একদিন কাঁদবে তুমিও পর্ব-৫৫+৫৬+৫৭

0
615

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫৫
#Saji_Afroz

সারাটা দিন অস্থিরতায় কাটলো নাবীহার। কী ভেবেছিল আর কী হলো! ইলারা জামানের নামে যে সবকিছু রয়েছে এই নিয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না তার। ইনতিসার! সে তো সব জানতো। তারপরেও এসব করার সাহস কিভাবে করলো সে! অন্তত মা বাবাকে রাজি করিয়ে এই বিষয়ে তার আগানো উচিত ছিল।
এমনটা করেনি বলে সবটা হাত ছাড়া হলো।
নাবীহার কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। সে বাইরে বেরুবে ঠিক করলো। এতে যদি খানিকটা অস্থিরতা কমে!

তৈরী হয়ে বেরুচ্ছে নাবীহা। তাকে থামিয়ে নায়লা খাতুন বললেন, কিছু ভাবলি?
-কী বিষয়ে?
-সংসার কিভাবে চলবে ভেবে দেখেছিস? ইনতিসারের টাকাও শোধ করতে হবে।
-ওর টাকা শোধের গুষ্টি উদ্ধার করব! আমাকে ঠকিয়েছে তাতেই শোধ হয়ে গেছে। আর আজকেই আমার স্বপ্ন ভাঙলো সে চিন্তা তোমার নেই।
-সেসব চিন্তা আমি করতেও চাইনা। বরং আজ তোর মুখে এটা শুনে ভালো লেগেছে যে, ইনতিসারের সঙ্গে বিয়েটা তোর হয়নি।

নাবীহা কিছু না বলে বেরুলো। গন্তব্য কোথায় জানা নেই। হেঁটে চলেছে সে। হঠাৎ একদল ছেলে তার পথ আঁটকায়। তার কালিমাখানো মুখের ছবি দেখিয়ে হাসি তামাশা করতে থাকে। নাবীহা রাগান্বিত হলে তাকে ঘেরাও করে ফেলে তারা। একজন তার উড়না ধরে টান দেয়। নাবীহা চ্যাঁচিয়ে উঠে। হঠাৎ আজরার কণ্ঠস্বর শুনে পেছনে ফিরে তাকায় নাবীহা। তার সঙ্গে রয়েছে সাদ।
সাদ ছেলে গুলোকে সামাল দেয়। এদিকে মাটিতে থাকা ওড়নাটা নিয়ে নাবীহার গায়ে জড়িয়ে দিলো আজরা। নাবীহা বলল, জিতে গেলি তাইনা?
-আমারই জেতার কথা ছিল। যদিও খেলা তুই শুরু করেছিস। তা হেরে কেমন বোধ করছিস?

এই যেন অন্য এক আজরাকে দেখছে নাবীহা। কত সহজেই কঠিন কথাগুলো হড়বড়িয়ে বলে ফেললো সে!

ওড়না ঠিক করতে করতে নাবীহা বলল, খেলা আমি নই। তুই শুরু করেছিস।

আজরা অবাক হয়ে বলল, আমি!
-হু তুই!

বখাটেরা চলে গেলে সাদও এগিয়ে এল এক বোতল পানি নিয়ে। নাবীহার দিকে এগিয়ে দেয় সে। নাবীহা পান করে চলে যেতে চাইলে তার পথ আঁটকায় আজরা। সে বলল, সেদিনও কথা অসম্পূর্ণ থেকে যায়! আজ বল কেন আমার সাথে এমন করেছিস তুই?
-কেন করব না? জীবনে কী পেয়েছি আমি! দু:খ আর দু:খ। আমার জীবনের শুরু থেকেই ভেবে দেখ না তুই! পরিবার হারানো এক মেয়ে আমি। ভালোবাসাও হারালাম। অভাবের তাড়নায় দিন যাবন করতাম।
-এসবের জন্যে আমার সংসার নষ্ট করবি তুই?
-হ্যাঁ করেছি। কারণ ইনতিসার তার প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য পাগল করে ফেলছিল আমায়।
-আমাকে জানাতে পারতি একটাবার! সবটা ঠিক করে নিতাম।
-আমি সেটা চাইনি।
-কিন্তু কেন! আমি তো সেটাই জানতে চাই।
-কারণ তুই দুমুখো আচরণ করেছিস আমার সঙ্গে।
-কী?
-মানতাশাকে আমার নামে আজেবাজে কথা বলেছিস তুই। অথচ আমি তোর ঘর চাইলে অনেক আগেই ভাঙতে পারতাম। তারপরেও বলেছিস আমি তোদের হিংসা করি! একবার নয়, পরপর দু’বার আমি নিজ কানে একথা শুনি। জানিনা আরও কতবার কত কী বলেছিস!

এইবার সবটা স্পষ্ট হয় আজরার কাছে। নাবীহার এসব করার কারণ যে এটা তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না।
নাবীহা বলল, করিসনি তুই এসব?

আজরা মাথায় হাত দিয়ে বলল-
করেছি। কেন করেছি জানিস? আরে আমি মানতাশাকে ওর ভাষা দিয়েই বোঝানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিলাম। আমার মনে তোকে নিয়ে এমন কোনো ধারণাই নেই। মানতাশা যেন তার সংসারে ফিরে যায় এইজন্যই এসব বলা। কারণ সে বারবার তোর কথা আমাকে বলছিল। আর এইজন্যই আমি ওসব বলেছি। যাতে করে সে তোর কথা বাদ দিয়ে আমার কথা শোনে। ওর সংসার বাঁচানোর জন্য এসব করেছি আমি। তুই একটা বার তো আমাকে সত্যিটা কী তা জিজ্ঞাসা করতে পারতি!

এসব শুনে চারপাশ যেন অন্ধকার দেখছে নাবীহা। কী শোনালো তাকে আজরা!
সাদ বলল-
একটা কথা শুনে সোজা বান্ধবীর স্বামীকে বিয়ে করে নিলেন। কেন সে এটা করলো জানার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করলেন না। এই ছিল আপনাদের বন্ধুত্ব!

আজরা ভাঙা গলায় বলল-
ইনতিসার আমার জীবনে পরে এসেছে। আগে এসেছিস তুই। সেই তুই কিভাবে আমাকে এত কষ্ট দিলি রে! আমি প্রেগন্যান্ট জেনেও কোনো সহানুভূতি তুই দেখাসনি। এতটা কঠোর কিভাবে হলি নাবীহা?

এই বলে আজরা কেঁদে ফেলে। সাদ ব্যস্ত হয়ে বলল, এই সময়ে কান্না করা একেবারেই উচিত নয়। প্লিজ চলুন আপনি।

আজরা চলে যেতে চেয়েও থামলো। নাবীহার দিকে তাকিয়ে বলল সে, আমার একটা কড়া কথাতে অতীতের সবকিছু সহজে ভুলে গেলি তুই! একটা সুখের জীবন তো তোকে আমিও দিয়েছিলাম। তখন আমি না চাইলে ইনতিসার কী তার কোম্পানিতে তোকে জব দিতো? আমার ভালো মানুষিকতার সুযোগ নিয়েছিস তুই। এত সহজে তুই ভালো থাকবি না।

এই বলে আজরা গাড়িতে উঠে বসে। নাবীহা নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। এ কী করে ফেললো সে রাগের মাথায়! আসলেই তো! সে চাইলেই আজরার সঙ্গে কথা বলে সব খোলাসা করতে পারতো। এমনটা না করে সে কী না আজরার সংসারটাই ভেঙে দিলো! এতটা জঘন্য সে কবে থেকে হলো!
আর কোথাও যাওয়া হলো না নাবীহার। বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলো সে। পথিমধ্যে একটি মেয়ের সাথে ধাক্কা লাগে তার। মেয়েটি তাকে দু:খিত বলতে গিয়ে থেমে গেল। তাকে দেখে বলল, আপনি নাবীহা?

হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নাড়ে নাবীহা। সে আনন্দিত হয়ে বলল, আপনাকে দেখার অনেক ইচ্ছে ছিল আমার। সরাসরি দেখে ফেললাম!

নাবীহা কিছু বুঝতে না পেরে তার দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এদিকে মেয়েটি পেছনে ফিরে কাউকে ডাক দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি এদিকে আসো না!

একটি সুদর্শন পুরুষ এগিয়ে আসলো। যাকে চিনতে ভুল হলো না নাবীহার।

ছেলেটির নাম আফতাব। যে কিনা বিশাল ব্যবসায়ীর মালিকের ছেলে। বাবার ব্যবসা সেই সামলাচ্ছে। ইনতিসারের অফিসে ব্যবসায়ীক কাজে এসেছিল একবার। কিন্তু তার বোন কেন নাবীহার সঙ্গে এভাবে কথা বলছে!
মেয়েটি অর্থ্যাৎ মিতালি বলল, দেখো ভাইয়া! নাবীহা আপুকে পেয়েছি।

আফতাব নাবীহার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল, ওকে পেয়ে আর কাজ নেই।
মিতালি অবাক হয়ে বলল, কেন?
-যে মেয়েটিকে পছন্দ করেছিলাম সে যে এমন জঘন্য জানা ছিল না। তোদের বলা হয়নি, এই মেয়ে বান্ধবীর সংসার ভেঙে নিজের সংসার গড়েছে। ইনতিসারকে বিয়ে করেছে সে।

মিতালি বলল, কীসব বলছ!
-হু। আয় তো এখান থেকে।

এই বলে আফতাব গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। নাবীহাকে নিশ্চুপ দেখে মিতালি বলল, ইনতিসার ভাই এর অফিসে নাকি আপনাকে দেখেছিল আমার ভাই। আপনাকে নিয়ে ও কাজ সম্পর্কে শুনে মুগ্ধ হয়ে আমাদের জানায় আপনার কথা। মা রাজিও হোন। কিন্তু বাবা বিদেশে থাকায় বিয়ের প্রস্তাবটা পাঠাতে পারিনি। ভাগ্যিস তাড়াহুড়ো করিনি! নাহলে পস্তাতে হত।

এই বলে মিতালিও চলে যায়। নাবীহা ঘরে এসে কাঁদতে শুরু করে। নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারলো সে। এ কী করে ফেললো! নিজের সাথে সাথে আজরার ভবিষ্যৎও অন্ধকার করে দিলো।
আজ আজরার সঙ্গে এমন না করলে আফতাবের মতন ধনী ঘরের বউ হত সে। সবই তার কর্মের ফল! এইজন্যই তো ঘরের বাইরেও বেরুতে পারছে না সে। সবার মুখে মুখে একটাই কথা, আর তা হলো নাবীহা অন্যের সংসার নষ্ট করেছে। এই সমাজের কেউই তাকে আর ভালো চোখে দেখে না। এসবের পরোয়া করে শুধুমাত্র ইনতিসারের সম্পদের জন্য সে এসব করেছিল। ভেবেছিল জীবনে টাকা থাকলে অন্যকিছুর পরোয়া করা কী প্রয়োজন! আজ কিছুই নেই তার। যার থেকে ভুল বুঝে সব ছিনিয়ে নিয়েছিল সব তারই আছে। প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে এতবড়ো অন্যায় কিভাবে করতে পারলো সে!

-ইনতিসার ভাই এসেছে।

জহিরের কথা শুনে চোখের পানি মুছে নিলো নাবীহা। সে জহিরকে বলল, তাকে আসতে দিলি কেন?

জহির মাথা নিচু করে রাখলো। নাবীহা ড্রয়িংরুমে আসলে ইনতিসার উঠে দাঁড়ায়। সে বলল, আমি জানি তোমার রাগ করাটা স্বাভাবিক। যা মিথ্যে বলেছিলাম সবটাই তো তোমাকে পেতে। আমরা দু’জনে মিলে আবার গড়ে নেব সবটা। প্লিজ রাজি হয়ে যাও!

নাবীহা দীর্ঘ একটা নি:শ্বাস ফেলে বলল, আমি আপনার সাথে যা করেছি সবটাই নিজের ভাগ্য আর আজরার উপরে রাগ করে। আমি তো আপনাকে ভালোই বাসিনা। তবুও আমার পেছনে কেন ছুটছেন?

ইনতিসার বলল, কিন্তু আমি তো ভালোবাসি তোমাকে!

ইনতিসারের কাছে এসে নাবীহা বলল-
আপনার বিয়ের প্রস্তাব আমার জন্য প্রথমে এসেছিল। একথা আজরা জানতো। কখনো বলেছিল আপনাকে?

ইনতিসার একথা শুনে অবাক হয়ে তাকায় নাবীহার দিকে। সে বলল, না বলেনি।
-কেন জানেন? এটা আজরা জানে তা জেনে আপনি যদি হীনমন্যতায় ভোগেন এই ভেবে আজরা কখনো আপনাকে জানতে দেয়নি। ও আপনাকে অনেক ভালোবাসে। আর আমি ভালোবেসেছি আপনার সম্পদকে। এরপরেও আপনি আমাকে চান? যদি চান তো আমি দু:খিত। আমি আপনাকে আর চাইনা। কেননা আপনার কিছুই নেই এখন। তবে আমি কেন আপনার কাছে যাব বলতে পারেন?
-তোমার কাছে এসব সম্পদই সব?
-আপনার কাছেও তো ভালোবাসা মূল্যহীন।

নিশ্চুপ হয়ে যায় ইনতিসার। নাবীহা বলল, সময় থাকতে নিজের ভুলটা বুঝতে শিখুন।

এই বলে নাবীহা ভেতরে চলে যায়। মেঝেতে বসে নিজের অপকর্মের কথা ভেবে কাঁদতে থাকলো সে। কী হয়েছিল তার! মানুষ ঠিকই বলে! স্বভাব তো তারই নষ্ট হবে, যার ঘরে রয়েছে অভাব!
.
চলবে

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫৬
#Saji_Afroz

কিছুদিন কেটে গেলেও ইনতিসার নিজ বাড়ি যায় না। এখনো নাবীহাতেই আঁটকে আছে সে। কখন এতটা ভালো সে নাবীহাকে বেসেছে নিজেরই জানা নেই! মোটামোটি মানের হোটেলে থেকে দিন পার করছে ইনতিসার। ভবিষ্যতের চিন্তা বলতে শুধু নাবীহাকে কিভাবে পাওয়া যায় এই নিয়েই ভাবছে। আজ খুব করে মনে পড়ছে তার নাবীহার কথা। মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে ইনতিসারের। জ্বর এসেছে তার। এই অবস্থায় নাবীহার কাছে গেলে নিশ্চয় তাকে ফিরিয়ে দেবে না। এই ভেবে নাবীহার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরুলো ইনতিসার।

এদিকে নাবীহা আবারও কাজের সন্ধানে লেগে পড়ে। ইন্টারভিউ দিতে শুরু করেছে সে। জানেনা কতদিনে একটা ভালো চাকরি পাবে।
আজও এক ইন্টারভিউ শেষে বাড়ি ফিরছে নাবীহা। হঠাৎ কারো কথা শুনে থামতে হলো তাকে। এক দোকানদার তাকে দেখে বলছে, রাজের হালে আছিলো তখন গাড়িতে চলছে। আর এখন দেখো! অর্ধেক পথ রিকশা আর বাকিপথ হাঁটা লাগে। মানুষের স্বভাবই খারাপ। নাহলে যে থালায় খায় সেই থালায় কী কেউ ছিদ্র করে! শালার আমরাই ভালো মানুষ হয়ে রয়ে গেলাম।
সবটা শুনে চুপ করে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলো নাবীহা। আর সেখানে বসে থাকতে দেখলো প্রতিবেশিনী সালেহা রহমানকে। নাবীহাকে দেখে সব কটা দাঁত বের করে হেসে সে কেমন আছে জানতে চায়। “ভালো” বলে নাবীহা নিজের রুমে যায়।
ভেতর থেকেই তার ও মা এর কথোপকথন কানে আসে নাবীহার।
-তোমার মেয়ে নাকি ওই ছেলের সঙ্গে আর থাকছে না?

নায়লা খাতুন এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি আমতাআমতা করে বললেন, জি। ঠিকই শুনেছেন।
-তা ডিভোর্স হয়ে গেছে ওদের? আসলে ভালো একটা প্রস্তাব ছিল আমার হাতে।

সে কথার জবাব না দিয়ে নায়লা খাতুন বললেন, কার জন্য প্রস্তাব আনলে?
-তুমি চেনো। আজিম আলম আছেনা? সে তো আবার বিয়ে সাদি করতে চায়। আমি নাবীহার কথা বলেছিলাম। সব শুনেও রাজি সে। তারও কী টাকাপয়সা কম আছে! শুধু সন্তানের জন্য একটা মা দরকার।

নায়লা খাতুন বিরক্ত হয়ে বললেন, তার বয়সের সাথে নাবীহার বয়স মিলে? তার বাচ্চারাও বড়ো হয়ে গেছে।

সালেহা রহমান বললেন, তোমার মেয়ের তো টাকা দরকার। তাই না বান্ধবীর জামাইকে বিয়ে করেছিল! আজিম আলমেরও অনেক টাকা। আমি ভাবলাম এটা শুনেই নাবীহা রাজি হবে।

নায়লা খাতুন বললেন-
নাবীহা কাউকে বিয়ে করেনি। ওসব দূর্ঘটনা ছিল।

একগাল হেসে তিনি বললেন, ঘটনা ঘটিয়ে দূর্ঘটনা বলে চাপিয়ে দিতে চাইছ নাকি?

নায়লা খাতুন বললেন, আচ্ছা তুমি আসো এখন। আমার কাজ আছে। বাইরে যেতে হবে।
-আজিমের ব্যাপারে ভাববে নাকি?
-নাহ!
-আজকাল কারো ভালো করতে নেই বাপু! এই মেয়েকে কে বিয়ে করবে দেখে নেব।

এই বলে সালেহা রহমান চলে যান। নাবীহা দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। নায়লা খাতুন চ্যাঁচিয়ে বললেন, অন্য জনের জন্য গর্ত করে সেই গর্তে নিজে পড়ে কেমন বোধ করছিস? বিয়ে না করেও আজ ডিভোর্সি তুই।

তার কথা শেষ করার আগেই ইনতিসারকে দেখতে পান তিনি। এ কী হাল হলো তার! এমন মলীন মুখটা দেখে নায়লা খাতুনেরও মায়া হলো। একটু হলেও তো এই ছেলে তার উপকারে এসেছিল! তিনি বললেন, এ কী হাল তোমার?

ইনতিসার ভাঙা গলায় নাবীহাকে খুঁজলো। নাবীহা হনহনিয়ে এসে বলল, আবার কী চায়?
জ্বরের ঘোরে ইনতিসার বলল, তোমাকে।

নায়লা খাতুন নাবীহার দিকে তাকিয়ে বললেন, শরীর ভালো না তার। দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

নাবীহা কড়া গলায় বলল, এটা কী ডাক্তার খানা যে এখানে আসবে?
ইনতিসার কাঁপাকণ্ঠে বলল, আমার তোমাকে খুব প্রয়োজন নাবীহা।
-কিন্তু আমার আপনাকে একটুকুও প্রয়োজন নেই। আপনি আসতে পারেন।

ইনতিসার একটু থেমে বলল, এক গ্লাস পানি দেবে? গলাটা শুকিয়ে গেছে।
-দোকানে পানির অভাব নেই।

নায়লা খাতুন অবাক হয়ে বললেন, নাবীহা!

সে নিশ্চুপ থাকে। ইনতিসার বেরুতে গিয়ে হঠাৎ মাথাটা ঘোরে। সে পড়ে যেতে চাইলে তাকে নায়লা খাতুন ধরলেন। তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, জ্বরে তো গা পুড়ে যাচ্ছে একদম!

নাবীহা কঠোর গলায় বলল, জ্বর এসব ওদের মতো বড়ো লোকের জন্য কোনো অসুখই না মা। যেতে দাও।

অসহায় দৃষ্টিতে একবার নাবীহার দিকে তাকালো ইনতিসার। এরপর বেরিয়ে যায় সে। আজ খুব করে তার মা কে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার সামান্য খারাপ লাগলেও ইলারা জামান অস্থির হয়ে উঠতেন। দিন-রাত সেবার নিয়োজিত থাকতেন। তার কাছে গিয়ে কোলে মাথাটা রেখে একটা শান্তির ঘুম দিতে ইচ্ছে হলো ইনতিসারের।

ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছে আজরা। সাথে সে আমের আচার খেতে ব্যস্ত। ইদানীং যেন আচার তার প্রিয় খাবারের মধ্যে একটি হয়ে উঠছে। যখন তখন আচার খেতে ইচ্ছে হয় তার।
একথা শুনে সাদ তার জন্যে হরেক রকমের আচার নিয়ে এসেছিল। তার ছোটোখাটো বিষয় গুলোরও সাদ অনেক খেয়াল রাখে। এখন থেকেই বাচ্চার জন্য কেনাকাটা শুরু করেছে সাদ। অথচ জানেই না ছেলে হবে নাকি মেয়ে। কিন্তু সে নিত্যদিনই এটা সেটা নিয়ে হাজির হয় আর আজরার রুম ভর্তি করে।

-আজরা?

হঠাৎ ইনতিসারের কণ্ঠ শুনে সামনে তাকায় আজরা। দাঁড়িয়ে পড়ে সে। ইনতিসার বলল, মা কোথায়? আমার শরীরটা ভীষণ খারাপ। একবার মা এর সঙ্গে দেখা করেই চলে যাব।
-কিন্তু উনি তো বাসায় নেই।

মলীন মুখে ইনতিসার বলল, ওহ!
-কী হয়েছে আপনার?
-জ্বর এসেছে। আচ্ছা আমি আসি।

এই বলে ইনতিসার পা বাড়ালেও দূর্বল শরীরের কারণে থামতে হয় তাকে। বারবার যেন গলাটা শুকিয়ে আসছে তার। পেছনে ফিরে একগ্লাস পানি চায় আজরার কাছে। আজরা নিজে তাকে পানি এনে দেয়। সে পানি পান করে ধন্যবাদ জানায়। আজরা বলল, আপনি চাইলে গেস্ট রুমে মা এর জন্য ওয়েট করতে পারেন।

আজরার কথা শুনে ইনতিসার খুব বেশি অবাক হয়। এমন কিছু সে আশা করেনি। আজরা আরও বলল, সাথে রেস্টও নিতে পারেন।

ইনতিসার হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নাড়ে। এরপর গেস্টরুমে এসে শরীরটা এলিয়ে দেয় সে। অনেক দিন বাদে নিজের ঘরে এসে মনের মাঝে অন্য এক রকম শান্তি অনুভব করছে সে।
খানিক বাদেই বুয়া স্যুপ নিয়ে হাজির হয়। ইনতিসার উঠে স্যুপটা খেয়ে আবারও শুয়ে পড়ে। কতক্ষণ সময় পার হতে থাকে জানা নেই ইনতিসারের। ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সে। ইলারা জামান এসে যে তাকে দেখেও গেছে, এটাও সে জানেনা।

রুমের বাইরে এসে আজরার উদ্দেশ্যে ইলারা জামান বললেন, আমার অনুপস্থিতিতে তুমি ওকে এখানে রেখেছ দেখে আমি অবাক হলাম।
-রাগ করলেন আপনি?
-নাহ! বরং এটা ভেবে অবাক হলাম যে, এখনো তুমি ওর প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছ।

আজরা খেয়াল করলো, ইলারা জামানের চোখে পানি। তিনি আরও বললেন, এ কী হাল হলো আমার ছেলেটার!

আজরা তাকে শান্তনা দেয়। তিনি ফ্রেশ হতে নিজের রুমে যান। আজরা ইনতিসারের কাছে আসে। না চাইতেও তার কপালে হাত দিয়ে দেখলো শরীর একদমই পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। সে ইনতিসারের কপালে জলপট্টি দিতে শুরু করে। এদিকে মিটমিট করে চোখ খুলে আজরাকে এরূপ কর্মকাণ্ড কর‍তে দেখে ইনতিসার। কিন্তু শরীরে জোর না থাকার কারণে কোনো কথা সে বলতে পারে না। পরম আবেশে চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয় সে।

আজরা ডাক্তার আনায়। মেডিসিন দেওয়া হয়। বুয়াকে সেসব বুঝিয়ে দেয় আজরা।

রাত হয়ে যায়। ইনতিসার এখানেই আছে। আজরা ঘুমানোর আগে তাকে দেখতে আসলো।
ঘুমে রয়েছে ইনতিসার। তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বেরিয়ে যায় আজরা। নিজের রুমে এসে ফুপিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো সে। এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরেও মানুষটার এই অবস্থায় নিজেকে সামলাতে কষ্ট কেন হচ্ছে তার!

পুরো দু’টো দিন পার হয়ে যায়। ইনতিসার সুস্থ হয়। তবে এই দু’টো দিন অসুস্থ হলেও সে ঘুম থাকাকালীন যে আজরা এসে তার সেবা করতো তা সে জানে। কারণ আজরা ভাবতো সে ঘুম। কিন্তু সে শরীর দূর্বলের কারণে চুপচাপ শুয়ে থাকতো।
কী করেনি তার সঙ্গে ইনতিসার! তাকে ঠকিয়ে তার বান্ধবীকে বিয়ে করেছে জানিয়েছে। এরপরেও তার প্রতি আজরার এমন আচরণ! কেন? আজও কী আজরা তাকে আগের মতোই ভালোবাসে?

ইনতিসার আজরাকে খুঁজতে থাকে। দক্ষিণের বারান্দায় তাকে পেয়ে যায়। কিন্তু সাথে রয়েছে সাদ। তারা মেতে রয়েছে খুনসুটিতে।
-এনেছেন মেয়ের পুতুল। আমার যদি ছেলে হয়?

আজরার কথা শুনে সাদ বলল, তবে এটা ওর গার্লফ্রেন্ড মনে করবে।
-দুষ্টু কথাবার্তা!

সাদ হাসে। এরপর একটু থেমে বলল-
এখনো ইনতিসার ভাই এর প্রতি এত টান কেন? না মানে কাল রাতে এখানে তো থেকেছি। দেখেছি আমি, গভীর রাতেও তাকে গিয়ে বেশ কয়েকবার দেখে এসেছেন।
-আপনি গভীর রাতে কী করছিলেন শুনি?
-পাহারা দিচ্ছিলাম বাড়ি।

এই বলে আবারও এক গাল হাসে সাদ।
আজরা সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, চেক আপের জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া প্রয়োজন।
-হু শিওর! অফিস সেরে নেব নাকি এখুনি?
-খানিকবাদেই।
-আচ্ছা।

ইনতিসার আবারও গেস্ট রুমে ফিরে আসে। তার প্রতি আজরার এরূপ আচরণে আজরার জন্য ভালোবাসার সৃষ্টি হয়।
নাবীহাকে কতটা ভালোবেসেছে সে। অথচ তার কিছু নেই জেনে নাবীহা কত সহজে চলে গেল। সত্যিটা জেনে চড়ও মেরেছিল।
এছাড়াও অসুস্থ শরীর নিয়ে তার কাছে গিয়েছিল ইনতিসার। এক গ্লাস পানি চেয়েও নাবীহার কাছে পায়নি সে। এদিকে আজরা! তাকে এত কষ্ট দেওয়ার পরেও দু’টো দিন তার সেবায় নিয়োজিত ছিল সে।
এ কী করে ফেললো ইনতিসার! মরীচিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে খাটি সোনা হাত ছাড়া করে ফেলেছে সে।
তার জীবনে আজরার মতন মেয়ে থাকতে অন্যদিকে কিভাবে মন গেল তার!

বিছানায় ধপাস করে বসে পড়ে ইনতিসার। জীবনে অনেক বড়ো ভুল সে করে ফেলেছে। যার প্রায়শ্চিত্ত করা জরুরি। খুব বেশি দেরী কী হয়ে গেছে!
সাদের সঙ্গে বেরুনোর জন্য তৈরী হয়ে নিলো আজরা। বেরুনোর সময় তাদের পথ আটকায় ইনতিসার। সে বলল, আজরাকে আমি নিয়ে যেতে চাই ডাক্তারের কাছে।

একথা শুনে আজরা ও সাদ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। সাদ বলল, তুমি নিয়ে যাবে! কেন?
-বাবার দায়িত্ব পালন করতে চাই।

একথা শুনে হেসে ফেলে সাদ। ইনতিসার বলল, এতে তোর সমস্যা হতে পারে বলে আমার মনেহয় না।
-কিন্তু যাকে নিয়ে কথা বলছ তার তো সমস্যা হতে পারে। তাইনা?

ইনতিসার জানে আজরা তাকে কতটা ভালোবাসে। সেই ভরসা থেকেই সে বলল, ওর ও সমস্যা নেই। আমি ওর সন্তানের বাবা। সেই সন্তানের উপর অধিকার আমারও আছে। বলো আজরা? আছে না?

একটু নীরব থেকে আজরা বলল, না নেই!

ইনতিসার অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
আজরা বলল-
যে সন্তানকে মেরে ফেলার কথা বলতেও দু’বার ভাবেননি আজ কেন তার জন্য এত দরদ?
-কারণ আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি আজরা।
-ভুল বুঝতে পেরেছেন আর আমি অতি সহজেই সবটা মেনে নেব ভাবলেন কিভাবে? আমার সন্তানের আশেপাশেও আপনাকে আমি দেখতে চাই না।

ইলারা জামান এসে বললেন, আজরা একদম ঠিক কথা বলছে।

ইনতিসার বলল, এইবার তো আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি মা। এইবার আমাকে অন্তত সাপোর্ট করো!
-সবকিছু শেষ করে ভুল বুঝে লাভ কী হবে বলতে পারিস!
-আমি আবার সবটা ঠিক করে নেব।
-কিভাবে? টাকার জোরে? সেই জোরটাও যে তোর নেই এখন!

আজরা বলল, থাকলেও সম্ভব না কিছুই। কেননা মনের জোরটাও যে নেই তার!

ইলারা জামান বললেন, তুই আসতে পারিস এখন।

ইনতিসার বলল, এভাবে তোমাদের থেকে দূরে সরিয়ে দিও না।

আজরা হেসে বলল-
কিছু বুঝি না ভেবেছেন! এখন কিছু নেই বলে নাবীহাও ছেড়ে গেছে। সেইজন্য ফিরে আসতে চাইছেন? একবার! একবার আপনার জীবনে অপশন হিসেবে ছিলাম আমি। আর নয়!

ইলারা জামান বললেন, তুই আমার মান না রাখলেও আমি রাখব। একটা ফ্ল্যাট তোর নামে করে দেব আমি। নিজের যোগ্যতায় জব করে সেখানে থেকে দিন পার করতে পারবি। কিন্তু প্লিজ! এখানে আসবি না।

সেসব কথার জবাব না দিয়ে ইনতিসার বলল, আজরা শোনো প্লিজ আমার কথা। আমি সবটা ঠিক করে নেব আবার।

আজরা সাদের উদ্দেশ্যে বলল, চলুন যাওয়া যাক।

ইনতিসার তাকে আবারও থামালো। সে বলল, আমার আর নাবীহার বিয়েটা হয়নি।

এইবার সবাই বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইনতিসারের দিকে। ইনতিসার বলল, আবার সবটা ঠিক হওয়া সম্ভব আজরা!

সত্যিটা বলে শান্তির একটা শ্বাস নেয় ইনতিসার। তার মন বলছে, এই সত্যি জেনে আজরা তার কাছে আবারও ফিরবেই!

.
চলবে

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫৭
#Saji_Afroz

সময় পার হতে থাকে। আজরা এখন নয় মাসের গর্ভবতী। এই ন’টা মাস ইনতিসার তার জীবনে অনেকবার ফিরে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু আজরা এতে রাজি হয়নি। ইলারা জামানের সঙ্গে সে দেখা করতে আসলেও নিজেকে রুম বন্দী করে রেখেছে আজরা। এদিকে ইনতিসার আজরাকে আবারও নিজের করে ফিরে পাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠে।
বাসায় এসে আজরাকে না পেলেও প্রায়ই তাকে পথে দেখতো ইনতিসার। বেশিরভাগই সাদের সঙ্গে হাসপাতালে যাওয়ার সময়। কিছুদিন আগেও দেখলো তাকে।
আজরা নিজের পেটে হাত রেখে হেঁটে গাড়িতে উঠেছে। গর্ভবতী হওয়ার পর আজরার সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে গেল। আজও আজরাকে দেখে আরেকবার মুগ্ধ হলো ইনতিসার। সাদের সঙ্গে শপিংমল এ এসেছে সে। নতুন বাচ্চার জন্য শপিং করতে ব্যস্ত তারা। তাদের পিছু নিয়েছে ইনতিসার। আজরা তোয়ালে থেকে শুরু করে বাচ্চাদের সমস্ত জিনিসপত্র কিনছে। ইনতিসার খেয়াল করলো সব জিনিসই দু’টো করে নিচ্ছে সে। আর তাকে এসব পছন্দ করতে সহায়তা করছে সাদ।
আজরা জামা কিনতে গেলে সাদ তার দিকে কয়েকটা ফ্রক বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এইগুলা নিন। সুন্দর!
-কিন্তু আমার ছেলে নাকি মেয়ে হবে তা জানিনা।
-তবুও নিয়ে রাখুন।
-নাহ। এমন কাপড় নেব যাতে ছেলে মেয়ে সবাই পরতে পারে।
এই বলে আজরা অন্য কাপড় দেখতে শুরু করে। কিন্তু সাদ ঠিকই সেই মেয়ের জামা গুলো গোপনে কিনে নেয়। এই দৃশ্য দেখে মৃদু হাসলো ইনতিসার। সাদের জায়গায় সে হলে ঠিক এমনটাই করতো। বরং সে ছেলে-মেয়ে দুজনেরই কাপড় নিয়ে রাখতো। আফসোস! এই সুন্দর একটা সময়ে আজরার পাশে থাকার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে সে।
শপিং থেকে বেরিয়ে নিজ ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওনা হলো ইনতিসার। পথিমধ্যে পুরনো এক বন্ধুকে দেখতে পায়। যে কিনা তাকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যেতে চায়। ইনতিসার তাকে থামিয়ে বলল-
কথা না বলেই চলে যাচ্ছিস?
আশেপাশে তাকিয়ে শারীফ বলল-
আমার স্ত্রী চায়না তোর সঙ্গে আমি কোনো সম্পর্ক রাখি।
-কেন?
-কারণ তুই বউকে ঠকিয়েছিস। তোর সাথে মিশলে যদি আমিও এসব শিখি!
বলতে বলতেই শারীফের বউ এসে হাজির হলো। সে বলল, তুমি এখনো এর সঙ্গে কথা বলো?
শারীফ আমতাআমতা করে বলল, নাহ! হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।
ইনতিসার বলল, ভাবী আমার উপরে রেগে আছেন কেন এত?
-আপনাদের মতো মানুষকে যদি সবাই অবহেলা করতে পারতো তবে দুনিয়াতে এসব পাপ কর্ম অনেকাংশেই কমে যেত।
এই বলে শপিংমল এর দিকে এগিয়ে যায় মেয়েটি। শারীফ বলল, আসলেই ভাই! জঘন্যতম কাজ করেছিস তুই। অন্তত বাবা হবি জানার পরে সবটা ঠিক করার চেষ্টা করতি?
এই বলে শারীফও চলে যায়। ইনতিসার হতাশ হয়ে বসে পড়ে গাড়িতে। নিজের জমানো টাকা থেকে পুরাতন একটা গাড়ি কিনেছে সে। মা এর দেওয়া ফ্ল্যাটে থাকে। একটা কোম্পানিতে চাকরি করছে। এইভাবে কাটছে সময় এখন!
আজ ছুটির দিন বলে অফিস নেই। তাই শপিংমল থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায় আসলো সে। দরজা খুলে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো। মাথাটা ধরে এসেছে। এক কাপ কফি বা চা হলে মন্দ হত না। কফি বা চা এর কথা মনে হতেই আজরার কথা মনে পড়লো। সে কিভাবে যেন বুঝে যেত, ইনতিসারের কখন চা বা কফি খেতে ইচ্ছে করছে।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে কফি বানালো ইনতিসার। রাতের খাবারটাও বানিয়ে রাখবে ঠিক করে। কিন্তু আর ইচ্ছে হয় না। আবারও ডিম আর ডাল দিয়ে এই বেলা চালিয়ে নেবে ভাবলো। প্রতিবারই এমনটা হয়। ডিম, ডালই চলে প্রায়। কারণ সে রান্না পারে না। এখন বুয়া রেখে বা বাইরে থেকে খাবার এনে টাকা নষ্ট করতে চায় না সে। ফ্রিজ থেকে বাশি ডাল বের করে নেয় ইনতিসার। কত আলিশান ছিল তার জীবন! না খেলেও টেবিলে থাকতো হরেক রকমের খাবার। তার ভুলের জন্যই আজকের এই অবস্থান। এই ভুল শোধরানোর কোনো কী উপায় নেই!

একটা প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করার সুযোগ পেল নাবীহা। বেতন মোটামুটি হলেও সে সন্তুষ্ট। অন্তত অভাবে তো থাকতে হবে না!
এক ক্লাসে পড়িয়ে অন্য ক্লাসে আসলো সে৷ বিদ্যুৎ চলে যায়। তবুও তার কাজ থাকে অব্যাহত। ঘামতে থাকে সে। ছোটো সেই বাচ্চাদের পড়ানোর পাশাপাশি তাদের সামলাতে হয়। ঘেমে ভিজে একাকার হয়ে যায় নাবীহা৷ বাচ্চাদের চ্যাঁচামেচিতে মেজাজ খারাপ হওয়ার উপক্রম। আগের কথা ভেবে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেললো নাবীহা। এসি রুমে অফিসের কাজ করতো সে। তেমন দিন কী কখনো ফিরে পাবে আর!
ক্লাস শেষে বেরুলো নাবীহা। বারান্দায় একজন মহিলা তাকে দেখে বলল, এই স্কুলে তুমি কী করছ?
নাবীহা কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, আমি পড়াই এখানে।
-প্রধান শিক্ষক কী তোমার ব্যাপারে জানেনা! বাচ্চারা কী শিখবে তোমার থেকে? ওদের ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার করে দেবে তুমি।
আরেকজন বলল, কেন আপা?
-আরে এই মেয়ে তো অন্যের সংসার নষ্ট করেছে। কিভাবে সে অন্যদের ভালো শিক্ষা দেবে?
নাবীহা ছলছল নয়নে তাকিয়ে বলল, আমি ভুল করেছিলাম। যেটা আমি মানছিও! প্লিজ আমাকে বারবার এসব মনে করিয়ে দেবেন না। সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারি না এসবের জন্য।
-কাজ যেমন করেছ ফল তো তেমনি ভোগ করবে বাপু।
অঙ্ক শিক্ষক জাদিদ এই পথেই যাচ্ছেন। এসব কানে আসতেই থামেন তিনি। সেসব অভিবাবকের উদ্দেশ্যে বললেন, উনি যে ভুল করে তা বুঝতে পেরেছেন এমনটা ক’জন পারে বলুন? ভুল করলে তা স্বীকার করার শিক্ষাটা অন্তত তিনি দিতে পারবেন। এটা তো মানেন?
জাদিদ স্যারকে সবাই সম্মান করেন বলে কথা বাড়ালেন না। তারা চলে যান।
নাবীহা তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, নিজেকে পরিবর্তন করার জন্য সবার সহায়তা প্রয়োজন। আপনি যেভাবে এগিয়ে এসেছেন সেভাবে সবাই যদি আসতো!
জাদিদ হেসে জবাব দেয়, এসব কেটে যাবে একদিন। তবে অবশ্যই এই পরিবর্তন টাই যেন সবসময় থাকে। ভালো কিছুর মাধ্যমে খারাপ সমস্ত কিছু দূর করা সম্ভব।
জাদিদের কথা শুনে যেন সাহস পেল নাবীহা। তার এই নতুন লড়াই এ জিততে তো তাকে হবেই!

রাতের খাবারের পর আজরার করা বাচ্চার শপিং দেখছে ইলারা জামান। সাদও রয়েছে সঙ্গে৷ তিনি ফ্রক গুলো দেখে বললেন, আজরা মা? বাচ্চার জেন্ডার তো আমরা জানিনা। ফ্রক নিলে যে?
আজরা অবাক হয়ে বলল, আমি নিইনি! কিভাবে এলো এখানে!
সাদ হালকা কাশলে এটা যে তার কাজ তারা বুঝে যায়। ইলারা জামান বললেন, তোর বুঝি মেয়ে বাবু বেশি পছন্দ?
-হু। আজরার দু’টো ফুটফুটে মেয়ে হলে আমি খুশি হব। তুমি কী বলো খালামনি?
-হু। আমার তো মেয়ে ছিল না। তাই আমিও চাইতাম প্রথমে নাতনীই আসুক। কিন্তু এসব আল্লাহ এর ইচ্ছে। তিনি যা দেন তাতে সন্তুষ্ট।
আজরাকে একই প্রশ্ন করলে সে বলল, সুস্থ বাচ্চাই কাম্য।
সাদ মজার ছলে বলল, ছেলে মেয়ে দুটোই যদি হয়ে যায়?
আজরা মিষ্টি একটা হাসি দেয়।
সাদ তার মুখটা মলীন করলে আজরা বলল, কী হলো?
-ছেলের কোনো পোশাক যে নিলাম না?
-আমি যা নিয়েছি তাতে ছেলে মেয়ে দু’জনকেই মানাবে।
-তবে হলোই! এইবার আসুন, আপনার হাসপাতালের ব্যাগে এসব রেখে দিই।
সাদ নিজে আজরার প্রেগ্ন্যাসির সেই আট মাস থেকেই তার হাসপাতালের ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছে। তাতে একেক দিন একেকটা জিনিস এনে রাখে সে। এভাবে করতে করতে এখন তার তিনটা ব্যাগ হলো। সাদের একটাই কথা! দু’টো বাচ্চার জন্য তিনটা ব্যাগ খুব বেশি নয়।

ব্যাগে এসব জিনিস রাখা হলে আজরা ঘুমানোর জন্য সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে। উঠার পরেই হঠাৎ তার পেটে ব্যথা করলে কেঁদে উঠে মেঝেতে বসে পড়লো সে। সঙ্গে সঙ্গে ইলারা জামান ও সাদ আসলো। আজরা পেটে হাত দিয়ে চিৎকার করতে থাকলে ইলারা জামান ড্রাইভারকে ফোন দেয়। সাদ কোনোকিছু না ভেবেই কোলে তুলে নেয় আজরাকে৷ ইলারা জামান কর্মচারীদের ডেকে গাড়িতে ব্যাগ গুলো দ্রুত রাখতে বললেন।
খানিকবাদে হাসপাতালে পৌঁছে যায় তারা। আজরার পেটের যন্ত্রণা আরও বেড়ে যায়। সে সাদের হাত ধরে বলল, আমি পারব না! অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি মারা যাব।
সাদ তাকে সাহস দিয়ে বলল, আপনি পারবেন! যন্ত্রণার পরেই যে দু’টো ফুটফুটে মুখ দেখতে পাবেন! তখন সব ভুলে যাবেন।

আজরাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সাদের হাত ছেড়ে দেওয়ার সময় বুকটা কেঁপে উঠলো তার। মনে হচ্ছে আজরা দূরে চলে যাচ্ছে তার কাছ থেকে। এতদিন তার সঙ্গে সময় কাটিয়ে মনের মধ্যে আলাদা একটা জায়গা তৈরী হয়ে গেল মেয়েটির জন্য।
মেয়েটা সুস্থভাবে তার সন্তানদের নিয়ে ফিরে আসুক। এটা একমাত্র কাম্য!

এদিকে আজরার ড্রাইভারের কাছে সব শুনে হাসপাতালে ছুটে আসে ইনতিসার। ড্রাইভারকে টাকা দেয় সে প্রতিমাসে শুধু আজরার খবর নেওয়ার জন্যে। আজও খবর পেয়ে চলে আসে সে। কিন্তু থাকে আড়ালে। কারণ আজরার পরিবারও এখানে উপস্থিত রয়েছে।
খানিকবাদে একজন নার্স আসে। ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ শোনা যায়। সবাই উৎসুকভাবে নার্সের দিকে তাকালো। সে একগাল হেসে বলল, অভিনন্দন! একটি ছেলে ও মেয়ে হয়েছে। উভয়ই ভালো আছে।
সবাই আনন্দিত হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে৷ সাদ ব্যস্ত হয়ে নার্সকে জিজ্ঞাসা করলো, আর আজরা?
-তিনিও ভালো আছেন।
এই কথা শুনেই সাদ মিষ্টি আনতে ছুটে যায় বাইরে। জানেনা এই রাতে মিষ্টি সে পাবে কি না! কিন্তু তার এখুনি মিষ্টির ভাণ্ডার লাগবে।
এদিকে আড়াল থেকে এই খবর শুনে ছলছল করে উঠে ইনতিসারের দুচোখ! কেমন বাবা সে! তার যে জমজ বাচ্চা হবে এটাও সে জানতো না। এটা জানার অধিকারও কী সে রাখেনা!
.
চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে