে এসো না। ভালোবাসি বলেই তোমার বাড়াবাড়ি সহ্য করি। মানুষটার কথা শুনে তাইয়ান ভুবন ভুলানি হাসি হাসলো। তা দেখে মানুষটার মুখশ্রী বিরক্তিতে কুঁচকে এল। তাইয়ান মানুষটাকে ওয়ারনিং দিয়ে ছাদ থেকে চলে আসলো। সে মানুষটার সাথে কথা বলে দুর্বল হতে চায় না। পৃথিবীর সব মানুষ একদিকে আর মুনতাসিম তার কাছে একদিকে। মুনতাসিমের জন্য সে নিজের জীবন দিতেও প্রস্তুত।

প্রভাতের আলো ফুটতেই মুনতাসিমের ঘুম ভেঙে গেল। রিয়াদ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে সারারাত ঘুমিয়ে ছিল। রিয়াদ চৌধুরী পরম যত্নে ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছেন। কখন যে সে ঘুমিয়ে গিয়েছিল তা তার জানা নেই। মায়ের পর এই মানুষ টাই তাকে অসম্ভব রকমের ভালোবাসে। তার ভুল গুলো অন্যায় গুলো ক্ষমা করে দেয়। প্রচন্ড খারাপ ব্যবহার করার পরে-ও রিয়াদ চৌধুরী এসে ছেলের সাথে আগে কথা বলেন৷ বাবারা বুঝি এমনই হয়৷ সেজন্য বাবাকে বটগাছের ছায়া বলা বলা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নিরাপদ হচ্ছে বাবার বুক। তা মুনতাসিম যত দিন যাচ্ছে। ততই উপলব্ধি করতে পারছে। সময়ের সাথে বাবার নামে করা অভিযোগ গুলো মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। সে বদলে যাইনি পরিস্থিতি তাকে চুপ থাকতে শিখিয়ে দিয়েছে। সে তো আর একা তার সন্তান নয়। তার প্রতি যেমন রিয়াদ চৌধুরীর দায়িত্ব আছে। ঠিক তেমনই বাকি সন্তানদের প্রতিও তার দায়িত্ব আছে। মুনতাসিম কোনো কথা না বলে বিছানা ছাড়ল। তখনই রিয়াদ চৌধুরীর কিছু কথা কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। মুনতাসিম বুঝল সে আগেই উঠেছে। মুনতাসিমের জন্য শুয়ে ছিল।

–আপনি যেটা বলছেন সেটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ আমার সন্মানে যে কলঙ্ক লাগাতে চেয়েছে। আমি তার সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করব। কথা গুলো বলেই চলে গেল মুনতাসিম। রিয়াদ চৌধুরী ছেলের কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

আজ শুক্রবার মুনতাসিমের আজকে ভিষণ করে বাড়ি ছাড়তে ইচ্ছে করছে। যেতে চেয়েছিল না সেই চেনা নীড়ে। কিন্তু অবাধ্য মনটা নিজের হয়েও অন্যের জন্য সব সময় মরিয়া হয়ে থাকে। সে কোনো কথা না বলে তাইয়ানকে গাড়ি বের করতে বলল৷ দীর্ঘ সময় পথ পাড়ি দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে এসে পৌঁছে গেল। মুনতাসিম বাসার দিকে না গিয়ে মাঠের দিকে যেতে লাগলো। তখনই তাইয়ান অস্থির হয়ে প্রশ্ন করল,

–আপনি ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন স্যার?

–টয়লেটে যাচ্ছি যাবে। তোমরা সব সময় চিনি জোঁকের মতো আমার সাথে লেগে থাকো কেন? আমার প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই! চলো গিয়ে দেখবে আমি টয়লেটের মধ্যে গিয়ে কি করি। তোমরাও আমার মতো সেই প্রসেস ব্যবহার করবে। কোন দুঃখে রাজনীতিতে এসেছিলাম আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন। জীবনে ঝামেলার কোনো শেষ নেই। বিরক্তিতে মুখশ্রী কুঁচকে ফেলল মুনতাসিম।

–আপনি হুকুম করলে আমরা আপনার সাথে টয়লেটে যেতেও রাজি স্যার। আমরা আমাদের দায়িত্ব অবহেলা করতে পারিনা। তাইয়ানের কথায় মুনতাসিম রক্তিম চোখে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করল। বজ্রকণ্ঠে তাইয়ান বলে গর্জন করে উঠল। তাইয়া মাথা নুইয়ে ধীর কণ্ঠে বলল, “স্যরি স্যার।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে