এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-০৭

0
1199

#এই মন তোমাকে দিলাম (সপ্তম পর্ব)
#ঈপ্সিতা মিত্র
<১১>
সেদিন হিয়ার চলে যাওয়ার পর স্পন্দন কেমন বুঝেছিল নিজের ভুলটা। রাগের মাথায় এইভাবে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঝামেলা করাটা ঠিক হয়নি ওর। তার ওপরে হিয়াকে এতগুলো কথা বলে ফেললো! নিজে ভালোবাসি, এটা বোঝানোর বদলে অনেক বেশি হার্ট করে ফেললো মেয়েটাকে! কথাগুলো ভেবেই সেদিন স্পন্দন সন্ধ্যেবেলা গেছিল হিয়ার বাড়ি। হিয়া ছাদে ছিল সেই সময়। ওদের ছাদের মাঝখানে একটা ছোট দোলনা আছে। মন খারাপের সময় হিয়া ওই দোলনাটায়ই গিয়ে বসে থাকে একা একা। তবে সেদিন হঠাৎ এই একাকীত্বের ভিড়ে স্পন্দন এসে হাজির। তবে ছেলেটাকে আজ দেখেই হিয়া উঠে দাঁড়িয়েছিল। তারপর কিছু না বলে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু স্পন্দন এবার সঙ্গে সঙ্গেই ওর হাতটা ধরেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে হিয়া জোর করেই নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। আজ হিয়ার এতটা রাগ হচ্ছে যে ও স্পন্দনের চোখের দিকেই তাকাচ্ছে না। তবে স্পন্দন এবার ওর রাস্তা আটকে বলেছিল,
——” এম রিয়ালি সরি.. জানি আজ ওইভাবে রাস্তায় কথা বলা উচিত হয়নি। আসলে ওই ছেলেটাকে দেখলে মাথার ঠিক থাকে না আমার। ছেলেটার কোন কাজ নেই! সারাক্ষণ তোর সাথে সাথে! ”
না, স্পন্দনের কথাগুলোকে শেষ হতে না দিয়েই হিয়া এবার রেগে বললো,
——” না, কারোর কোন কাজ নেই। উজানেরও নেই। আমারও নেই। আর আমি ক্যারেক্টারলেস। তাই তো সারাক্ষণ একটা ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াই পড়াশোনা ছেড়ে। আর কাল তোমাকে ভালোবাসতাম, আজ ওকে ভালোবাসি। হয়েছে শান্তি? এটাই তো বলতে চেয়েছিলে আজ রাস্তায়, সবার সামনে! প্রমাণ হয়ে গেছে। শুনে নিয়েছ সত্যিটা। এরপর তাই প্লিজ আর আমার মতন খারাপ মেয়ের সাথে কথা বলতে এসো না। আর এমনিতেও তোমার সাথে তো আমার সব কথা শেষই! ”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেছিল হিয়া। তারপর স্পন্দনের কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই ছাদটাকে খালি করে দিয়ে চলে গেছিল সেদিন। আসলে এতটা খারাপ লেগেছে আজ ওর! তাই স্পন্দনের কাছ থেকে কিছু শোনার ইচ্ছাও নেই যেন।
তবে স্পন্দন বুঝেছিল ও ভুল করে ফেলেছে আজ। রাস্তার মাঝে ওইভাবে সিন ক্রিয়েট করাটা ঠিক হয়নি ওর। কিন্তু হিয়া কি বুঝতে পারছে না স্পন্দনের কেন এত রাগ হচ্ছে! কেন ওই ছেলেটার সাথে হিয়াকে দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না স্পন্দন! কথাগুলো ভীষণভাবে মনে হচ্ছিল সেদিনের পর থেকে। সেই জন্য অনেকবার ফোনও করেছে হিয়া কে এরপর। কিন্তু হিয়া আর একবারও ফোন ধরেনি ওর। আর এইভাবে মাঝখান থেকে সাতটা দিন কেটে গেছে ধীরে ধীরে। কিন্তু স্পন্দনের এবার সত্যিই মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে যেন। হিয়া সেদিনের পর থেকে আর একটা শব্দও বলেনি আসলে স্পন্দনকে। নিঃস্তব্ধ ভাবেই যেন রোজ বুঝিয়ে দেয় মনের দূরত্বটা। এদিকে আজই পুজোর আগে শেষ দিন ইউনিভার্সিটি তে। আর দুদিন বাদেই ষষ্ঠী। তাই কাল থেকে পুজোর ছুটি পড়ে যাচ্ছে। সেই জন্য সবার মধ্যেই একটা আনন্দ ছড়িয়ে। পুজো আসার আনন্দ। তবে স্পন্দনের মনে এই আনন্দের লেশমাত্র নেই। শুধু মনে হচ্ছে হিয়ার সাথে আর হয়তো কোনদিনই কিছু ঠিক হবে না! এই ভাঙা সম্পর্কটাই থেকে যাবে সব সময়। সেদিন এই ভাবনার মাঝেই স্পন্দন খুব আনমনে কাজ করছিল ল্যাবে। আর তখনি ঘটে গেল বিপত্তি। সালফিউরিক এসিডটা টেস্টটিউব থেকে হাত ফস্কে পড়লো সোজা হাতের ওপর। ডান হাতের অনেকটা জুড়ে এসিডটা ছড়িয়ে পড়লো, আর সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে গেল হাতটা! স্পন্দন যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলো সেই মুহূর্তে। ল্যাবের বাকিরা সেই আওয়াজ শুনে ওর কাছে এসে দেখে ডান হাতের ওপরটা খুব বাজেভাবে পুড়ে গেছে স্পন্দনের। না, তারপর আর অপেক্ষা না করেই ওরা স্পন্দনকে সামনের একটা ক্লিনিকে নিয়ে গেছিল, হাতটা ড্রেসিং করানোর জন্য। তবে এই এক্সিডেন্ট এর খবরটা সেদিন ছড়িয়ে গেছিল ডিপার্টমেন্টে। যদিও হিয়া এই ব্যাপারে জানতো না কিছুই। ও ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফেরার জন্য বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিল। তখনই কৌশানী এসে বললো,
——-” এই শুনলি স্পন্দনদার কি হয়েছে?”
এই প্রশ্নে হিয়া কিছু বুঝতে না পেরে বললো,
——-” কি হবে স্পন্দনের! ”
এই কথায় কৌশানী ডিটেলস এ বললো,
—–” ওহ, মানে তুই জানিস না! আরে আজ না কি ল্যাবে কাজ করতে গিয়ে হাতে সালফিউরিক এসিড পড়ে গেছে স্পন্দনদার খুব বাজে ভাবে! হাতটা ভালোই পুড়েছে। শুনলাম সামনের ক্লিনিকে নিয়ে যেতে হয়েছে ড্রেসিং করানোর জন্য! ব্লিডিং হচ্ছিল। সত্যি, পুজোর আগে এরকম একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেল!”
শেষ কথাটা ও নিজের মনেই বললো। তবে এইসব শুনে হিয়ার মনটা হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠলো যেন! হাত পুড়ে গেছে এসিডে! তার মানে তো খুব লেগেছে ছেলেটার। কেমন আছে এখন স্পন্দন! কথাগুলো কেমন এক মুহূর্তে ভেবে বসলো হিয়া।
<১২>
তবে এরপর আর নিজেকে আটকাতে পারলো না হিয়া। স্পন্দনের কাছে যেতেই হলো ওকে। আসলে কৌশানীর মুখে এক্সিডেন্ট এর খবরটা শুনে স্পন্দনকে দেখতে ইচ্ছে করছিল খুব। এতদিনের জমা রাগ, অভিমান, দূরত্ব গুলোকে ভেঙে তাই আজ ও গিয়েছিল স্পন্দনদের বাড়ি। তারপর একটু সময় নিয়ে বাজিয়ে ছিল কলিং বেল। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর স্পন্দনই এসে দরজা খুলেছিল ওকে। তবে হিয়া এই হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় স্পন্দনকে দরজা খুলতে দেখে অবাক হয়ে গেছিল কেমন। বাড়িতে কি কেউ নেই! কথাটা আনমনে ভাবতে খেয়াল করেছিল স্পন্দন কেমন নিস্পলক ভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে! আসলে হিয়াকে ও একদমই এক্সপেক্ট করেনি এই মুহূর্তে। তবে হিয়া এবার চুপ না থেকে বলেছিল,
——” বাড়িতে কেউ নেই? তুমি একা?”
এই প্রশ্নে স্পন্দন একটু সময় নিয়ে উত্তর দিয়েছিল,
——” না। বাবা মা কাল কোচবিহার গেছে, দেশের বাড়ি। যাইহোক, ভিতরে আয়।”
কথাটা বলে ও দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল। হিয়া এবার কিছু না বলে ভিতরে ড্রইং রুমে এসে জিজ্ঞেস করেছিল,
——-” হাত কেমন আছে তোমার? খুব লাগছে?”
স্পন্দন এই প্রশ্নে অল্প কথায় বলেছিল,
——-” না, ওই আছে! ঠিক আছে। ”
হিয়া এটা শুনে চুপ ছিল কিছুক্ষণ। তখন স্পন্দন নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করেছিল অন্য প্রশ্ন,
——” রাগ কেমন আছে তোর? কমেছে একটু? না কি এরপর বাড়ি ফিরে আবার সেই আগের মতন হয়ে যাবি! আর কথা বলবি না আমার সাথে।”

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে