একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৬৭+৬৮+৬৯

0
318

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৬৭
খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও বরগুনার মাঝে ইমাদরা ঠিক করেছিল বাগেরহাটের মংলা দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকবে। সে অনুযায়ী মংলা থেকে ২ রাত ৩দিনের শিপ বুকিং করা। যখন ওরা মংলা পৌঁছুলো তখন ভোর। মংলা বাসস্টপের কাছেই ফেরিঘাট। ফেরিঘাট থেকে ট্রলারে করে খানিক দূরে নোঙর করা শিপে পৌঁছে যে যার রুম বুঝে নিলো। রানা ট্যুর ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে আছে। সে নিলয় আর ইমাদকে ডাবলবেড উইদ বাঙ্কার এ্যাকোমোডেশনের একটা রুম দিয়ে বলল, “তোমরা হলে পার্ফেক্ট ফ্যামিলি৷ মাম্মি, ড্যাডি আর খোকা। তাই তোমাদের বাঙ্কার সহ ঘরটা দিলাম।”
নিলয় পুরো ঘেউ ঘেউ করে উঠল, “কি বললেন রানা ভাই? বাসে আমাদের কি কথা হয়েছিল? ওই বিচ্ছুর সাথে রুম শেয়ার যেন করতে না হয় সেজন্যই তো আমি সিটটা ছাড়লাম।”
“উপায় নেই৷ হুট করে এক্সট্রা কেবিন বুক করা যায় না। সব ফুল। আমরা কেবল আমাদের সংখ্যা গুনে ডাবল বেড এর কয়েকটা কেবিন নিয়েছিলাম। তাও ভাগ্য ভালো এই একটা কেবিনে বাঙ্কার পেয়েছি। তোমরা বেড এ থাকবে, বিচ্ছুটাকে বাঙ্কারে উঠিয়ে দিবে।” রানা বুঝালো।
নিলয় হাত নেড়ে বলল, “এতকিছু বুঝি না ভাই। আমাকে আর ইমাদকে অন্য কেবিন দিন। আপনার রুমমেট। আপনি থাকুন।”
মুবিন কাছেই দাঁড়িয়েছিল। রানা এবং নিলয়ের মধ্যকার এই সূক্ষ ঝামেলায় সে ভয়াবহ খুশি। দুজনেই ওর বর্তমান শত্রু। শত্রুরা নিজেরা নিজেরা কুরুযুদ্ধে নামলে তা তা থৈ থৈ তা তা থৈ থৈ। মুবিন পরিস্থিতির খুব মজা নিয়ে বলল, “চাবি দিন। আমি আমার বাঙ্কারে যাই। আপনারা বসে জুয়া খেলুন। যে হারবে চলে আসুন।”
মুবিন ঠোঁট উল্টে হাসছিল হালকা। নিলয় বলল, “ইমাদ তোর খোকাকে সামলা।”
মুবিন চটে গেল, “না সামলালে কি করবেন?”
নিলয় দিলো ধমক, “এখানেই ফেলে যাব।”
মুবিন লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল,
“আপনি কি জানেন? আপনাকে তুলে শিপ থেকে ফেলে দিতে পারি?”
নিলয় মুবিনের দিকে তাকাল। ইয়া লম্বা, তাগড়া, স্বাস্থ্যবান মুবিনকে দেখে নিলয়ের মনে হলো তার সামনে বাদামী টিশার্ট, সাদা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরা মনুষ্যরূপী একটা ষাঁড় দাঁড়িয়ে আছে। সে একবার মিজের দিকেও তাকাল। মা ঠিক বলে, আসলেই ওর আরো খাওয়া দাওয়া করা দরকার৷ কত শুকিয়ে গেছে! এই ষাঁড়টা যদি সত্যি তাকে তুলে ফেলে দেয়? এজন্যই মায়ের কথা কানে তুলতে হয়।
সাঁতার সে জানে, শিপও এখনও ছাড়েনি, পানিও এখানে অতটা গভীরে নয়। কিন্তু, সে না ডুবলেও, পুচকে একটা ছেলে তাকে কোলে তুলে নদীতে ফেললে মান সম্মান তো ডুববেই। নিলয়কে ফ্রিজ হয়ে যেতে দেখে, মুবিনের গরম রক্ত ঠান্ডা হলো৷ সে শিষ বাজাতে বাজাতে রানার হাত থেকে খাবলা দিয়ে চাবি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। দুতলার রুম। জানালা দিয়ে বাইরের নদী আর জঙ্গল দেখা যাবে। বাহ্ দারুণ তো। খানিক বাদে ইমাদ, নিমরাজি রানাকে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকল। নিলয় শেষ পর্যন্ত এই কেবিনে থাকতে রাজি হয়নি। রানাকে অগত্যা বাধ্য হয়ে আসতেই হলো। মুবিন বাঙ্কারে পা ঝুলিয়ে বাবলগাম চিবুচ্ছিল। রানাকে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে টিটকারি মারল, “হ্যালো, মাম্মি। ওয়েলকাম টু আওয়ার হ্যাপি ফ্যামিলি।”
রানা টগবগ করে উঠল, “চুপ করো তো, মুবিন৷ বাজে কথা বলবে না।”
“আপনিই তো বাইরে এটাকে আমার ফ্যামিলি কেবিন বলেছিলেন। এখন আমি আপনার খোকা।”
রানা ফুঁসতে ফুঁসতে ইমাদের দিকে তাকাল, “ইমাদ, এসব বলতে তুই ওকে না করবি কিনা বলতো আমাকে?”
ইমাদ কিছু বলার আগেই মুবিন ঝম্প মেরে বাঙ্কার থেকে শীপের ফ্লোরে নামল, “মাম্মি, প্লিজ ড্যাডির সাথে ঝগড়া করো না। আমরা সুন্দর একটা ট্যুরে এসেছি। ড্যাডির কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে ড্যাডিকে জ্বালাবে না।”
রানা বাকহারা! রাগে ওর কান দিয়ে ধোয়া বেরুচ্ছে। ইমাদ নির্বিকার। সে ব্যাগ থেকে তোয়ালে বের করে কেবিনের ভেতর থাকা অ্যাটাচ্ড বাথে ঢুকল ফ্রেশ হতে। আর মুবিন আপাতত সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার৷
.
“এক কাপ চা পাওয়া যাবে?” কাদিন বলল মিষ্টি গলায়।
দীপা তাকাল ভ্রু কুঁচকে, হাতের বইটা বন্ধ করে, “তুমি এখনও এখানে কি করছ? সকাল হয়েছে বাসায় যাও। কাল রাতে এসেছ। আমি না করা সত্ত্বেও শাশুড়ি তার কলিজার টুকরা জামাতাকে রেখে দিয়েছেন। চা খেতে মন চাইলে শাশুড়িকে বলবে। নতুবা, নিজে করে খাবে। এই বাসায় আমি রান্না করি না। তোমার শাশুড়িরও বয়স হয়েছে বলে এখন রান্নাঘরে যান না। প্রেশার বেড়ে যায়৷ বুয়া যা রাঁধে তাই খাওয়া হয়। তুমি যদি ভেবে থাকো আমি তোমাকে রেঁধেবেড়ে খাওয়াব তাহলে তোমার ধারণা ভুল। এই বাসায় বাঁচতে হলে তোমাকে বেয়ার গ্রিলস হতে হবে। ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড।”
কাদিন বিপদে পড়ে বিড়বিড় করল, “ম্যান ভার্সেস ওয়াইল্ড ওম্যান।”
দীপা খেকিয়ে উঠল, “কি বললে তুমি? কি বললে?”
কাদিন বলল, “কিছু না। তেমন কিছু না।”
“না, কিছু একটা তো বলেছ। আমি শুনেছি।”
“কবুল বলেছি, কবুল। আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।”
“আমার চোখের সামনে থেকে যাও।”
কাদিন সকালের নাস্তা না করেই অফিসে গেল। কপালে জুটল না সমান্য চাও। রাতে ঠিকঠাক ঘুমাতেও পারেনি। চোখে রাজ্যের ঘুম, পেটে ক্ষুধা আর স্মৃতিতে বিভৎস গতরাতে দীপার নৃশংসতা মনে করে অফিসের এক্সিকিউটিভ চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলো। ঠিকই বলে সবাই, নারী নিষ্ঠুর, নির্মম, নির্দয়। বিশেষ করে দীপার মত সহজ, সরল কোমলমতী নারীরা। গতরাতে দীপা অমন একটা কাজ করতে পারল! সত্যিই দীপা করল! কীভাবে করল? এত বড় শাস্তি তার! সে ফিরে গিয়ে বলেছিল, “তুমি এখান থেকে না গেলে, আমিও যাচ্ছি না।”
দীপা জবাবে বলল, “ভেবে বলছ?”
“আমি এক কথার মানুষ।”
“আমি যদি সারাজীবন এখানে থাকি তুমিও থাকবে?”
“তুমি সারাজীবন এখানে থাকবে না।”
“থাকব।”
“পারবে না।”
“পারব।”
“তোমার মন পুড়বে, তুমিও গলবে।”
“কক্ষনো না।”
“কেন?”
“কারণ তুমি এমন কাউকে ডিজার্ভ করো যে তোমার মতই ম্যাচিউর, পার্ফেক্ট, অ্যাস্থেটিক।”
“আর তুমি কেমন মানুষ ডিজার্ভ করো?”
দীপা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আমি এমন একজনকে ডিজার্ভ করি যে আমাকে আমার মতন করে মেনে নিবে। আমাকে বদলাতে চাইবে না। প্রেশারাইজ করবে না। নিঃশ্বাস নিতে দিবে। যার কাছে আমার দমবন্ধ লাগবে না।”
“তোমার ভালোর জন্য তোমাকে বদলাতে চেয়ে যদি আমার অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে আমাকে মাফ করে দাও।”
“তুমি তোমার স্ট্যান্ডার্ডের জন্য আমাকে বদলাতে চেয়েছ। আমার ভালোর জন্য নয়।”
“মেনে নিলাম।”
“তোমার মানা না মানা দিয়ে কিছু যায় আসে না।”
“কিসে যায় আসে বলো। সেটাই করব।”
“তুমি চলে যাও।”
“ঘুমাব দীপা। দু চোখ ভেঙে আসছে।” কাদিন ক্লান্ত।
দীপা বিতর্কে উপসংহার ছাড়া ইতি টানল। বিছানার সামনে থেকে সরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। জনমানবশূন্য সুনসান রাস্তা। কাকপক্ষীও নেই, খালি দাঁড়িয়ে আছে হলুদ আলো মাথা নিয়ে ল্যাম্পপোস্ট৷ কাদিনও কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, “একটা বিছানার চাদর দিবে?”
“বিছানায় চাদর দেয়াই আছে।”
“এটা তুলব।”
“এটা তোলা হবে না। থাকতে হলে এভাবেই থাকো।”
কাদিন শুলো ঠিকই কিন্তু সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারল না। বিছানায় নতুন, ফ্রেশ চাদর না বিছিয়ে নতুন কোথাও গিয়ে সে ঘুমোতে পারে না। দীপা জানে৷ তবু করল এমন? সারারাত ছটফট করে সকালে উঠে নাশতাও করতে পারল না। কাদিন বাইরের কিংবা অন্যকারোর রান্না খেতে পারে না। দীপা জানে। তবু অভুক্ত রাখল! আহ্ নিষ্ঠুর প্রিয়া।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৬৮
অফিস থেকে ফিরেই কাদিন বাসায় চিৎকার চেঁচামেচি শুনলো। শু খুলে শো র্যাকে জুতা রাখতে রাখতে ক্রুদ্ধ মেহেদীর তীব্র বাক্যবাণগুলো সে খুব ভালো করে খেয়াল করল। তারপর এগিয়ে গেল দীপার ঘরের দিকে। ঘরে গিয়ে বুঝল ঘটনা কি। ঘটনা দীপা মেহেদীর হেডফোন এনেছিল। সেটা ভেঙে ফেলেছে। মেহেদীর ভাষ্যমতে এই হেডফোন সে তার বন্ধুর বড় ভাইকে দিয়ে দেশের বাইরে থেকে আনিয়েছিল। কাদিন যে কথাগুলো শুনলো সেগুলো অনেকটা এরকম “যত্ন করে রাখতে না জানলে অন্যের জিনিস তুই ধরিস কেন?”
“স্যরি। আমি তোকে আরেকটা এনে দিব।”
“সেটা তো তোকে অবশ্যই কিনে দিতে হবে৷ তবে নেকস্টটাইম আর কখনো আমার কোনো জিনিসে হাত দিবিনা।”
“আমি কি জানি এটা ভেঙে যাবে?”
“তুই জানিসটা কি? তোর হাতে পরলে কোনো জিনিস থাকেনা। এর আগেও তুই নানা ঝামেলা বাধিয়েছিস। তোর মাথায় ঘিলু নেই কোনো?”
দীপা করুণ মুখ করে মেহেদীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে গেল। মেহেদী বিরক্ত হয়ে দীপার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “দূর হো। তুই একটা সমস্যা।”
কাদিন এই পর্যায়ে দরজায় দাঁড়িয়েই গমগম করে উঠল, “হোয়াট ইজ দিস, মেহেদী? আমি তো তোমাকে অন্যরকম ভাবতাম।”
মেহেদী বলল, “স্যরি ভাইয়া আপনি এসেছেন খেয়াল করিনি। আসুন ভেতরে এসে রেস্ট নিন।”
কাদিন ঘরের ভেতর গেল। মেহেদী বের হয়ে চলে আসছিল৷ কাদিন তাকে থামাল, “দাঁড়াও মেহেদি। সামান্য একটা বিষয়ে তুমি তোমার বড় বোনের সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না৷ তুমি যেসব কথা বলেছ তার জন্য তোমার এখনই উচিত তোমার আপুকে স্যরি বলা।”
“এটাই প্রথমবার না, আপু এর আগেও আমার কত কত শখের ডিভাইস নষ্ট করেছে।”
“ডিভাইসের সাথে সাথে তুমিও নষ্ট হচ্ছ নাকি?”
“শী শ্যুড বি মোউর রেসপন্সিবল।”
“এন্ড ইউ শ্যুড রেসপেক্ট হার।” কাদিন পুরো ঘর কাঁপিয়ে ধমক দিলো মেহেদীকে।
দীপা বলল, “ওকে বকতে হবে না৷ ও নতুন না, একাও না। জগতের সবাই আমার সাথে এভাবেই কথা বলে। ইন্ক্লুডিং ইউ।”
মেহেদী আর কাদিন দুজনেই যেন বিদ্যুৎপৃষ্ট হলো। মেহেদীর ভাই সত্ত্বা কোথাও হতে বলে উঠল, “আমার বোনের সাথে এভাবে কথা বলে কাদিন ভাইয়া! ইটস আ মেন্টাল টর্চার।”
কাদিনের স্বামীর সত্ত্বা তো আগেই লড়ছিল দীপার ভাইয়ের সাথে। জগতে আমরা কেবল অন্যের ভুল ধরি৷ ঘরজুড়ে পিনপতন নীরবতা। বাজ পরা মুহূর্তটা কেটে উঠতেই মেহেদী মাথা নীচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.
পশুর নদীর জলে সাঁতার কেটে শিপ এগুচ্ছে সুন্দরবনের দিকে। কিছুক্ষণের মাঝে চারিদিকে সবুজের ছোঁয়া লাগল। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল অরণ্যের সবুজ গাছ গাছালি। সুন্দরবন সবুজ আর পশু, পাখির প্রাকৃতিক প্রাসাদ। এখানে সিংহ রাজা নয়৷ রাজা ডোরাকাটা হলুদ রাজকীয় পোশাক পরিহিত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। এখানে রহস্য, রোমাঞ্চ, অপার সৌন্দর্য্য যেমন আছে, তেমনি আছে ভয়, অশনি সংকেত, হুমকি,হিংস্রতা। প্রাকৃতিক সবুজ প্রাসাদের সর্বত্র বিচরণ জনসাধারণের জন্য নয়। জনসাধারণ কেবল বনবিভাগ থেকে অনুপ্রাপ্ত গুটি কয়েক অংশে পা রাখতে পারবে। হাড়বাড়িয়া, করমজল, দুবলারচর, কচিখালি, কটকা, হিরণস্পট এই কয়টি স্থান ছাড়া প্রাসাদের বাকি অংশ বিপজ্জনক এবং নিষিদ্ধ। ঘণ্টা দুয়েক চলার পর শিপটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে নোঙর করল। ইমাদ জাহাজ থেকে নামার আগে মুবিন নেমেছে কিনা চোখ বুলিয়ে নিলো। শিপ ছাড়ার পর থেকে আর কেবিনে বসেনি। পুরো শিপ জুড়ে টৈ টৈ করেছে। ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে সবাইকে ট্যুর গাইড স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলো কোন স্পটে কতক্ষণ থাকবে, কোথায় কি করবে, কি করা যাবে, কি করা যাবে না। মুবিন খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল। কিন্তু ইমাদ সহ বাকি সবাই সুনিশ্চিত ট্যুর গাইড এখানে যা যা বলছে মুবিন ঠিক তার উল্টো কাজগুলোই করবে।
.
অভ্র! প্রতিদিন কলম নিয়ে আসতে ভুলে যাওয়া ছেলেটি, পদার্থবিজ্ঞানের প্রাইভেটে কিচ্ছু না বুঝা ছেলেটি, প্রাইভেট শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা আগে এসে, ছাদের কোণে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল চালাতে থাকা ছেলেটি ঝা করে মডেল টেস্টে ফার্স্ট হয়ে গেল। রেজাল্ট শুনে মিলার মাথা ভনভন করে উঠল। এটা কীভাবে সম্ভব? সে তার হা হয়ে যাওয়া মুখ কিছুতেই বন্ধ করতে পারছিল না৷ সে অনেকক্ষণ নীচু হয়ে বেঞ্চে মাথা দিয়ে রাখল। বিড়বিড় করে বারবার নিজের মনে আওড়াতে লাগল, অভ্র ফার্স্ট! আমি সেকেন্ড! সেদিন ফিজিক্স টিচার কি পরাল মিলা কিছু বুঝল না। কিছু শুনল না৷ কোনোমতেই, মনোযোগ ধরে রাখতে পারল না। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগল৷ কখন সময় শেষ হবে? কখন ছুটি হবে? শেষ পর্যন্ত ছুটি হলো। মিলা একটা ঘোরের মধ্য দিয়েই বেরুচ্ছিল। গেটের সামনে অভ্র দাঁড়িয়ে৷ মিলাকে দেখে এগিয়ে এল, “রোদমিলা, থ্যাঙ্ক ইউ। কতগুলো টপিক আমি তোমার কাছ থেকে বুঝেছি। স্যারের চাইতে আমি তোমার কাছে ভালো বুঝি। তুমি বড় হয়ে টিচার হবে।”
মিলা ফ্যাকাসে চেহারা নিয়ে বলল, “মাই প্লেজার।”
অভ্র বলল, “কংগ্রেচুলেশন্স তোমাকেও।”
মিলা যন্ত্রের মত বলল, “হুম থ্যাঙ্কস। আমি যাই।”
অভ্র আবার পিছু বলল, “আমাকে তাড়িতচুম্বকের অংক গুলো একদিন বুঝিয়ে দিবে?”
মিলা ছোট করে বলল, “দেখি।”
তারপর খুব তাড়াহুড়া করে একটা রিকশা ডেকে চলে গেল। সারাদিন সে এই ভেবে বিরক্ত হয়ে রইল যে, এটা কীভাবে হলো! এটা কি হলো!
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৬৯
সুন্দরবনে প্রথম যে স্পটে ওরা নামল সেটা হলো হাড়বাড়িয়া। সবাইকে বনের ভেতর যেতে হবে একটা কাঠের ট্রেলের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে। গাছের ফাঁকফোঁকর দিয়ে সূর্যের তীর্যক রশ্মি এসে ট্রেলের উপর পড়ছে। যেন সোনালি গালিচার আস্তরণ। দলবেঁধে সূর্যের আলোর পথে ট্রেলে নেমে পড়ল সবাই। ভয়ঙ্কর সুন্দর এই সবুজের অরণ্যে যত হারিয়ে যেতে থাকল তত ম্যানগ্রোভ গাছের শ্বাসমূল, গোলপাতা, জঙ্গলজুড়ে থাকা বিচিত্র গাছপালার আধিপত্য দেখা গেল। চোখ জুড়িয়ে যায়। এখানে একটা পদ্মপুকুর আছে। পুকুরের একপাশ দিয়ে ঘুরে আরেক পাশ দিয়ে বের হয়ে আসতে হয়। মুবিন মনে মনে ঠিক করল রানা কিংবা নিলয় দুজনের একজনকে সে এই পুকুরে ফেলবে। যাকে সুবিধা করতে পারবে তাকেই। ইমাদ চারিদিক দেখতে দেখতে ধীরে সুস্থে এগুচ্ছিল। সাথে নিলয়। বাকিরা সবাই দলবেঁধে আছে। আর মুবিন দৌড়োচ্ছে সবার আগে আগে। সে চারিদিকে দৃষ্টি ছুড়ে ছুড়ে কেবল পশুপাখি আর প্রাণের উৎস খুঁজছে। একটু পর পর বিভিন্ন পাখি ডেকে উঠলে মুবিনও শিষ বাজায়, পাখিদের পাল্টা জবাব দেয়। কিন্তু ট্রেলের উপর দিয়ে হেঁটে ওর ঠিক পোষাচ্ছিল না। ওর মন চাইছে ট্রেল থেকে লাফিয়ে নেমে সোজা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে। ইমাদ ব্যাপারটা দূর থেকে দেখেই বুঝতে পারল। কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তা থেকে দ্রুত বড় বড় পা ফেলে সবাইকে কাটিয়ে সে মুবিনের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল সে। মুবিন তাকাল ভ্রু কুঁচকে। ইমাদ তাকাল না। মাঝে মাঝে পশুপাখিরও দেখা মিলছে। সামনে একটা ওয়াচ টাউয়ারটার। ওয়াচ টাউয়ার থেকে পুরো হাড়বাড়িয়া দেখা যাবে এক পলকে। ওয়াচ টাউয়ারের সিঁড়ি বেয়ে উপর উঠে বেশিরভাগ মানুষ ব্যাকগ্রাউন্ডে হাড়বাড়িয়ার অপার সৌন্দর্য নিয়ে ছবি তোলার প্রলোভন প্রতিহত করতে পারল না। ওরা ছবি তুলতে লাগল। মুহূর্তেই শান্ত পরিবেশটা গমগম করে উঠল। কোনো কোনো প্রেমিকযুগল ওয়াচ টাউয়ারের দেয়ালে নিজেদের নাম লিখে গেছে। নিলয় ইমাদের পেটে কনুই দিয়ে খোঁচা মেরে বলল, “লিখবি নাকি তুইও? কড়ি+ ইমাদ।”
কড়ির সাথে একটু কথা বলার তেষ্টাটা নিলয় যেন আরো বাড়িয়ে দিলো। ইমাদ একটু সাইডে গিয়ে মোবাইল হাতে নিলো। নাহ নেটওয়ার্কের অবস্থা ভয়াবহ খারাপ। ঠিক মত কল’ই যাবে না। আর কল গেলেও কড়ি যে কল রিসিভ করবে, কথা বলবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। ওদিকে সুযোগ পেয়ে মুবিন নিলয়কে প্রায় ল্যাং মেরে ফেলেই দিচ্ছিল। নিলয় পড়ে যেতে যেতে কোনোমতে রেলিং ধরে ঝুলে থাকল। সবাই নিলয়ের চিৎকার শুনে দৌড়ে গেল। মুবিন এত ভয়ানক! এত ভয়ঙ্কর! টেনে তুলল ওরা নিলয়কে৷ সবাই মিলে চেপে ধরল মুবিনকে, “এটা তুমি কি করলে?”
মুবিন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “আমি কি করলাম?”
“তুমি নিলয়কে ল্যাং মারলে?”
“না, উনি ঐ দড়িতে পা বেজে পড়লেন।” মুবিন মাটিতে গড়িয়ে পড়ে থাকা একটা দড়ির দেখিয়ে হামি তুলল। কারো কিছু বলার আছে এখানে? কি’বা বলা যেতে পারে এই বিচ্ছুটাকে? কিছুই না।
.
হাড়বাড়িয়া ঘুরা শেষ করে শিপে ফেরত চলে এল সবাই। জঙ্গলঘেরা নদীর উপর দিয়ে চলতে চলতে শিপের খোলা ছাদের ডাইনিংয়ে বসে দুপুরের খাওয়া দাওয়া হলো। পরবর্তী গন্তব্য সুন্দরবনের আরেক রূপ কটকায়। শিপ চলছে নিরন্তর গতিতে মহা সমারোহে। কেউ কেউ খাওয়া দাওয়া শেষে খানিক বিশ্রাম নেবার অভ্যাসে চলে গেল নিজ নিজ কেবিনে। রানাও উঠে কেবিনের দিকে যাচ্ছিল।
ইমাদ ডাকল, “ঘুমোবেন?”
রানা কুঁড়ি মুড়ি দিয়ে বলল, “শিপে ঘুমাতে কেমন লাগে দেখতে চাই।”
“এখন থাকেন রানা ভাই। রাতে শিপেই ঘুমাতে হবে।”
“রাতে ঘুমানোর চিন্তা থাকলে মাথা থেকে সরাও। রাতে জম্পেশ আড্ডা হবে। ঘুমাতে দিব না একটি প্রাণীকেও।”
ইমাদ মাথা নাড়ল, “আচ্ছা।”
অনেকেই ইমাদের মত পড়ন্ত বিকেল উপভোগের প্রলোভনে বসে রইল শিপের ডেকে। এক কাপ চা হাতে সুন্দরবনের নদী আর বনের সূর্যাস্ত দেখে ভুলে গেল জীবনের যান্ত্রিকতা, মন ভাঙার গল্প, বুকপকেটে থাকা অতীত এবং দূরের ভবিষ্যৎ। নদী যেন কথা বলে।
মুবিনের একটু পর পর ক্ষুধা লাগে। তার ব্যাগভর্তি নানান ড্রাইফুড। সে খায় আর পুরো শিপ মুখস্থ করছে। কোথায় কি আছে, কে কি করছে সে সব জানে। এমনকি সে এক ফাঁকে শিপের রান্নাঘর থেকেও ঘুরে চলে এসেছে। এই শিপ নিয়ে তাকে যেকোনো পরীক্ষা নিতে এলে প্রশ্নকর্তা নিজে হয়রান হয়ে যাবে। বিকেল ঢেকে সন্ধ্যা যখন ঘোমটা তুলতে লাগল মুবিন ঝপাৎ করে সুইমিংপুলে লাফ দিলো। চিত সাঁতার, প্রজাপতি সাঁতার, বুক সাঁতার কাটল ইচ্ছেমত। চোখের পাতা বন্ধ, কানে কি নৈসর্গিক শব্দ। আহা জীবন। আহা জল। মুবিন প্রশান্তি খুঁজে বেড়ায়। এই ঠান্ডা জলে, নীল গগণে, সবুজ বনে, এখানে ওখানে। কোথায় শান্তি? কোথায় একটু শান্তি?
অনেকক্ষণ পর সুইমিংপুল থেকে উঠে এসে চুপচাপ ভেজা কাপড়েই বসে ছিল ও। তারপর এক কাপ চা খেল। এখানে যখন ইচ্ছা যত ইচ্ছা, তত চা খাওয়া যায়। ও যদি চা-খোর হতো ভালোই হতো। লোকে বলে চায়ের নেশা বড় নেশা। যারা নেশা করে, ওরা যতক্ষণ না নেশা করতে পারে ততক্ষণ পাগলের মত করতে থাকে। নেশা করার পর ওরা শান্তি পায়। শান্তি! নেশা করলে যদি একটু শান্তি পাওয়া যায়। মুবিন রাতের দিকে কেমন ঢুলছিল। ইমাদ অনেকভেবে চিন্তে এগিয়ে গেল। মুবিনের কাঁধে হাত রাখল, “কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?”
মুবিন এক ঝটকায় কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে দিলো। ওর চোখ ঢুলুঢুলু।
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে