এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০২

0
1264

#এই মন তোমাকে দিলাম (দ্বিতীয় পর্ব)
#ঈপ্সিতা মিত্র
<৩>
সেদিন হিয়ার ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর ওই শেষ দুপুরে ও ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস দিয়ে বাইরে যাচ্ছিল। সাথে কয়েকজন বন্ধুও ছিল। তখনই হঠাৎ স্পন্দনের মুখোমুখি ও। ছেলেটা সেই সময় ক্যান্টিন থেকে ফিরছিল। একই ইউনিভার্সিটি হলেও হিয়ার সাথে টাইমিং ম্যাচ করে না বলে দেখাও হয় না বিশেষ। তাই আজ দূর থেকে দেখেই ও নিজে থেকে চেঁচিয়ে উঠলো হিয়ার নাম ধরে। তবে হিয়া এই ডাকে স্থির হয়ে গেল কেমন! আসলে ওর বন্ধুরা জানতো না এতদিন, যে স্পন্দন চেনে হিয়াকে। যদিও হিয়ার সামনে সবাই বহুবার স্পন্দন কে নিয়ে আলোচনা করেছে। কিন্তু হিয়া প্রত্যেকবারই চুপ থেকেছে এই আলোচনায়। আসলে ও ক্লাসে কাউকে জানাতেই চায় না যে স্পন্দন ওর ছোটবেলা থেকে বন্ধু। একই পাড়ায় থাকে। তাই আজ এই ডাকে বেশ ইতঃস্ততই হয়ে পড়েছিল সবার সামনে। তবে স্পন্দন এই মুহূর্তে জোরে পা চালিয়ে ওর কাছেই এগিয়ে এসে বললো, ——” কি হলো? ক্লাস শেষ? বাড়ি যাচ্ছিস?”
এই কথাগুলো শুনে হিয়ার বন্ধুরা তো বেশ অবাকই হয়েছিল সেইদিন! আসলে স্পন্দন বেশ ইন্ট্রোভার্ট। নিজে থেকে কারোর সাথেই বেশি কথা বলে না। এটা অনেকেরই শোনা, আর নিজেরাও টুকটাক আলাপ করতে গিয়ে এক্সপিরিয়েন্স করেছে। সেখানে হিয়ার সাথে নিজে থেকে এসে কথা বলছে ছেলেটা; এটা দেখেই ওরা বেশ বড় বড় চোখে তাকিয়ে ছিল হিয়ার দিকে!
সেই সময় হিয়া সবার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে একটু তাড়াতাড়ি করেই বলে উঠেছিল,
——“হ্যাঁ, ক্লাস শেষ। বাড়ি যাচ্ছি। আর দু চার মিনিট দেরি হলেই বাসটা মিস হয়ে যাবে! আসলাম।”
কথাটা বলেই ও আর স্পন্দনের কোন প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই জোরে পা চালিয়েছিল গেটের দিকে। যদিও হিয়ার বন্ধুরা বেশ অবাক হয়েই তাকিয়েছিল ওদের দিকে সেই মুহূর্তে। কিন্তু স্পন্দন নিজে কিছু বুঝতে পারছিল না এখন! হিয়া এরকম এভয়েড করে চলে গেল কেন হঠাৎ! এসবের কি মানে! আজ বাড়ি ফিরেই এই মেয়েটার সাথে কথা বলতে হবে।
তবে সেদিন এর উত্তর পাওয়ার জন্য বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি স্পন্দনকে। হিয়া সন্ধ্যেবেলা নিজে থেকেই এসেছিল ওদের বাড়ি। তারপর সোজা স্পন্দনের ঘরে ঢুকে বলেছিল,
——-” এই শোনো, ইউনিভার্সিটি তে দেখা হলে একদম আমাকে চিনবে না। মানে জাস্ট ইগনোর করে চলে যাবে, বুঝেছো?”
এই কথায় স্পন্দন কিরকম আকাশ থেকে পড়ার মতন মুখ করে বলেছিল,
——-” মানে? চিনবো না কেন! আর তুই আজ ওইভাবে এভয়েড করে চলে গেলি কেন আমাকে সবার সামনে? ”
এই প্রশ্নে হিয়া কিছুটা ক্লান্ত স্বরেই বললো,
——” কারণ আমি আমাদের ক্লাসের কাউকেই জানাতে চাই না যে আমি তোমার বন্ধু, আমরা একই পাড়ায় থাকি। কারণ তোমার যা ক্রেজ ইউনিভার্সিটি তে! এরপর যদি এটা ওরা জেনে যায় যে আমি তোমার বন্ধু, তাহলে আর রক্ষে থাকবে না। ওরা আমার কাছে তোমার ফোন নাম্বার চাইবে, আলাপ করাতে বলবে! আর এসব আমি একদমই চাই না।”
কথাগুলো বেশ গাল ফুলিয়ে বললো হিয়া। কিন্তু এইসব শুনে স্পন্দন একদমই পাত্তা না দিয়ে বলে উঠলো,
——-” কে তোকে এইসব উল্টো পাল্টা বুঝিয়েছে রে? আমি কি কোন ফিল্ম স্টার যে আমাকে নিয়ে ক্রেজ হবে সবার! শোন, কারোর মাথা ব্যাথা নেই আমাকে নিয়ে। ”
এই কথায় হিয়া বেশ জোর দেখিয়ে বললো,
——” তাই! সেই জন্যই তুমি যখন করিডোর দিয়ে যাও, আমাদের ক্লাসের মেয়েগুলো হুমড়ি খেয়ে দেখে। তুমি ফেস্টে গান গাইলে, সবাই হাঁ করে শোনে! তোমার সাথে কথা বলার, আলাপ জমানোর হাজার চেষ্টা করে কোন না কোন ভাবে। আমাদের ক্লাসে দিপা, সংযুক্তা, আর সহেলী বাদে বাকি সকলের ক্রাশ তুমি। আর শুধু আমাদের ডিপার্টমেন্ট কেন, এরকম প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্ট এ খুঁজলেই তোমার ফ্যান ফলোয়ার পাওয়া যাবে।”
কথাগুলো বেশ তেজ দেখিয়ে বললো হিয়া। তারপর নিজের মনেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো যেন। কিন্তু এই সময় স্পন্দন ও এইসব শুনে কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল হঠাৎ। তাই কথা ঘুরিয়ে বললো, —–” আচ্ছা, হয়েছে হয়েছে। আর এক্সপ্লেন করার দরকার নেই। যাইহোক, যা গিয়ে পড়তে বস। রাত আটটা বাজে! ”
এই কথায় হিয়া ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললো,
——” উফ, সারাক্ষণ শুধু পড়া পড়া! সেই ক্লাস টেন থেকে এম.এস. সির ফার্স্ট সেম, সব সময় দেখলেই একটা কথা, ‘ পড়তে বস।’
যাইহোক, আমি পায়েস দিতে এসেছিলাম কাকিমাকে। আজ বাবার জন্মদিন, তাই নিজে ইউটিউব দেখে বানিয়েছি। ”
শেষ কথাটা বেশ প্রাউডলি বললো হিয়া। কিন্তু স্পন্দন এই কথায় মুচকি হেসে বললো,
——–” পায়েসটা একবার টেস্ট করেছিস তো? মানে চিনির জায়গায় নুন ঢেলে ফেলিসনি তো?”

এই কথায় তুলি বেশ রেগেই বললো,
——-” সেই, ওটাই বাকি আছে! সত্যি; তোমার জন্য কিছু পাঠানোই উচিত না। আসছি। ”

কথাটা বলেই তুলি আর দাঁড়ালো না। বেশ ক্ষেপেই চলে গেল স্পন্দনের কাছ থেকে। কিন্তু এই মুহূর্তে স্পন্দন না হেসে পারলো না! এই মেয়েটাকে রাগিয়ে যা মজা না! তাই স্পন্দন লোভ সামলাতে পারে না।
তবে ও হিয়াকে রাগায় যেমন, সেরকম রাগ ভাঙায়ও দ্বায়িত্ব নিয়ে। এই যেমন সেদিনই রাতে হিয়ার হোয়াটস অ্যাপে একটা মেসেজ গেল স্পন্দনের নাম্বার থেকে। যেখানে লেখা,
—— ” পায়েসটা খেলাম। এরপর আমার জন্মদিনেও এরকমই এক বাটি পায়েস চাই, তোর হাতের। ”
মেসেজটা পড়ে হিয়ার মুখে এক চিলতে হাসি। না, এরপর আর ক্ষেপে থাকা সম্ভব না ছেলেটার ওপর!

যাইহোক, তবে এর পরের দিন হিয়া যখন ইউনিভার্সিটি গেছিল, তখন ক্লাসের অনেকের মধ্যেই কালকের ঘটনাটা ছড়িয়ে গেছে। তাই বেশ কিছু জনই হিয়াকে এসে জিজ্ঞেস করেছিল,
——” তুই চিনিস না কি স্পন্দনদাকে? আগে বলিসনি তো! কাল যেইভাবে স্পন্দনদা এসে তোর সাথে কথা বললো! বেশ ভালো রকম চেনে বলেই তো মনে হচ্ছিল।”
এই কথায় হিয়া একটু এলোমেলো হয়েই বলেছিল,
—–” চেনা মানে সেরকম কিছুই না রে! ওই মুখ চেনা আর কি।”
এটা শুনে কৌশানী এবার বেশ জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
——” শুধুই মুখ চেনা! কিন্তু আমি তো শুনলাম তুই আর স্পন্দনদা না কি একই পাড়ায় থাকিস? স্পন্দনদার বন্ধু অভিলাশদাই বলেছে। ”
এই কথায় হিয়া কিছুটা কথা সাজিয়ে বললো,
—— ” একই পাড়ায় থাকি, ওই অব্দিই। কিন্তু কখনো সেইভাবে কথা হয়নি। আর তোরা তো নিজেরাও আলাপ করতে গিয়ে দেখেছিস, কতটা ইন্ট্রোভার্ট তোদের স্পন্দন। দরকার ছাড়া তো বেশি কথা বলে না। আমার সাথেও তাই।”
কথাটা বলার পরই সেদিন ক্লাসে ম্যাম এসে গিয়েছিলেন। তাই আর বেশি প্রশ্ন শুনতে হয়নি হিয়াকে। সেই মুহূর্তে যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল ও। তবে ক্যান্টিনে গিয়েও শান্তি নেই। কৌশানি এসে হাজির। এমনিতে মেয়েটা এই এক মাস ক্লাস শুরু থেকে হিয়ার সাথে কোন কথা বলেনি! কিন্তু আজ হঠাৎ হাসি মুখে এসে ওর টেবিলে বসেই বললো,

——-” এই, একটা কথা বলবো। রিকুয়েস্টও বলতে পারিস!”
এটা শুনে হিয়া বেশ অবাক হয়েই বলেছিল,
——” কি কথা?”
এই প্রশ্নে কৌশনী একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেছিল,
——-” তুই আর স্পন্দনদা তো একই পাড়ায় থাকিস। তোর কাছে স্পন্দন দার ফোন নাম্বার আছে? আসলে যেদিন থেকে ওর গান শুনেছিলাম ফেস্টে, সেদিন থেকেই আমি পুরো ফিদা! যেরকম গানের গলা, সেরকম হ্যান্ডসম দেখতে! তার ওপরে এত ভালো পড়াশোনায়! শুনেছি না কি এম.এস.সি পড়তে পড়তেই নেট ক্লিয়ার করেছিল। এরকম ছেলে কি দেখা যায় বল!”
কথাগুলো বলতে বলতে যেন হারিয়ে গেছিল কৌশানী নিজের খেয়ালে। কিন্তু এই মুহূর্তে হিয়া মনে মনে জ্বলে যাচ্ছিল যেন! কেমন রাগে গজগজ করেই বলে উঠেছিল আস্তে গলায়,
——” না, ঠিকই! এরকম ছেলে তো দেখাই যায় না! স্পন্দন তো আকাশ থেকে নেমে এসেছে মনে হয়।”
এই কথাটা কৌশানী অর্ধেক শুনে একটু অবাক হয়ে বলেছিল,
——” কি! কি বললি? আকাশ না কি? ঠিক শুনলাম না।”
এটা শুনে হিয়া নিজেকে শান্ত করে তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরিয়ে বলেছিল,
——” না না, কিছু বলিনি। আর স্পন্দনের ফোন নাম্বার সত্যিই নেই আমার কাছে। একই পাড়ায় থাকলেও আমরা কখনো বিশেষ কথা বলিনি। ওই মুখ চেনা, ওই অব্দিই! যাইহোক, আমি একটু লাইব্রেরী যাবো। আসছি রে।”
কথাটা বলেই হিয়া আর থাকেনি সেদিন ক্যান্টিনে। তাড়াতাড়ি ব্যাগ পত্তর নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল কৌশানীর সামনে থেকে। সত্যি! কি জ্বালা। ওরই মনের মানুষকে লাইন মারছে ওরই সামনে! আর হিয়ার কিছুই করার নেই। আর যদি এটুকুও কখনো বুঝতো যে স্পন্দনও ওর জন্য ফিল করে একই ভাবে! তাহলে হিয়া নিজের গল্পটাকে এইভাবে ঝুলিয়ে কখনোই রাখতো না। নিজেই গিয়ে বলে দিত ছেলেটাকে মনের কথা। কিন্তু স্পন্দন যে কখনোই আলাদা করে কিছু বোঝায়নি হিয়াকে! সব সময় হয় পড়াশোনার কথা বলেছে, নয় লেগ পুল করেছে। কখনো এর বেশি স্পেশ্যাল কিছু তো করেইনি ছেলেটা ওর জন্য! আর এরপর হিয়া নিজের মুখে কিভাবে বলবে নিজের ফিলিংসের কথা! তাই এইভাবেই একটা অসমাপ্ত বইয়ের পাতার মতনই এগিয়ে যাচ্ছে জীবনটা।
<৪>
কিন্তু হঠাৎই এই বইয়ের পাতায় এমন একটা চ্যাপ্টার শুরু হলো, যেটা ভীষণভাবে অচেনা ছিল হিয়ার। সেদিন ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরীতে গিয়ে হঠাৎ পা টা থমকে গেল ওর। স্পন্দন একটা মেয়ের সাথে কিছু বই সমেত বেশ মন দিয়ে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল হিয়ার সামনে থেকে। এমনকি ওকে একবারও নোটিশই করলো না; এতোই ব্যাস্ত ওই মেয়েটার সাথে কথা বলতে। কিন্তু হিয়ার কিরকম খারাপ লাগলো এই সময়। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেল স্পন্দনদের ল্যাবে নতুন একটা মেয়ে জয়েন করেছে। সুচেতা নাম মনে হয়! এই চশমা পড়া সিরিয়াস মুখের মেয়েটা সেই সুচেতাই নয় তো!

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে