কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-০৩

0
1050

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব:০৩
লিখা:জাহান আরা

দরজায় টোকা পড়তেই অভ্র খানিকটা বিরক্ত হলো।এরকম রোমান্সের সময় আবার কে এলো বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।
অভ্র দরজা খুলতেই রুমে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লো ৫ জন মানুষ। সবার মুখে মুখোশ পরা।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি,অভ্র দুজনেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।সম্বিৎ পেতেই আমি চিৎকার করে উঠি,কে আপনারা? কি চা…

আমার কথা শেষ হবার আগেই একজন এসে আমার মুখ বেঁধে দিলো।”

এটুকু বলে একটা লম্বা শ্বাস নিলাম।এর পরের ঘটনা আমি কাউকে বলতে পারবো না কি হয়েছিলো আমার সাথে।সেটা ভাবলেই আমার ইচ্ছে করে পুড়িয়ে দিতে এই শরীরটা কে।

ওপাশ থেকে নেহাল জিজ্ঞেস করলো,”তারপর কি হলো?”

নেহালের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে নিজের অজান্তে দুচোখ ভিজে গেলো বুঝতে পারি নি।চোখ মুছে নিলাম পরনের সাদা শাড়ির আঁচল দিয়ে।
বাহিরে কোথাও একটা পাখি অনেকক্ষণ ধরে ডেকে চলেছে। সেই ডাক ও যেনো কান্নামাখা।সেই পাখিটিও যেনো কারো বিরহে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে,করুণ সুরে অন্য কাউকে ডাকছে।কিন্তু যাকে ডাকছে সে আসছে না।
আচ্ছা এই পাখিটিও কি আমার মতো নিজের ভালোবাসার মানুষ হারিয়েছে?
তার ছোট্ট বুকেও নিশ্চয় একবুক জ্বালা?

নেহাল আবার জিজ্ঞেস করলো,”তারপর কি হলো?”

“সবগুলো লোকের পরনে কালো শার্ট-প্যান্ট ছিলো। সবাই খুব লম্বা। সাথে থাকা রশি দিয়ে ওরা আমাকে আর অভ্র কে বেঁধে ফেললো।তারপর আমাকে বললো,রুমে যা আছে,টাকা পয়সা,স্বর্ণালংকার সব বের করে দিতে।
আমার দুচোখ তখন কান্নায় ভিজে যাচ্ছে। অভ্রর দিকে তাকাতেই দেখলাম অভ্র চোখ দিয়ে ইশারা করছে আমাকে সব বের করে দেয়ার জন্য।
আমি আলমারির সামনে যেতেই আমার হাতের বাঁধন খুলে দিলো।
কাঁপা কাঁপা হাতে আমি আলমারি থেকে সব বের করে দিলাম।বিয়েতে স্বর্ণ দিয়েছিলো শাশুড়ি আম্মা ১০ ভরি,অভ্র একটা ডায়মন্ডের নেকলেস সেট গিফট করেছিলো বাসর রাতে।তাও দিয়ে দিলাম।২ লক্ষ টাকা ছিলো,দুদিন আগেই অভ্র ব্যাংক থেকে তুলে এনেছিলো,সেই টাকা ও দিয়ে দিলাম ওদের হাতে।
তোর মনে আছে,তুই আমাকে একটা রিং দিয়েছিলি,আর একটা লকেট,সবসময় ওগুলো আমার পরা থাকতো। সেই লকেট আর রিং ওরা কেঁড়ে নিলো।
আমার হাত আবার বেঁধে দিলো ওরা,তারপর নিয়ে গেলো বাহিরে ডাইনিং রুমে।
আমাকে আর অভ্রকে ডাইনিং রুমে দাঁড় করিয়ে ওরা একে একে আব্বা আম্মা,বড় ভাবী,ছোট আপা সবার রুমে ঢুকলো।
সবার থেকেই স্বর্ণালংকার,টাকা সব বের করে নিলো।
সবাইকে ডাইনিং রুমে নিয়ে এলো।
কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই একজন হাতে থাকা চাপাতি দিয়ে এক কোপ বসিয়ে দিলো অভ্রর ঘাড়ে।
আমার বুক ফেটে চিৎকার আসছিলো কিন্তু চিৎকার করতে পারছিলাম না মুখের বাঁধনের জন্য।মনে মনে আল্লাহকে বলছিলাম,আল্লাহ বাঁচাও আমার স্বামীকে। কেনো ওকে মেরে ফেলছে আল্লাহ,আমাকে বিধবা করো না।

চোখের সামনেই কুপিয়ে টুকরো করতে লাগলো ওরা অভ্রকে,আমার তখন আর সহ্য করার ক্ষমতা ছিলো না।জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম।”

নেহাল চুপ করে রইলো শুনে,আমার প্রচন্ড বুক ব্যথা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর নেহাল জিজ্ঞেস করলো, “তুই আজকাল কি করছিস,সময় কাটাচ্ছিস কিভাবে?”

নেহালের প্রশ্ন শুনে আমার মনে পড়লো আমি যে একটা কলেজের রসায়ন টিচার,ডিপার্টমেন্ট হেড।
কতো দিন আমি কলেজে যাই না!
আশ্চর্য,এতো দিন আমার মনেও ছিলো না আমি আসলে কিছু করতাম।
আমার চুপ করে থাকার মানে বুঝতে পারলো নেহাল,তারপর বললো,”এভাবে থেকে কি লাভ হবে বল?
কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখ,তাহলে অন্তত ডিপ্রেশন থেকে কিছুটা রিলিফ পাবি,কিছু সময়ের জন্য সব ভুলতে পারবি।বাসায় বসে থাকলে যন্ত্রণা কুঁড়ে কুড়ে খাবে।বারবার সেই কালো স্মৃতি মনে পড়বে।কাল থেকে কলেজে জয়েন কর।”

“আচ্ছা,দেখি।”

“অনেক রাত হয়েছে,এবার ঘুমানোর ট্রাই কর।আগামী পরশু দেখা হবে তোর কলেজে।
রাখছি,আল্লাহ হাফিজ।”

নেহাল ফোন রেখে দিতেই আমার বুকের ভিতর আবারও চিনচিনে ব্যথা টের পেতে লাগলাম।এই রুমেই তো অভ্র ছিলো আমার সাথে।এই বিছানায়!
এই সেই ড্রেসিং টেবিল,যেখানে অভ্র আমাকে কাজল পরিয়ে দিয়েছে।
আজ সব কিছু আছে শুধু অভ্র নেই!

অভ্র নেই কথাটা আজও আমার বিশ্বাস হয় না।মনে হয় যেনো এখনই অভ্র হাসপাতাল থেকে ফিরবে।ফিরার আগে আমাকে কল দিয়ে বলবে,আমি বের হচ্ছি কাজল,তুমি প্রিপেয়ার্ড তো,আজ কিন্তু কোনো ছাড়াছাড়ি নেই।

এটুকু বলেই হাহাহা করে হাসবে।বিয়ের পর অভ্র যেখানেই যেতো কোনো কাজে,বাসায় ফেরার আগে আমাকে কল দিয়ে এই কথা বলতো।বলে নিজেই অট্টহাসিতে ভেঙে পড়তো।
আর ওদিকে আমি লজ্জায় লাল হয়ে যেতাম।

ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই মিথ্যে অপেক্ষা করে বসে রইলাম,এখনই অভ্র কল দিবে,ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠবে “অভ্র” নামটা।

আমার মিথ্যে অপেক্ষারা আর শেষ হবে না এই জন্মে,আর কখনোই অভ্রর কল আসবে না।তবুও তো মন বুঝতে চায় না।জেনেও মন অপেক্ষা করে।

বুকের ভিতর যেনো আগুন জ্বলছে। সেই আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে আমাকে।এই যে আগুন বুকের ভিতর,এই আগুন নিভবে সেদিন,যেদিন অভ্রকে যেভাবে খুন করেছে,সেভাবে খুনীদের ও খুন করবো আমি।

চলবে……???

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে