খোলা জানালার দক্ষিণে পর্ব-৬১+৬২+৬৩

0
182

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৬১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সময়কে বিষন্নতা গ্রাস করে ফেলছে। সময় তার বিষাদ দিয়ে হৃদয়কে তিক্ত করে তুলেছে। দুঃখ আছে বলেই সুখের এত মূল্য! সুখ মানুষের জীবনে ক্ষণিকের জন্য আসে আর দুঃখ মানুষকে মৃত্যু পর্যন্ত তাড়া করে বেড়ায়। সুখ যদি ভাগ্যে না-ই বা থাকবে তবে ক্ষণিকের জন্য এসে কেন মায়া ধরিয়েছিল? মস্তিষ্কে এত প্রশ্ন কিন্তু উত্তর দেওয়ার মানুষ নেই। উত্তর দেওয়ার জন্য মানুষের প্রয়োজন আছে। কিন্তু যে মানুষটা উত্তর দিবে সেই মানুষটাই যে আর নেই। সে দুঃখের কাছে হার মেনে পালিয়েছে। মানুষের ভালোবাসা গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখার পাশাপাশি মানুষের ঘৃণা সহ্য করার ক্ষমতাও অর্জন করতে হয়। না হলে রিয়াদ চৌধুরীর মতো বৃদ্ধ বয়সে এসেও ঝরে যেতে হয়। রিয়াদ চৌধুরী নেই দুই মাস হয়ে গিয়েছে। চৌধুরী বাড়ি আগের ন্যায় আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে না। মুনতাসিম আগের মতো রাগ করে না৷ প্রত্যেকটি মানুষ কেমন জানি নিরব হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিম নিজের কক্ষে গম্ভীর হয়ে বসেছিল। তখনই সাহেলা চৌধুরী আসেন৷ সে মুনতাসিমের পাশে বসে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–এমন দুর্বল মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে আমার ভালো লাগে না। আমার শত্রুপক্ষ যদি শক্তিশালী না হয়। তবে তার সাথে লড়াই করে আমার কোনো লাভ নেই। সাহেলা চৌধুরী প্রতিটি বাক্য হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করল। মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত মস্তিষ্ক জ্বলে উঠল। সে রক্তিম দৃষ্টিতে সাহেলা চৌধুরীকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। সে কণ্ঠে তেজ তুলে বলল,

–আমাকে কোন দিক দিয়ে আপনার দুর্বল মনে হয়? এত সহজের ভেঙে পড়ার মতো ছেলে আমি না। আমাকে ভাঙতে আসলে আমি আপনাকেই গুঁড়িয়ে দিব। মুনতাসিমের কথায় মুনতাসিমের আড়ালেই সাহেলা চৌধুরী মলিন হাসলো। সে খুব সংগোপনে হাসি গম্ভীরতার শক্ত আবরণে ঢেকে দিল। আগের ন্যায় গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

–আমার সতীনের ছেলে ভেঙে পড়েছে। সেটা আমি বহুদিন ধরেই দেখতে পাচ্ছি। এমন ভাঙা মানুষের সাথে যুদ্ধ করে শান্তি পাওয়া যায় না। আমার একটা শক্তপোক্ত মানুষ চাই। এই ডায়েরিটা তোমার বাবা তোমাকে দিতে বলেছিল। তুই এই ডায়েরিটা মেহেভীনের সাথে পড়বে। তোমার বাবার শেষ ইচ্ছে ছিল। এই ডায়েরিটা নিজে তোমাদের পড়ে শোনাবে। তিনি শোনাতে পারেনি। তাই যাবার আগে আমাকে বলে গিয়েছিল। আমি যেন দু’জনের হাতে ডায়েরিটা বুঝিয়ে দেই। মেহেভীনের সাথে সবকিছু ঠিকঠাক করে নাও। সবাই এভাবে ভেঙে পড়লে জীবন তার সৌন্দর্যতা হারাবে। একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে। তার জন্য কি আমাদের জীবন থেকে থাকবে। বাক্য গুলো শেষ করে দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করল সাহেলা চৌধুরী। মুনতাসিম দেখল একটা কঠিন নারী কিভাবে নিজের অশ্রু লুকিয়ে সংসার টাকে আগের ন্যায় প্রাণখোলা করার প্রচেষ্টা করছে। মুনতাসিমের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করে দিয়েছে। সময় অদ্ভুত একটা জিনিস স্রোতের ন্যায় টান ধরে চলে গেল। বাবা যাবার পর প্রথম কারো থেকে ভরসা পেল মুনতাসিম। এই ভরসাটাই তাকে সতেজ হতে সাহায্য করবে। মেহেভীনের মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বুক কেঁপে ওঠে। মেয়েটা আছে বলেই বাঁচার ইচ্ছে আছে নয়তো বা এ জীবন কবেই রবের কাছে চলে যেত। মুনতাসিমকে মন্ত্রী সভায় যেতে হবে। সে বিলম্ব করল না দ্রুত প্রস্তুত হয়ে নিল। এখন থেকে সে নতুন ভাবে জীবন শুরু করবে। চৌধুরী গৃহে আবার আনন্দ উল্লাস হবে। শুধু কিছু মানুষ সেই আনন্দ উল্লাসের ভাগিদার হবে না। মুনতাসিম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কক্ষ থেকে বেড়িয়ে গেল।

মেহেভীন জানালার পাশে বসে চিন্তা মগ্ন ছিল। তখনই মুঠোফোনটা শব্দ করে বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনের নানু নামটা ভেসে উঠতেই দ্রুত ফোনটা কর্ণে ধরলো। ওপাশ থেকে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে কিছু ভেসে এলো। মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এলো। সে দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বের হতেই সুফিয়া চৌধুরী এবং তাহিয়ার সামনে পড়লো। তাদের মুখশ্রীতে হাসির রেখা বিদ্যমান। সুফিয়া চৌধুরী ব্যঙ্গ করে বলল,

–অবশেষে মহারানী রাজ্য ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তোমার অনেক দিন আগেই চলে যাবার কথা ছিল। আমার ভাই টা মরে মুনতাসিমের পাশে থাকার নাম করে কয়টাদিন বেশি থেকে গেলে। মুনতাসিম আমার হিরার টুকরো ছেলে বলেই তোমার মতো মেয়েকে এতদিন এই বাসায় রেখেছে। অন্য কোনো পুরুষ হলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিত।

–আপনাকে আপনার স্বামী ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে ফুপি। তাই বাংলাদেশে এসে একদম গেড়ে বসেছেন?

–তোমার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি! বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা আমার বাবা মা তোমাকে শেখায়নি?

–আমাকে আমার বাবা-মা শিখিয়েছে। কিন্তু আপনাকে আপনার বাবা-মা শেখায়নি বাড়ির বউদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়?

–তোমার তেজ আমি বের করছি। আমার ভাবির নাকফুল আমার ভাইয়ের দেওয়া চুড়ি, গলার চেইন, কর্ণের অলঙ্কার সবকিছু খুলে দিয়ে তারপর এ বাড়ি থেকে যাবে। তার আগে এ বাড়ি ছেড়ে এক পা-ও যেতে দিব না। আমিও দেখতে চাই তোমার তেজ কোথায় যায়?

–সে আমি আপনাকে খুলে দিয়ে দিচ্ছি। আমিও দেখব আপনি কতক্ষণ এগুলো নিজের কাছে রাখতে পারেন। আমার স্বামী আমাকে এগুলো দিয়ে আবার নতুন ভাবে নতুন রুপে এ বাড়িতে নিয়ে আসবে। সেটা আপনার চোখের সামনে আপনি বসে বসে দেখবেন আর মজা আমি নিব। বাক্য গুলো শেষ হতেই মেহেভীন অলঙ্কার গুলো সুফিয়া চৌধুরীর হাতে তুলে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে গৃহ ত্যাগ করল।

রুগ্ন অবস্থায় আস্তরণে শায়িত আছে মেহেভীনের নানি। রজনীর মধ্য প্রহর থেকে ভিষণ রুগ্ন হয়ে গিয়েছে। মেহেভীনের নানা অর্ধাঙ্গিনীর মস্তকের কাছে বসে আছে। মেহেভীনকে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

–নানু ভাই তুমি এসেছ? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তোমার নানু একদম রুগ্ন হয়ে গিয়েছে। আমাদের পাকঘরে যাবার মতো কেউ নেই। কাল থেকে পাকঘরে আগুন জ্বলেনি। তোমাকে খানা তৈরি করার জন্য ডেকেছি। নানার কথায় মেহেভীন কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

–নানি এত অসুস্থ আমাকে আগে জানাবে না। তোমাদের কাজ করতে কে বলেছে? আমি কতবার বলেছিলাম কাজের লোক রাখি! কিন্তু তোমরা আমার কথা শুনোই না। আমি এখন রান্না করতে যাচ্ছি। কালকে থেকে কাজের লোক আসবে। আমি আসার সময় কাজের লোক ঠিক করে রেখে এসেছি। বাক্য গুলো শেষ হতে মেহেভীন কক্ষ ত্যাগ করল।

ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা ছুঁই ছুঁই। ক্লান্ত কায়া নিয়ে গৃহে প্রবেশ করল মুনতাসিম ও তাইয়ান। পথে আসার সময় থেকে তাইয়ান ভিষণ উসখুস করছে। সে মুনতাসিমকে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু জড়তার জন্য বলতে পারছে না। মুনতাসিম তাইয়ানকে সময় দিচ্ছে কিন্তু তাইয়ান বলতে পারছে না৷ এই কয়দিনে মুনতাসিমের নিস্তেজ মুখশ্রী তাইয়ানকে ভেতর থেকে কাবু করে ফেলছে। সে তুলিকে বিয়ে করতে পারেনি৷ তবে আজ তার মন গহীন ডেকে বলছে। যে মানুষটা সবার ভালো চাইল সেই মানুষটারও ভালো থাকার অধিকার আছে। তার জন্য যদি মুনতাসিম ভালো থাকে তাহলে সে না হয় মুনতাসিমের জন্য নতুন জীবন শুরু করল। তার বিনিময়ে কিনে নিল মুনতাসিমের জন্য এক টুকরো সুখ। তাইয়ান মস্তক নুইয়ে বলল,

–আমি তুলিকে বিয়ে করব স্যার। আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলুন। আমি সাত দিনের মধ্যে বিবাহ সম্পূর্ণ করতে চাই৷ আপনি যদি আমাকে মায়া করতেন। তাহলে আমি খুব উপকৃত হতাম। তাইয়ানের বাক্য গুলো কর্ণকুহরে আসতেই মুনতাসিম বিস্ময় নয়নে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাইয়ানের মুখশ্রীতে লজ্জার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। তাইয়ানের আর মুনতাসিমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস হলো না। সে দ্রুত পালিয়ে গেল। তাইয়ানের কর্মে মুনতাসিমের মুখশ্রীতে হাসি ফুটে উঠল। কক্ষে এসেই মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হয়ে গেল মুনতাসিমের। মাশরাফি সকালের সব ঘটনা মুনতাসিমকে বলে দিয়েছে। মুনতাসিম উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় সুফিয়া চৌধুরীর কক্ষ এলো। মুনতাসিমকে দেখে সুফিয়া চৌধুরী কিছু বলতে যাবে। তার আগেই মুনতাসিম রাগান্বিত হয়ে বলল,

–মেহেভীনের থেকে সকালে যা যা নিয়েছেন। এখন এই মুহুর্তে সবকিছু আমাকে দিবেন। আমি অযথা কোনো বাক্য অপচয় করা পছন্দ করি না। সুফিয়া চৌধুরী কোনো বাক্য উচ্চারন করার সাহস পেল না। সে দ্রুত অলঙ্কার গুলো মুনতাসিমের হাতে বুঝিয়ে দিল। তাহিয়া ক্রোধিত দৃষ্টি মেলে মাশরাফির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মাশরাফির অধরের কোণে তৃপ্তির হাসি বিদ্যমান।

রজনীর শীতল হাওয়া মুনতাসিমকে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। দূর গাছের ডাল থেকে নিশাচর পাখি ডাকছে। ঝিঁঝি পোকা রজনীর আঁধারে শব্দ তুলে ডাকতে ব্যস্ত। পথটাও যেন দীর্ঘ হয়ে গিয়েছে। কিছুতেই স্রোতের ন্যায় গড়িয়ে যাচ্ছে না। মুনতাসিম মুঠোফোনটা হাতে নিল। মেহেভীনের নানির নাম্বারে ফোন দিল। মেহেভীন খেয়ে সবে মাত্র কক্ষে এসে জানালার কাছে দাঁড়িয়েছিল। তখনই নানির ফোনটা শব্দ করে বেজে ওঠে। মেহেভীনের নানি ফোনটা তুলতেই মুনতাসিম রসিকতা করে বলল,

–কেমন আছ ডার্লিং? আমি তোমার কাছে খুব তাড়াতাড়ি চলে আসছি সুইটহার্ট। রাতে দরজা খোলা রেখো।

–তুমি কোন ডার্লিংয়ের লাইগা আইতাছ, হেইডা মুই ভালা কইরাই জানি। আমারে আর কইতে হইবো না। দু’জনের কি মান-অভিমান হইছে। যার লাইগা তুমি তারে কল না দিয়া আমারে দিছো।

–আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তোমাকে বিয়ে না করা। তোমাকে বিয়ে করলে জীবনে স্বর্গসুখ পেতাম আমি। আমার এখন খুব আফসোস হচ্ছে ডার্লিং।

–হইছে আমারে আর পাম পট্টি দেওন লাগবো না। তুমি তাত্তাড়ি আইয়া পড়ো। তোমার নানা বুঝে নাই অকারণের মাইয়াডারে ডাইকা লইয়া আইছে। এখন রাখছি। মেহেভীনের নানির বাক্য গুলো শেষ হতেই কলিং বেল বেজে উঠল। মেহেভীন অবাক হলো এতরাতে কে এলো? সে উঠে আসার আগেই মেহেভীনের নানা-নানি কণ্ঠ স্বর কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাল। মুনতাসিমকে বসার ঘরে দেখতেই মেহেভীনের মস্তক নুইয়ে গেল। মুনতাসিম চোয়াল শক্ত করে বলল,

–দুই মিনিট সময় দিলাম। কক্ষ গিয়ে ব্যাগ নিয়ে আসুন৷

–আমার নানি অসুস্থ আমি কয়টা দিন থাকব।

–আমি বলেছি আমার সাথে আপনাকে যেতে হবে।

–এই মাইয়া জেদ করছোস ক্যান? স্বামী যা কয় তাই শুনুন লাগে। আমি এখন সুস্থ আছি৷ তোর নানা বুঝে নাই। তোরে ফাউ কাজে ডাইকা লইয়া আইছে। স্বামীর সব কথা শুনুন লাগে তবেই না স্বামী সোহাগ বেশি পাবি। নানির কথায় মেহেভীনের মস্তিষ্ক গরম হয়ে গেল। মুনতাসিম নানির কথায় মিটমিট করে হাসছে। মেহেভীন দ্রুত সেখানে থেকে চলে যায়। মুনতাসিম ফোনটা বের করে একটা মেসেজ করে দিল, “ভদ্র মেয়ের মতো বের হবেন নাকি কোলে তুলে নিয়ে আসব৷” মেসেজটা পড়ে মেহেভীনের আঁখিযুগল বড় হয়ে গেল। মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এলো, অসভ্য লোক একটা। মেহেভীন ব্যাগ হাতে নিয়ে বসার ঘরে এলো। নানি মুনতাসিমকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। দু’জনের ভালোবাসা দেখে মেহেভীনের আঁখিযুগল শীতল হয়ে গেল। তারা কিছুক্ষণ বসে বাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো। মেহেভীন হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে মুনতাসিম মেহেভীনের পিছু পিছু হাঁটছে।

–আমি আজকের রাতটা থাকতে চেয়েছিলাম।

–আমি আপনাকে ছাড়া এক রাতও থাকতে পারবো না।

–মুখে লাগাম টানুন।

–বিয়ের পর থেকেই টেনে আছি আর কত টানব? মুনতাসিমের কথার উত্তরে কোনো উত্তর করল না মেহেভীন। মানুষটার সাথে কথা বলা মানে নিজেকে লজ্জায় ফেলা৷ সে চুপচাপ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। মুনতাসিম এগিয়ে এসে মেহেভীনের হাতে ভাজে নিজের হাত রেখে পথ চলতে শুরু করে দিল।

–আমি তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম না তুলি। আমি মুনতাসিম স্যারকে ভিষণ ভালোবাসি। স্যারের পরিবারের করুন অবস্থা ভেতরটা রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। যে বাড়িতে সারাক্ষণ আনন্দরা রাজত্ব করতো। সেই বাড়িটা দুঃখের সমু্দ্রে তলিয়ে গিয়েছে। এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। আমার মধ্য দিয়ে যদি এ বাড়িতে সুখ ফিরে আসে, তবে আমার নিজেকে স্বার্থক বলে মনে হবে। তুমি আমাকে একটু সময় দিও। আমি সবকিছু মানিয়ে নিব। ভালোবাসা নামটাই আমার কাছে বিষাক্ত আমি ঘৃণা করি নারীকে। আমার অস্তিত্ব জুড়ে শুধু নারীর প্রতি ঘৃনা বসবাস করছে। যদি কখনো সুযোগ পাই তবে তোমায় ভালোবাসবো।

–ভালোবাসার আগে এটা বলুন আপনার সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? আমার আপনাকে নিয়ে সন্দেহ হয়৷ আপনি বিয়ে কেন করতে চান না? ভালোবাসাবাসি পরে হবে আগে বিয়ে করুন। আপনাকে আমায় ভালোবাসতে হবে না। আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে আপনাকে জিতে নিব। তুলির কথায় তাইয়ান শব্দ করে কেশে উঠল। তাইয়ানের রক্তিম আঁখিযুগলের দিকে দৃষ্টিপাত করে তুলি বলল,

–ভেবেছিলাম নিকোটিনে জ্বলে যাওয়া কালো কুচকুচে ঠোঁট দিয়ে আমাকে চুমু খাবে কোনো এক বুড়ো। আপনার সাথে বিয়ে ঠিক হবার আগ পর্যন্ত আমার এটাই মনে হয়েছিল, জানেন বাবুর আব্বু।” তুলির কথায় বিস্ময় নয়নে তুলির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে তাইয়ান। তুলি পানশে মুখশ্রী করে তাইয়ানের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাইয়ানের আঁখিযুগলে তুলির প্রতি কতটা ক্ষোভ জমেছে। সেটা তাইয়ানের আঁখিযুল বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। তাইয়ান বিরক্ত হয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। তবে মেয়েটা যখন তাকে বাবুর আব্বু বলে সম্মোধন করে তখনই ভয়ংকর ভাবে তাইয়ানের বুকটা কেঁপে উঠে।

তাইয়ানের বিয়ের মধ্য দিয়ে সবাই আগের মতো হতে শুরু করে দিয়েছে। চৌধুরী গৃহের চারপাশে মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। সমস্ত গৃহ আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে। গৃহ ভর্তি মেহমান এসে গিজগিজ করছে। মেহেভীন হলুদের অনুষ্ঠানে বসেছিল। তখনই চিকন গড়নের ফর্সা যুবক এসে তার পাশে বসে। সে খুব আগ্রহী হয়ে মেহেভীনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–তুমি কোন পক্ষের হয়ে এসেছ? আমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলতে পারি না। আমার তোমাকে অনেক ভালো লেগেছে৷ আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই৷ তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? যুবকের কথায় মেহেভীন আড়দৃষ্টিতে যুবককে পর্যবেক্ষক করে নিল। তৎক্ষনাৎ শব্দ করে হেসে উঠল। মেহেভীনের হাসির শব্দের প্রতিধ্বনিতে কারো হৃদয়ে আগুন জ্বলে উঠল। মেহেভীনের অকারণে হাসির অর্থ বোধগম্য হলো না যুবকের। সে মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে নিয়ে এসে বলল,

–তুমি হাসছ কেন?

–এই ছেলে তুমি জানো আমি তোমার কতবড়। এতটুকু ছেলে হয়ে বিয়ে করতে চাও লজ্জা করে না। তাছাড়া আমি বিবাহিত আমার স্বামী জানলে তোমাকে খু’ন করে ফেলবে।

–আমি বিশ্বাস করি না। বিবাহিত মেয়েদের হাতে চুড়ি থাকে নাকে নাকফুল থাকে তোমার তো কিছুই নেই। তাহলে আমি কিভাবে বিশ্বাস করব? তুমি বিবাহিত! মেহেভীন শুধু হাসলো কোনো উত্তর দিল না। মুনতাসিম রক্তিম আঁখিযুগলে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। তাহিয়া মুনতাসিমের সামনে দিয়ে ফল নিয়ে যাচ্ছিল। মুনতাসিম তাহিয়াকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

–ছেলেটা কে রে তাহিয়া?

–আমার দাদির বাড়ি থেকে এসেছে ভাইয়া। আমাকে কেমন লাগছে দেখে বলো তো। মুনতাসিম ফল খেতে খেতে তাহিয়াকে পর্যবেক্ষণ করে নিল। একটা ফল নিয়ে তাহিয়ার হাতে দিয়ে বলল,

–এটা খেয়ে দেখ অনেক মিষ্টি ফল। মুনতাসিমের কর্ম দেখে মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রীতে আষাঢ়ের কালো মেঘ ঘিরে ধরলো। সে রাগান্বিত হয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিম ইচ্ছে করে মেহেভীনকে দেখেও না দেখান ভান করে তাহিয়ার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। মেহেভীন জ্বলতে জ্বলতে ছাদে চলে গেল।

সমস্ত আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছে। রাতে বোধহয় বৃষ্টি নামবে। মেহেভীনের হঠাৎ করে মায়ের কথা স্মরন হলো। বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠল। তার জীবনে এত সুখ এলো কিন্তু তার মা এলো না। আঁখিযুগলে এসে অশ্রু জমা হলো। তখনই একজোড়া শীতল হাত মেহেভীনকে আলিঙ্গন করল। মুনতাসিম মেহেভীনের কাঁধে চিবুক রেখে বলল,

–রাগ করেছেন ম্যাডাম। মেহেভীন উত্তর দেয় না। তার মস্তক গরম হয়ে গিয়েছে। আচমকা বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। দু’জনের একে অন্যের কাছে আসার উষ্ণতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। মেহেভীন মুনতাসিমকে যত দূরে সরিয়ে দিচ্ছে মুনতাসিম ততই মেহেভীনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিচ্ছে।

“ভালোবাসা গুলো বৃষ্টি হয়ে নামুক।
দুঃখ গুলো ঝরে যাক।
দ্বিধাদ্বন্দের দেওয়াল ভেঙে যাক।
প্রণয়নের হাওয়া এসে কায়াতে লাগুক।
প্রেয়সীর উষ্ণতা আমায় আলিঙ্গণ করুক।
শ্রাবনের ধারাতে ভালোবাসাবাসি হয়ে যাক।”

মুনতাসিমের বলা প্রতিটি বাক্য মেহেভীনের হৃদয় স্পর্শ করে গেল। শ্রাবনের ধারার গতিবেগ বাড়তে শুরু করেছে। কায়াতে ধীর গতিতে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে নিজের দিকে ঘোরালো। মুনতাসিমের অধরের উষ্ণতা দিয়ে মেহেভীনের ললাট উত্তপ্ত করে দিল। মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রীতে অধর ছোঁয়াল মুনতাসিম। মেহেভীনের সমস্ত কায়া অবশ হয়ে আসছে। সে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে৷ ধারার সাথে উষ্ণতাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। মেহেভীন আঁখিযুগল বন্ধ করে আছে। মুনতাসিম নিজের অধরযুগলের সাথে মেহেভীনের অধর যুগল এক করে দিল। ধারা যেমন জমিনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ঠিক তেমনই একটি তৃষ্ণার্থ হৃদয় তার প্রেয়সী মাঝে উষ্ণতা ছড়াতে ছড়াতে নিজেও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বর্ষনের প্রতিটি ফোঁটা দেখলো দু’টি প্রেমিক যুগল তাদের মতো ধারার ন্যায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। দু’জন দু’জনকে উষ্ণ করার খেলায় মেতে উঠেছে। তাদের ভালোবাসা দেখে চন্দ্রও লজ্জা মুখশ্রী আড়াল করে নিল।

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৬২
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সুখানুভূতিতে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে চারপাশ। যেদিকেই আঁখিযুগল যায়। সেদিকেই যেন সুখ দুঃখকে গ্রাস করে ফেলছে। গানের তালে তালে রমনীরা নৃত্য করছে। চৌধুরী বাড়িতে আনন্দের মেলা বসেছে। অনুভূতিরা আনন্দে মেতে উঠেছে। সমস্ত মস্তিষ্ক জুড়ে অদ্ভুত ভাবে শীতলতা অনুভব করছে। হৃদয়ে শান্তি এসেছে ভেতরটা পরিতৃপ্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তুলি এবং তাইয়ানের বিবাহ সম্পূর্ণ হয়েছে। শেহনাজ অশ্রুসিক্ত নয়নে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। ভেতরটা তার হাহাকার করে উঠছে। সে তাইয়ানকে ভালোবাসলে এই সুখ তার হতো। সে তুলির জায়গায় থাকতো ভাগ্য তার সহায়ক হলো না। দিনশেষে একটা নরপিশাচকে মন দিয়ে দুঃখের সমু্দ্রের অতল গভীরতে তলিয়ে গিয়েছে। শেহনাজ ভেতর থেকে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। তুলিকে করে তার ভিষণ ঈর্ষা হচ্ছে। তুলিকে খু’ন করে তাইয়ানকে গ্রাস করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। তাহিয়া অসহায়ত্ব মুখশ্রী করে মুনতাসিম এবং মেহেভীনের হাসোজ্জল মুখশ্রী দেখছে। মুনতাসিম তাকে ভালোবাসলে মেহেভীনের সমস্ত সুখ তার হতো। তাহিয়া বুক ভারি করা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে নিজের কক্ষে চলে গেল। এখানে থাকলে যন্ত্রনার মাত্রা প্রকোপ পাবে।

–তাইয়ান এবং তুলির কক্ষের সাথে মুনতাসিম এবং মেহেভীনের কক্ষটাও ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিও। সাহেলা চৌধুরী কথায় কয়েকজনের রমনী মস্তক নাড়াল। তারা মুনতাসিমের কক্ষটা পুষ্প দিয়ে সাজিয়ে দিল। সমস্ত কক্ষ জুড়ে গোলাপ আর রজনীগন্ধার গন্ধ নাসারন্ধ্রে এসে ঠেকছে। রমনীরা সিলিং ফ্যানের সাথে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিল। মেহেভীন আর মুনতাসিম কক্ষে প্রবেশ করলেই ফ্যান ছেড়ে দিবে। পুষ্পের বর্ষণে দু’জনকে পুষ্পময় করে তুলবে। কিন্তু তাদের আশায় পানি ঢেলে দিল বৃষ্টি। আকাশটা জানান দিচ্ছে বর্ষন ধেয়ে আসছে। তাদের ভাবনার মাঝেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সমস্ত বাড়ি অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। মেহমানরা সব বাড়ি যেতে শুরু করেছে। কিছু মেহমান দুপুরে খেয়ে চলে গিয়েছে। দূরের মেহমান গুলো থেকে গিয়েছে প্রভাতের আলো ফুটতেই তারা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবে।

মেহেভীন কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখল কক্ষে মোমবাতি জ্বালানো। সমস্ত কক্ষ জুড়ে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। মেহেভীন বেলকনিতে চলে গেল। বর্ষণের ধারা এসে মেহেভীনের মুখশ্রী স্পর্শ করে যাচ্ছে। মেহেভীন হাত বাড়ির বৃষ্টির ফোটা গুলো হাতের তালুতে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠেছে। তার পরনে লাল টুকটুকে রঙের একটা শাড়ি। কায়াতে সামান্য কিছু অলঙ্কার জড়ানো। মুনতাসিম কৃত্রিম সাজসজ্জা পছন্দ করে না বলেই মেয়েটা সাজেনি৷ অধর যুগলটা শুধু লাল রঙে রাঙিয়েছে। এতেই যেন মেয়েটাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই মুনতাসিম এসে মেহেভীনকে আলিঙ্গন করল। মুনতাসিমের শীতল স্পর্শে মেহেভীনের সমস্ত কায়া কেঁপে উঠল। মুনতাসিম মেহেভীনের কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে বলল,

–আমার মহারানী কি ভাবছে?

–ভাবছি আমাদের তুলি ভাগ্যটা ভিষণ ভালো। শুনেছি যে মেয়ের বিয়ের দিন বৃষ্টি হয়। সেই নারী নাকি বিয়ের পরে সুখী হয়।

–আপনি আমায় পেয়ে সুখী না ম্যাডাম?

–আপনার মতো মানুষ পেয়ে যে বলবে সে সুখী না। তার মতো অভাগা কেউ নেই। কতটা ভাগ্য নিয়ে জন্মালে আপনার মতো স্বামী ভাগ্যে থাকে। আপনি ভাবতেও পারবেন না। আপনি যতটা জানেন তার থেকে-ও বেশি সুখী আমি আপনাকে পেয়ে। এই আপনা-আপনি আর কতদিন চলবে মন্ত্রী সাহেব? আমরা কি আপনি থেকে তুমিতে আসতে পারি না?

–এই তুমির যুগে আমার একটা আপনি হোক। যে আপনিটা হাজারো তুমির মাঝে হারাবে না। আমার বুকের বা পাশে যার ঠাঁই হবে। সে আমার ভিষণ প্রিয় হবে। তুমি শব্দটাতে ভালোবাসা এবং অধিকার মেশালো থাকলে-ও শ্রদ্ধা এবং সন্মান টা আমি খুঁজে পাই না। আমি তো আপানাকে একের ভেতর সবকিছু দিতে চাই। আমরা তাকেই আপনি বলি যাকে আমরা ভিষণ ভালোবাসি, সন্মান করি, শ্রদ্ধা করি। যাদের আমরা মহামূলবান ভাবি, তাদেরকেই আপনি বলি। আপনি আমার কাছে মহামূল্যবানের থেকে-ও অনেক কিছু। তাই আমি আপনাকে তুমির মাঝে হারাতে দিতে চাইছি না। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন হাসলো। মানুষটার প্রতিটি বাক্যে মুগ্ধতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। মানুষটা একবার মুখ খুললে দ্বিতীয়বার কথা বলার শক্তি থাকে না। মেহেভীন হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–ইচ্ছে ছিল একদিন আপনার খুব প্রিয় হব। আপনার বুকের বা পাশে আমার ঠাঁই হবে। আপনার হৃদপিণ্ডে আমি নামক এক অসুখ বাসা বাঁধবে। নিয়ম করে আমাকে আঁকড়ে ধরার ইচ্ছে জাগবে। আমার ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়ে গিয়েছে মন্ত্রী সাহেব। আমি ভিষণ খুশি। আমি খুব ভাগ্যবতী যে আমি আপনার মতো স্বামী পেয়েছি। আমার মা মানুষ চিনতে ভুল করেনি। আপনি আমার মায়ের দেখা আমার জন্য আমার জীবনে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ পুরুষ। মেহেভীনের কথার উত্তরে মুনতাসিম নিরব রইল। মুনতাসিমের নিরবতা মেহেভীনের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ বাড়িয়ে তুলেছে। মুনতাসিমে মাদকাসক্ত কণ্ঠে বলল,

–আমি আপনাকে বলেছিলাম। যেদিন আপনার সামনে আমি আমার অধিকার নিয়ে হাজির হব৷ সেদিন কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না৷ আজকে যদি আমি প্রয়োজনের থেকে একটু বেশি করে ফেলি, তবে কি আমায় শাস্তি পেতে হবে ম্যাডাম?

–আমি আপনাকে ভিষণ কড়া শাস্তি দিব। একদম অসভ্যতামি করতে আসবেন না। আমার থেকে দূরে থাকুন। খু’ন করে ফেলব একদম।

–আমি শাস্তি পাবার জন্য প্রস্তুত ম্যাডাম। আপনি শাস্তির ব্যবস্থা করুন। খু’ন তো আমি সে কবে থেকেই হয়ে আছি ম্যাডাম। বাক্য গুলো শেষ করেই মুনতাসিম মেহেভীনকে কোলে তুলে নিল। আচমকা কোলে তুলে নেওয়াতে মেহেভীন ভয় পেয়ে মুনতাসিমের গলা জড়িয়ে ধরলো। মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রীতে অন্যরকম নেশা ছড়িয়ে পড়েছে। মেহেভীনের ভেতরটা কেমন জানি লজ্জায় কুঁকড়ে আসছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে কক্ষে নিয়ে এসে আস্তরণে শায়িত হলো। সে খুব সংগোপনে মেহেভীনের আঁখিযুগলের পাতায় অধর ছোঁয়াল। মেহেভীন আঁখিযুগল বন্ধ করে রেখেছে। ভেতরে অস্থিরতার ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার৷ তখনই বিদ্যুৎ আসলো সিলিং ফ্যান চলতে শুরু করল। উপর থেকে পুষ্পের বর্ষণ হতে শুরু করল। মুনতাসিম মেহেভীনের হাতের ভাজে হাত রেখে মেহেভীনে গলদেশে মুখশ্রী ডুবালো। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠল চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষ। তাদের প্রণয়ের পরিনতি দেখে মোমবাতি গুলো লজ্জা নিভে গেল। হাওয়া এসে দু’জনকে আরো উন্মাদ করে তুললো। তাদের ভালোবাসা দেখে চন্দ্র বহু আগেই লজ্জায় মেঘের লুকিয়ে পড়েছে। চার দেওয়ালের আবদ্ধ কক্ষে দু’টি প্রেমিক যুগলের প্রেমের মহাপ্রলয় ঘটে গেল।

তুলি তাইয়ানের জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। তাইয়ানের আসার নামে কোনো খোঁজ নেই। তার ভেতরে দারুন অস্থিরতা কাজ করছে। এতদিন মুখে শত কথা বললেও আজ ভয় লাগছে। তার চিন্তার মাঝেই তাইয়ান এসে উপস্থিত হয়। তাইয়ান গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,

–এভাবে বসে আছ কেন তুমি? তোমাকে অপেক্ষা না করে ঘুমোতে বলেছিলাম।

–সবাই আপনার জন্য জাগতে বলেছিল।

–তোমাকে বলেছি আমাকে সময় দিতে হবে। তুমি বিয়ের রাতেই অর্ধাঙ্গিনীর অধিকার ফলাতে আসলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে!

–আমি কখন আপনাকে অর্ধাঙ্গিনীর অধিকার দেখালাম?

–অনেক রাত হয়েছে ঘুমাও এবার। তুলি আর কোনো কথা বলল না। সে আস্তরণের এক কোণে শায়িত হলো। তাইয়ান অসহায় দৃষ্টিতে তুলির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে কোথাও এই মেয়েটার প্রতি অন্যায় করে ফেলতে না তো আবার! সে মেয়েটার সাথে সহজ হতেই চাইছে। কিন্তু মেয়েটার সামনে আসলেই মস্তিস্ক উত্তপ্ত হয়ে যায়। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

চারিদিকে প্রভাতের আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। মেহেভীন আঁখিযুগল মেলে তাকাতেই মুনতাসিমের স্নিগ্ধ মুখশ্রীটা সামনে ভেসে উঠল। মানুষটার দিকে দৃষ্টি যেতেই সমস্ত মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করল। অথচ মানুষটা তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মেহেভীন সাবধানতা অবলম্বন করে উঠে বসলো। এলোমেলো বস্ত্র কোনোরকম কায়াতে পেঁচিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। একটু পরে গোসল করে এসে মাথায় চিরনি করতে লাগলো। তার অধরের কোণে প্রশান্তির হাসি বিদ্যমান। হঠাৎ করে গলার দিকে নজর যেতেই যে লজ্জায় মিইয়ে গেল। দ্রুত ওড়না দিয়ে গলাটা ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিল।

–স্বামীর ভালোবাসা পেলে বুঝি মেয়েরা এভাবে হাসে? মুনতাসিমের প্রশ্নে চমকে উঠল মেহেভীন! সে কোনো বাক্য উচ্চারন না করে উঠে দাঁড়ালো। মেহেভীনের লাজুক মুখশ্রী মুনতাসিমের ভেতরটা কাঁপিয়ে তুলছে। সে মেহেভীনের কাছে এসে কর্ণে ফিসফিস করে বলল,

–অল্প বয়সে বউহারা হতে চাই না৷ গলায় এত ওড়না পেঁচিয়ে আ’ত্ন’হ’ত্যা করবেন না আবার। কেউ কিছু বললে বলবেন। আমার স্বামী আমাকে ভালোবেসে দিয়েছে।

–গলায় কি করেছেন আপনি!

–কি করেছি? মুনতাসিমের প্রশ্নে মেহেভীন লজ্জায় মুনতাসিমের বুকে মুখ লুকালো। মুনতাসিম মেহেভীনের লজ্জা বাড়িয়ে দিতে বলল,

–যাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছেন। তার বুকেই মুখ লুকাচ্ছেন! সে যদি লজ্জার পরিমান বাড়িয়ে দেয়। তাহলে আপনার কি হবে? আপনার ভয় নেই ম্যাডাম? কি সাংঘাতিক নারী আপনি!

–আমি আপনাকে খু’ন করে ফেলব।

–আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।

–অসভ্য পুরুষ একটা যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন।

–আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। আপনার খবর আছে। কথা গুলো বলেই মুনতাসিম ওয়াশরুমে চলে গেল। মস্তকে কাপড় জড়িয়ে নিচে চলে গেল মেহেভীন। সবাই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে। মুনতাসিম গোসল করে এসে মেহেভীনকে দেখতে না পেয়ে নিচে এলো। মেহেভীন চায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। তার মাথাটা ভিষণ ধরেছে। তখনই মুনতাসিমে এসে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল,

–আপনাকে না আমি বলেছি। আমি যতক্ষণ বাসায় থাকব। ততক্ষণ আপনি এক মুহুর্তের জন্য আমার চোখের সামনে থেকে সরবেন না। তবুও কেন নিচে এসেছেন? এখনই আমার সাথে কক্ষে যাবেন চলুন।

–আমি এখন কক্ষে যাব না কি করবেন আপনি? মুনতাসিম বেশ বুঝতে পারছে। মেয়েটা তার থেকে দূরে দূরে থাকতে চাইছে। তাই তো পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া লাগানোর চেষ্টা করছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহেভীনকে কোলে তুলে নিল।

–আরে কি করছেন কেউ দেখে ফেলবে!

–ভালো কথায় কাজ হয়নি আঙুল বাঁকিয়েছি।

–আপনি বেশি অধিকার দেখাচ্ছেন কিন্তু!

–বউ আমার অধিকারও আমার। মুনতাসিমের মুখশ্রীতে বউ শব্দটা যেন মেহেভীন সমস্ত বাক্য কেঁড়ে নিল। মেহেভীনের নিস্তব্ধতা দেখে মুনতাসিম হেসে দিল। সে কোনো বাক্য উচ্চারন না করেই নিজের কক্ষে চলে গেল।

সময় স্রোতের ন্যায় গড়িয়ে চলেছে। তাইয়ান এবং তুলির বিয়ের দু’মাস হয়ে গেল। তবুও দু’জন স্বাভাবিক হতে পারলো না। শেহনাজ আজকে সবার জন্য রান্না করেছে। মেহেভীন আজকাল কিছুই খেতে পারে না৷ সারাক্ষণ মস্তক ঘোরাতেই থাকে। মেহেভীনের চিন্তায় মুনতাসিমের রজনীর নিদ্রা পালিয়েছে। ডক্টর দেখে বলে সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। কিন্তু মেহেভীনের অসুস্থতা যেন কমছে না৷ আজকে শেহনাজকে মেহেভীন কালো জিরা ভর্তা এবং ভাত রান্না করতে বলেছিল। তার নাকি কালো জিরা ভর্তা দিয়ে ভিষণ ভাত খেতে ইচ্ছে করছে। টেবিলে বসে সবাই খাবার খাচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ করে মেহেভীন দৌড়ে উঠে চলে যায়। মেহেভীনের পেছনে পেছনে মুনতাসিমও উঠে চলে যায়। মেয়েটা বমি করছে৷ কাল রাত থেকে বমি করতে করতে মেয়েটার অর্ধেক জীবন শেষ! মুনতাসিমের ভাবনার মাঝে মেহেভীন পড়ে যেতে নিলে মুনতাসিম মেহেভীনকে ধরে ফেলল। মেহেভীনকে জ্ঞান হারাতে দেখে মুনতাসিমের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল। ভেতর টা অদ্ভুত ভাবে হুঁ হুঁ করে উঠল। সে হুংকার ছেড়ে গাড়ি বের করতে বলল। তাইয়ান, তুলি, শেহনাজ সহ সবাই সেখানে এসে উপস্থিত হলো। মুনতাসিম শেহনাজের দিকে তাকিয়ে বলল,

–আমি আগেই জানতাম কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না। ঠিক তেমনই তোমার স্বভাব কোনোদিন ভালো হবে না। আমি তোমার করা রান্না মেহেভীনকে কিছুতেই খেতে দিতে চাইনি। আজ যদি মেহেভীনের কিছু হয়ে যায়। তাহলে আল্লাহর কসম তোমাকে আমি খু’ন করে ফেলব। বাক্য গুলো শেষ হতেই মুনতাসিম মেহেভীনকে নিয়ে বেড়িয়ে গেল। শেহনাজ তাইয়ানের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করে আছে। সে করুন কণ্ঠে বলল,

–তুমি অন্তত আমাকে বিশ্বাস করো তাইয়ান। আমি ভাবির খাবারে কিছু দেইনি। তাইয়ান কিছু বলার আগেই তুলি এগিয়ে এসে বলল,

–আপনি কি করেছেন না করেছেন সেটা আমার স্বামীকে কেন বলছেন? আপনি আমার স্বামীর সাথে কথা বলবেন না। আপনি আমার স্বামীর সাথে কথা বলুন এটা আমি চাইনা। তাইয়ানের মস্তিষ্ক এমনিতেই উত্তপ্ত ছিল। তুলির কথায় তাইয়ান রাগান্বিত হয়ে বলল,

–আমার সব বিষয়ে তোমাকে কথা বলতে বলেছি। আমি স্যারের জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমাকে ভালোবেসে না। তুমি আমার বিষয়ে একটা কথাও বলবে না। তুমি কিসের আশায় এখানে পড়ে আছ? আমি তাইয়ান দেহের লোভী না এটা তুমি এতদিনে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছ। টাকার জন্য আমার কাছে এসেছিলে তাই না। তুমি চাইলে নিষিদ্ধ পল্লীর গলিতেও যেতে পারো। সেখানে ভালো টাকা ইনকাম করতে পারবে। আজকের পর তোমার মুখ দেখতে চাই না। আমি বাসায় এসে যেন দেখি তুমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছ। বাক্য গুলো শেষ করেই তাইয়ান বেড়িয়ে গেল। তুলির আঁখিযুগল বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। আঁখিযুগল ভয়ংকর ভাবে রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। তুলি কক্ষের দিকে যাবে এমন সময় গুলির বিকট শব্দে কেঁপে উঠল চৌধুরী বাড়ি। কালো বস্ত্র পরিধান করা বলিষ্ঠ দেহের কিছু লোক প্রবেশ করল চৌধুরী বাড়িতে। কিছু গার্ডদের লা’শ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। এসব দেখে শেহনাজ ভয় পেয়ে গেল। সে পালাতে চাইলে তাকে খপ করে ধরে ফেলল। তুলি স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। নিজের প্রতি তার নিজের ঘৃণা হচ্ছে। তাইয়ান আজকে তার আসল জায়গা দেখিয়ে দিয়েছে। বাঁচতে ইচ্ছে করছে না তার। তুলির মুখে রুপাল চেপে অবচেতন করা হলো। তুলি তাদের এতটুকুও বাঁধা দিল না। বাড়িতে তাহিয়া, তুলি, শেহনাজ ছিল। তিনজনকেই তারা নিয়ে চলে গেল। বেশিভাগ গার্ড মুনতাসিমের সাথে গিয়েছে। এই সুযোগটাই শত্রুরা লুফে নিয়েছে। প্রেয়সীকে আঘাত করে নিজেই দ্বিগুণ জ্বলে পুড়ে যাওয়া তাইয়ান জানতেও পারল না। তার বিধস্ত প্রেয়সীকে হায়নারা নিয়ে গিয়েছে। সে বাসায় এসে যার অভিমান ভাঙানোর কথা ভাবছে। হায়নারা তাকে ছিঁড়ে খেয়ে খু’ন করার কথা ভাবছে। তাইয়ান কি পারবে তার প্রেয়সীকে বাঁচাতে?

হসপিটালে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে মুনতাসিম৷ সে একটু পর পর ডক্টরের চেম্বারে গিয়ে ডক্টরকে বিরক্ত করে তুলেছে। তাইয়ান মুনতাসিমের পাশে বসে আছে। সে জাফর ইকবালের কথা মুনতাসিমকে বলবে সেটাও বলতে পারছে না। একটু পরে ডক্টর মুনতাসিমকে ডাকল। ডক্টরের অধরের কোণে প্রশান্তির হাসি। সে হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–কংগ্রাচুলেশনস স্যার আপনি বাবা হতে চলেছেন। কি মধুর শোনালো বাক্যটা মুনতাসিমের কাছে। কিছু সময়ের জন্য মুনতাসিমের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ স্থির হয়ে গেল। মেহেভীনের জ্ঞান ফিরেছে। মেহেভীনের সমস্ত মুখশ্রী চকচক করে উঠল৷ তার সমস্ত মুখশ্রীতে পূর্ণতার হাসি। মুনতাসিম ডক্টরের থেকে সবকিছু জেনে মেহেভীন নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। এত সুখ এত আনন্দ দুঃখের কালো ছায়া এসে ধংস করে না দেয় আবার!

চলবে…..

#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৬৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

সুখানুভূতিতে তিক্ততা এসে ধরা দিয়েছে। মস্তিষ্ক টগবগ করছে উঠছে। ক্রোধ যেন শিরা-উপশিরায় ভ্রমন করছে। মুনতাসিমের ললাটের রগ গুলো ফুলে উঠছে। সমস্ত মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। তাইয়ান নিস্তব্ধ হয়ে মুনতাসিমের পাশে বসে আছে। কণ্ঠলানি দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারন হচ্ছে না। তুলির কথা স্মরন হতেই ভেতরটা হাহাকার করে উঠল৷ মেয়েকে সে একটু বেশিই আঘাত করে ফেলছে। মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে সে নিজেকে কিভাবে ক্ষমা করবে? প্রতিদিন যার মুখ থেকে বাড়ি থেকে বের হয়। আবার যে মানুষটার মুখ দেখেই বাড়িতে প্রবেশ করে সেই মানুষটা হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেলে যে ভেতর পুড়ে! তাইয়ানের ভেতরটা ভিষণ বাজে ভাবে পুড়ছে। তার জীবনে তুলির গুরুত্ব ঠিক কতটা, তা তাইয়ানের ভেতরটা কঠিন ভাবে স্মরন করিয়ে দিচ্ছে। বাড়িতে প্রবেশ করেই মেয়েটার মুখ না দেখে ভেতরটা কেমন ছটফট করছে। মুনতাসিম মেহেভীনকে কক্ষে রেখে এসে ড্রয়িং রুমে বসেছে৷ সে খুব শান্ত মস্তিষ্কে তাইয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–তোমাকে আমি জাফর ইকবালের সমস্ত খবর আমাকে দিতে বলেছিলাম তাইয়ান৷ তুমি আমাকে পুরোপুরি তথ্য দাওনি। বুড়ো বয়সে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করার ভিষণ সাধ জেগেছে তার। আমি তার ছেলের মতো হয়েও সেই সাধ পূরণ না করে থাকতে পারি বলো? তার গোপনে কুকর্ম করার ঠিকানা বলো ওর কতবড় কলিজা হয়েছে, সেটা আমিও দেখতে চাই। আমার বাড়ি এসে আমার বাড়ির মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া!

–তুলি তো তাদের কোনো ক্ষতি করেনি স্যার। তাহলে ওরা তুলিকে নিয়ে চলে গেল কেন? তুলির কিছু হয়ে গেলে আমি কিভাবে বাঁচব? আমার জন্য সবকিছু হয়েছে আমি মেয়েটাকে বেশি আঘাত করে ফেলছি। আমাকে শাস্তি দিন স্যার।

–তাইয়ান শান্ত হও। কিছু আঘাত দুরত্ব বাড়ায় না কিছু আঘাত গুরুত্ব বাড়ায়, কিছু আঘাত দুরত্ব কমায়, কিছু আঘাত দূর থেকে কাছে নিয়ে আসে বুঝেছ। তুমি চিন্তা করো না আমি আছি। আমি সবকিছু ঠিক করে দিব। আমি তুলিকে বোন ডেকেছি। আমি থাকতে আমার বোনের কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। তুমি আমাকে সকল তথ্য গুলো দাও।

–শহর থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে একটা নদী আছে। সেখানে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর আছে। সেই ঘরটার পাশেই বিশাল একটা বটগাছ আছে। বটগাছের সাথেই নৌকা বাঁধা নৌকা করে নদীর ওপাশে যেতে হয়। নদীর ওপাশে গভীর অরণ্য আছে ভেবে সবাই ভুল করতে পারে। কিন্তু সেই গভীর অরণ্যের মধ্যে জাফর ইকবালের পাপের রাজত্ব আছে। সেখানে তিনি মেয়েদের আঁটকে রাখেন। ঐ এলাকায় ঘনবসতি কম হওয়ায় সেখানে কেউ যায় না। আমাদের ওখানে একা যাওয়া রিস্ক হয়ে যাবে স্যার।

–তুমি চিন্তা করো না তাইয়া কিছু হবে না। আমরা সেখানে যাওয়ার দশ মিনিট আগে পুলিশকে ইনফর্ম করবে। পরে যা হবে বাকিটা আমি দেখে নিব৷ সময় নষ্ট না করে চলো। আমাদের বাড়ির চারপাশে গার্ডের পরিমান বাড়িয়ে দাও। কোনো শত্রুর নিঃশ্বাস ও যেন আমার বাড়িতে না পড়ে। যদি কোনো ভুল হয়েছে আমি সবকিছু ধংস করে দিব । কথা গুলো শেষ করেই মুনতাসিম বেড়িয়ে পড়লো। তাইয়ান আরিয়ানকে ডেকে সবকিছু বলে সে-ও মুনতাসিমের সাথে চলে গেল।

চারিদিক আঁধারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। দূর থেকে নিশাচর পাখির ডাক কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাচ্ছে। তাইয়ান মুনতাসিমের কথা না শুনে পুলিশকে আগেই ইনফর্ম করে দিয়েছে। ছোট্ট কুঁড়েঘরটায় মোমবাতি জ্বলছে। নদীর আশেপাশে গার্ড দিয়ে ভরা। মুনতাসিম তার গার্ডদের নিস্তব্ধ হয়ে যেতে বলল। সবাই ফোনের আলো অফ করেই সামনের দিকে এগোতে লাগলো। সবার হাতে একটা করে রুমাল। রজনীর আঁধারের সুযোগ লুফে নিতেই এই পদ্ধতির ব্যবহার। দশ-বারো জনকে তারা অচেতন করে ফেলছে। কারো পদধ্বনির শব্দ কর্ণকুহরে আসতেই কিছু গার্ড গু’লি করতে শুরু করল। নিজেদের রক্ষা করতে মুনতাসিমের গার্ড গুলো গু’লি করতে শুরু করে দিল। মুহুর্তে মধ্যে শত্রু পক্ষের সাতজন রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। মুনতাসিমের তিনজন গার্ড আহত হলো। নদীর এপাশে ফাঁকা হতেই মুনতাসিম সহ আরো কয়েকজন গার্ড নৌকায় চড়ে বসলো। সবাই মিলে গভীর অরণ্যের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে। কিছু পথ অতিবাহিত হবার পর একটি আলোকিত বাড়ির দেখা মিললো। বাড়ির চারপাশে আলো ঝলমল করছে। গার্ডরা খুব সতর্কতার সাথে বাড়িটা ঘিরে রেখেছে।

তাহিয়া, শেহনাজ এবং তুলির জ্ঞান এসেছে। শেহনাজের পাশে তুলিকে দেখে উত্তপ্ত হয়ে গেল শেহনাজ। সে রক্তিম আঁখিযুগলে তুলির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। জাফর ইকবাল নিকোটিনের ধোঁয়া ছাড়তে ব্যস্ত। তিনজনের জ্ঞান ফিরতে দেখে সে লোভাতুর দৃষ্টিতে তুলির দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। জ্বলন্ত সিগারেটে শেষ টান দিয়ে হাসোজ্জল মুখশ্রী করে বলল,

–তোমাদের মধ্যে কে আগে আমার সাথে শুতে চাও? জাফর ইকবালের কথায় ঘৃণায় মন মস্তিষ্ক রি রি করে উঠল। তুলি রাগান্বিত হয়ে জাফর ইকবালের মুখশ্রীতে থুতু ফেললো। এতেই জাফর ইকবাল হিংস্র হয়ে উঠল। উঠে এসে তুলির কেশগুলো মুঠোয় পুরে নিল। তুলি ব্যথায় কুঁকড়িয়ে উঠল কিন্তু হাল ছাড়লো না। সে জাফর ইকবালের পুরুষাঙ্গ বরাবর লাথি মারল। জাফর ইকবাল হৃদয়বিদারক চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সে তুলিকে বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করল। সে চেচিয়ে বলল,

–তোরা কে কোথায় আছিস? এই শালীকে ধরে বেঁধে ফেল। এই শালীর কত তেজ হয়েছে সব তেজ আমি কমাব। জাফর ইকবালের কথায় তুলি তেজী কণ্ঠে বলল,

–কেউ আমার কাছে আসার চেষ্টা করবি না৷ তোকে এক লাথি দিয়েছি বেঁচে গিয়েছিস৷ কিন্তু পরের বার লাথি দিলে বাঁচবি না। তুলির কথা শেষ হতেই গার্ড গুলো এসে তুলিকে ধরে ফেললো। তুলির হাত-পা শক্ত করে চেয়ারে বেঁধে ফেললো। জাফর ইকবাল এসে পর পর দু’টো থাপ্পড় তুলির গালে বসিয়ে দিল। তুলির ফর্সা মুখশ্রী মুহুর্তের মধ্যে রক্তিম বর্ন ধারণ করল। জাফর ইকবাল তুলির চুলের মুঠি ধরে বলল,

–আমি তোরেই আজ রাতে ভোগ করব। তুই আমারে আটকাতে পারলে আটকা।

–আমার মুনতাসিম ভাই থাকতে তুই আমার কিছু করতে পারবি না। তুই নিজের মৃত্যুর সময় গুনতে থাক মুনতাসিম ভাই তোকে ধংস করতে আসছে। তুলির কথায় শব্দ করে হেসে উঠল জাফর ইকবাল। তাহিয়া থরথর করে কাঁপছে। শেহনাজ পালানোর ফন্দি আঁটছে। তখনই বাহির থেকে গু’লা’গু’লি’র শব্দ কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাচ্ছে। জাফর ইকবাল জানালা দিয়ে মুনতাসিমকে দেখতে পেল৷ মুনতাসিমকে দেখে জাফর ইকবালের মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়লো। মুনতাসিম এবং তাইয়ান দু’জনেই দক্ষ হাতে গু’লি করছে। একটা গু’লিও যে মাটিতে পড়ছে না। তাহিয়া দৌড়ে এসে তুলির হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল। এই সুযোগে তিনজনই ঘরের বাহিরে গেল। ভাগ্য সেদিন খারাপ হয় সেদিন সবকিছুই খারাপ হয়৷ দৌড়াতে গিয়ে তুলি পড়ে গেল। তুলিকে ধরতে এসে তাহিয়াও ধরা পড়ে গেল। তারা মুনতাসিমদের অতি সন্নিকটে চলে এসেছে। তুলি উঠে মুনতাসিমের কাছে আসতে যাবে। তখনই পেছনে থেকে কেউ ভারি কিছু দিয়ে তুলির মস্তকে আঘাত করল। তুলি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তুলির করুন অবস্থা দেখে তাইয়ানের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল৷ সে ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়লো। তার হাত যেন আর চলছে না। কিন্তু মস্তিষ্ক স্মরন করিয়ে দিচ্ছে প্রেয়সীকে বাঁচানোর জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যেতে হবে। তুলিকে আরেকটা আঘাত করতে যাবে তখনই তাইয়ান গার্ডটাকে গু’লি করে দিল। সে দ্রুত তুলির কাছে গেল। তুলিকে বুকে নিয়ে শেহনাজকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। তুলিকে বুকে নেওয়াতে শেহনাজের ভিষণ ঈর্ষা হলো। তাইয়ান শেহনাজকে চেচিয়ে বলল,

–শেহনাজ তুমি উঠো না তুমি উঠলে ওরা গু’লি করে দিবে। আমি না বলা পর্যন্ত উঠবে না। তুমি গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ো। কিন্তু কথায় থাকে না হিংসা মানুষের মন মস্তিষ্ককে নষ্ট করে দেয়। হিংসা মানুষকে ধংস করে দেয়। যে মানুষের মনে হিংসা যত বেশি তার ধংস হওয়ার সম্ভবনাটাও ততই বেশি। শেহনাজ ঈর্ষায় বশিভূত হয়ে বলল,

–তুলি তোমার কাছে লুকাতে পারলে আমি কেন পারব না? আমিও তোমার আড়ালে লুকোতে চাই। তুমি ওখানে থাকো আমি আসছি। কথা গুলো বলেই শেহনাজ উঠে দাঁড়ালো। তাইয়ান তাকে বসার জন্য অনবরত অনুরোধ করছে। তবুও তাইয়ানের অনুরোধ তার মস্তিষ্ক গ্রহণ করছে না। সে কিছুদূর এগিয়ে আসতেই পরপর চারটে গু’লি এসে শেহনাজের বুকটা ছিদ্র করে দিয়ে গেল। শেহনাজ গলা কাটা মুরগীর ন্যায় ছটফট করতে করতে মাটিতে লুকিয়ে পড়লো। এসব রক্ত এবং গু’লা’গু’লি দেখে তাহিয়া গাছের আড়ালেই জ্ঞান হারালো। তুলি মস্তকে আঘাত পেয়েই জ্ঞান হারিয়েছে। তুলির মস্তক বেয়ে স্রোতের ন্যায় রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তুলির রক্তাক্ত মুখশ্রী তাইয়ানের ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। তাইয়ানের ভাবনার মাঝেই পুলিশ এসে উপস্থিত হয়। মুনতাসিম জাফর ইকবালের বুক বারবার গু’লি করেই শেহনাজের কাছে আসলো। পুলিশ তদন্ত করে অরণ্যের ভেতর থেকে তুলি, শেহনাজ এবং তাহিয়াসহ ৮১ টা মেয়ে উদ্ধার করল। আহতদের হসপিটালের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হলো। মুনতাসিমের প্রথম শেহনাজের জন্য খারাপ লাগছে। সে শেহনাজকে কথা বলতে বলছে কিন্তু শেহনাজ ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়েছে। তুলিকে তাইয়ান বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছে। দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে তারা হসপিটালের আসলো। তাহিয়া ঠিক আছে ভয়ের জন্য অচেতন হয়ে গিয়েছে। তুলির মোটামুটি আহত হয়েছে। তবে শেহনাজের অবস্থা ভালো না। ডক্টররা জরুরি বিভাগের নিয়ে গিয়েছে। তাইয়ান তুলির চিন্তায় এতটাই মগ্ন আছে যে পুরো দুনিয়ায় দারী ভুলে গিয়েছে সে। মুনতাসিম গম্ভীর মুখশ্রী করে জরুরি বিভাগের সামনে পায়চারি করছিল। তার শুভ্র পাঞ্জাবিটা রক্তে ভিজের রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। তখনই মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে নিয়ে এসে ডক্টর আসে। ডক্টরের মুখশ্রী দেখে মুনতাসিমের বুকটা কেঁপে উঠল। দুই সন্তান হারিয়ে সাহেলা চৌধুরী কিভাবে বাঁচবেন? ভাবতেই মুনতাসিমের অন্তরটা হুঁ হুঁ করে উঠছে। ডক্টর এগিয়ে এসে মস্তক নুইয়ে বলল,

–স্যরি স্যার আমরা আপনার বোনের চিকিৎসা করতে পারিনি। আপনার বোন তো পথে আসার সময় দশ মিনিট আগেই মারা গিয়েছে। আমরা চেষ্টা করার সুযোগ পাইনি। ডক্টরের কথায় মুনতাসিম কিছু বলল না৷ সে একদম নিরব হয়ে গিয়েছে। মেয়েটা জীবনে ভালোবাসা খুঁজতে গিয়ে ভালো থাকাটাই হারিয়ে ফেললো। মুনতাসিম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাহিয়ার কেবিনে গেল। তাহিয়া ভালো আছে। মুনতাসিম জড়তা নিয়ে তুলির কেবিনে গেল। তাইয়ান বিধস্ত অবস্থায় তুলির হাত ধরে বসে আছে। ওদের তিনজনকে ৮১ টা মেয়ের সাথে পাওয়া যাওয়াতে পুলিশের অনুমতি ছাড়া নিয়ে যাওয়া যাবে না। মহিলা পুলিশ এসে তাদের দায়িত্ব পালন করছে। মুনতাসিম সবকিছু ঠিকঠাক করার বন্দোবস্ত করে ফেললো।

রজনীর আঁধার কেটে গিয়েছে। চারিদিকে প্রভাতের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। মুনতাসিমের কথাতেই তাহিয়া এবং শেহনাজকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। তুলিকে দু’টো দিন ডক্টর হসপিটালে থাকতে বলেছে। শেহনাজের মৃত্যুর খবর তাইয়ান পেয়েছে। এতেই সে আরো শক্ত করে তুলিকে আঁকড়ে ধরেছে। তুলিকে ছেড়ে দিলে তুলি পালিয়ে যাবে। মুনতাসিম অবাক হলো ঘৃণা জিনিসটা কি মারাত্মক তাই না! একটা সময় যে মানুষটাকে ভালোবাসত আজ সেই মানুষটার মৃত্যুর খবরেও কিছু যায় আসে না। ঘৃণা এমনই হওয়া উচিৎ নয়তো নিকৃষ্ট মানুষের মিছে ভালোবাসার একটা মানুষকে বাঁচতে দেয় না। তাইয়ানের নিজেকে সামলে নেওয়াটা মুনতাসিমের ভিষণ পছন্দ হলো। তাইয়ান শেহনাজের জানাজায় অংশ নিয়েছিল। সে বেশিক্ষণ দেরি করেনি। শেহনাজের মৃত্যু যে তার ভেতরে নাড়া দেয়নি এমনটা না৷ শেহনাজ যে এখন তার কাছে পরনারী আর একটা পরনারীকে নিয়ে ভাবাও যে পাপ তার ঘরে বউ আছে৷ তার বউয়ের করুন অবস্থা দেখে অন্য নারীর জন্য কষ্ট পাবে। এতটা নিকৃষ্ট এখনো তাইয়ান হয়নি। শেহনাজের জন্য খারাপ লাগছে কিন্তু তুলির জন্য ভেতর পুড়ছে। যে মেয়েটা তাকে এতটা ভালোবাসা দিল আর সে ছোট একটা ভুলের জন্য মেয়েটাকে এতটা শাস্তি দিল!

চৌধুরী বাড়ি জুড়ে আবার শোকের ছায়া নেমে এলো। মুনেম এবং শেহনাজকে হারিয়ে সাহেলা চৌধুরী সর্বহারা প্রায়। তাকে কেউ কিছুতেই স্থির করতে পারছে না। মেহেভীন সবকিছু শুনে কেমন জানি নির্বাক হয়ে গিয়েছে। তাদের জীবনেই কেন এত দুঃখ এত কষ্ট একটু সুখ কি তাদের জীবনে আসতে পারতো না! মুনতাসিমকে সে কিভাবে সামলাবে? সমস্ত মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে গিয়েছে মেহেভীনের। এত কোলাহলের মধ্যে সে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাইয়ান তুলির মস্তকের পাশে বসেছিল। তুলির জ্ঞান ফিরেছে। তুলি পাশ ফিরে তাইয়ানকে দেখে মুখশ্রী ঘুরিয়ে দিল। সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে যেতে লাগলে হাতে ব্যথা অনুভব করল। তুলি ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। তাইয়ান আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারল না। সে শক্ত বন্ধনে তুলিকে নিজের বুকের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলল। সে খুব শক্ত হাতে তুলিকে আলিঙ্গন করে রেখেছে। তুলি এতটুকু নড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তুলি কেমন হাসফাস করে লাগলো। তাইয়ান তুলির ললাটে চুমু খেয়ে বলল,

–আমাকে তুমি মাফ করে দাও তুলি। আমি তোমাকে অনেক আঘাত করে ফেলছি। তুমি আমাকে শাস্তি দাও তবুও আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি তোমার এবং স্যারের চুক্তির কথা শুনে ফেলছিলাম। সেদিনের পর তোমার প্রতি আমার মনে ক্ষোভ তৈরি হয়। আমার মস্তিষ্ক শুধু একটা কথাই বলতো যে তুমি আমাকে শুধু টাকার জন্য বিয়ে করেছ। আচ্ছা আমি যদি তোমাকে টাকার জন্য বিয়ে করতাম, তাহলে তুমি আমাকে কিভাবে গ্রহণ করতে? তুমি তো আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করোনি তুলি। তুুমি তোমার মায়ের সুস্থতার জন্য টাকাকে বিয়ে করেছ। আমার হৃদয়ের কান পেতে শুনো হৃদয়টা আমার জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছে। তুমি কি আমার হৃদয়ের হাহাকার শুনতে পাচ্ছো তুলি? আমাকে তোমার এতটা বাজে ছেলে মনে হয়? তোমার একটা অসুস্থ মাকে আমি দেখতাম না তুলি! আমি এতটাও খারাপ না তুলি। তাইয়ানের কথায় তুলির বুদ্ধিরা সজাগ হলো। সে তাইয়ানের হৃদয়ের আঘাতের গভীরতা অনুভব করতে লাগলো। সে তো আসলেই মানুষটাকে ভালোবেসে বিয়ে করেনি। তবে যে মানুষটার সাথে থাকতে থাকতে মনের অজান্তেই মানুষটাকে মন দিয়ে বসেছে। সে খবর কি মানুষটা পাইনি? যদি পেয়ে থাকতো তাহলে এত গুলো অভিযোগ করতো না। তুলি তাইয়ানকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠল। সে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল,

–আমি আসলেই আপনার যোগ্য না তাইয়ান। আমি সত্যিই আমার মা ভালো থাকবে বলে আপনাকে বিয়ে করেছি৷ কিন্তু আপনার সাথে থাকতে থাকতে কখন যে মন দিয়ে বসেছি৷ তার খবর আমি নিজেও জানি না। আপনাকে বিরক্ত করে আমার দিন শুরু হয়। আপনাকে বিরক্ত করে আমার রাত শেষ হয়। আপনি আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছেন। আপনাকে ছাড়া আমার দম বন্ধ লাগে তাইয়ান। আপনি তো বলেই দিয়েছেন আপনি আমার মুখ দেখবেন না৷ কিন্তু আপনি তো এটা বলে দেননি ,আপনাকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকব? আপনি আমাকে বলে দেন তাইয়ান আপনাকে ছাড়া আমি কিভাবে বাঁচব? আমাদের শুরুটা ভালোবাসা দিয়ে না হলে-ও শেষটা যে ভালোবাসা দিয়ে শেষ হতে যাচ্ছে। আমি আপনাকে ছাড়া কিভাবে থাকব বলে দিন তাইয়ান। তুলির প্রতিটি বাক্য তাইয়ানের হৃদয় স্পর্শ করে গেল। সে তুলিকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি কোথাও যাবে না। তুমি সারাজীবন আমার সাথে থাকবে। তোমাকে আমি কোথাও যেতে দিব না। আমার হৃদয়ের গুপ্ত কুঠুরিতে তোমাকে লুকিয়ে রাখব। আমার বুকের মধ্যে ফুলের মতো যত্নে তুমি থাকবে তুলি। তোমাকে আর কখনো কষ্ট পেতে দিব না। তুমি আমাকে মায়া ধরিয়ে দিয়েছ। আমি মায়াকে কিভাবে পিছু ছাড়াব? আমিও যে তোমাকে ভিষণ ভালোবেসে ফেলছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও তুলি। তোমাকে আমি আঘাত করে কথা বলেছি।” তাইয়ানের কথা শেষ হতেই তুলি তাইয়ানকে আঁকড়ে ধরল। তাইয়ান উন্মাদ প্রেমিকের ন্যায় তুলির সমস্ত মুখশ্রীতে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলতে লাগলো।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে