একদিন কাঁদবে তুমিও পর্ব-০১

0
1276

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_১
#Saji_Afroz

আজরার হবু বরের ছবি দেখে চমকে উঠলো তার বান্ধবী মানতাশা। বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলল, আরে! উনাকে তো আমি চিনি।

আজরা ভ্রু কুচকে বলল, তাই না কি?
-হু। কেন তুই চিনতে পারছিস না?

কিছুটা অবাক হয়ে আজরা বলল-
চেনার মতো কেউ না কি?
-হু। নাবীহার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল এই ফ্যামিলির ছেলে। নাবীহার কাছেই ছবি দেখেছিলাম। তোকে দেখায়নি?
-বলেছিল একজনের কথা। কিন্তু কেন যেন ছবি দেখা হয়নি আমার। সেই ইনতিসার কী এই ইনতিসার?
-জি ম্যাডাম। ছেলে তো নাবীহার ছবি দেখে তাকে বেশ পছন্দ করেছিল। নাবীহার এখন বিয়ে করার ইচ্ছে নেই বলে আগ্রহ দেখায়নি। তাছাড়া তার না কি ব্যবসায়ী পছন্দ নয়।
-ও আচ্ছা।
-ও আচ্ছা? নাবীহা প্রত্যাখ্যান করেছে এমন ছেলেকে তুই বিয়ে করবি?
-সে খারাপ বলে না করেছে এমন তো নয়। নাবীহার পছন্দ ভিন্ন৷ তাই করেছে।
-কিন্তু ইনতিসার নাবীহা কে পছন্দ করেছিল। বেশ কয়েকবার প্রস্তাবও না কি পাঠিয়েছে।

এইবার চিন্তার ভাজ পড়লো আজরার কপালে।
সে, নাবীহা ও মানতাশা খুব ভালো বান্ধবী। তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক অনেক দিনের। একে অপরের প্রাণ বলা যায়। তারা একই সাথে অনার্স শেষ করেছে মাত্র।
কিছুদিন যাবত বিয়ের কথা চলছে আজরার।
মা বাবার কথা তে ইনতিসার কে বিয়ে করতে রাজি হয় সে। যদিও তার ইনতিসার কে অপছন্দ এমনটা নয়। বরং তাকে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছে আজরার। তাছাড়া তার সম্পর্কে শুনে মুগ্ধও হয়েছে সে। অল্প বয়সেই বেশ সফলতা লাভ করেছে ইনতিসার। তাছাড়া তাদের পরিবারের সবাইও বেশ মিশুক। ধনী পরিবারের সদস্য হয়েও কোনো অহংকার তাদের মাঝে দেখেনি আজরা।
সবমিলিয়ে নতুন জীবনে পা দেওয়ার জন্যে মনস্থির করেছিল সে। কিন্তু এখন মানতাশার কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়ে আজরা।
ইনতিসার ও নাবীহা মুখোমুখি হলে বিষয়টা কী অন্যরকম হয়ে যাবে?

-এই আজরা? কী ভাবছিস তুই?

মানতাশার ডাকে ঘোর কাটে আজরার।
সে বলল-
ও কিছু না।
-তুই নাবীহা কে ইনতিসারের ছবি দেখাসনি?
-নাহ। ও চাকরি খোঁজা ও টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত জানিসই তো। তাই গত একমাস ধরে কথা কম হয়েছে। আমি তো আর হুটহাট তোর মতো বেরও হতে পারি না। তাই দেখাও হয়নি। তবে ফোনে বলেছিলাম বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা।
-ও শুনে মজা পাবে, ওর প্রত্যাখ্যান করা পাত্র কে তুই বিয়ে করছিস শুনে।

এই বলে হেসে উঠে মানতাশা। আজরা কে নিশ্চুপ দেখে মানতাশা বলল, তোর জায়গায় আমি হলে বিয়েটা করতাম না কখনো। আত্মসম্মান বলতেও কিছু রয়েছে।

-কী হয়েছে?

আজরার মা আজিজা বানুর উপস্থিতি দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো মানতাশা। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল, আমি আসি রে। কাজ আছে আমার।

আজরা তাকে কিছু বলতে চাইলেও শুনলো না সে। দ্রুত প্রস্থান নেয় সেখান থেকে। আজিজা বানুর কটু কথা শোনার চেয়ে চলে যাওয়াই শ্রেয়। উনি যে মানতাশা কে খুব একটা পছন্দ করে না, এটা সে জানে। তার উপর এসব বলছে শুনলে নিশ্চয় কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দেবেন।

সে যেতেই আজিজা বানু বললেন, কী কুপরামর্শ দিচ্ছে তোকে এই মেয়ে?

মুখটা মলীন করে আজরা বলল, নাবীহার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল ইনতিসারের পরিবার। ইনতিসারও না কি তার ছবি দেখে পছন্দ করেছিল। তাই ও বলছে এই বিয়েটা করা আমার ঠিক হবে কি না?

আজরার দুই বান্ধবীর মাঝে মানতাশা কে একদমই পছন্দ নয় আজিজা বানুর। তার স্বভাব আজরা ও নাবীহার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। চঞ্চল একটা মেয়ে সে। চালচলন কথাবার্তা বেশ স্মার্ট। দেখতেও ভারী সুন্দর। কিন্তু স্বভাবটা কেমন যেন। জিন্স, টি-শার্ট, টপস পরে ঘুরে বেড়ায়। কথা বলার সময় কোনো হুশ জ্ঞান থাকে না। ভালো-মন্দ বিচার বিবেচনা করার বোধ নেই। মনে যা আসে তাই করে থাকে।
মেয়ে মানুষের এমন চঞ্চলতা আজিজা বানুর পছন্দ নয়।
এই যে এখন, আজরার মনে এসব না ঢুকালেও সে পারতো। কী দরকার ছিল মেয়েটা কে চিন্তিত করার? বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছে তার! মানতাশার জায়গায় নাবীহা থাকলে নিশ্চয় এমন করতো না।

আজিজা বানু বললেন, তাতে কী হয়েছে? ওদের কী প্রেম ছিল?
-তা নয়!
-তবে? বিয়ের জন্য পাত্রী দেখবেই। এটা স্বাভাবিক।
-কিন্তু…

তাকে থামিয়ে আজিজা বানু বললেন, তুই বরং নাবীহার সাথেই এই বিষয়ে কথা বল। ওর ভাষ্য কী শোন।

নাবীহার উপরে আস্থা আজিজা বানুর আছে। আর সেইজন্যই তাকে নাবীহার সাথে কথা বলতে বলা হয়েছে। ওর সাথে কথা বললে মেয়েটার অশান্ত মন শান্ত হবে শতভাগ নিশ্চিত তিনি।
.
.
.
আজকে দুপুরের দিকে গরমের মাত্রা ছিল অনেক বেশি। যদিও এখন গরমের তেজটা কমে এসেছে। সূর্যটা এখন আর মাথার উপরে নেই। একটু একটু করে হেলে পড়তে শুরু করেছে পশ্চিমে।

টিউশনি পড়িয়ে বাসার দিকে রওনা হচ্ছে নাবীহা।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে সে। টিউশনি করিয়ে নিজের হাত খরচ সহ ছোটো ভাইটার পড়াশোনার খরচ তাকে চালাতে হয়। বাবা নামক মানুষটার উপরে তো এত চাপ দিতে পারে না। একজন মানুষ কত দিকই বা সামলাবেন! সবেমাত্র বড়ো বোনের বিয়ে দিয়েছেন। আর এই দেশে মেয়ে বিয়ে দেওয়া মানে নিজেদের জমা জাটি সব উজাড় করতে হবে। যতক্ষণ উজাড় করা যাবে,ততক্ষণই সব ভালো।
এই তো তার বোনের বিয়ের সময়, বর কে স্বর্ণের চেইন দিয়েছে তাতে তাদের মন ভরেনি। বরের বোনের স্বামীদেরও চেইন দিতে হবে জানিয়েছে।
বাবার সামর্থ্য অনুযায়ী হাতের আংটি দিয়েছিল। তাতে হয়নি তাদের! কটু কথা শুনিয়েছিল তার বাবা কে।
অবশ্য সবাই এক না। কিন্তু ভালো মানুষও সহজে পাওয়া মুশকিল।
.
.
.
অফিস থেকে বাসায় যাচ্ছে ইনতিসার। মা কোনো কাজে তাড়া দিয়েছে তাকে। পথিমধ্যে হঠাৎ তার গাড়ি থেমে যায়। ড্রাইভার কে কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, দেখতে হবে স্যার।

ড্রাইভার একটু পর ফিরে এসে বলল, গাড়িতে সমস্যা হইছে। আপনাকে কষ্ট করে অন্য গাড়িতে বাড়ি যেতে হবে।

ইনতিসার বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলল না। গাড়ি থেকে নেমে পড়লো সে।
যদিও বাসার অনেকটা কাছাকাছিই চলে এসেছে। ড্রাইভার বলল, গাড়ি ঠিক করে দেই আপনাকে?
-একটা রিকশা ঠিক করো।

রিকশার কথা শুনে তার দিকে অবাক হয়ে তাকায় ড্রাইভার। কেননা কখনো তাকে কার ছাড়া চলাচল করতে সে দেখেনি৷
ইনতিসার কিঞ্চিৎ ধমকের সুরে বলল, দাঁড়িয়ে না থেকে রিকশা ঠিক করো।

ছাত্র জীবন শেষ হওয়ার পর শেষ কবে রিকশায় বসেছিল মনেই পড়ে না ইনতিসারের। আজ অনেক দিন পর রিকশায় উঠার ইচ্ছে হলো তার। নিঃসন্দেহে রিকশায় চড়ার মজা আলাদা।
রিকশায় যেভাবে চারপাশে খোলামেলা থাকে আর সবদিকে দেখতে দেখতে যাওয়া যায়, অন্য কোনো যানবাহনে সেই ব্যাপারটা নেই। তাছাড়া প্রাকৃতিক বাতাস একদম সরাসরি পাওয়া যায় আর আকাশটাও খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়। অনেকদিন পর আবার এসব অনুভব করতে চলেছে ইনতিসার। তবে হ্যাঁ, বিয়ের পর মাঝেমধ্যেই বউ কে নিয়ে রিকশায় ঘুরবে সে। শুনেছে রিকশায় বসে প্রেম করার মজাই আলাদা!

-আপা, আমিই আগে ডাকছি এই মামা রে। মামার থেকেই জেনে নেন।

ড্রাইভারের আওয়াজ শুনে সেদিকে এগিয়ে যায় ইনতিসার। দেখলো, কোনো মেয়ের সাথে কথা বলছে সে। মেয়েটিও তাকে বলছে, আমি অনেক দূর থেকেই এই মামা কে ডেকেছি।

ইনতিসার তাদের কথার মাঝে বলল, কোনো সমস্যা?

মেয়েটি পেছনে ফিরতেই তাকে দেখে চমকালো ইনতিসার৷ মেয়েটিও অবাক চোখে তাকালো তার দিকে। কারণ মেয়েটি আর কেউ নয়, সে নাবীহা। টিউশনি পড়িয়ে বাসায় যাওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছিল সে। একটা পেয়ে কাছে ডেকেছিল। কিন্তু তার কাছে আসার আগেই ইনতিসারের ড্রাইভার তাকে আঁটকায়। আশেপাশে আর রিকশা না দেখে নাবীহাও ছুটে আসে। তার তাড়াতাড়ি বাসায় যাওয়া প্রয়োজন। মেহমান আসবে বাসায়। কিন্তু এই রিকশার চক্করে পড়ে যে ইনতিসারের সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবেনি সে। যদিও তাকে কখনো সরাসরি দেখেনি নাবীহা। কিন্তু ছবিতে দেখার কারণে চিনেছে সহজেই।
নাবীহা বুঝতে পারছে না, তাকে ইনতিসার চিনেছে কি না। সে বুঝতে চায়ও না। তাড়াহুড়ো করে বলল সে, আপনারাই চলে যান।

এই বলে সে চলে যেতে চাইলে তাকে আঁটকালো ইনতিসার। ইনতিসার বলল, আপনিই যান৷ আমার তাড়া নেই।
-সমস্যা নেই। আপনি যান।

রিকশাওয়ালা বলল-
কেউ কী যাইবেন? না কি আমিই চইল্লা যামু?

ইনতিসার বলল, ম্যাডাম যাচ্ছেন।
নাবীহা বলল, শিওর? আপনার সমস্যা হবে না তো?
-নাহ।

আর কথা না বাড়িয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিকশায় উঠে পড়লো নাবীহা।
ইনতিসার বলল, আপনি চিনেছেন আমায়?

হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নাড়লো নাবীহা।

আর কোনো কথা বলার সুযোগ রিকশাওয়ালা দিলো না। সে রিকশা চালাতে শুরু করে।
ইনতিসার কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। তাকিয়ে থাকলো সে চলন্ত রিকশাটির দিকে।

নাবীহার ছবি দেখেই ভালো লেগেছিল তার। আজ সরাসরি দেখে ভালো লাগাটা আরও বেড়ে গেল। কিছু দিন পর তার বিয়ে। মনে হচ্ছে বিয়ের কনে নাবীহা হলে জীবন পরিপূর্ণ হয়ে যেত। সে বুঝতে পারছে, এই মুহুর্তে এসব ভাবা তার উচিত হচ্ছে না। কিন্তু নাবীহা কে দেখার পর যে তার শান্ত মনটা অশান্ত হয়ে গেল!
.
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে