এক শহর ভালোবাসা পর্ব-১৬

0
3073

#এক_শহর_ভালোবাসা
#পর্ব_১৬
#সুরাইয়া_নাজিফা

শোনো প্রিয়তমা তোমার ওই কাজল কালো ভেজা চোখে আমি ডুবে যেতে চাই
তোমার রাঙা ঠোঁটের এক চিলতে হাসিতে আমি নিজেকে খুঁজে পাই
তোমার ঘন কালো এলোমেলো কেশে মন চায় হারিয়ে যাই, মাতাল হয়ে যাই তোমার ওই রেশমি চুলের সুগন্ধে
তোমার মাঝে মিশে যেতে চাই ঠিক ততটা যতটা মিশলে কেউ আমাদের পৃথক করতে পারবেনা

আমার বেখেয়ালি, তোমার মনে হয় আমি পাগল।তবে শোনো হুম আমি পাগল,কাউকে কোনো স্বার্থ ছাড়া পাগলের মতো ভালোবাসি বলে আমি পাগল, তোমার প্রেমেতে পাগল,তোমার জন্য পাগল, তোমার সাথে সময় কাটাতে পাগল, তোমার কোলে মাথা রেখে দুজনে একসাথে জোসনাবিলাস করতে পাগল, একসাথে হাতে হাত রেখে কোনো এক খোলা মাঠে প্রেম করতে পাগল, বৃষ্টির দিনে তোমার সাথে বৃষ্টিবিলাসে পাগল,কোনো এক ছুটির দিনে ধোয়া উঠা কফি নিয়ে তুমি আমার কাঁধে মাথা দিয়ে আমি তোমার ওই মুখপানে চেয়ে সময়টা পার করতে পাগল, জীবনের প্রতিটাক্ষন তোমার সাথে কাঁটাতে পাগল,কারণ আমি তোমার পাগল প্রেমিক। তোমাকে এতটাই ভালোবাসি যে তুমি কখনো সেটা পরিমাপই করতে পারবেনা।

তুমি যদি কখনো জানতে চাও তোমাকে এতো ভালোবাসার কারণ? আমি কখনোই বলতে পারবো না। শুধু এটুকুই বলতে পারি তোমাকে ভালোবাসার জন্যই হয়তো আমি পৃথিবীতে এসেছি। আমি জানি তোমাকেই আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। নিজের থেকেও বেশী। যতোটা ভালোবাসলে কারো জন্য নিজের জীবনটা উৎসর্গ করা যায়।

তুমি কি কখনো বুঝবে আমার মনের কথা হৃদয়েশ্বরী।
এই মনে তোমার জন্য ছোট্ট একটা শহর গড়েছি যেখানে শুধু তোমার বসবাস।
সেখানে এক শহর ভালোবাসা শুধুই তোমার জন্য।

আমার মনের শহরে নিমন্ত্রণ রইল তোমার মেঘপরী ।তুমি জানোই না সেখানে তোমার জন্য কতো প্রেম জমে আছে তোমায় দেবো বলে কখনো এসো এক শহর ভালোবাসা তুলে দেবো তোমায় যেই ভালোবাসা কখনো শেষ হবে না। তোমায় ভালোবাসার চাঁদরে মুড়ে রাখব। এতো ভালোবাসবো যে তুমি নিজেকেই ভুলে যাবে। একদম যত্ন করে লুকিয়ে রাখব আমার বুকের ভিতরে।

আচ্ছা কখনো কি তুমি আসবে আমার মনের শহরে!
আমাকে ছুয়ে, শুধু আমার জন্য, শুধু আমায় ভালোবেসে।

এই কয়েকটা লাইনের মাঝে আমি যেন হারিয়ে ছিলাম এতক্ষন। এই রাগি,রুড মানুষটার মনে কারো জন্য এতটা ভালোবাসা জমা রয়েছে এই চিরকুটটা হাতে না পড়লে হয়তো কখনো জানতেই পারতাম না। কোথাও শুনেছিলাম রাগি মানুষরাই পৃথিবীতে সবথেকে বেশী ভালোবাসতে পারে। তাদের শুধু বাহিরটাই শক্ত আবরণ কিন্তু ভিতরটা মাটির চেয়েও নরম। শানকে দেখে এখন সেটা খুব ভালো করে বুঝতে পারছি।সবসময় নাকের ডগায় রাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কখনো বুঝতেই দেয় না যে সেও কাউকে এতোটা পাগলের মতো ভালোবাসতে পারে।

“কাউকে না বলে কারো পার্সোনাল জিনিসে হাত দেওয়া ব্যাড মেনার্স জানো না সেটা? ”

হঠাৎ একটা পুরুষালি কণ্ঠস্বর শুনে আমার হাত থেকে চিরকুটটা পড়ে গেল। কারণ কন্ঠোটা আমি খুব ভালো করেই চিনি।শান চলে এসেছে সর্বনাশ! আমি হুড়মুড়িয়ে পিছনে ঘুড়ে তাকালাম। শান আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার বুক কাঁপছে কি না কি বলে আল্লাহ জানে। শান আমার সামনে এসে একটু ঝুকে চিরকুটা হাতে তুলে নিলো। নিজে কিছুক্ষন চিরকুটটার দিকে তাকিয়ে মাথা উপরে তুলে আমার দিকে তাকালো,

শান গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“এই শাড়ী আর চিরকুটটা কোথায় পেয়েছো তুমি?”
আমি মাথা নিচু করে বললাম,
“আলমারিতে।”
“এটা তো আমার জামা কাপড়ের মধ্যে ছিল কেন বের করেছো?”

আমি এবার গলা উঁচিয়ে বলে উঠলাম,
“আমি ইচ্ছা করে বের করিনি।আমি শাড়ী পড়ব ভেবেছিলাম কিন্তু এখানের একটা শাড়ীও পছন্দ হচ্ছিলো না। খুঁজতে খুজতে দেখলাম আপনার জামা কাপড়ের মধ্যে একটা শাড়ী। শাড়ীটা ভালো লাগলো ভাবলাম পড়ব। শাড়ীটা বের করতেই সাথে এটাও পড়ল। ”

“কাজটা একদমই ভালো করোনি। পরে গেছে ভালো কথা তুলে রাখতে পড়ার দরকার কি ছিলো?”

আমি এবার উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
“পড়ব না মানে। এমন একটা হৃদয় নিংড়ানো অনুভুতি মানুষ না পড়ে কি করে থাকবে। না পড়লে তো জানতেই পারতাম না আজকাল বিজন্যাস ছেড়ে আপনি সাহিত্যিক হয়ে গেছেন। ”

শান আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“অন্তরের অন্তস্থল থেকে নিজের একান্ত আপন কিছু অনুভুতি লিখলেই কেউ সাহিত্যিক হয়ে যায় না। ”

“তাও ঠিক। তারপরেও আমি তো আপনার এই দুইলাইন লেখারই প্রেমের পড়ে গেছি। যাইহোক তা মনের মাঝে এতো অনুভুতি কার জন্য রেখেছেন শুনি?”

শান আমার দিকে তাকিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে খানিকটা হাসল,
“ছাড়ো তার কথা। বলে লাভ নেই কারণ সে কখনোই বুঝবে না আমার অনুভুতিগুলো। সে বুঝলে তো আমার কপালে চাঁদ উঠতো।”

আমি তারপরও বায়না করে বললাম,
“বলেনই না একটু শুনি। হয়তো তাকে দেখার ভাগ্য আর কখনো আমার নাও হতে পারে। ”
“হবে অপেক্ষা করো সময় হলে ঠিকই দেখতে পাবে। ”

আমি বুঝলাম আর খুঁচিয়ে লাভ নেই এই ব্যাটার পেটে বোম মারলেও কিছু বের হবে না। উনি চলে যাচ্ছিলেন তখনই উনার পিছু ডেকে আমি বললাম,

“আচ্ছা এই শাড়ীটাও কি ওই মেয়েটার জন্য কিনেছেন?”
শান আমার দিকে ফিরে বললো,
“কেনো?”
আমি মিনমিনিয়ে বললাম,
“না আসলে শাড়ীটা আমার অনেক পছন্দ হয়েছে তো তাই আমি পড়তাম বাট এটা যদি আপনি অন্য কারো জন্য কিনে থাকেন তাহলে থাক। ”
শান মাথা নেড়ে বললো,
” সমস্যা নেই তুমি পড়ো। ”

কথাটা বলেই উনি চলে গেলেন ফ্রেস হতে।উনার পারমিশন পেয়ে মনটা খুশি হয়ে গেল। এই শাড়ীটা এতো সুন্দর যে সত্যিই আমি পড়তে চাইছিলাম। উনি রুমে নেই এই ফাঁকে আমি জামাটা চেন্জ করে শাড়ীটা দ্রুত পড়ে নিলাম। শাড়ীটা পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। বাবা অনেক সুন্দর লাগছে তো শাড়ীটাতে। আমি বুঝতে পারলাম না শাড়ীটা বেশী সুন্দর না আমি। বাহ পছন্দ আছে বলতে হবে উনার। নাহলে কখনো কাউকে এতো পারফেক্ট লাগে।

শান ফ্রেস হয়ে এসে শাড়ীটা পড়ে সোহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল। শাড়ীটা পড়ে সোহাকে যেভাবে কল্পনা করেছিলো তার থেকেও বেশী সুন্দর লাগছে। শাড়ীটা কেনার সময়ও ভাবেনি শাড়ীটাতে এই পিচ্ছি মেয়েকে এতটা বড় বড় লাগবে। শান নিজের বুকের বাম পাশে হাত দিলো কত জোরে জোরে বিট করছে। শুধু একটা মানুষকে পাওয়ার জন্য কত বছর ধরে বুকটা খা খা করে আছে। শান নিজের চোখ সরিয়ে নিলো না জানি কখন ওরই নজর লেগে যায় ওর মায়াপরীর উপর।

“নিজেকে নিজে এতো দেখলে হবে অন্যকাউকেও দেখার সুযোগ দেও? ”

শানের বলা কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। ইশ,কি লজ্জা উনি খেয়াল করেছেন। আমার এই পাগলামি জীবনেও গেল না। আমি আমতা আমতা করে বললাম,
“দেখাবো মানে?”

শান আমার কাছে এসে বললে,
“মানে আয়না।”
আমি উনার কথা বুঝতে না পেরে বললাম,
“আয়না কে?”

উনি নিজের কপালে হাত দিয়ে বললো,
“আল্লাহ তুমি এতো কম বুঝো কেন? বললাম সেই কখন থেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে দেখে যাচ্ছো। অন্য কাউকেও আয়নাটা দেখার সুযোগ দেও অদ্ভুত। ”

উনার কথা শুনে আমি নিজের জিভ কেটে তাড়াতাড়ি পাশ কেঁটে চলে গেলাম। ঢের হয়েছে আমার। উফ এবাবে লজ্জা দিয়ে দিলো। ঠোঁট এতো পাতলা কেন লোকটার কে জানে?নিজেকে ভালো লাগছে বলেই তো দেখছি অন্যকাউকেও তো আর দেখিনি । জানেনা মেয়েরা নিজেদের সুন্দর দেখতে বেশী পছন্দ করে তারপরেও এই কথাটা বলা কি খুব দরকার ছিলো।



কিছুক্ষন পর আমরা বেরোবো হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।আমি আর শান বসে আছি ব্রেকফাস্ট করার জন্য। উনি কালকে রাত থেকে না খেয়ে আছে তাই আজকে উনাকে ছাই পাস না দিয়ে ভাত দিয়ে দিলাম।

উনি দেখেই নাক সিটকে বললো,
“সকাল সকাল ভাত দিয়েছো কেন?”
“কালকে থেকে না খেয়ে আছেন এখন কোনো বাহানা না করে খেয়ে নিন। ”
“তুমি তো জানোই আমি সকালে ভাত খাই না তুলে রাখো। ”
আমি রেগে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আপনি যখন বলেন আপনার সব কথা আমি শুনি তাহলে আপনাকেও শুনতে হবে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন নাহলে বাড়ি থেকে এক পাও বের হতে দিবো না। ”

শান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
” বাবা এতো বড় থ্রেট। কি আর করা যাবে এতো মিষ্টি মেয়েটা এতোটা রেগে শ্রীমতী ভয়ংকরী রূপ নিয়ে যখন বলছে তখন তো কথাটা শুনতেই হবে।আমার ঘাড়ে কটা মাথা যে শুনবো না। ”

উনার কথা শুনে আমি হেসে দিলাম। সাথে শানও হাসল।
“আচ্ছা মা কই? ”
“মা রুমে আছেন। আমি খাবার উপরে পাঠিয়ে দিছি অসুস্থ লাগছে নাকি।”
শান উতলা হয়ে বললো,
“কি হয়েছে মায়ের? ”
“হয়তো পেশার বেড়ে গেছে। আমি ভাবছি আজকে তো হাসপাতালে যাবো সেখানে নাহয় মাকেও দেখিয়ে নেবো কি বলেন। ”
“হুম।মাকেও রেডি হতে বলো। ”
“বলেছি আমি। আচ্ছা ঐশী আপু এখন কেমন আছে? ”
“ভাল আছে এখন। শুধু সারা শরীরে চোট পেয়েছে এজন্য ঠিক হতে কিছু দিন সময় লাগবে। ”
“আল্লাহ রহমতে ভালো থাকলেই ভালো।আমার অনেক চিন্তা হচ্ছিল রাত থেকে। ”

শান খাওয়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তাই বুঝি শুধু কি ঐশীর জন্যই টেনশন হচ্ছিল নাকি লিস্টে আমিও আছি? ”

আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম,
“আপনি থাকবেন কেন? আপনারও কিছু হয়েছিল নাকি?”

“একদম না জানার ভান করো না কালকে যখন আনি হাসপাতালে আছি বলেছি তখন তোমার কন্ঠে স্পষ্ট আমার জন্য চিন্তা,অস্থিরতা ফুটে উঠেছিল সেটা তোমার কথা শুনেই বুঝেছি।”

আমি উনার কথা শুনে বিষম খেয়ে গেলাম।শান আমার দিকে পানিটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“রিলেক্স বেবী এতো তাড়াতাড়ি বিষম খেলে হবে। এখনো তো কিছু বললামই না। ”

উনার কথাটা শুনে আমি চোখ বড় বড় করে নিজের সামনের চুল কানের পিছনে গুজে বললাম,
“কি বলবেন আপনি? একটা মানুষ যে কখনো এতো রাত অব্দি বাড়ির বাহিরে থাকেনা সে কালকে রাতে বাড়ি ফিরল না তার জন্য মানুষ হিসেবে চিন্তা হওয়াটা তো ভুল কিছু না। একসাথে থাকি যখন চিন্তা হতেই পারে। ”

“হুম। কিন্তু আমাদের চিন্তাটা তখন হয় যখন সে আমাদের বন্ধু হয় অথবা খুব আপন কেউ। কিন্তু আমি যতটুকু জানি তুমি তো আমাকে শত্রু ভাবো। তাহলে সেই শত্রুর জন্য নিজের ঘুম নষ্ট করে কেন বসে বসে চিন্তা করছিলে তার জন্য। মিস করছিলে বুঝি?”

আমি উনার দিকে তাকিয়ে থাকলাম নির্লিপ্তি দৃষ্টিতে আর উনি আমার দিকে মিষ্টি হেসে তাকিয়ে রইল। আমি অন্যমনষ্ক হয়েই বলে দিলাম,
“আপনি আমার স্বামী। আপনাকে মিস করব না তো কাকে করব। ”

কথাটা আস্তে বললেও শান কিছুটা শুনতে পেল শুনেই শান আশ্চর্য হলো,
“কি বললে? ”

হঠাৎ শান এভাবে চিৎকার করে উঠতেই আমি সম্ভিত ফিরে পেলাম সর্বনাশ এটা কি বলে দিলাম। উফ এখন উনি কি ভাববে। আমি তাড়াতাড়ি কথা এড়ানোর জন্য বললাম,

“আপনাকে মিস করতে আমার বয়েই গেছে। জাস্ট মা আপনার কথা জিজ্ঞেস করলে যাতে আমার কাছে বলার মতো কথা থাকে তাই জেগে ছিলাম নাথিং ইলস। এসব কথা বাদ দিয়ে চলুন লেইট হচ্ছে আমাদের। ”

কথাটা বলেই আমি দ্রুত ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। সোহা যেতেই শান হো হো করে হেসে উঠল। মেয়েটা এতোটা ফিল করে আমার জন্য তাও মুখ ফুটে বলবে না। ওকে আমিও দেখি কতদিন না বলে থাকো। মুখ তো তুমি খুলবে সেটা আজ হোক বা কাল।



হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে ঐশী। শরীরে প্রায় বিভিন্ন জায়গায় ব্যাথার কারণে নড়তেও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তারওপর এই বান্ডেজ গুলো তো আছেই।মাথাটাও কেমন ভার ভার লাগছে। ডাক্তার কড়া ঘুমের মেডিসিন দিয়েছিল তাই হয়তো। ঐশী একবার চারদিকে চোখ বুলালো ও হাসপাতালে কেন? কে নিয়ে এসেছে? জীবনের ওপর থেকে তো মায়া ছেড়েই দিয়েছিলাম তারপরও কেন বেঁচে গেলাম।

“ঘুম ভেঙে গেছে? এখন কেমন আছো? ”

ঐশী চোখ খুলে সামনে তাকাতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো তিমিরকে দেখে ,
“আরে আপনি এখানে?তাহলে কি আপনি কালকে আমাকে বাঁচিয়েছিলেন? ”

তিমির বেডের পাশে টুলটা টেনে সেখানে বসে বললো,
“বাঁচানোর মালিক তো আল্লাহ আমি তো আপনাকে জাস্ট হাসপাতাল পর্যন্ত এনেছিলাম। কেন আশা করেন নি। ”

ঐশী থমথমে গলায় বললো,
“সত্যি বলতে না।”
তিমির হাসল,
” না করাই স্বাভাবিক আপনার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে যা যা হয়েছে তাতে বিশ্বাস করার কথাও নয় যে আমি আপনাকে হাসপাতাল পর্যন্ত এনেছি। তবে বিশ্বাস নাহলেও এটাই সত্যি। ”

ঐশী তিমিরের দিকে কিছুক্ষন তাকালো। ছেলেটার চোখ মুখ কেমন কালো কালো লাগছে। চুলগুলো এলো মেলো হয়ে গেছে। দেখে মনে হয় সারারাত ঘুমায়নি। ঐশীর খারাপ লাগলো তিমিরকে দেখে হয়তো ওর জন্যই ছেলেটার এই অবস্থা। ঐশী অপরাধীর মতো বললো,

“দুঃখিত আমার জন্য আপনাকে এতো কষ্ট করতে হলো।”
তিমির অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বললো,
“কিসের কষ্ট? ”

ঐশী স্বাভাবিকভাবেই বললো,
“আপনাকে দেখেই মনে হচ্ছে কাল সারারাত ঘুমাননি হয়তো হাসপাতালেই ছিলেন এতটা কষ্ট না করলেও হতো।দুদিনের পরিচিত একটা মেয়ের জন্য এতটা না করলেও হতো। তারপরও করেছেন যেহেতু আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ। ”

তিমির হেসে বললো,
“না এতে কষ্টের কিছু নেই। আমি একা ছিলাম না সাথে শানও ছিল। ”

শানের কথা শুনে ঐশীর চোখ খুশিতে ছলছল করে উঠল। ব্যাথা শরীর নিয়েই খানিকটা উঠে বসে বললো,
“শান এসেছিল? কোথায় ও? এখনো আছে? ”

তিমির ঐশীর শানের জন্য এতো অস্থিরতা দেখে একটু অবাক হলো তারপরও নিজের কৌতুহল চেপে রেখে বললো,
“আরে আপনি উঠছেন কেন। শুয়ে পড়ুন। শান এখন নেই। সারারাত ছিল কিছুক্ষন আগেই বাসায় গেছে। আবার আসবে ফ্রেস হয়ে। ”

ঐশীর এতোক্ষনের খুশিটা যে ধপ করে কমে গিয়ে মুখটা আবার গোমরা হয়ে গেল শান নেই শুনে সেটা বুঝতে তিমিরের খুব একটা কষ্ট হলো না। তিমির বললো,

“আপনি কালকে ড্রিংক করে গাড়ি চালাচ্ছিলেন কেন?কালকে কি হতে পারতো আপনার কোনো ধারণা আছে। ”
“কি হতো বেশী হলে মরে যেতাম তেমন তো কিছু হতো না। ”

কথাটা শুনে তিমিরের বুকে চিনচিন ব্যাথা করছিল তিমির রেগে বললো,
“আপনার মতো বিচক্ষণ একটা মানুষের কাছে এটা আশা করিনি। আপনার কথা শুনে তো মনে হয় আপনি কালকে ইচ্ছা করেই এক্সিডেন্টটা করিয়েছেন।”

তিমিরের কথা শুনে ঐশী একটু নড়েচড়ে বসল। কথা এড়িয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“পৃথিবীতে সবাই বাঁচতে চায়। আমিও চাই। আর কালকে আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন এজন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে বাঁচানোর জন্য। ”

“আপনার এই হেয়ালি কথার মানে বুঝলাম না। আপনি কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?”

ঐশী নিজের মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠল “আহ ” সাথে সাথে তিমির এগিয়ে গেল।ঐশীর মাথায় হাতনদিয়ে বিচলিত হয়ে বললো,

“কি হয়েছে আপনার? অসুস্থ লাগছে? ডাক্তার ডাকবো?”
ঐশী তিমিরকে মাথা নেড়ে বললো,
“লাগবে না। আমি শুধু একটু রেস্ট নিতে চাই।আপনি চাইলে এখন বাসায় যেতে পারেন। আমি ঠিক আছি। ”

তিমির একটু একটু করে ঐশীর দিক থেকে সরে গেল। ঐশীর এভাবে কথা বলাতে তিমিরের খুব খারাপ লাগলো।একটু ভালোভাবে কথা বললে কি এমন হতো ঐশীর। তিমির ঐশীর দিকে তাকালো চোখ বন্ধ করে আছে।তিমির বেশ বুঝতে পারছে ঐশী ওকে ইগনোর করছে। হয়তো ঐশীর প্রতি একটু বেশীই অধিকার দেখিয়ে ফেলছে তিমির তাই এতোটা ইগনোরেন্স পেতে হচ্ছে। এটা চিরন্তন সত্য আমরা যাকে বেশি ইমপরটেন্স দেই তারাই আমাদের সব থেকে বেশি ইগনোর করে। তাই তিমির ভাবল এখন থেকে ঐশীর থেকে দূরেই থাকবে।



কিছুক্ষন আগেই আমরা হাসপাতালে এসে পৌছালাম। মাকে চেকাপ করিয়ে আমরা ঐশীর কেবিনে যাবো তখনই সেখানে মায়ের পুরানো বান্ধবীর সাথে দেখা হয়ে গেল। সে কি গলায় গলায় ভাব। নিজের বান্ধবীকে পেয়ে মা তার সাথে চলে গেল। আমরাও ভাবলাম ভালোই হলো নাহলে ঐশীর সম্পর্কে মাকে অনেক কথা বলতে হতো। তার চেয়ে সে তার বান্ধবীর সাথে টাইম স্পেন্ড করুক আমরা নাহয় ততক্ষনে ঐশীর সাথে দেখা করে আসি তারপর বাসায় যাওয়ার সময় মাকে নিয়ে যাবো। সেই ভেবেই মাকে ওনার বান্ধবীর সাথে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আর শান চলে গেলাম ঐশীর কাছে।

ঐশীর কেবিনের সামনে এসে আমি আগে ডুকলাম। ঐশী বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে আর একজন নার্স ওকে ঔষুধ খাওয়াচ্ছে। আমি গিয়ে ঐশীর হাতে ফুলের বুকেটা তুলে দিলাম আর মুচকি হেসে বললাম,

“একটা নতুন সকালে নতুন জীবনের জন্য তোমাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা। কেমন আছো এখন? ”
ঐশী হেসে বললো,
“ধন্যবাদ। এইতো ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? ”
“আমিও ভালো আছি।

দুই রমণী বসে বসে খোশ গল্পে মেতে উঠেছে। দেখে মনে হবে কতদিনের পরিচয়। শান গালে হাত দিয়ে তাদের দেখে চলেছে শানের মনে পড়ে না ও কখন ওদের পরিচয় করিয়েছে। হঠাৎ শান বলে উঠল,

“আচ্ছা আমাকে একটা কথা বলো তোমরা দুজন দুজনকে চেনো কি করে?আমি তো পরিচয় করাইনি। ”

শানের কথা শুনে আমি আর ঐশী একে অপরের দিকে তাকালাম তারপরই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলাম শান ওদের হাসি দেখে বোকা হয়ে গেল।ঐশী নিজের হাসি থামিয়ে বললো,

“তোমাকেই কেন পরিচয় করিয়ে দিতে হবে আমরা কি পারিনা নিজেরা নিজেরা পরিচিত হয়ে নিতে। ”
“অবশ্যই পারো কিন্তু কিভাবে সেটা তো বলো?”
তখন আমি বললাম,
“উফ কালকে থেকে কি একটা টপিক নিয়ে পড়ে আছেন। ঐদিন যে আপনার অফিসে এলাম সেদিনই ঐশী আপু সাথে পরিচিত হয়েছে। ”
শান বললো,
“ওহ তাই বলো। ”

ঐশী বারবার শানের দিকে তাকাচ্ছে। ঐশী চাচ্ছে শান ওর সাথে একান্তে একটু কথা বলুক মন থেকে। শানকে বুঝতে পারছে না ঐশীর আজকে এই অবস্থা শুধু ওকে না পেয়ে। আসলে ভালোবাসা না পেলে কেমন কষ্ট হয় সেটা তো শান জানে না তাই হয়তো আমার অবস্থাটা বুখতে পারছে না। ঐশীর চোখ শানের দিকে তাকিয়ে ছলছল করে উঠল।

ঐশীর বারবার তাকানোটা আমার চোখ এড়ালো না। ঐশীর চোখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে শানের প্রতি আকুলতা। কি করবো বুঝতেছি না।তাহলে কি আমিই চলে আসলাম ওদের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে।

শানের দিক থেকে চোখ সরাতেই ঐশীর হঠাৎ চোখ পড়ল সোহার শাড়ির দিকে। ঐশী অবাক হলো। এই শাড়ীটা ঐশী নিজে পছন্দ করে শানকে কিনে দিয়েছিল। মাস ছয়েক আগে শান একদিন হুট করেই ঐশীকে শপিং মলে নিয়ে এলো,

“কি হলো শান হঠাৎ শপিং মলে? ”
“মেয়েদের চয়েজ তো আমি বুঝি না তুমি আমাকে একটা শাড়ী কিনে দেও একজনকে গিফট করবো।
ঐশী অবাক হয়ে বললো,
“স্পেশাল কেউ? কে সে?”
শান বণিতা করে বলেছিল,
“বলবো কোনো একসময় এখন সিক্রেট। ”

ঐশী মনে মনে খুশি হয়েছিল অনেক ভেবেছিল শাড়ীটা ওর জন্যই কিনছে। কিন্তু আজ বুঝতে পারছে সেই শাড়ীটার মালকিন আসলে কে ছিল।

ঐশী সোহার দিকে তাকিয়ে বললো,
“অনেক সুন্দর লাগছে তোমাকে শাড়ীটাতে? ”
আমি খুশি হয়ে বললাম,
“ধন্যবাদ আপু। ”
“ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। ঠিক মানুষের হাতে ঠিক জিনিসটা পৌছেছে দেখে ভালো লাগলো। ”
কথাটা বলতেই ঐশীর ভিতর থেকে কষ্টের একটা চাঁপা নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসল।
.
.
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে