একমুঠো বসন্ত পর্ব-২২

0
560

#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_২২

দুইদিন কেটে গেল। আজ রিনা আহমেদরা আসবেন। যেহেতু আর দুইদিন পরেই বিয়ে সেহেতু তারা সবাই ব্যস্ত। তাই রিনা আহমেদদের নিয়ে আসার দায়িত্ব পড়েছে রিহি আর নিহিলার উপরে। নিহিলা গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকালো। একটু এগিয়ে যেতেই ওদের চোখে পড়লো। ঐতো অদূরে অরিন আহানদের দেখা যাচ্ছে। নিহিলা তাদের আশেপাশে চারদিকে উঁকি দিল কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে দেখতে পেলো না। মনকে এতো বুঝিয়েও শান্ত রাখতে পারছে না। বারেবারে যেকোনো কারণে মন আবার উতলা হয়ে উঠছে।

অরিন আহান এসে দাঁড়ালো। নিহিলা সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করলো। প্রথমবারের মতো নিজের পরিবারের সাথে মিলবেন বলে রিনা আহমেদের মুখের হাসি যেন সরছেই না। তিনি এসেই নিহিলাকে জড়িয়ে নিলেন,
“তোর জন্য আমি আমার সুখ ফিরে পাচ্ছি। তোর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ থাকবো রে মা।”

“উঁহু ফুপি, এমন করে বলিও না।”

রিনা আহমেদের কথার প্রেক্ষিতে অরিন আহানও তাল মিলালো,”আসলেই, তোমার জন্যই আমরা আমাদের এই পরিবারকে চোখের দেখা দেখবো। ”

আহানও তাল মিলালো,
“আসলেই, আই থিঙ্ক এই দেখাটার মধ্যে শুভ কিছুই হবে।” বলতেই অরিন তার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই আহান চুপ হয়ে গেল।

“বাহ্ রে, আমিও তো খুশি তোমাদের সাথে আবার দেখা হচ্ছে বলে। এইবার আসো গাড়িতে উঠো। বড়ো বাবা অপেক্ষা করছেন।” বলতেই তারা সবাই গাড়িতে উঠে পড়তেই নিহিলাও উঠতে নিল। সে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে ঢুকার আগেও পেছনে আরেকবার তাকালো। তার মনে হচ্ছে মানুষটা আসবে। এসেই রিনা আহমেদের দিকে তাকাবে,
রিনা আহমেদ জিজ্ঞেস করবেন, “কিরে তোর এতক্ষন লাগলো ক্যান?”
জবাবে মানুষটা শীতল কণ্ঠে জানাবে, “এইতো সবকিছু সেটিং করতে আটকে পড়েছিলাম।”
অরিনের ডাকে নিহিলা ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। আসার পরে থেকে নিহিলার এভাবে আশেপাশে তাকানো দেখে অরিন আহান দুজনেই কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে।

“কিরে গাড়িতে উঠে পর?”

“হ্যাঁ” সূচক মাথা নেড়েই নিহিলা গাড়িতে উঠে বসলো। তার মন হুট্ করে কেন জানি খারাপ হয়ে গেল। অথচ তার আরো খুশি হওয়ার কথা কিন্তু সে খুশি হতে পারছে না কেন!

বাড়িতে এসে রিনা আহমেদ আমান শেখকে সালাম করতেই তিনি বোনকে জড়িয়ে নিয়ে কেঁদে দিলেন। কেউ এটা কল্পনাও করেনি। রিনা আহমেদ নিজেও করেননি। এরপর আমান শেখ অরিন-আহান দুজনকেই কাছে টেনে নিলেন। এতক্ষনে নিহিলার কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নটি আমান শেখ করলো,
“তোর বড়ো ছেলে কই?”

“ভাইজান, ওর কাজ আছে তাই ফ্লাইট একসাথে পড়েনি।”

“দুইদিন পরে হলেও আসতে বল।”

“জি ভাইজান।”
—–

নিহিলা হলুদ সবুজ মিশ্রনের শাড়ি পড়েছে। যতই অন্য রঙগুলো সুন্দর লাগুক গায়ে হলুদের জন্য এই রঙগুলোই মানানসই লাগে। অরিনকেও পড়িয়ে দিয়েচ্ছে। ও শুধু ঘুরে ফিরে নিজেকেই দেখছে কারণ প্রথমবারের মতো শাড়ি পড়া। রিহিকে সবাই হলুদ লাগাচ্ছে।

নিহিলা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ডালা নিয়ে যাওয়ার সময় রিনা আহমেদ ডাক দিলেন।

“নিহি, ডালাটা আমাকে দেয়। তুই এই কফিটা একটু রাহানকে দিয়ে আয় তো মা। আমাকে ভাইজান ডাকছে।”

নিহিলা কফির কাপটা নিল। তার ইচ্ছে করছে না বারবার ঐ মানুষটার সামনে পড়তে, অবশ্য আসার পরে থেকে আরেকবারও দেখা হয়নি। নিহিলা সামনে যায়নি, এখন কফির কাপটা দিতে গিয়ে যদি দেখা হয়ে যায়! কিন্তু মুখের উপর জবাব দেওয়া অভদ্রতা। সেজন্যই নিহিলা কাপটি অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতে নিল। রাহান ভাই দুপুরের পরপরই এসেছিলেন। উনিও আর রুম থেকে বের হয়নি বিধায় নিহিলার অস্বস্তি কম লেগেছে কিন্তু এক মনে অস্বস্তি কমলেও আরেকমনে উনি কী করছেন সেটাই দেখতে ইচ্ছে করে।
পাশ দিয়েই অরিন মোবাইল কানে দিয়ে যেতেই নিহিলা ডাক দিল।

“অরিন এটা তোর বড়ো ভাইয়ের জন্য। দিয়ে আয়।”

“ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। তোর জন্য তো ঐ রুম নিষিদ্ধ না। তুই যা।” বলেই সে সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল। রিহির বিয়ের সব আয়োজন ছাদে হচ্ছে বিধায় মানুষজন তেমন একটা নেই।
নিহিলা এগিয়ে গেল। দেরি করলে চলবে না। তার উপরে যাওয়া লাগবে। সে রাহানের রুমের দরজার ফাঁক দিয়ে একটু দেখার চেষ্টা করলো। না দরজা বন্ধ। সেইবার যে কথা হলো এরপর এই প্রথম দেখবে। কিন্তু মনে ভীষণ অস্তিরতা ঘিরে ধরছে। মনে হচ্ছে যেন কতগুলো মাস মানুষটাকে দেখেনি!নিহিলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। পরক্ষনেই নিজেকে সামাল দিল। সে কেন এতো আড়স্থ হচ্ছে! এখন কী করবে! ঠোকা দিবে না-কি ডাকবে?

সে ঠোকা দিল। পরপর দুইবার ঠোকা দিতেই নিহিলার মুখশ্রী তেতো হয়ে গেল।

রাহান দরজা খুলেই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আবারো লেপটপ দেখার স্থানে বসে পড়লো।
তা দেখে কফির কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিহি গুটিয়ে গেল। মানুষটা এতগুলো দিন পরেও দেখে এমন ভাব করছে যে প্রতিদিনই দেখা হয়। নিহিলা তাকালো, তার এমন ভাব দেখে মনে হচ্ছে নিহিলার এখানে আসা স্বাভাবিক।
“আপনার কফি।” রাহান এক পলক কফির দিকে তাকিয়ে লেপটপের স্ক্রিনে দৃষ্টি দিল।
“আমি ধোয়া উঠা ছাড়া খাই না। তুমি অলরেডি ঠান্ডা করে ফেলেছো। আবার বানিয়ে নিয়ে এসো।” বলেই রাহান নিজের কাজ করতে লাগলো।
নিহিলা রাগী দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করে রাগী স্বরে কিছু বলতে নিবে সেসময় রাহান একবার মুখ তুলে তাকালো। তা দেখে নিহিলা মুহূর্তর মধ্যে বোকা বোকা চাহনীতে হাসার চেষ্টা করলো,
“আসলে শাড়ি পড়ে এতসব! উপরে ওরা ডাকবে আমাকে।”

“তো পড়েছো কেন?”

“মানে? আমার বোনের বিয়ে আর আমি শাড়ি পড়বো না?”

“বারণ করেছে কে!”

নিহিলা বিরক্ত হলো।
“আশ্চর্য তো! এই কফি বানানোর দায়িত্ব আমার না।”

নিহিলার কথায় রাহান ভ্রু কুঁচকে গম্ভীরস্বরে বলল,
“আমি নাহয় অতিথিদের সাথে খারাপ ব্যবহার করি কিন্তু তোমরাও এমন কিছু করো জানা ছিল না।”

নিহিলা মুহূর্তের মধ্যে শান্ত হয়ে গেল। আসলেই তো তাদের বাড়িতে অতিথি এসেছে সে কীভাবে সামান্য কফির জন্য এভাবে ব্যবহার করছে!
নিহিলা পিছু ফিরে গেল। তা দেখে রাহানের ঠোঁটের কোনা প্রশস্ত হলো।

বেশ কিছু সময় পরে নিহিলা ধোয়া উঠা কফি নিয়ে ফিরে এলো। সে এসে দাঁড়াতেই রাহান ঐভাবেই আগের ন্যায় কাজ করতে লাগলো।
তা দেখে নিহিলা এগিয়ে রাহানের সামনের টেবিলটাতে কফি রেখে দিতে যেতেই রাহান গম্ভীর কণ্ঠে শুধলো,

“তোমাকে রাখতে বলছি?”

নিহিলার এবার রাগ চড়ে গেল। সে বেশ রাগী কণ্ঠে শুধালো,

“আমি কী এখানে পড়ে থাকবো?” বলেই নিজে নিজের জিব্বায় কামড় দিল। কী বলে ফেলেছে সে এটা!

রাহান লেপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। সে সোজা কাপড়ের ট্রলির কাছে এগিয়ে গিয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে পা বাড়াতে গিয়ে থেমে পিছু ফিরে নিহিলার দিকে তাকালো,

“এখন তো আছোই। তোমাদের বাড়ি তুমি চাইলে এভাবে থাকতে পারো। মাইন্ড করবো না।”

রাহান ওয়াশরুমে ঢুকতেই নিহিলা কফির কাপ ঐভাবেই রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মানুষটার এমন অদ্ভুত কর্মকান্ড তার মাঝে মাঝে সহ্য হয় না। এই যেমন এখন হচ্ছে না। এটা ভাবতেই মুহূর্তের মধ্যেই নিহিলার মনে জবাব দিয়ে দিল, এই বিরক্তের গম্ভীর স্বভাবটাই তো তার ভালো লাগার কারণ কিন্তু সামনে থাকলে এমন অস্তিরতা ঘিরে ধরে কেন! বোধহয় প্রথমদিনের সেই ভয়টা রয়ে গেছে। এতকিছুর পরেও এতো ভালো লাগার কারণ সে খুঁজে পায় না! এতদিন মন নির্জীব ছিল অথচ এখন সেই নির্জীব ভাবটা আর নেই। তাহলে কী তার সব সজীবতা এই মানুষটার মাঝেই! এটা ভাবতেই সে নিজেকে সামাল দিল। বারবারে এমন ভাবনা তার মানাই না। এসব কিছুই হবে না। তার নিজেকে শক্ত করা উচিত।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে