একমুঠো বসন্ত পর্ব-২৩

0
680

#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_২৩

আজ রিহির বিয়ে। নিহিলা রিহিকে জড়িয়ে ধরে আছে। রিহি সাজতে পারছে না কোনোভাবেই। ক্ষনে ক্ষনে চোখের পানি চলে আসছে। পাশেই অরিন তাকিয়ে আছে। সে বারবার জিজ্ঞেস করছে,”বিয়েই তো হচ্ছে, এখানে কান্না করে নিজের সুন্দর মুখটা নষ্ট করছো কেন? ”

নিহিলা অরিনের এমন বোকা বোকা প্রশ্নে হাসলো,
“শোনো অরিন, এখানে বিয়ে মানে হচ্ছে শশুরবাড়ি চলে যাবে আর আগের মতো বাবার বাড়িতে আসতে পারবে না। আগের মতো মুক্তভাবে চলতে পারবে না।”বলা শেষ করতেই রিহির এতক্ষনের চাপা কান্না আরো জোরে বেরিয়ে এলো।

নিহিলা মনে মনে নিজেকে গা’লি দিল। কী দরকার পড়ছিল এখন অরিনকে বোঝাতে যাওয়া! একজনকে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে গিয়ে আরেকজন উপলব্ধি করে কান্না করে দিচ্ছে। এতক্ষন কোনোমতেই চুপ করালে এখন তার নিজের কথা শুনে আরো বেশি কান্না। এখন তারই সামাল দিতে হবে ভেবে নিহিলা মলিন চোখে রিহির দিকে তাকালো। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে নয়তো ওরা এসে দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এজন্যই তো নিহিলাকেই রিহির সাথে রুমে পাঠিয়েছে। নিহিলা এক পলক ঘড়ির দিকে তাকালো,এদিকে সময় চলে যাচ্ছে। নিজের পায়ে নিজের কুড়াল মা’রা বোধহয় এটাকেই বলে। অরিন বিজ্ঞ ব্যক্তিদের মতো বোঝার ভান করে মাথা নাড়লো। সে আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে নিতেই নিহিলা থামালো,
“অরিন তোকে আমি রাতে সব বুঝিয়ে দিবো। এখন এরে সামলায় আগে।”বলেই নিহিলা রিহির দিকে তাকালো,
“তুই জানিস? তোরে কান্না করলে কী বিশ্রী লাগে? আর তোর না ইচ্ছে ছিল বিয়েতে এতো সুন্দর করে সাজবি। বিশবছর পরে যখন তোর বিয়ের এমন কান্নামাখা ছবি দেখবি তখন ইচ্ছে করবে অতীতে এসে আরেকটু ভালো করে সেজে যায়। তোর বাচ্চারা বলবে,’মা তুমি এভাবে মুখ করে ছিলে কেন!’ বিয়ে মানুষের একবারও হয়। আর হবে না কিন্তু। না কি তোর আরেকটা করার ইচ্ছে আছে?” বলতেই অরিন নিহিলাকে হাত দিয়ে থামিয়ে নিজেই বলা শুরু করলো,

“একবার কেন! আমাদের এখানে অ্যানিভার্সিরি হয়। প্রতি বছর বছর সুন্দর করে সাজে। তোমাদের এখানে হয় না?” অরিনের বোকা বোকা প্রশ্নে রিহি নিহিলা দুজনেই হেসে দিল। সে এখানের সংস্কৃতি আর ঐখানের সংস্কৃতি গুলিয়ে ফেলছে। সকাল থেকে নিহিলাকে কত বোকা বোকা প্রশ্ন যে করেছে তা নিহিলা রিহিকে বলে শোনাতেই রিহি হেসে দিল। এর মধ্যেই মন ভালো অবস্থায় নিহিলা রিহিকে সাঝানোর ব্যবস্থা করলো।
———

রিনা আহমেদ ছেলের দিকে এগিয়ে এলেন।

“আসা পর্যন্ত রুমে ছিলি যে? একটু বাইরের পরিবেশ দেখতি ভালো লাগতো।”

“আমি অচেনা জায়গায় খাপ খাওয়াতে পারি না। তোমার জন্যই এখানে আসা।”

“তাই বলে সবাই ডাকতে এসেছিলো তবুও গেলি না যে? ”

“মা আমার ভালো লাগে না।”

রিনা আহমেদ অনেকক্ষন নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে মুখ খুললেন,
“তুই কী নিহিলাকে পছন্দ করিস?”

“কেন মনে হচ্ছে?”

“না, তোর জন্য যদি জীবনসঙ্গী হিসেবে নিহিলাকে ঠিক করি তাহলে আমি কী তোর মনের বিরুদ্ধে যাবো?”

“তুমি কোনোদিন আমার মনের বিরুদ্ধে যাওনি।”

“তাহলে কী তুই রাজি ধরে নিবো?”

“তোমার উপরেই সব।”

রিনা আহমেদ খুশি খুশি মনে বেরিয়ে গেল। যাক, তার ছেলে বিয়ের জন্য রাজি হয়েছে। তাহলে অরিন আহান ঠিক ছিল।
———

বোনের বিয়ে উপলক্ষে সাফাত এসেছে বোনকে বিদায় দিতে। দীর্ঘ দুইবছর পরে সে বাড়ির দরজায় পা রাখলো। তার হুট্ করে কান্না পাচ্ছে কিন্তু ছেলেদের না-কি কান্না করতে নেই এইটা ছোটবেলা থেকেই আমান শেখ বলে এসেছেন। নিহিলা যখন তার কোনো খেলনা নেয়ার বায়না করতো সে তখন কান্না করে দিতো। তখনই আমান শেখ এসে বলতেন, যায় হয়ে যাক না কেন ছেলেদের কান্না করা মানায় না। সেই কথা মনের মধ্যে রাখতে গিয়ে আর বাস্তবতা উপলব্ধি করতে করতে গিয়ে এখন আর কান্না করে না। কান্না করে না এটা ভুল সে তো কান্না করে। তবে মানুষের সামনে নয়, আড়ালে। এখন যে ঢাকায় থাকে সেই বাড়ির প্রতিটা দেয়াল জানে তার রাতের চিত্র। তার তো বোঝানোর মতোও কেউ নেই। হয়ত নিজে দোষেই সবাইকে হারিয়েছে। তারও ইচ্ছে করে দিন শেষে কাউকে মনের সব কথা উজাড় করে বলে হালকা হতে কিন্তু সে মানুষের যে বড্ড অভাব তার! সাফাত বাড়িটার দিকে তাকালো। আজ তার একমাত্র ছোট বোনটার বিয়ে। তার সেই ছোট বোনটাও আজ বড়ো হয়ে গিয়েছে! বোনটার কথা রাখতেই তো এখানে আসা। বোন ভেবেছে ভাই বুঝি তাকে ভুলে গেল! মানুষের অনুপস্থিতিতে মানুষ পেলে ভোলা যায় কিন্তু সে তো কোনো মানুষ পায়নি! তবে ভুলবে কীভাবে! সাফাত মলিন শ্বাস ফেলল। নিহিলাও বোধহয় এসেছে। চারবছর পরে মেয়েটাকে দেখবে। বাড়িতে অনেক মানুষের আনাগোনা। কারোর দৃষ্টি সাফাতের দিকে পড়লো না। সাফাত আস্তে ধীরে বাড়ির সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে এগিয়ে গেল। সাফাত ঘরে ঢুকেই চারদিকে তাকালো। তার নিজের বাড়ি, প্রতিটি দেয়ালে তার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে অথচ আজ কেন জানি অচেনা লাগছে সব। হয়ত দুইবছর পরে এসেছে তাই সব অচেনা হয়ে আছে। সে একটু এগিয়ে যেতেই একটা রুম থেকে হাসির আওয়াজ ভেসে আসলো। এটা রিহির হাসি সে সেটা ভালোমতো বুঝতে পেরেছে। সে এগিয়ে গেল। রুমে সব মেয়ে বিধায় সে ঢুকলো না। সে দরজায় ঠোকা দিয়ে ডাকলো, “রিহি!”
সাফাত ভেবেছিল এতো আওয়াজের মাঝে কেউ তার ডাকটা শুনবে না কিন্তু না। এতো সব আওয়াজের মাঝে রিহি ঠিকই ভাইয়ের আওয়াজটাকে ধরে নিল। সে মাথা তুলে তাকালো। সবার পিছে দরজার ধারে তার ভাই দাঁড়িয়ে আছে। রিহি দৌড়ে ভাইয়ের কাছে এগিয়ে গেল।
রিহি এগিয়ে গিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো। সাফাতও পরম আদরে বোনকে জড়িয়ে নিল। রিহি ভাইয়ের দিকে মাথা তুলে তাকালো। সে তার সুদর্শন ভাইকে চিনতে পারছে না। এমন অচেনা, অগোছালো হয়ে গিয়েছে তার ভাই!

“ভাই তুই এমন হয়ে গেছিস ক্যান? এই ভাই তোকে চেনা যাচ্ছে না কেন?” বলেই মুখে হাত বুলিয়ে দিল,
“দাঁড়ি রেখেছিস? তুই তো এমন কালো ছিলি না!এতটা পাল্টে গেলি!”
বোনের কথায় সাফাত মলিন হাসলো। সবাই বাইরের চাকচিক্য মলিন দেখেই প্রশ্ন করে অথচ ভেতরেরটা যে ম’রে গেলেও কেউ খেয়ালও করে না!

নিহিলা সবেমাত্র রুমে ঢুকতে নিচ্ছিলো। এমন সময় রিহির এমন কথায় থমকে দাঁড়ালো। সে মূলত রিহির কিছু জুয়েলারী রুম থেকে আনতে গিয়েছিল। নিহিলা সরে দাঁড়ালো যাতে করে ওকে কেউ না দেখে।
রিহির কথায় নিহিলাও সাফাতকে একবার পরখ করে নিল। আসলেই আগের সুদর্শন সাফাত ভাই আর এখনের সাফাত ভাইয়ের বিস্তর পার্থক্য। একান্ত নিজের চেনা পরিচিত না হলে এখন কেউ চিনবে না। দাঁড়িতে ভর্তি, অগোছালো চুল। নিহিলা শার্ট এর দিকে তাকালো। শার্ট এর হাতা একটা উঁচু করে রাখা আরেকটু নিচু। নিহিলা থমকালো। অথচ আগে কত পরিপাটি করে থাকতেন উনি। সবসময় নিজেকে আলাদা করে গুছিয়ে রাখতেন। নিহিলার খারাপ লাগলো এমন কেন হয়েছে উনি! তাহলে কী সাফাত ভাই একটুও ভালো নেই!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলভ্রান্তি ক্ষমার নজরে দেখার অনুরোধ। সর্বোপরি পাশে থাকার জন্য ভালোবাসা নিবেন 🌸)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে