একমুঠো বসন্ত পর্ব-০৪

0
614

#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৪

“বড়োবাবা?”

নিহিলা খেতে খেতে আমান শেখের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষন যাবৎ নিজের সাথে যুদ্ধ করে ডাক দিল।

আমান শেখ নিহিলার কথা শুনে উঠে দাঁড়াতে গিয়েই থেমে গেল। বাকিরাও উৎসুক চোখে নিহিলার দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ এ বাড়িতে একটা নিয়ম আছে যে খাওয়ার সময় কোনো কথা বলতে নেই। এটা মূলত নিয়ম না কিন্তু আমান শেখের খাওয়ার সময় কথা বলা পছন্দ না বিধায় সবাই চুপচাপ খাওয়া শেষ করে। একটা টু শব্দও হয় না। তাই তো এতক্ষন নিহিলা নিজের সাথে যুদ্ধ করে প্লেটের ভাতগুলো নাড়াচাড়া করছে। আর নিহিলা জানে তার কথাটা বলতে হলে এখানেই বলতে হবে সাহস সঞ্চয় করে। কারণ আমান শেখ খাওয়ার পরপরই রুমে চলে যান।

“হ্যাঁ বলো?”

নিহিলা নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করলো।

“কিছু বলতে চাইছো? নির্ধিদায় বলে ফেলো।”

“আমি যদি এমন কিছু চাই যেটা তোমাদের পছন্দ না সেটা কী মেনে নিবা?”

নিহিলার কথায় আমান শেখ হাসলো।

“এতক্ষন গম্ভীর করে কথা বলছি তাই বলার সাহস পাচ্ছ না তো? এইবার বলো দেখি।”

“আমি বাহিরে গিয়ে পড়তে চাই।”

নিহিলার কথায় বাকিরা স্তব্ধ হয়ে রইলেও আমান শেখ বেশ স্বাভাবিক আছেন। মনে হচ্ছে তিনি আগে থেকেই জানতেন নিহিলা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিবে।

“কোথায়? তুমি কী পারবে?”

বাকিরা আমান শেখের দিকে অবিশ্বাস্য নজরে তাকালো। তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছে না যে নিহিলা বললো আর আমান শেখ স্বাভাবিকভাবে রাজিও হয়ে যাচ্ছেন!

“আমি স্কলারশিপ পেলেই যাবো। আর আমার মনে হচ্ছে আমি পাবো। এতে খরচও অনেক বেঁচে যাবে। আর আমি পারবোই বাবা।”

“খরচের কথা চিন্তা করিও না। আমি আছি তো। তুমি আমান শেখের অংশ হয়ে এমন কথা মানায় না। হ্যাঁ স্কলারশিপ হলে তো ভালোই। নাহলেও সমস্যা নেই। তবে তোমার সবকিছু ভাবতে হবে। আবেগের বশে বলিও না মা। ঐ অচেনা জায়গায় তোমার কেউ নেই। সেই প্রস্তুতি নিয়েই যাবে। আর সবকিছু সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা নিয়েই যাবে।”

“জি।” নিহিলা কথাটা বলবে কী বলবে না ভাবলো। জাপানে তো তার ফুপি আছে। সে ফুপাতো বোন তাসফির সাথে মিলিয়ে সব করছে। তাসফিই সব ব্যবস্থা করছে। সেও তারই সাথে পড়বে কিন্তু কথাটা কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না।

——–

সাফাত আজকে রুম থেকে বের হলো নিজেকে বেশ শান্ত করে। এ কয়েকদিন রুমেই সব চলছিল। তাদের নিচে আসা বারণ। সাফাত জানে তাকে বেশ কথা শুনতে হবে তবে সে আজ বাবার পা ছেড়ে উঠবে না। রুম থেকে বের হতেই নিহিলার রুমের দিকে দৃষ্টি পড়লো। দরজা বন্ধ। সাফাতের কেন জানি বুঁকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। মেয়েটাকে আজ চারদিন যাবৎ চোখের দেখাও দেখতে পারেনি।

নিচে নামতেই আমান শেখ পত্রিকা পড়ছিলেন। এমন সময় সাফাত সামনে গিয়ে ডাকতেই তিনি চোখ ফিরিয়ে আমেনা বেগমের দিকে তাকালেন।

“আমেনা, এ ছেলেকে আমার সামনে থেকে যেতে বলো।”

“বাবা প্লিজ এমন…”

সাফাতকে বাকী কথাটুকু বলতে না দিয়ে আমান শেখ সোফা ছেড়ে পত্রিকা ছুড়ে উঠে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সাফাত গিয়ে বাবার পা জড়িয়ে ধরে বসে পড়লো।

“বাবা, তুমি যতক্ষণ না মাফ করবে আমি তোমার পা ছাড়বো না। একটা ভুল করে ফেলেছি। মাফ চাইছি আমি।”

সাফাতের কথা শুনে আমান শেখ পা ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও পারলো না। সাফাত আরো জোরে বাবার পা জড়িয়ে নিল।

“তোমার মনে হচ্ছে এটা ছোট ভুল? কই এ কয়দিন রুমের ভেতর বউ নিয়ে তো ভালোই ছিলে। কী দরকার পড়েছে তোমার?”

“বাবা তুমি যা বলবে তাই করবো। তোমার এতো কঠোরতা মেনে নিতে পারছি না আমি।”

“যা বলবো তাই?”

“হ্যাঁ।”

“তবে বেশ। আজ রাতেই তুমি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। ওখানের ব্যাবসাটা তুমিই দেখবে।”

সাফাত যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো খুশি হলো। অবশেষে তার উদ্দেশ্য সফল। সে তো এতসব মিলির কথানুসারে করছিলো নাহয় বাবার পা কে ধরে! শুধুমাত্র সম্পত্তির জন্য। কারণ সেদিনই বাবা বলে দিয়েছিল সাফাত এ ঘরের কিছুই পাবে না। সেই কথার রেশ ধরে মিলি এতক্ষন ধরে বুঝিয়েছিল। এভাবে রুমে বসে থাকলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। এতে ওরা আরো পরিবারের চোখে খারাপ হবে। সাফাত তৃপ্তির হাসলো। যাক, অবশেষে সব মিটলো বলে!

সাফাত দ্রুত পায়ে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে নিতেই আমান শেখের ডাকে থেমে গেল।

” উপরে কই যাচ্ছ? আমি তো কাজ বুঝিয়ে দিইনি। ”

“মিলিকে কাপড় গুছাতে বলতে যাচ্ছি। সব তো গুছাতে হবে।”

সাফাতের কথায় আমান শেখ হাসলো। যেন তিনি ছেলের সব বুঝে ফেললেন। এতো সহজে তো হবে না।

“কিন্তু মিলি তো না। তুমি একায় যাবে। আর হ্যাঁ অফিসের ফোনেই সব করবে। এই কাজটা গুরুত্বপূর্ণ। দিনে একবার বাড়ির ফোনে কল করবে। শুধু পাঁচ মিনিট। আমি চাই না কারোর পাল্লায় পড়ে আমার কাজটা তুমি হেলাফেলা করে করো।”

উপর থেকে মিলি এসব শুনতেই রেগে গেল। এই বৃদ্ধকে সে ভুলাভালা মনে করেছিল কিন্তু তা তো না। সাফাত চলে গেলে সে কেন থাকবে এখানে!

বেশ কিছুসময় পরে সাফাত রুমে এসে খাটে বসতেই মিলি এগিয়ে আসলো।

“তোমার বাবা কী বলেছে?”

“কী বলেছে সব তো শুনতেই পেয়েছো। আবার জিজ্ঞেস করছো কেন?”

“শুনতে পেয়েছি মানে?”

সাফাত মিলির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলো।

“মানে তুমি নিজের কাছ থেকেই জিজ্ঞেস করো। আড়ালে দাঁড়িয়ে কথা সবগুলোই তো শুনেছো।”

মিলি একটু নরম হলো।
“আমাকে না নিয়ে কেন যাবে?”

“বাবা কী বলেছে শুনেছোতো। এমনিও এই ঘটনাটা করে সবার চোখে অপরাধী হয়ে গিয়েছি। এখন এই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাই না।”

“হাতছাড়া করতে চাওনা মানে? আমাকে না নিয়ে কোথাও যেতে পারবে না তুমি।”

সাফাত মিলির দিকে তাকালো।

“তুমি কী চাইছো বলো তো? তোমার কথায় তো বাবাকে রাজি করিয়ে ব্যাবসাটা কোনোমতেই নিজের হাতে নিলাম। এখন আবার তুমিই বিপরীতে বলছো?”

“তখন তো ভেবেছিলাম আমি সহ গিয়ে আমরা ওখানে আলাদা করে সংসার পাতবো। আর এসব শোনা লাগবে না। ব্যাবসাটা দিয়ে আমরা ভালো ভালোই চলবো কিন্তু শুধু যে তোমাকে পাঠাবে সেটা তো ভাবিনি।”

“মানে?”

“মানে হচ্ছে আমি এখানে একা থাকতে পারবো না। তোমার পরিবারটাকে আমার সহ্য হয় না।”

“সহ্য হওয়ার জন্য মন মতো কোনো কাজ করেছো? আসার পরে থেকে দ্বিতীয়দিনের ঐ সকাল ছাড়া আর এ কয়দিনে রুম থেকে বের হয়েছ? কারোর মন পাওয়ার চেষ্টা করেছো?”

সাফাতের কথায় মিলি রেগে গেল। সে সাফাতের দিকে আঙ্গুল তাক করে বলে উঠল,
“তুমি কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করছো সাফাত। তোমার পরিবার আমাকে মূল্যায়ন করেছে?”

“করবে কেন? যে কাজটা করেছি সেক্ষেত্রে বাড়িতে জায়গা পেয়েছি এ অনেক। আর তোমার যে ভাবনা! এমন নিচু ভাবনার মেয়েকে ওরা কেন যেচে পড়ে মূল্যায়ন করতে আসবে। ”

“সাফাত, তুমি কিন্তু আমাকে রীতিমতো অপমান করছো।

সাফাত তাচ্ছিল্য হাসলো।

“তুমি চেয়েছিলে আমি পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যায় তাই তো?”

সাফাতের কথায় মিলি আমতা আমতা করে বলে উঠল,
“না সেটা কেন চাইবো। তুমি ভুল বুঝছো।”

মিলির কথায় সাফাত আর জবাব দিল না। সে কাপড় নিয়ে হনহনিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। সে যেন বিয়ের আগের মিলি আর এ মিলির সাথে মিলাতে পারছে না। মিলি নিজের পরিবার ছেড়ে এসেও কোনো মন খারাপ বা অনুশোচনা নেই। সাফাতের তখন ভালোবাসার উপরে আর কিছু মাথায় আসেনি বিধায় তার মনে হয়েছিল মিলি যেটা করছে ঠিক করছে। এমন পালিয়ে বিয়ে, তবুও নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা না করে আলাদা সংসার পাতার ভাবনা নিয়ে এসেছে!তাও বা বিয়ের চারদিনের মাথায়! এখনো সপ্তাহও পেরোয়নি। সাফাতের নিজেকে নিজের অসহায় লাগলো। নিহিলার সাথে অন্যায়টা না করলেও পারতো। সে কী মানুষ চিনতে বড়োসড়ো ভুল করে ফেলল! নিজের ভবিষ্যত নিজেই কী শেষ করলো! কী হবে পরবর্তীতে!

———-

এরমধ্যে তিনদিন কেটে গেল। নিহিলা রুম থেকে কোনো কাজ ছাড়া বের হয়নি। আজ বের হয়েছে। শুনেছে সাফাত ঢাকায় যাবে আজ। একমাস পরে ফিরে আসবে। সেদিন সে যদি কাজটা ভালোভাবে মনোযোগ দিয়ে করতে পারে তবেই বড়ো বাবা তার প্রতি সিদ্ধান্ত নিবেন।

নিহিলা রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ির কাছে আসতেই দেখলো সাফাত উপরে উঠছে। নিহিলা সাফাত উঠা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইল।

সাফাতের দৃষ্টি আজ অনেকদিন পরে নিহিলার দিকে। নিহিলা দ্রুতপদে নেমে যেতে নিতেই সাফাত হাত ধরে ফেলল।

নিহিলা হাতের দিকে একবার তাকিয়ে রাগীচোখে সাফাতকে শাসালো।

“হাত ছাড়ুন সাফাত ভাই।”

নিহিলার এমন ক্রোধপূর্ণ কথায় সাফাত সাথে সাথে হাত ছেড়ে দিল। নিহিলাকে কেমন অগোছালো লাগছে অথচ এই মেয়েটাই এ বাড়িতে ছোটবেলা থেকে গোছানো স্বভাবের। সবসময় বাড়ি মাতিয়ে রাখতো অথচ এই প্রথম বাড়িটা এতো নির্জীব লাগছে। সাফাতের অপরাধবোধে জেগে উঠলো। তার জন্যই কী সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে!

“কেমন আছিস তুই?”

“ভালোই আছি।”

“আমাকে কী ক্ষমা করা যায় না নিহু?” সাফাতের কণ্ঠ অসহায় শোনালো। তার এমন কণ্ঠে নিহিলা শক্ত থাকতে পারছে না। ভেতরে ভেতরে কোথাও জানি র’ক্ত’ক্ষরণ হচ্ছে।

“আর আমার নাম নিহু নয় নিহিলা। আর কিছু মনেই রাখিনি, ক্ষমার প্রশ্নই আসে না।” বলেই সে নিচে নেমে গেল।

সাফাত ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। এ মেয়েটিকে দেখে তার এমন কেন লাগছে। মনে হচ্ছে সে হীরা চিনতে ভুল করে ফেলেছে। সে যদি এইদিন এমন হবে জানতো তবে কোনোদিন মিলির রাখা ফাঁদে পা দিতো না। তবে সে কী নিহিলার সাথে অন্যায়ের ফল পাচ্ছে!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে