এক শহর ভালোবাসা পর্ব-১৭

0
3101

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_১৭
#সুরাইয়া_নাজিফা

শানের পাশ থেকে উঠতে নিতেই হুট করে উনি আমার ওড়না টেনে ধরেন পেছন থেকে।আমি একটু সামনে আগালেই ওড়নাটা টান লেগে পুরোটাই ওনার হাতে চলে যাবে এমন অবস্থা। আচমকা শানের এমন আচরণে আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই।

একহাত দিয়ে গলার কাছে ওড়নাটাকে ধরে পিছনে ফিরে ওনার দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
“এসব কি হচ্ছে? ওড়না ধরে টানছেন কেন?ছাড়ুন ওড়নাটা। ”

কথাটা বলতে না বলতেই শান ওড়নাটার মাথার দুই অংশ একত্র করে একটা হেচকা টান দিল ফলস্বরূপ আমি উল্টে গিয়ে উনার বুকের উপর পড়লাম।গলায় চাপ লাগাতে খুকখুক করে দুইবার কেশে উঠলাম। গলায় প্রচন্ত ব্যাথা পেয়েছি জরজেটের ওড়না হওয়ায়। আমার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পরতে শুরু করলো উনার হঠাৎ এমন ব্যবহারে।

আমি উনার দিকে ফিরে কান্না মাখা কন্ঠে বললাম,
“কি করেছি আমি? এমন করছেন কেন আমার সাথে? ”

শান আমার ওড়না ছেড়ে দিল।ওড়না ছাড়তেই আমি তাড়াতাড়ি ওড়ানাটা গলা থেকে খানিকটা নামিয়ে নিলাম। যে জায়গাটায় ব্যাথা পেয়েছি ওই জায়গায় হাত দিতেই আতকে উঠলাম। হাত দিলেই জ্বলছে। কতটুক কি হয়েছে বুঝতেছি না। আমি একটু ওনার থেকে দূরে সরে গেলাম। দূরে সরতেই শান আবার আমার হাত ধরে টান দিয়ে ওনার একদম কাছে নিয়ে আসলো। আমি ওনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। শান আমার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“আমারও তো একই প্রশ্ন কেন করছো তুমি আমার সাথে এরকমটা? ”

আমার চোখে এখনও বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। আমি ওনার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বললাম,
“আমি কি করেছি আপনার সাথে? ”

শান এখনো আমার দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“দুইদিন ধরে তোমার ব্যবহারে এতো পরিবর্তন কেন এসেছে বুঝতেছি না আমি। প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথে ঠিক করে কথাই বলছো না। হাসপাতাল থেকে আসার পরই তোমার মাঝে এই পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করছি কারণ কি বলো আমাকে? ”

আমি উনাকে ফিরতি প্রশ্ন করে বললাম,
“আমি আপনার সাথে ভালো করে কথা বলতাম কবে সেটাই তো আমার মনে পড়ছে না। তাহলে পরিবর্তন দেখলেন কোথায়? ”

“একদম ত্যাড়া কথা বলবে না। তুমিও খুব ভালো করেই জানো তোমার কথায় যথেষ্ঠ পরিবর্তন এসেছে।কি হয়ছে?কেউ কিছু বলেছে? ”

আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
“না। ”
শান উনার একহাত দিয়ে আমার গালের দুইপাশে হাত দিয়ে মুখটা জোর করে উনার দিকে ফিরিয়ে বললেন,
“আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো যে কিছু হয়নি। ”
আমি একবার উনার চোখের দিকে তাকালাম তাকিয়েই চোখ আবার নামিয়ে নিলাম। চোখ থেকে একফোঁটা পানি পড়ল,
“আমি ব্যাথা পাচ্ছি হাতটা সরান মুখ থেকে। ”

শান আমার গাল থেকে হাত সরিয়ে নিলো। আমার হাত ধরে আস্তে বিছানার উপর বসিয়ে দিলো। উনি আমার পায়ের কাছে হাটু মুড়ে বসে আমার দুই হাত উনার দুইহাতের মুঠোয় বন্ধ করলেন। তারপর নরম কন্ঠে বললেন,
“স্যরি আমি তোমার সাথে এমনটা করতে চাইছি না কেন তুমি আমাকে সত্যিটা বলছো না কি হয়েছে তোমার? প্লিজ লক্ষ্মীটি বলো না। ”

আমি উনার দিকে ছলছল চোখে তাকালাম। উনিও আমার দিকে আকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার কথা শুনার জন্য। আমি শানের দিকে তাকাতেই শান আমাকে আবারও চোখের ইশারায় কারণটা জানতে চাইল। আমি ধীর কন্ঠে বললাম,
“আমাকে ডিভোর্স দিচ্ছেন কবে?

কথাটা বলতেই শানের হাতটা আমার হাত থেকে আস্তে আস্তে সরে গেল।এতক্ষন যেই চোখে আমার জন্য সহমর্মিতা, আমার কথা শোনার জন্য আকুলতা ছিল কিছু সময়ের মধ্যে সেখানে হিংস্রতা ফুটে উঠল। শান আমার সামনে ওভাবেই স্থির হয়ে শীতল কন্ঠে বললো,
“কি বললে আবার বলো। শুনতে পাই নি। ”

উনার এমন শীতল কন্ঠ শুনে আমি মনে হয় জমে যাচ্ছিলাম। উনি কথাটা স্বাভাবিকভাবে বললেও শুনতে কেমন ভয়ংকর লাগছে। কি বলবো আমার মনে হচ্ছে আমার কথা গুলো পেটের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে মুখে আর আসছে না। শান আবারও শান্ত ভাবে বললো,
“কি হলো কথা বলছো না কেন? কি বলছিলে তখন? ”

আমি নিজেকে সামলে নিচের দিকে তাকিয়েই বললাম,
“ডিভোর্সের কথা বলছি আমি। এমনিতেও আপনি বিয়ের দিন তো বলেছিলেনই আপনি শুধু আমাকে আপনার আর আমার পরিবারের জন্য বিয়ে করেছেন। শুধু শুধু এমন একটা রোবটিক্স সম্পর্কে থেকেই বা কি লাভ। যেখানে না আছে ভালোবাসা আর না আছে এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ। আমরা দুজনেই কেউ এই সম্পর্কটা চাই না। তাই আমার মনে হয় আমাদের এখন সরে আসা উচিত। ”

হঠাৎ শান আমার হাতের বাহু ধরে এক টানে বিছানা থেকে উঠিয়ে উনার সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। উনার চোখ থেকে আগুন ঝড়ে পড়ছে। উনি কঠোর কন্ঠে বললো,
“এসব কথা তোমার মাথায় কে ডুকিয়েছে? ”
আমি কাঁপা কন্ঠে বললাম,
“কেউ না আমার মনে হলো তাই বলছি। আপনি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে ঐশী আপুকে বিয়ে করে নিন উনি আপনাকে অনেক ভালোবাসে। ”
“ঐশী বলেছে কিছু তোমাকে? ”

আমি উনার থেকে আমার হাত সরানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু উনি এতো জোরে ধরেছে যে নাড়াতেই পারছি না। আমি শান্তভাবে বললাম,
“না বলতে হবে কেন? ঐশী আপুর সাথে আমার যেদিন প্রথম দেখা হয় সেদিন আমি
ধারণা করেছিলাম উনার কথা শুনে কিন্তু কালকে হাসপাতালে স্পষ্ট ওনার চোখে আমি আপনার জন্য ভালোবাসা দেখেছি। এটা বলতে হয় না একটা মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়ের মনের কথা বুঝা কঠিন কিছু না।আমি জানি আপনি ঐশী আপুর সাথে ভালো থাকবেন। ”

শান এবার আমার দুই বাহু ধরে আমাকে ঝাকিয়ে বললো,
“কে বলেছে তোমাকে আমার জন্য এতো ভাবতে। আমি কিসে ভালো থাকব কিসে খারাপ থাকব সেটা আমি বুঝব। একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো ঐশী আমাকে ভালোবাসলেও আমি ওকে ভালোবাসি না সেটা ঐশীও খুব ভালো করে জানে।সবার মনের কথা না বলতেই বুঝে যাও শুধু আমার মনের কথাটাই বুঝতে পারোনা তাই না। ”

কথাটা বলেই উনি পাশে থাকা ল্যাম্প লাইটা টেবিল সহ এক লাথি মেরে ফেলে দিলেন।আমি চোখ মুখ খিঁচে আমার কান চেপে ধরলাম। আমার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে।উনাকে কখনো এমন আচরণ করতে দেখিনি। উনার এমন হিংস্র রূপ এই প্রথম দেখলাম আমি।ভয়ে আমার চোখ গুলো বড় বড় হয়ে গেছে। আমি ক্ষীণ কন্ঠে বললাম,

“মা শুনতে পেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। প্লিজ এমনটা করবেন না। ”

কথাটা বলতেই উনি আমার দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন আমি দুই পা পিছাতে গিয়ে পা স্লিপ করে পড়ে যেতে নেবো তখনই উনি আমার হাত ধরে ফেললেন। হাত ধরে টেন আবার আগের জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। চিৎকার করে বললেন,

“কেন মা শুনলে কি হবে? ডিভোর্সের পর কি সবাই জানবে না। তাহলে সেটা এখন জানলে কি হবে? ”

উনার চিৎকার শুনে আমি আমার চোখ বন্ধ করে নিলাম। উনি আবারও ধমক দিয়ে বললেন,
“কি হলো চোখ বন্ধ করে আছে কেন? কথা বলো। উত্তর দেও আমার প্রশ্নের। ”

উনার ধমকে আমার এতক্ষনের সাহস সব পানি পানি হয়ে গেলো। বুক ফেঁটে কান্না আসছে। আমি তো উনার ভালোর জন্যই বলেছিলাম। তারপরেই আমার সাথে কেন উনি সবসময় এমন ব্যবহার করেন। আমি অশ্রুমাখা চোখে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আপনিতো বিয়ের রাতে বলেছিলেন আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে। আর ঐশী আপুকে দেখে মনে হলো উনিই আপনার সেই প্রেমিকা। তাই ভাবলাম…….।”

আমি পুরো কথা শেষ করার আগেই উনি রাগান্বিত হয়ে বললেন,
“কিছু ভাবনি তুমি। ভাবলে এমন কথা কিছুতেই বলতে পারতে না। তোমার সাথে যেদিন থেকে বিয়ে হয়েছে ঐদিন থেকেই আমার লাইফ থেকে আমি সবাইকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি বুঝেছো তুমি। ভেবো না তেমার জন্য শুধু মাত্র আমার বাবা মায়ের কথা ভেবে। ডিভোর্স তো তোমাকে আমি কিছুতেই দিবোনা।এই একটা ডিভোর্স আমাদের দুই পরিবারকে ভেঙে চুরমার করে দেবে সেটা আমি কিছুতেই হতে দেবো না।সো তোমার এই ডিভোর্সের স্বপ্ন সারাজীবন স্বপ্নই থেকে যাবে। তুমি চাইলেও আমার সাথে থাকতে হবে আর না চাইলেও। তাতে তোমার যা খুশি করতে পারো আই ডোন্ট কেয়ার। ”

ওনার কথা শুনে আমার অনেক খারাপ লাগলো। আমি পুরো শকড হয়ে গেলাম।আমি তো এক পলকের জন্য ভেবেছিলাম হয়তো আমার জন্য বাট উনিতো আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েই দিল ওনার লাইফে আমার কোনো ইমপরটেন্স নেই। আমি রেগে বললাম,
“আপনি কেয়ার না করলেও আমি করি।খুব তাড়াতাড়ি আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে চলে যাবো তই আমার ডিভোর্স চাই। ”
কথাটা শেষ করতে না করতেই শান আমার চুলের মুঠি ধরে আমার মুখটা একদম উনার মুখের কাছে নিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেঁপে বললেন,
“শুধু এই বাড়ি থেকে এক পা বেরিয়ে দেখো সাহস থাকে তো। আরিয়ান আরেফিন শানকে তুমি চেনো না। আমি য। বলি তা করি। হয় তুমি থাকবে নাহয় আমি মাইন্ড ইট। ”

কথাটা বলেই উনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে বেডে ফেলে হনহনিয়ে বাহিরে বেরিয়ে গেলেন। উনি যাওয়ার পর এতক্ষনে আমার জমে থাকা কান্নাটা ঝর্ণাধারার মতো বইতে লাগলো। আমি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। ঘুটিঘুটি পায়ে ড্রেসিংটেবিলের দিকে চলে গেলাম। গলা থেকে ওড়নাটা সরিয়ে দেখলাম তখনের জায়গাটায় অনেক খানি ছড়ে গেছে।দুই হাতের বাহুও ব্যাথা হয়ে আছে। সব শক্তি শুধু আবার উপরেই দেখায়। বাহিরে একদম ভালল মানুষ ভাজা মাছ ও উল্টে খেতে জানে না আর ভিতরে ভিতরে এক নম্বরের শয়তান। অভদ্র লোক মনুষ্যত্ব বলতে কিছু নেই।

হঠাৎ পেছন থেকে কেউ এসে হাত ধরে টান দিতেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম।কিন্তু যখনই তাকে দেখলাম অবাক হলাম,
“ওমা ইনি এখানে কি করে এইমাত্র না চলে গেছিল। ”

আমি তাড়াতাড়ি আমার ওড়নাটা ঠিক করে গায়ে পড়ে নিলাম। শান আমার হাত ধরে ড্রিসিংটেবিলের সামনে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। আমি ধরা গলায় বললাম,
“কি হয়েছে। আবার কি করলাম। ”
“ওড়নাটা সরাও। ”
উনার কথা শুনে আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
“ওড়না সরাবো মানে? কি বলেন এসব। ”
আমি আবারও আমার ওড়না ঠিক করতে লাগলাম। উনি রেগে বললো,
“বাংলাতেই তো বললাম। সোজা কথা বুঝো না ওড়না সরাও। গলায় মলমটা লাগিয়ে দেই নাহলে দাগ পড়ে যাবে। ”
আমি ইতস্তত করে বললাম,
“লাগবে না। আমাকে দিন আমি লাগিয়ে নেবো। ”
শান আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো,
“আমি বলেছি যখন আমি লাগাবো তাহলে আমিই লাগাবো। ”

কথাটা বলেই উনি আমার গলার কাছ থেকে একটু করে ওড়নাটা নামিয়ে মলম লাগিয়ে দিচ্ছিলেন। ওনার স্পর্শে আমি বারবার কেঁপে উঠছিলাম। মলম লাগানো শেষে শান আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি আমাদের সম্পর্কে কোনো ভালোবাসা দেখো না তাই তো। আজ থেকে ভালোবাসা কাকে বলে সেটা তুমি দেখবে।”

উনি আমাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত গোল গোল চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে চলে গেল।উনার কথার অর্থ না বুঝে আমি হা করে রইলাম ভালোবাসা দেখাবে মানে?



দুইদিন পর ঐশীকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিলো। কিন্তু প্রপার বেড রেস্টে থাকতে হবে। তিমির, ঐশীর বাবা আর শান এসেছে ঐশীকে নিতে। যদিও তিমির বলেছিল ঐশীর থেকে দূরে থাকবে। কিন্তু দূরে থাকব বললেই তো থাকা যায় না। তিমির অস্বীকার করলেও যে ঐশীর জন্য ওর মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত টান তৈরী হয়েছে সেটা ও খুব ভালো করে বুঝতে পারছে। তাই যতটুকু পারছে ঐশীর আশেপাশে থাকছে। সুখের সময় না হোক অন্তত দুঃখের সময় তো ওর পাশে থাকতে পারবে সেটাই ওর শান্তি।

ঐশীকে ওরা সবাই বাড়িতে নিয়ে আসল। ঐশীর জন্য বাড়িতে নার্স সহ সব রকম সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ঐশীর বাবা। ঐশীর মাথায় হাত বুলিয়ে ঐশীর পাশ থেকে ঐশীর বাবা উঠে বললো,

“ওকে ঐশী তাহলে থাকো। আশা করি তোমার কোনো সমস্যা হবে না। আমাকে বিজন্যাসের জন্য জরুরী একটা কাজে দেশের বাহিরে যেতে হবে। তোমার কোনো প্রবলেম হলে শান আর তিমিরকে জানিও। ”
ঐশী ওর বাবার কথা শুনে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিলো,
“তুমি যেতে পারো বাবা। শুধু শুধু নিজের দায়িত্বটা অন্য কারো ঘাড়ে চাপানোর দরকার নেই। ছোটবেলা থেকে নিজেরটা নিজে করে নিয়েছি এখনও পারবো। ”

“এভাবে বলছো কেন ঐশী? তোমার জন্যই তো এতো কিছু করছি। ”

ঐশীর চোখে পানি ছলছল করছে,
“থাক বাবা যথেষ্ঠ করেছো তুমি আমার জন্য। আমাকে তুমি কখনো বুঝবে না। তুমি তোমার কাজে যাও। ”

তিমির বুঝলনা ঐশী কেন ওর বাবার সাথে এভাবে কথা বলছে কিন্তু শান খুব ভালো করে জানে ঐশীর সাথে ওর বাবার সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। তাই শান পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বললো,
“আচ্ছা আঙ্কেল আপনি যান আপনার ফ্লাইটের টাইম হয়ে যাচ্ছে ঐশীর খেয়াল আমরা রাখব। ”

ঐশীর বাবা শানের কথায় আশ্বস্থ হলো। ঐশীর দিকে একবার তাকালো কিন্তু ঐশী ওর বাবার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। ওর বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলেন আর ঐশীর চোখ থেকে নিরবে একফোঁটা চোখের জল বয়ে গেল।

ঐশীর বাবা যেতেই শান ঐশীর পাশে বসল,
“সকালে মেডিসিন নিয়েছিলে?”
ঐশী মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম। ”
“আচ্ছা আমাকে একটু অফিসে যেতে হবে তিমির তোমার খেয়াল রাখবে। যতদিন ফুল সুস্থ না হচ্ছো ততদিন বাসায় থাকবে। আর ঠিক মতো মেডিসিন গুলো নিবে। আমি যেন কোনো অনিয়ম না শুনি। ”
ঐশী মন খারাে করে বললো,
“একা বাসায় থেকে কি করব। আর ঐদিকে অর্ডারের কাজটাও শুরু করতে হবে। আমি না গেলে কিভাবে হবে। ”
“কিছু হবে না আমি আর তিমির সব সামলে নিবো টেনশন নিয়ো না। আর তুমি একা না তিমির থাকবে তোমার সাথে ওকে। ”
ঐশী মুখে কিছু না বলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
শনা ঐশীর দিকে তাকিয়ে হাসলো সাথে ঐশীও। শান তিমিরকে ঐশীর সাথে রেখে ওর খেয়াল রাখতে বলে ওদের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো ওদের বাড়ি থেকে।



রাতে আমরা সবাই খেতে বসেছি। টেবিলটা পুরা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বাবা ঐ যে গেছে এখনো আসেনি। বাবা থাকলে খেতে বসলেই পুরো আড্ডা জমিয়ে দিতো বাট এখন সবাই চুপচাপ খাচ্ছে। যদিও মা আমার সাথে টুকটাক কথা বলছে বাট খারুচটা নিজের মনে খেয়েই যাচ্ছে। আমি সবাইকে সার্ভ করে দিয়ে বসে রইলাম।তখনই মা বললো,

“কিরে বসে আছিস কেন? রাত হয়ে যাচ্ছে খেয়ে নে। ”

শান এখনও নিচের দিকে তাকিয়ে খাচ্ছে। আমি উনার দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে বললাম,
“না মা আজকে তোমার ছেলে আমাকে অনেক কিছু খাইয়েছে তাই এখন আমার আর খুদা নেই খাবো না আজকে। ”

কথাটা বলতেই শান খাওয়া রেখে আমার দিকে তাকালো। উনি আমার দিকে তাকাতেই আমি উনাকে মুখ ভেঙালাম। তখনই মা বললো,
“কিরে শান মেয়েটাকে কি সব ছাইপাশ খাইয়েছিস এখন ভাত খেতে চাইছে ন। এরোকম করলে তো মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পরবে। এমনিতেই খাওয়ার যে অনিয়ম।কোনো কথা শুনিস না তোরা আমার। ”

মা শানকে বকতে বকতে খাওয়া শেষ করে উঠে চলে গেলেন।উনার একটু তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হয়।তবে শানকে বকা খেতে দেখে আমি মনে মনে অনেক শান্তি পেলাম। মা যেতেই শান আমার দিকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে। বিপদ বুঝে আমি একটু হাসি হাসি মুখ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তখনই শান আমার হাত ধরে চোখের ইশারায় বললো বসতে। আমি আর উপায় না পেয়ে বসে পড়লাম।

শান গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠল,
“খুশি হয়েছো আমাকে বকা খাইয়ে। শোধ নিয়ে নিয়েছো তখনের এভার খেয়ে নেও। ”
আমি মুখ ভেঙিয়ে বললাম,
“নিজে খেয়েছেন এইবার নিজের কাজ করেন আমি খাবো না আজকে। ”
শান আমাকে ধমক দিয়ে বললো,
“খাও বলছি তাড়াতাড়ি। ”

ওনার হঠাৎ ধমক দেওয়ায় আমি ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠলাম। অভদ্র লোক আবার ধমক দেওয়া শুরু করেছে। আমি ঠোঁট উল্টালাম । আর মনে মনে ভেবেই নিলাম উনার কথা শুনবো না।

শান আমাকে এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বললো,
“শুনবে না তো কথা আমি জানি তো তুমি কখনো সোজা কথা বুঝতেই পারো না। ওকে চলো তোমার খাবার খেতে হবে না। আজকে আমি তোমাকে ভালোবাসা খাইয়ে পেট ভরাবো চলো। ”

উনার কথা শুনে আমি থতমত খেয়ে গেলাম ভালোবাসা খাবে মানে সেটা আবার কি জিনিস? কথাটা বলেই উনি চেয়ার থেকে উঠে আমার দিকে উঠে আসছিলেন।উনার এগিয়ে আসা দেখে আমি ভয় পেয় গেলাম আর চিৎকার করে তুতলিয়ে বললাম,
“আমি আমি ওসব বাজে জিনিস খাই না পেট খারাপ করবে তার থেকে খাবারই ঠিক আছে। ”

কথাটা বলেই আমি দ্রুত টেবিল থেকে খাবার নিয়ে গপাগপ মুখে পুরতে লাগলাম। সোহার অবস্থা দেখে শান একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে হাঁসতে হাঁসতে খাবারের রুম থেকে বেরিয়ে গেল।



দেখতে দেখতে ঐ ঘটনার পর এক সপ্তাহ কেঁটে গেছে।তবে এই এক সপ্তাহে ঐশীর টপিকটা আমাদের মধ্যে থেকে সরে আবার শান আর আমার মধ্যে আগের মতো খুনশুটিটা ফিরে এসেছে। সকালে সবাইকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে দিলাম। কিছুক্ষন পরেই শান বেরিয়ে যাবে অফিসের জন্য তখনই আমি দৌড়ে শানকে পিছনে ডাকলাম। আমার ডাক শুনে শান পিছনে ফিরে তাকালো,

“ডাকছো কেন? ”

আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম,
“উফ আপনার জন্য একটা জিনিস বানিয়ে ছিলাম সেটা দিতেই ভুলে গেছি তাই ডেকেছি। ”

শান অবাক হয়ে বললো,
“আমার জন্য বানিয়েছো?”
আমহ মাথা নেড়ে বললাম,
“হুম। ”
শান খুশি হয়ে বললো,
“কি দেখি দেও। ”
আমি মুচকি হেসে উনার হাতে রুমালটা তুলে দিলাম,
“নিন এটা আমি স্পেশালি আপনার জন্য নিজের হাতে নিজের ওড়না দিয়ে বানিয়েছি। কেমন হয়েছে বলুন তো। ”

শান রুমালটার দিকে তাকালো। অনেক সুন্দর করে রুমালের উপর নকশা করে শানের নাম লিখে দিয়েছে। এই প্রথম সোহা শানকে কিছু দিলো। শানের এতো ভালো লাগছে যে বলার বাহিরে। শান সোহার গাল টেনে বললো,
“তুমি দিয়েছো আর আমার ভালো লাগবে না সেটা হয় নাকি অনেক ভালো হয়েছে ধন্যবাদ। তবে এটা কালো কেন? ”
“কারণ কালো আমার প্রিয় রং। যাইহোক রুমালটা ব্যবহার করবেন কিন্তু। ”
“ওকে ডিয়ার। এখন আসি। ”

কথাটা বলেই শান চলে গেল। শান যেতেই আমি খুশিতে দুই তিনটা লাফ দিয়ে নিলাম। একবার শুধু রুমালটা ইউজ করো চান্দু এরপর বুঝবে মজা।
.
.
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে