একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-২৪+২৫

0
290

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৪
বৈদ্যুতিক সংযোগ চলে গেছে। কতক্ষণে ফিরে আসবে জানা নেই। কাদিন হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে হয়রান হয়ে গেল। একটুর জন্য হাতপাখা হাতছাড়া হলেই ঘেমে যাচ্ছে। বাইরেও যেতে পারছে না। গ্রামের রাস্তাঘাট তার ভালো লাগে না। এখানে গর্ত, ওখানে কাঁদা! বিরক্তিকর! বেরুলেই প্যান্টে ধুলোবালি লাগার ভয়। বড় বিপাকে সে। টি -শার্ট ঘামে ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। এটাও তার সহ্য হচ্ছে না। ঘামে ভেজা পোশাক সে গায়ে রাখে না। টি- শার্ট একটানে খুলে ফেলতেই দীপা এসে ঘরে ঢুকল। কাদিন দীপার সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিল, “গরমে মরে যাচ্ছি।”
দীপা বলল, “সব ছেলেরা বাইরে বসে আড্ডা দিচ্ছে। এমনকি বাবাও সেখানে। আপনি ঘরে বসে নিজেকে বউ পাগলা প্রমাণ করতে চান?”
কাদিনের চেহারা থমথম করে উঠল, “এখানে ত আর নতুন আসিনি। সবাই জানে আমি কেমন। ধুলোবালি, আবর্জনা এড়িয়ে চলি আমি।”
“ন্যাকা।” দীপা নাকে টেনে বলল।
কাদিন চোখ মুখ শক্ত করে আরো বলল, “কত বউ পাগলা তা নিশ্চয়ই তোমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।”
দীপা স্পষ্ট খোঁচার আভাস পেয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমিও ত আবর্জনাই। এড়িয়ে চলুন, আরো ভালো করে এড়িয়ে চলুন।”
কাদিন দীপার সাথে দূরত্ব ঘোচাতে চেয়েছিল। দীপাকে তার আবারো ভালো লাগতে শুরু করেছে। তাই বলল, “রাগ করে আছ নাকি?”
দীপা বলল, “তো আপনি আর কি আশা করেন? আপনার জন্যে কড়িকে আমি কথা শুনিয়েছি। এখন কড়ি যতই বলুক রাগ করেনি কিন্তু আমি জানি সে রাগ করে আছে।”
“কথা শুনিয়েছিলে?”
“হ্যাঁ, আপনার জন্য। দোষ আপনার।”
“আমাদের মধ্যকার বিষয়াদি তুমি আমার বোনের সাথে আলোচনা করো?”
“তো করব না? ও কেন আপনাকে সব জানায়নি? এরপর দোষটা কার হলো? আমার না?”
কাদিন ফোঁস করে শ্বাস ফেলল, “ওর সাথে আর আলোচনা করবে না।”
“না, আরো করতে হবে। ওর রাগ ভাঙাতে হবে আমার। বুঝাতে হবে দোষটা আমার না, দোষটা ওর ভাইয়ের। রাগ হলে ও ওর ভাইয়ের উপর রাগ হবে।”
“কড়ি রেগে নেই। কড়ি রেগে থাকলে অন্যরকম হয়ে যায়। আমি বুঝি।”
“সত্যি?”
“মিথ্যে কেন বলব?”
দীপা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। আপনমনে কিসব ভাবল। পরে বলল, “ঠিকই ত। আমার মত নিষ্পাপ মানুষের প্রতি কেন রেগে থাকবে?”
অন্যসময় হলে কাদিন দীপার এ কথায় বিরক্ত হতো। এখনি বলছে এটা, আবার দু মিনিটে বদলে যাচ্ছে। কোনো স্থিরতা নেই। না আছে দু পয়সার কোনো বুদ্ধি। কিন্তু সে চেয়েও বিরক্ত হতে পারল না। বরং দীপার সাথে তাল মিলিয়ে বলল, “হু তোমার মত নিষ্পাপ মানুষের উপর কেন রেগে থাকবে, কড়ি?”
“আপনার কি ধারণা? আমি নিষ্পাপ নই? আমি রুমডেট করা ফাজিল ক্যাটাগরির মেয়ে?” দীপার গলার স্বর আচমকা বদলে গেল।
কাদিন অবাক হয়ে বলল, “কি বলছ?”
দীপার ঠোঁট কাঁপছে, “আপনি যা চক্ষুলজ্জায় বলতে পারছেন না আমি সেটাই বলে দিলাম।”
কাদিন কঠোর গলায় বলল, “আমি এধরনের কিছুই ভাবিনি।”
“অবশ্যই ভেবেছেন।”
“বললাম না ভাবিনি।”
“ভয় পাচ্ছেন কেন?”
কাদিনের কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল, “তুমি বেশি বুঝো, দীপা।”
দীপা কাদিনকে এক সমুদ্র বিস্ময়ে ডুবিয়ে দিয়ে বলল, “তাহলে এখনি আমাকে চুমু খান।”
কাদিন অদ্ভুত দৃষ্টিতে দীপার দিকে তাকাল। দীপা চার্জার লাইটের আলোআঁধারিতে কাদিনের দিকে এগিয়ে এল, “কি হলো চুমু খান। আপনি নিশ্চয়ই সাধু সন্ন্যাসী না। কোনো মহাপুরুষও না যে বউয়ের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকবেন। তাহলে চুমু খাচ্ছেন না কেন?” দীপা কাদিনের উপর ঝুঁকে এল। কাদিন হতভম্ব। সে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “দীপা!”
দীপা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমি দেখেছি আপনি ঢেকে রাখা পানির গ্লাসেও মুখ দেয়ার আগে পানি পরিষ্কার কিনা দেখে নেন। প্লেট একজন ধুয়ে টেবিলে রাখলেও আপনি আবার সে প্লেট ধুয়ে তারপর তাতে খাবার নেন। বউটা শুধু শূচি হলো না। তাই রুচে না।”
কাদিন হাত দিয়ে ঠেলে দীপাকে সরিয়ে উঠে চলে গেল।
বাইরে আকাশ বুকে অগণিত তারা নিয়ে মাথার উপর ছাদ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার নীচে হারিকেন এর আলোয় দাবা খেলতে বসেছেন নিলয় এবং কাদের সাহেব। কায়েস, কাইয়ূম, রিমা, ইমাদ, মেহেদী ওরা তাঁদের ঘিরে বসে খেলা দেখছে। কাদিন গিয়ে চেয়ার টেনে ওদের পাশে বসল। খেলায় টান টান উত্তেজনা। কাদের সাহেব দাবা খেলায় ঝানু লোক। নিলয়ও কম যায় না। দুজনেই বুদ্ধির প্রতাপ দেখিয়ে লড়াই করছে। কড়ি বসে আছে একটু দূরে, সামনের পুকুরপাড়ে। একটু পর পর ঝুঁকে পানিতে হাত ছোঁয়াচ্ছে সে। কাদিন বসার কিছুক্ষণ পর কাদের সাহেব রহস্যময় গলায় বলে উঠলেন, “চ্যাকমেট।”
নিলয়কে শেষ পর্যন্ত অভিজ্ঞ কাদের সাহেবের কাছে হারতেই হলো। কায়েস বলল, “এবার আমি খেলব।”
কাদের সাহেব বললেন, “তো আয়।”
“উহুঁ, বাবা তোমার সাথে খেলব না। আমি হারতে চাইছি না।”
কাদের সাহেব হৈহৈ করে মহানন্দে হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। দাবা খেলায় জিতে যাওয়ার যে আনন্দ, সে আনন্দ রাজ্যাভিষেকের সম্রাটেরও নেই। কায়েস তার বাবার জায়গায় বসল। নিলয় হামি তুলতে তুলতে বলল, “নাহ আমার মনটাই ভেঙে গেছে। জিততে জিততেও হারলাম।”
কায়েস বলল, “আরে ধুর মিঞা বাবার কাছে সবাই হারে। আমরা দুজন খেলে দেখি হালচাল কি হয়।”
নিলয় আড়মোড়া ভেঙে উঠতে উঠতে বলল, “না ভাই আমি খেললে আবার আঙ্কেলের বিপরীতেই খেলব আর জিতবও।”
ইমাদ তার আগ্রহহীন চোখে কায়েসের দিকে তাকাল, “মে আই?”
কায়েস বলল, “অফকোর্স, অফকোর্স।”
ইমাদকে কায়েসের সাথে খেলতে বসতে দেখে কড়ির ঠোঁটের কোণায় রহস্যময় হাসি দেখা গেল। কয়েক মুহূর্ত মুচকি হেসে কি যেন ভাবল সে। তারপর আস্তেধীরে উঠে দাঁড়িয়ে দাবা খেলার আসরটার দিকে এগিয়ে গেল। ইমাদ এবং কায়েস যখন পুরোপুরি খেলায় ডুবে যাচ্ছিল তখন কড়ি দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি খেলতে চাই।”
ইমাদ মুখ তুলে তাকাল না। চুপচাপ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কড়ি বলল, “আপনি মেহমান মানুষ, আপনি কেন উঠছেন? ছোট ভাইয়া উঠবে।”
ইমাদ নির্বিকার গলায় বলল, “না আপনারা খেলুন, আমি আসছি।”
ইমাদ চলে যাওয়ায় কায়েস কড়িকে ধমক দিলো, “এটা কোনো কাজ করলি, কড়ি? বেচারা খেলতে বসেছিল। তুই মাঝে এসে খেলবি বলে উঠিয়ে দিলি। মেহমান না আমাদের? একদম বাচ্চাদের মত করলি।”
“আমার খেলতে ইচ্ছে করছে। তুমি তোমার চেয়ার ছাড়ো। উনাকে ডেকে নিয়ে আসি।”
কড়ি ইমাদের পেছন পেছন গেল।
ইমাদ বাড়ির পেছনের সুপারিবাগানে এসে পড়েছে। এক হাতের ভেতর অন্যহাত গুটিয়ে সুপারি গাছে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে দাঁড়াল। কড়ি এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল “চলে এলেন কেন? আপনার সাথেই খেলতে গিয়েছিলাম।”
ইমাদ বলল, “আচ্ছা।”
“আমি জানি আপনি আমার সম্মতিতে আমার সাথে দাবা খেলতে চান এবং আজীবন খেলে যেতে চান। এরপরও আপনার সাথে খেলতে চাইছি।”
কড়ির কণ্ঠের স্পষ্ট টিটকারি টের পেয়ে ইমাদ চোখ ঘুরিয়ে কড়ির দিকে তাকাল। চোখ রাখল কড়ির চোখের দিকে। এই অন্ধকারেও মেয়েটার চোখ জ্বলজ্বল করছে। বিড়ালের মত চোখ বলেই কি? নাকি মেয়েটার প্রতি তার প্রবল অনুভূতিই আলো হয়ে জ্বলজ্বল করছে? ইমাদ বুঝে উঠতে পারল না। ধীর গলায় বলল, “আপনার সাথে দাবা খেলার প্রশ্নই উঠে না।”
“তাই?”
ইমাদ কিছু বলল না, চুপ করে রইল। কড়ি কপালে ভ্র উঁচিয়ে একগালে হেসে বলল, “ভয় কিসের?”
ইমাদ আবার আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল। তার চাহনী এবং মুখের অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন নেই। সে নির্বিকার কণ্ঠে বলল, “আপনি কেমন খেলেন জানা নেই। ভালো খেলেন, খারাপ অথবা, মোটামুটি যাইহোক জিতলে মনে করবেন আপনার কাছে নিজেকে জাহির করে আপনাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছি আর হারলে বলবেন হেরে গিয়ে ইমপ্রেস করছি।”
“ওহ আচ্ছা এই ভয়।”
ইমাদ নিশ্চুপ। কড়ি সংশয় কাটাতে বলল “চলুন কিছুই মনে করব না।”
“আচ্ছা।” ইমাদ চট করে হাঁটতে শুরু করল। কড়ি আর ইমাদ মুখোমুখি বসতেই কারেন্ট চলে এল। উঠোনের লাইট দুটো ওদের দুজনের মুখে আলোর জোয়ার ভাসিয়ে জ্বলে উঠল। চোখাচোখি হলো দুুজনের। কড়ি ইমাদের চোখের দিকে তাকিয়েই তার কালো সৈন্যকে এগিয়ে দিলো। ইমাদ চালল তার চাল। তার গুটি সাদা রঙের।
কাদিন গরম অনেক সহ্য করেছে। আর পারছে না। কারেন্ট আসায় পাখার বাতাসের লোভে ঘরের দিকে এগুলো সে। থমকে গেল ঘরের ভেতর গিয়ে। দীপা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে পা দুলাচ্ছে। এতক্ষণে বাল্বের আলোয় দীপার পান খাওয়া লাল ঠোঁট চোখে পড়ল কাদিনের। কাদিন দ্রুত পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেল। দীপাকে থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়ে চুমু খেতে গেল। দীপা নিজের মুখ সরিয়ে ধাক্কা দিয়ে ওকে দূরে সরিয়ে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল, “লুচ্চা কোথাকার!”
দীপার মাথা গিয়ে লাগল খাটের স্ট্যান্ডে। মুহূর্তেই কপাল ফুলে গেল। কাদিন হতবাক! এইনা বলল চুমু খেতে! এখন আবার সে লুচ্চা হয়ে গেল!
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ২৫
কড়ির শেষ ঘোড়াটা ইমাদ তার নৌকা দিয়ে ঠেলে ফেলল।
মেহেদী পিনপতন নীরবতাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে সিটি বাজিয়ে উঠল। নিলয় গলার কাছে হাত রেখে জিহ্বা বের করে মরে যাওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “হায়হায় ইস কামবাখাতনে বেয়াইন সাহেবাকো মারডালা।”
কড়ির রাজা ছাড়া আর কোনো গুটি অবশিষ্ট নেই। সে ইমাদের গুটিগুলো এক পলক দেখে নিলো। রাজা, রাণী আর নৌকো। চিন্তিত ভঙ্গিতে কপাল কুঁচকে তার পরবর্তী চালটা চালল সে। ইমাদ তার রাণীকে কয়েক ঘর কোণাকুণি সরাল। কড়ির রাজাকে আবারো ইমাদের রাণী আর নৌকার আক্রমণ থেকে পালাতে হলো। রিমা টানটান উত্তেজনা নিয়ে দাবার বোর্ডে ঝুঁকে দেখল পরের চালেই কড়ির চেকমেট হয়ে যাবে। ইমাদ খুব ধীরে সুস্থে তার রাণীর চাল চালল। কড়ির হাতে দুটো চাল আছে। কিন্তু দুটোর একটাও সে চালতে পারছে না। কারণ কড়ি যে দুইদিকে যেতে পারছে তার একদিকে ইমাদের নৌকা ঐ ঘরগুলো দখল করে আছে। আর অন্যদিকে চাল চাললে ইমাদের রাণীর চেকের কারণে সে সেই ঘরটিতেও যেতে পারছে না। এদিকে তার উপর এখন কোনো চেকও নেই। ব্যস হয়ে গেল স্টেলমেট। কড়ির ঠোঁট হেসে বলল, “ইট’স ড্র।”
ইমাদ হকচকিয়ে উঠল, “ড্র?”
নিলয় এবার দু’হাতে তালি বাজাতে বাজাতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ওয়েহোয়ে বেয়াইনসাহেবা হামকো মারডালা।”
কড়ি সবার সামনেই ইমাদকে হাসতে হাসতে চোখ মেরে বলল, “জি বেয়াই সাহেব ড্র হয়ে গেল। আপনি জিতে গিয়ে ইমপ্রেস করতে পারলেন না। আর না পারলেন বেয়াইনের কাছে হেরে গিয়ে তাকে ইমপ্রেস করতে।”
রিমা মজা করে বলল, “অনেক আগে আমাদের গ্রামে একবার উত্তরপাড়ায় দাবা খেলা নিয়ে ঝগড়া করে মাথা ফাঁটাফাঁটি পর্যন্ত হয়ে গেল। এখন আবার তোমরা শুরু করো না যেন। বিয়ে বাড়ি মনে রেখো, বাচ্চারা। পরে গ্রামবাসী বরপক্ষ আর কনেপক্ষের ঝগড়ার ঘটনা পুরো ইউনিয়নে ছড়িয়ে দিবে। হা হা হা। ”
ইমাদ কড়ির রাজা হাতের আঙুলে চেপে ধরে নিঃস্পৃহ গলায় বলল, “আমি তো আর আমার গুটির রাজা ছিলাম না। রাজা ছিলাম বেয়াইন সাহেবার সৈন্যদলের। বেয়াইন সাহেবার হয়েই খেলেছি। এই যে আমি।”
এরপর অন্যহাতে নিজের রাণী কড়ির রাজার পাশে ঠেলে দিয়ে আরো যোগ করল, “আর এইতো আমাদের বেয়াইন সাহেবা, আমার রাণী। আমরা একজন আরেকজনের বিপক্ষে না খেলে একে অপরের জন্য খেলেছি। আমাদের মধ্যে বড়ই মিল মহব্বত। মাথা ফাটাফাটির প্রশ্নই আসে না।”
সবাই ইমাদের রসিকতায় একসাথে হো হো করে হেসে উঠল।
কড়ি কটমট করে তাকাল। দাঁতে দাঁত ঘষে শ্লেষাত্মক হাসি হেসে বলল, “বেয়াই সাহেব দেখছি ফ্লার্টিং মাস্টার। গার্লফ্রেন্ড কয়টা আপনার?”
এ কথায় একেকজন হাসতে হাসতে একে অপরের উপর গড়াগড়ি পর্যন্ত খেল। ইমাদ কিছু বলল না। কড়ির চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসল। কড়িও সোজা ইমাদের চোখের দিকেই তাকিয়ে রইল। দুজনের কেউ’ই চোখ সরাচ্ছিল না। দীপা এসে তাদের চোখাচোখিতে বাগড়া দিলো, “এখানে এত হাসাহাসি কেন? আমাকে ত সবাই ভুলেই গেছে।” দীপা এমন একটা ভাণ করল যেন ওর কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
ইমাদ কড়ি থেকে চোখ সরিয়ে দীপার দিকে তাকাল। নিলয় দীপাকে ক্ষ্যাপিয়ে বলল, “তুই এখানে কি করিস? নতুন বউদের হাসাহাসি মানা। নতুন বউ হয়েছিস, মুখে আঁচল চেপে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদ। লজ্জাশরম কিছুই নেই মেয়েটার।”
দীপা রাগে ফোঁস ফোঁস করে উঠল। ইমাদ বলল, “আমি একটু ঘুরে আসি।”
দীপা বলল, “হ্যাঁ, আমি এসেছি না, এখন ত তোকে যেতেই হবে।”
ইমাদকে দেখে মনে হলো সে দীপার কথা শুনতেই পায়নি। একা ঘুরতে চলে গেল সে। মন খারাপ করে দীপা বলল, “ধুর আমার আসাই ঠিক হয়নি।”
দীপা চলে যাচ্ছিল। কায়েস পিছুডেকে বলল, “মেজো ভাবি, যাচ্ছ কোথায়? জানালা নেই বলে বসবে না, নাকি? এখন উঠোনে আমি তোমার জন্য জানালা কি করে ব্যবস্থা করি বলো তো।”
দীপা ঘাড় ঘুরিয়ে লাজুক গলায় বলল, “যাহ দুষ্টু।”
কায়েস বুকের বা’পাশে দু’হাত চেপে বলল, “ইশ্ কি মিষ্টি!”

এই গ্রামের বাজারে ক’টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে কে জানে! ইমাদ দ্রুত পা বাড়াল। নাহ্ শেষ পর্যন্ত বাজারে দু একটা দোকান খোলা ছিল। ইমাদ একটা আইস ললি কিনল। আইস ললি হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে দীপার ঘরের দরজায় কড়া নাড়ল।
দীপা বলল, “কে?”
ইমাদ প্রশ্নের উত্তরে গম্ভীর গলায় ডাকল, “দীপু?”
দীপা একা একা মুখ ভেঙাল। তারপর বলল, “দরজা খোলাই আছে। ভেতরে আয়।”
ইমাদ দরজা ঠেলে ভেতরে এসে আইস ললির প্যাকেটটা দীপার কপালে চেপে ধরল। দীপার চোখ ভিজে উঠল। সে যখন একটু আগে বাইরে গিয়েছিল তখন সবাই’ই তো ছিল। সে যে ব্যাথা পেয়েছে কেউ’ই খেয়াল করেনি। এই একটুখানি ফুলেছে, চোখে পড়ার মত তো নয়। ইমি এত ভালো কেন! ঐ যে কি একটা গান আছে না? “তুমি মায়ের মতই ভালো!” ইমি ঠিক তেমন। ইমিকে একদিন বলতে হবে, “তুই মায়ের মতই ভালো, তুই বাবার মতই ভালো, তুই ভাইয়ের চেয়েও ভালো।”
ইমাদকে দূর থেকে দীপার ঘরে ঢুকতে দেখে নিলয় দৌড়ে চলে এল, “এই আমাকে ছাড়া এখানে কিসের ফুসুর – ফাসুর হচ্ছে?”
বলতে বলতে থেমে গেল সে। দীপু বিছানার এক কোণে বসে আছে। ইমাদ খাটের পাশে দীপুর কপালে ঠাণ্ডা বোতল চেপে ধরে দাঁড়ানো। নিলয় আঁৎকে উঠে ওদের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “কি হয়েছে দীপুর?”
দীপা বলল, ” অন্ধকার ঘরে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি খাটের স্ট্যান্ডে আমার মাথা ঠুকে গেল।”
নিলয় অবাক হয়ে চোখ বড় করে বলল, “খাটের স্ট্যান্ডে লেগে এই অবস্থা! আর তুই কি বাচ্চা নাকি?”
দীপা ফোঁস করে জ্বলে উঠে বলল, “তা আমি বড়ই’বা ছিলাম কবে?”
হ্যাঁ গাধী দীপা এটা অবশ্য ঠিক বলেছে। দীপা যে কোন কালেই বড় ছিল না তা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই।
নিলয় গুরুজনদের মত ভাব নিয়ে বলল “দীপু, তোর এখন বিয়ে হয়েছে। তোকে হরলিক্স খেয়ে এখন তাড়াতাড়ি বড় হতে হবে।”
নিলয়ের কথার ভাবে ইমাদও একটু না হেসে পারল না।
এদিকে কাদিন তখন বরফকুচি নিয়ে আসতেই তিন বন্ধুর হাসাহাসির শব্দ শুনল। ওর মেজাজটা চটে গেলে আরও। তাকে লুচ্চা বলে এখন বন্ধুদের সাথে হাসা হচ্ছে! সে গিয়েছিল দীপার জন্য বরফকুচি জোগাড় করতে। বাড়িতে থাকা হয়না বলে ফ্রিজ নেই। পাশের বাড়ির হাশেম চাচাদের ফ্রিজ থেকে বরফকুচি আনতে গিয়ে সেখানেও পেল না। আরো কয়েকঘর খুঁজে তারপর আনতে আনতে দেরি হয়ে গেল। ঘরের ভেতর প্রবেশ করল না আর। বরফকুচি নিয়ে সোজা সে উল্টোপথে হাঁটা ধরল। আসলে দীপা গাধী নয়, সে নিজে গাধা। শুধু গাধাই না, উচ্চমানের মস্তবড় গাধা। গাধা না হলে কেউ দীপার মত মেয়েকে বিয়ে করে না।
.
পুরোনো টিয়া রঙের পাঁচ তলা বাড়ি। একেকটা সিঁড়ি ইয়া চওড়া আর উঁচু। উঠতে নামতে দম বেড়িয়ে আসে সবার।
মুবিন আর মিলা একসাথে এখানে চারতলায় ব্যাচে পড়ে। পাঁচতলায় ছাদ। সামনের অর্ধেক বেঞ্চ মেয়েদের জন্য বরাদ্দ। আর শেষের বাকি বেঞ্চগুলো ছেলেদের। যারা তাড়াতাড়ি আসে তারা সেগুলো দখল করতে পারে। তারপর বাকি ছেলেমেয়েরা টুল নিয়ে বসে পড়ে। এত বেশি ভিড় এখানে! ঘরটার একটাই দরজা এবং সেটি পেছনের দিকে হওয়ায় ছুটির সময় আগে পেছনে বসা ছেলেরা বের হয়। এরপর সামনে বসা মেয়েরা। আর প্রবেশ করার সময় মেয়েরা আগে আগে প্রবেশ করে। ছেলেরা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। মিলার অবশ্য কখনোই মেয়েদের সাথে মেয়েদের বেঞ্চগুলোতে বসার সৌভাগ্য হয়না। মুবিনের ঢিলেমির কারণে প্রতিদিনই দেরি হয়ে যায়। তখন বেঞ্চে বসার জায়গাটুকু সে আর পায়না। ছেলেদের পাশাপাশি টুল নিয়ে বসে ক্লাস করতে হয়। আজ মুবিন আসেনি বলে মিলা তাড়াতাড়ি আসতে পেরেছে। অনেক বুঝিয়েছিল মিলা, কিন্তু মুবিন মায়ের উপর জেদ দেখিয়ে আসলই না। মিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আগের ব্যাচের এখনও ছুটি হয়নি। সে একটু তাড়াতাড়িই এসে পড়েছে। তাই পাঁচতলার চিলেকোঠার পাশে সিঁড়িতে বসে রইল। আচমকা সিঁড়িতে দপদপানির আওয়াজ হলো। মিলা গলা উঁচিয়ে তাকাতেই দেখল একটা ছেলে লাফিয়ে লাফিয়ে ইয়া বড় বড় দুই তিনটে সিঁড়ি একসাথে টপকে উপরে উঠে আসছে। ছেলেটাকে সে চিনতে পারল। ছেলেটার নাম অভ্র। এই ছেলেটা গত বৃহস্পতিবার ক্লাসের বাইরে রাখা মিলার জুতা জোড়ার উপর জুতা পায়ে দাঁড়িয়েছিল। কি আশ্চর্য! ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়াবে না? কারো জুতার উপর দাঁড়িয়ে থাকা এ কেমন অভদ্রতা! তাও আবার জুতা পায়ে! মিলা চোখমুখ কুঁচকে স্বাভাবিক গলায় বলেছিল, “সরো।”
অভ্র প্রথমে বুঝতেই পারেনি, কোথায় সরবে সে? কেন সরবে? মিলা ফের বলল, “আমার জুতা।”
অভ্র তখন গিয়ে বুঝল। নীচে তাকিয়ে বিব্রত হয়ে গেল। দ্রুত সরে দাঁড়াতেই মিলা বিরক্ত ভঙ্গিতে জুতা পায়ে দিলো। ওর জুতাগুলোর অবস্থা ময়লায়, ধূলোয় এমন হয়েছিল যে পায়েই দেয়া যাচ্ছিল না।
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে