কেবিন নং থার্টি সিক্স পর্ব-০৪

0
1147

#কেবিন_নং_থার্টি_সিক্স
পর্ব: ০৪
জাহান আরা

পরের দিন গেলো আমার সবকিছু আবার ও চিন্তাভাবনায়।ঘটনাগুলো আবারও ভাবতে লাগলাম শুরু থেকে।
কোথাও একটা অসঙ্গতি রয়ে গেছে,আমি ধরতে পারছি না।
কি সেটা?
ভাবতে ভাবতে রুমে পায়চারী করছি।
হঠাৎ করেই আমার ফোন বেজে উঠলো,ঠিক তখনই আমার মাথায় এলো অসঙ্গতিটা কোথায় ছিলো।
ফোন নিয়ে দেখি ভাবী কল দিয়েছে।

কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভাবীর বিষণ্ণ কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।বুঝতে পারলাম কোনো কারনে ভাবীর মন খারাপ।
নিজের ভিতরের কষ্টকে লুকিয়ে বেশ হাসিখুশি ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”কি হয়েছে ভাবী তোমার?”

“আমারই তো সব জ্বালারে বোন।”

“কি হয়েছে,আমাকে বলো ভাবী?”

“তুমি কেনো এরকম করে ওবাড়ি চলে গেলে কাজল,কিসের টানে?”

“ভাবী তুমিও এই কথা বলছো?”

বেশ অবাক হলাম আমি ভাবীর মুখে এরকম কথা শুনে। অনন্ত ভাবী তো জানে আমি অভ্রকে কতো বেশী ভালোবাসি।

ভাবীর কান্নার শব্দ শুনে আমি খুবই অবাক হলাম।কি হয়েছে ভাবীর?

কান্না বন্ধ করে ভাবী বললো,”কাজল,আমার তো বোন নেই তুমি জানো,তুমি নিজেই আমার বোন,কখনো তোমাকে আমি ননদীর চোখে দেখি নি।যখন তুমি অভ্রকে ভালোবাসতে অভ্র তোমাকে ভালোবাসতো,তখন থেকে তোমাকে ফুল সাপোর্ট আমি দিয়েছি,তুমি যা বলেছো,যেভাবে বলেছো আমি শুনেছি,সেভাবে করেছি।”

“হ্যাঁ ভাবী,আমিও সেটা স্বীকার করি,কিন্তু এখন কি হয়েছে?”

“বোন রে,আমি যে তোমার এই কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।আমার বুকের ভিতর এক আকাশ কষ্ট জমে আছে।বারবার মনে হয় আমি সুখে স্বামীর সংসার করছি আর আমার বোনটা কষ্টে আছে,তুমি ওই বাড়ি থেকে চলে আসো কাজল,তোমার পুরো জীবন এখনো পড়ে আছে সামনে,এভাবে তোমার জীবন নষ্ট করো না।নতুন করে সব শুরু করো আবার।”

ভাবীর কথাগুলো তীরের মতো এসে আমার বুকে বিঁধতে লাগলো।মুহুর্তেই আমার হৃৎপিন্ড তীরের আঘাতে যেনো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো।কি বললো ভাবী এটা?
কিভাবে বললো ভাবী?
আবার নতুন করে সব শুরু করবো আমি?
কি শুরু করবো আবার নতুন করে?

প্রেম করবো?
যেই প্রেম আমাকে আমার অভ্র শিখিয়েছে,সেই প্রেম আমি অন্য কারো সাথে করবো আবার?
নাকি সংসার করবো?
সংসার আর কি করবো নতুন করে?
সংসার করার শখ আমার মিটে গেছে আজীবনের জন্য।
এই দেহ আবার অন্য কাউকে দিবো?
এতোটাই সহজ সবকিছু?

ভাবতেই হাসি পায় আমার।

আমার চুপ করে থাকা দেখে ভাবী আবারও জিজ্ঞেস করলো,”কিছু বলো কাজল?”

“কি বলবো ভাবী?কিভাবে সম্ভব ভাবী এটা বলো?
আমি কিভাবে অন্য কাউকে মেনে নিবো?
ভালোবেসেছি একজন কে,সংসার করলাম একজনের সাথে,সে নেই বলে এখন অন্য কাউকে ভালোবাসবো?
ভাবী,ভালোবাসা কি এতোটাই ঠুনকো?
আর এতোই পরিবর্তনশীল?

ভাবী,কিভাবে বিশ্বাস করবো,অন্য কাউকে বিয়ে করলে সে আমাকে অভ্রর মতো ভালোবাসবে?
অভ্রর মতো করে আমাকে বুঝবে,আমার যত্ম নিবে?
তুমি কি সেই নিশ্চয়তা আমাকে দিতে পারবে?”

ভাবী চুপ করে রইলো।

“ভাবী,মৌষলপর্বে বসুদেবের মৃত্যুর পর তাঁর চার স্ত্রী দেবকী, ভদ্রা, মদিরা ও রোহিণী সহমরণে যায়।এক সময় সতীদাহ প্রথার প্রচলন ছিলো। রাজা রামমোহন রায় দক্ষ হাতে সতীদাহপ্রথা বিলুপ্ত করেছেন।এযুগে যদি সতীদাহ প্রথা থাকতো তবে আমিও অভ্রর সাথে সহমরণে যেতাম।সে আমার বড় সৌভাগ্য হতো ভাবী।

আমি বড় অভাগী ভাবী।আমি তো অভ্রর সাথে সহমরণে যেতে পারি নি,ছোট একটা জীবন কি আমি অভ্রর স্মৃতি নিয়ে জীবন কাটাতে পারবো না?
কতোদিন বাঁচবো ভাবী আর?
অভ্রর যে ভালোবাসা পেয়েছি তা নিয়ে বাকী জীবন কাটাতে পারবো,বরং তোমরা নতুন করে সব শুরু করতে বললেই আমার আরো কষ্ট হবে।
আমাকে এরকম কিছু কখনো বলো না আর ভাবী।”

“তুই কেনো এতো ভালোবাসতে পারিস রে কাজল,কেনো এতো পাগল তুই?
তুই যেভাবে সুখী হোস বোন,তাই থাক,আমি আর বলবো না বোন কিছু।”

অতি আবেগের সময় ভাবী আমাকে তুই করে বলে,এখন ভাবী অনেক কিছু বলবে আমি জানি।
ফোন কেটে দিলাম আমি।আমার মাথায় এখন অন্যকিছু ঘুরছে।

অভ্রর সেদিন রাতে একটা কল এসেছিলো!

প্রচুর গোয়েন্দা গল্প পড়ার কারনে হঠাৎ করেই আমার মনে পড়ে গেলো বিষয়টা নিশ্চয় পরিকল্পিত। সেদিন রাতে যেই ব্যক্তি কল দিয়েছে অভ্রকে,সে নিশ্চয় কোনো না কোনোভাবে ডাকাত দলের সাথে যুক্ত।

আলমারি খুলে দ্রুত অভ্রর ফোন বের করলাম।
ফোনের ওয়ালপেপারের দিকে তাকাতেই চোখ ভিজে গেলো নিজের অজান্তেই।
অভ্রর আর আমার একটা ক্যান্ডিড ছবি।কলেজের ল্যাবে তোলা একটা ছবি।অভ্র গালের নিচে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে,আমি একটা জার হাতে নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করছি।বাতাসে আমার চুল উড়ছে,চোখে খয়েরী ফ্রেমের চশমা,পরনে সাদা এপ্রোন।অভ্রর পরনে কালো শার্ট,নীল জিন্স।

আমার খুব প্রিয় ছিলো ছবিটি,তাই অভ্র ছবিটি ওয়ালপেপারে রেখেছে।
এই ছবিটি তোলার দিনের কথা আমার মনে পড়ে গেলো।
সেদিন অভ্রর সাথে বাহিরে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিলো।হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়ে অভ্র কলেজের সামনে চলে আসে আমাকে পিক করার জন্য,কিন্তু এসে দেখে আমি নেই।অগত্যা অভ্র কলেজের ভিতরে চলে যায়।ডিপার্টমেন্টে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে আমি ল্যাবে আছি।
সেকেন্ড ইয়ারের প্রাকটিক্যাল ক্লাস নিচ্ছি।বলে রাখা ভালো,অভ্রকে কলেজের সব স্যার,ম্যাডামেরা চিনতো আমার হবু বর হিসেবে।
সহজেই তাই অভ্র ল্যাবে যেতে পারলো।গিয়ে দেখে আমি মহা ব্যস্ত,দম ফেলার ও ফুরসত পাচ্ছি না।অগত্যা বেচারা গালের নিচে হাত দিয়ে বসে বসে আমাকে দেখতে থাকে।সেই মুহুর্তে কলেজের ফটোগ্রাফার ল্যাবে আসে আমার সাথে অনুষ্ঠানের ছবি তোলা নিয়ে কথা বলতে।এরকম একটা ভিউ দেখে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারে না সে।তুলে ফেলে ছবিটি। পরবর্তীতে আমাদের বিয়েতে বড় করে বাঁধাই করে ছবিটি আমাকে গিফট করে সে।সেদিন আমি আনন্দে কেঁদেই ফেলেছিলাম।

পুরোনো স্মৃতি ভাবতে ভাবতে আবারও কেঁদে ফেলি আমি।
কোথায় চলে গেলো অভ্র আমাকে রেখে!

অভ্রর কথা ভাবলেই আমার মনে পড়ে যায় চোখের সামনে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া একজন মানুষের কথা।জীবন্ত একজন মানুষ যে কি-না কিছু সময় আগেও আমার সাথে ছিলো।

না,আর পারছি না ভাবতে।মাথায় ভোঁতা এক ধরনের ব্যথা হচ্ছে,ভীষণ ভার ভার লাগছে মাথা,দুচোখ জ্বলে যাচ্ছে।
বুকের ভিতর একটা প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে আমার।এই আগুন নিভবে কবে?
কে জানে!

ফোন থেকে সেদিনের কল হিস্টোরি বের করলাম।লাস্ট কল এসেছে একটা রবি নাম্বার থেকে।
কলটির রেকর্ডিং অপশনে গেলাম।রেকর্ড প্লে করতেই নিশ্চিত হলাম এটা আসলেই প্ল্যান করা ছিলো।কেননা যেখানে ঘরেই ফুল নেটওয়ার্ক থাকে,সেখানে অভ্র কল রিসিভ করে কথা বলা মাত্রই ওপাশের লোকটি বললো,স্যার কথা ক্লিয়ার শুনতে পাচ্ছি না,আপনি একটু বের হয়ে কথা বলেন,নেটওয়ার্ক প্রবলেম করছে।

অবাক হলাম আমি,এই বাসায় সবসময় ফোর জি থাকে,সেখানে রুমে নেটওয়ার্ক প্রবলেমের কথাটা বলার কারন কি হতে পারে?
নিশ্চয় অভ্রকে ঘর থেকে বের করার জন্য,যাতে ওদের কেউ একজন নিশ্চিন্তে বাসায় ঢুকতে পারে।

দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে আমার কোনো অসুবিধা হলো না।
নাম্বারটা নিজের ফোনে নিয়ে ডায়াল করলাম আমি।যদিও সন্দেহ ছিলো ফোনটা অফ থাকবে।

আমার ধারণাই সত্যি হলো।সুইচ অফ বলছে ফোনের।একটা ক্লু তো পেয়েছি,এই নাম্বারটা কার নামে রেজিস্ট্রেশন করা তা থেকেই খুঁজে বের করতে পারবো কে ছিলো সেই লোক।

অনেক দিন পরে নিজের অজান্তেই হেসে উঠলাম আমি।কেমন যেনো নিশ্চিন্ত অনুভব করছি আজ।অন্তত কানাগলিতে আর ঘুরতে হবে না খুনীদের ধরার জন্য।এখন শুধু নেহাল আসার অপেক্ষা। নেহাল আসলেই ওর মামাকে দিয়ে এই নাম্বারের ডিটেইলস বের করে জানা যাবে সবকিছু।
ফোনে অভ্রর একটা ছবি বের করে কয়েকটা চুমু খেলাম,তারপর আস্তে করে অভ্রকে বললাম,”আর অল্প কয়দিন সোনা,আমি শীঘ্রই খুঁজে বের করবো ওদের।আমার পরনের লাল শাড়ি কেঁড়ে নিয়েছে যারা,আমাকে বিধবা করেছে যারা,বিনা কারনে তোমাকে হত্যা করেছে যারা,তাদের শাস্তি আমি নিজ হাতে দিবো।”

অনেক রাত হয়ে গেছে,ঘুমাতে হবে,কাল থেকে কলেজে জয়েন করবো।বাসায় বসে থাকলে কষ্ট আরো বাড়বে,নেহাল ঠিকই বলেছে।
অভ্রর একটা ছবি বুকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।বিয়ের পর অভ্রকে কথা দিয়েছি সারাজীবন অভ্রকে আমার বুকে ঘুমাতে দিবো,এখন অভ্র নেই,কিন্তু তবুও ওকে দেওয়া কথার বরখেলাপ আমি করতে পারছি না।
মৃত্যুর পর যদি দেখা হয় কখনো,অভ্র যাতে না বলতে পারে আমি ওকে দেওয়া কথা রাখি নি।

চলবে…..???

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে