এই প্রেম তোমাকে দিলাম পর্ব-১১+১২

0
2131

#এই প্রেম তোমাকে দিলাম
#পর্ব_১১
#আফিয়া_আফরিন

আকাশে সাদা শুভ্র মেঘের আনাগোনা চলছে। তার মধ্যেও রোদের তীব্রতা রয়েছে প্রকৃতিতে। আবার মৃদু বাতাসও বইছে। বর্ষাকালটা বোধহয় এমনই হয়!

ভালোবাসার তাপদাহে হৃদয় যখন ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল তিথির, এখন তিথির পৃথিবীটাকে ভালোবাসার ঐশ্বর্য ভরিয়ে দিতে আগমন ঘটে এক রূপকথার রাজকুমারের!
আয়েশ তার শ্যামল সুন্দর রূপ নিয়ে স্পষ্ট ভাবে তিথির সামনে আবির্ভূত হয়েছে। তিথিও তার আগমনী বার্তাকে স্বাগত জানিয়েছে অনেক আগেই, নিজের অজান্তে!

তিথির মন যখন আয়াশের ভাবনায় মত্ত, তখন আয়াশ পাশ থেকে তাকে বলে উঠলো,
“কি ব্যাপার মন খারাপ কেন তোমার?”

তিথি ভাবনা থেকে বেরিয়ে মৃদু হেসে বললো, “এতক্ষণ মন খারাপ ছিল। কিন্তু এখন আর নেই। ভীষণ ভালো লাগছে এখন।”

আয়াশ হেসে বলল, “মন খারাপের কারণ কি মিস বাঁচালিনী?”

“আদিত্য!”বেশ সহজ ভাবে বলল তিথি।

আয়াশ বললো, “কেনো? কি করেছে সে?”

“হি ওয়ান্টস টু ব্যাক এগেইন!”

“ও আচ্ছা। তুমি কি বললে?”

“আমি পরিষ্কারভাবেই বলে দিয়েছি, যেটা ও চায় সেটা কখনো সম্ভব না।
কারন সে আমার বিশ্বাস নষ্ট করেছে, তাকে ভালবাসতাম, বিশ্বাস করতাম। আসলে ও আমার বিশ্বাসের অংশীদার ছিল। কিন্তু বিশ্বাসটা টিকিয়ে রাখতে পারে নাই।”

বর্তমানে আয়েশার তিথি ঢাকার পাশ দিয়ে বয়ে চলা একটি নদীর নৌকা তে অবস্থান করছে। গায়ে হাওয়া মাখাতে এই দিকে আসা। অবশ্য এখানে এসে তিথির মনটা ভালো হয়েছে। বেশ হালকা লাগছে নিজেকে।

নদীর ঢেউ গুলো নৌকার গায়ে লেগে ছলাৎ ছলাৎ ছন্দ তুলছে। তিথি মনোমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওই দিকে।
তিথি আর আয়াশ পাশাপাশি নৌকার গোলুইয়ের উপর বসে আছে।

তিথি জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি নৌকা চালাতে পারেন?”

“চেষ্টা করলে হয়তো পারবো। কিন্তু, কখনো চালাই নাই।”

“আমি পারি।”

“তাই?”

“হ্যাঁ।”

“কখনো চালিয়েছো?”

“হ্যাঁ। আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে। আমরা ভাই-বোনেরা মিলে এমনি ছোটোখাটো একটা পালতোলা নৌকায় চড়ে দিলে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। নৌকার বৈঠা আমি ধরেছিলাম।”

“গুণবতী কন্যা!”

তিথি শব্দ করে হেসে ফেলল।
বললো, “আপনার কি নদী পছন্দ?”

“হ্যাঁ ভীষণ। তাইতো তোমাকে নিয়ে এখানে ঘুরতে এলাম।”

তিথি মুচকি হাসলো। আয়াশ কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর আনমনে কণ্ঠে বললো, “প্রিয় মানুষের সাথে প্রিয় জায়গায় ঘোরার ফিলিংসটা সত্যি ব্যক্ত করার মত নয়!”

তিথি চমকালো। তাকালো আয়াশের দিকে। স্থির দৃষ্টিতে সে সামনে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে কেমন যেন বিষন্নতা, কিছু না পাওয়ার ব্যাকুলতা!
বেলা পেরিয়েছে।
আকাশে রৌদ্র-মেঘের আনাগোনা লেগেই আছে। আয়ান আর তিথি পাশাপাশি হাঁটছে।

তিথি আচমকা প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা, আপনি কখনো প্রেম করেছেন?”

আয়াশ সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দিলো, ” হ্যাঁ তোমাদের বয়সি থাকতেই। সে চার/পাঁচ বছর আগের কথা।”

“তাহলে ব্রেকআপ কেন করেছিলেন?”

“ঠিক ব্রেকআপ বলা যায় না ওটাকে, ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।”

“আপনাদের মধ্যে সম্পর্ক থাকলে বিয়ে হয় কেমনে তার?”

ফ্যামিলি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। তখন আমি কেবল লাস্ট সেমিস্টার এ পড়াশোনা করি। একটা বেকার ছেলের কাছে কখনো তার মা-বাবা নিজের আদরের মেয়েকে তুলে দেবে না?”

“তারপর, মনে পড়ে না ওকে?”

“নাহ।”

“কেনো?”

“যেখানে মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই সেখানে মায়া কাটাতে শিখতে হয়। যেদিন ওর বিয়ে হয়ে গেলো, সেদিন থেকেই ওর কথা ভাবা বন্ধ করে দিয়েছি। সে এখন বিবাহিত, মনে করে কি হবে?”

“বুঝেছি। আসলেই আপনার প্রতিটা কথায় কিছু না কিছু শেখার আছে!”

আয়াশ হাসলো। প্রাণ খোলা সে হাসি!

তিথি বললো, “আপনি অনেক মিষ্টি!”

“তাই? তাহলে একবার সুগার লেভেলটা টেস্ট করিয়ে নেওয়া দরকার।”
মুখ টিপে হেসে বলল আয়াশ।

আর চোখে তাকিয়ে তিথি বললো, “সাথে ভীষণ পাজিও আপনি।”

“তাই?”

“হ্যাঁ। প্রচুর।”

“বৃষ্টি আসবে মনে হয়। মেঘ ডাকছে, দেখো।”

“আসুক, বৃষ্টিতে ভিজবো।”

“ঠান্ডা লেগে যাবে।”

“একদিন ঠান্ডা লাগলে এমন কিছুই হবে না। আপনিও ভিজবেন।” আদেশের সুরে বলল তিথি।

আয়াশ হেসে বললো, “জো হুকুম, মহারানি!”
.
.
.
বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছে তিথি। কিন্তু বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। বিরক্তিতে তিথি বারবার বলছে,
“কখন বৃষ্টি নামবে?”

আয়াশ তিথির এরকম হাসফাঁস অবস্থা দেখে বললো,
“তুমি এই দশ মিনিটের মধ্যে শতবার এই কথাটা বলেছে। বৃষ্টি এলে তো দেখতেই পারবে।”

তিথি অসহায় মুখ করে বললো, “আসছে না কেন এখনো বৃষ্টি?”

“এরকম বাচ্চা মানুষের মতো করলে কেমনে হবে?”

“আচ্ছা, আপনি বসুন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাইচারি করছেন কেন?”

“তোমার বৃষ্টির অপেক্ষায়!”

“অপেক্ষা করতে হবে না। আপনি চুপচাপ বসেন।”

তিথি নিজেই আয়াশের হাত ধরে পাশে বসালো।
আয়াশ বললো, “তোমার বাচ্চমি দেখে খুব হাসি পাচ্ছে।”

তিথি হেসে ফেলল। আয়াশ ফের বললো, “তোমার হাসিটা মারাত্মক রকমের সুন্দর!”

তিথি লজ্জা পেল।
“তাই? তবে আমার মনে হয় আপনার হাসিটা বেশি সুন্দর। আমি হাসলে তো আমার গালে আপনার মতো টোল পড়ে না।”
একটু মন খারাপ করেই বললো তিথি।
আয়াশ স্বজরে হেসে উঠলো।
.
.
শেষ পর্যন্ত তিথির বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টি এলো না। একপ্রকার মন খারাপ করেই বিকেল নাগাদ বাসায় ফিরলো। অবশ্য আয়াশ ই তিথিকে পৌঁছে দিয়ে গেছে।
দুজনে মিলে অনেকক্ষণ পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করেছে। তিথি আয়াশের মাঝে প্রথম প্রথম খানিকটা দূরত্ব থাকলেও, পরবর্তী তে সেই দূরত্ব ঘুঁচে যায়। খুব সুন্দর বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে তাদের মাঝে।
তিথি বাসায় ফেরার পর থেকেই সারাদিনের কথা গুলো বারবার ভাবতে লাগলো। আয়াশের হাসি, স্বচ্ছ চোখের চাহনি, সবকিছুই কেমন যেন অদ্ভুত রকমের ঘোর লাগানো। বারবার নিজের সাথে আয়াশের সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করছিল সে।
.
.
একটা সময় তো তিথির মনেই হয়েছিল ভালোবাসা জিনিসটার মধ্যে অভিনয় ছাড়া কিছুই নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম শব্দ ভালবাসা।
কিন্তু না, এই ধারণাটা তার ভুল প্রমাণিত হলো!
ভালোবাসার মতো পবিত্র সুন্দর শব্দ পৃথিবীতে আর একটাও নেই!

সেদিনের পর থেকে তিথি আর আয়াশের মধ্যিকার সকল দ্বিধা দূর হয়ে গিয়েছিলো। দুজনেই বেশ উপলব্ধি করতে পেরেছে দুজন দুজনকে পছন্দ করে; ভালোবাসার পর্যায়ে যেতে পেরেছে কিনা সেটা নিয়ে দুজনেই সন্দিহান!
.
.
.
এরই মধ্যে দিয়ে কোন এক শুভ লগ্নে অরিনের বিয়ে হয়ে গেল, হঠাৎ করেই।
বিয়ের দিন উপস্থিত ছিল আয়াশ, আকাশ, তিথি, তানিশা। তাছাড়াও আরো অনেক বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয় স্বজন তো ছিলই।

অরিনের শ্বশুরবাড়ি রংপুর। বেঁচে থাকা সত্ত্বেও দুই বান্ধবী আগের মত দেখা করতে পারবেনা, আড্ডা দিতে পারবেনা। অরিন আর তিথি দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলো।

অবশেষে চলে এলো বিদায়ের অন্তিম মুহূর্ত। অরিন যখন গাড়িতে গিয়ে বসলো, তখনই আয়াশের চোখ আটকে গেল বাইশ/তেইশ বছরের এক যুবতীর দিকে। তার কোলে দু-তিন বছরের একটা বাচ্চা।

আয়াশ তিথিকে তৎক্ষণাৎ এক সাইডে ডেকে নিয়ে আসলো। তিথির চোখ মুখ ফোঁলা, কান্নাকাটি করার কারণেই এই অবস্থা!

“কি হলো, এখন অরিন চলে যাবে। আমি ওর কাছে থাকবো না? আপনি আমাকে এভাবে নিয়ে এলেন কেন?”

“তোমাকে বলেছিলাম না, রায়ার কথা?”

“আপনার যে এক্স গার্লফ্রেন্ড ছিলো।”

“হুমম।”

“ওই তো সে!”
আয়াশ আঙ্গুলের ইশারায় দেখালো।
তিথি দেখল মেয়েটাকে। ওর দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল। কি সুন্দর মেয়েটা! আয়াশের মতো ওর গালেও টোল পরে। মেয়েটিকে দেখা মাত্রই তিথির বুকের ভিতর কেমন যেন অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে।

তারপরেও তিথির মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, “কি সুন্দর?”

আয়াশ অবাক হয়ে বললো, “কিসের, কি সুন্দর?”

“ওই আপুটা খুব সুন্দর।”

আয়াশ হাই তুলতে তুলতে বললো, “নজর দিও না কিন্তু তিথি, সে বিবাহিত।”

তিথির হঠাৎ করেই মনে পড়ল, তাই তো সে তো বিবাহিত। বুকের উপর থেকে শক্ত একটা পাথর নেমে গেল নিমিষেই।

হাসি হাসি মুখ করে বললো, “আমি কেন নজর দিব? আপনি নজর দেন।”

আয়াশ মুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বললো, “আমার তো নজর দেওয়ার মানুষ আছেই একজন।”

“কে সে?”

“বলবো না তো।”

“থাক। আমার জানতে হবে না। কিন্তু একটা কথা বলেন, এত বছর পর তাকে সামনে দেখে আপনার কোন অনুভূতি হচ্ছে না?”

“তার প্রতি আমার সব অনুভূতি আরো আগেই শেষ হয়ে গেছে।”

“আজাইরা!” মুখ বাঁকিয়ে বলল তিথি।

আয়াশ হাসলো। ঠিক সেই সময় রায়ার ও চোখ পড়ে গেল আয়াশের দিকে, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে!
তখন আয়াশ তিথি দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছিল।
রায়া আয়াশের দিকে এগিয়ে গেল।
আয়াশ তাকে লক্ষ করে নাই।
.
.
“কী খবর, কেমন আছো?”
অচেনা মানুষের আচমকা এমন প্রশ্ন থতমতো খেয়ে গেলো আয়াশ। সামনে তাকিয়ে দেখলো রায়া। রায়াকে তার সামনে এসে কথা বলতে দেখে অবাক হলো।
পরক্ষণে নিজেকে সামলিয়ে নিলো।
মুখের হাসির রেখা বড় করে বললো, “আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?”

“ভালো আছি।”

তিথি পাশেই দাঁড়িয়ে। সে ওদের কথোপকথনের মধ্যে থাকতে চাচ্ছিল না। আনইজি ফিল হচ্ছে।
তাই পিছন দিকে সরে যাচ্ছিলো। আয়াশ রায়ার সাথে কথা বলতে বলতেই তিথির হাত ধরে থামালো। তিথিও থেমে গেল।
দুজনের কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছিল না।
শেষ পর্যায়ে রায়া তিথির দিকে তাকিয়ে আয়াশকে প্রশ্ন করলো, “এই মেয়েটি কে? তোমার বউ নাকি?”
.
.
.
.
চলবে…..

#এই_প্রেম_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব_১২
#আফিয়া_আফরিন

সামনে থাকা মেয়েটির মুখে এমন কথা শুনে ভেবাচ্যাকা খেয়ে যায় তিথি। আয়াশ ও দেওয়ার মতো কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। তিথি পাশে দাঁড়িয়ে আছে, না হয় আয়াশ বলেই দিত যে ‘ভালোবাসার মানুষ’।
কিন্তু এখন কি উত্তর দেবে? সে তো শুধুমাত্র আয়াশের নিজস্ব ভালোবাসা! আয়াশ জানে তৃতীয় হয়তোবা তাকে পছন্দ করে, কিন্তু তবুও একটা দ্বিধা থেকে যায়।
এমন দ্বিধা নিয়ে কোন উত্তর দেওয়া যায় না।

এমন দ্বিধা দ্বন্দ্বের মুহূর্তে ওখানে এক ভদ্রলোক চলে এলেন। রায়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কি ব্যাপার এখানে কি করছ? যাওয়ার সময় হয়ে গেছে চলো।”

রায়া আয়াশ এবং তিথির দিকে তাকিয়ে বলল, “ইনি আমার হাজব্যান্ড।”

তারপর ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি যাও, আমি আসছি।”
রায়ার হাজব্যান্ড চলে গেলেই রায়া আয়াশের দিকে তাকিয়ে বললো, “ভালো থেকো তোমরা, সুখে থেকো।”

তারপর তিথির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মুচকি হাসলো। উত্তরে তিথি ও মৃদু হাসি দিল।
সত্যি কি এ জনমে তারা আয়াশের বউ হওয়ার সৌভাগ্য হবে?

রায়া সম্পর্কে অরিনেরর ননদ হচ্ছে, সেই সূত্র ধরে এখানে আসা।
অরিনের বিদায়ের সময় শেষবারের মতো দুই বান্ধবী একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো।
.
.
.
.
বিদায় পর্ব শেষ হলে চারজন একসাথে অরিনের বাসা থেকে বিদায় নিয়েই বের হলো। রাত সাড়ে আটটা পার হয়েছে।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আকাশ তিথিকে বললো, “দোস্ত, তুইও একটা বিয়ে করে ফেল।”

“কেন? আমি কেন? আমার তো কেউ নাই। তোর আছে, তুই কর।”

আকাশ তানিশা দুজনেই থতমত খেয়ে গেল। আকাশ স্বাভাবিকভাবে বললো, “ধুর, আমার আবার কে থাকবে?”

আয়াশ এতক্ষণ নিরব দর্শক হয়ে তাদের কথা শুনছিল। এবার সে সামনে এগিয়ে আকাশের কান টেনে বললো, “কেউ নেই, তাই না?”

আমতা আমতা করে আকাশ বললো, “আ আমার আবার কে থাকবে? কি বলো না বলো?”

“তাহলে তোতলাচ্ছিস কেন?”

“নার্ভাস! না মানে লজ্জা লাগছে, সবার সামনে এভাবে কান টেনে আছো কেন ভাইয়া?”

তিথি বললো, “লাইক সিরিয়াসলি! লজ্জা পাইলে মানুষ তোতলায়?”

এবার মুখ খুললো তানিশা। তিথির দিকে তাকিয়ে বললো, “আপু তাড়াতাড়ি বাসায় চলো। প্রচন্ড গরম বাইরে, ভালো লাগছে না।”

“কি ব্যাপার তানিশা? তুই এই ঠান্ডার মধ্যে গরম কোথায় পেলি? আর এভাবে ঘামছিস কেন?”

হেসে ফেললো আয়াশ। আকাশ আর তানিশার উদ্দেশ্যে বললো, “তোমরা দুইজন যে তলে তলে প্রেম করো সেটা আমরা ভালোভাবেই জানি।”

দুজনেই প্রচন্ড অবাক হলো। একই সাথেই দুজনের মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো, “কেমনে?”

আয়াশ মুচকি হেসে বললো, “ওমনেই!”

আকাশ কি করলো? লজ্জা পেয়ে দিল এক ছুট। তানিশা পড়ে গেল বেকায়দায়। তিথি তানিশার দিকে তাকালে, তানিশা বলে উঠলো,
“আল্লাহর দোহাই লাগে আপু। আমাকে আর কিছু বলে লজ্জা দিও না।”

তিথি আর আয়াশ দুজনেই হেসে ফেললো। এমন সময় তানিশার ফোনে আকাশের মেসেজ এল। সে দেখা করতে বলেছে। সামনেই আছে।
তানিশা অসহায় দৃষ্টিতে তাকানো তিথি এবং আয়শ এর থেকে। আয়াশ মনে হয় ব্যাপারটা ধরতে পারলো। সে বলল,
“যাও যাও রোমিওর ডাক করেছে তো।”

অনুমতি পেয়ে তানিশাও দিল দৌড়।
.
.
আয়াশ শক্ত করে তিথির হাত চেপে ধরলো। তারপর ফিসফিস করে বললো, “সরি!”

“সরি কেন?”

“তখন রায়ার ওই কথার জন্য।”

“কোন কথা?”

তিথি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে কোন কথা, তবুও আয়াশকে জিজ্ঞাসা করলো। সে আয়াশের মুখ থেকে শুনতে চায়।

আয়াশ বললো, “ওই যে বউ বলে সম্বোধন করার জন্য।”

তিথি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মেঘমন্ত্র বললো, “ইটস ওকে।”
.
.
তিথি বাড়ি ফিরে দেখল, তানিশা এখনো ফেরে নাই। তৎক্ষণাৎ ফোন করলো।
“তোদের প্রেমলীলা শেষ হলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আয়।”

“আসছি আপু। কাছাকাছি।”

তানিশা ফিরে এলে দু’বোন গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসলো।
তানিশার প্রতিটা গল্পই আকাশকে ঘিরে। একপর্যায়ে তিথি বলে উঠলো,
“আকাশকে বড্ড ভালোবাসিস তাই না?”

“খুব বেশি। ও যে ভালোবাসার মতনই একজন মানুষ।”

“প্রথম দিন তো ঝগড়া দিয়ে তোদের আলাপ শুরু হলো।”

“হঠাৎ করে আবার দুজনের প্রতি ভালোবাসা এসে পড়ল, সপ্তাহখানেক এর মধ্যে।”

“আকাশ নিঃসন্দেহে ভালো ছেলে। আর আমার বন্ধু হিসেবে সে বেস্ট। সবসময় আমার পাশে থেকেছে, সাপোর্ট করেছে। ইভেন আদিত্যের ব্যপারটা তেও আকাশ সবচেয়ে বেশি পাশে ছিল।”

“আর অরিন আপু?”

“অরিন ও যথেষ্ট করেছে। তবে কয়েক মাস ধরে ওর দাদু অসুস্থ ছিল। তাই ওর খুব ছোটাছুটি করতে হয়েছে। সেভাবে আমাদের টাইম দিতে পারে নাই। খুব মিস করবো রে, ওকে।”

“ফোনে কথা বলবে। তাহলেই তো হয়।”

তিথি কিছুক্ষণ হাসলো। তারপর বললো,
“অরিন আমার জীবনের অন্যরকম মানুষ ছিল। সে সবসময় আমার বড় বোনের মধ্যে ট্রিট করতো। আমার মন খারাপ হলে বুকে জড়িয়ে নিতো। এই সেই মজার মজার গল্প করে মন ভালো করতো।
এখন হয়তো শুধু ফোনে কথা হবে। কিন্তু কষ্ট, সুখ-দুঃখ আগের মত ভাগাভাগি করে নিতে পারব না তো। মন খারাপ হলে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেও পারবো না।
আর আগের সাথে এখনকার হিসাব ই বা মেলাচ্ছি কেন? এখন সে বিবাহিত, তার স্বামী সংসার আছে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো তিথি।

“বেশি ভালোবাসার মানুষগুলো কি তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায়, আপু?”

“এ কথা কেন বলছিস?”

“আমার না ভয় লাগছে আকাশ যদি কখনো আমায় ছেড়ে চলে যায়। অনেক বেশি ভালোবাসি ওকে।”

তিথি তানিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, “জানি তো! তবে এই ব্যাপারে আমি তোকে গ্যারান্টি দিচ্ছি, আকাশ ও তোকে ভালোবাসে। আর সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষরা কখনো একে অপরকে ছেড়ে যেতে পারে না। তারা অতি শক্ত করে যত্নের সুযোগ নিজের ভালোবাসাকে আজীবন টিকিয়ে রাখে।”

“আদিত্য ভাইয়া কি কখনোই তোমাকে ভালোবাসে নাই?”

“সেটা আদিত্য ভালো বলতে পারবে। পুরো একটা বছরের সম্পর্ক ছিল আদিত্যর সাথে। এত সহজে কিন্তু আলগা হওয়ার নয়। ৩৬৫ দিনের মধ্যে একদিন হয়তো ভালোবেসে ছিল, তাই এখন ব্যাক করতে চাই সে!”

“তুমি কি ফিরতে চাও?”

“কখনোই না। মনটা বোধহয় উল্টে পাল্টে গেছে রে। কোন এক ভালোবাসার সন্ধানে একজনের কাছে চলে গিয়েছে হয়তো।”
“ওরে আল্লাহ, কে সে?”

“আছে হয়তো একজন। পরে জানাবো।”
.
.
দুজনের গল্প করতে করতে রাতভোর হয়ে গেলো।ফযরের আযান দিলে দুজন উঠে নামায পড়ে ঘুমাতে গেলো।
ঘুম ভাঙলো সকাল এগারোটায়, তাও ফারজানা বেগমের ডাকে।

তিনি তিথি তানিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “তোরা যে এত বেলা করে ঘুমাস, বলি যে শ্বশুর বাড়িতে শ্বাশুরী জায়গা দেবে তোদের?”

“এমন জায়গায় বিয়ে কেন করবো মা, যেখানে ১০ টার আগে ঘুম থেকে উঠতে হবে?”

তানিশা ও তিথির কথায় তার মেলালো।

ফারজানা বেগম হাসতে হাসতে বললেন, “আল্লাহ্ ই ভালো জানে, তোদের কপালে কেমন শ্বাশুড়ি জোটে।
যাইহোক, হাত মুখ ধুয়ে খেতে আয় মা।”

দু’বোন খেয়ে দেয়ে গেল বাইরে ঘুরতে। তিথি আর তানিশা একসাথে হলে তাদের কখনোই ঘরে আটকে রাখা যায় না।
বয়সে একে অপরের থেকে চার বছরের ছোট বড় হলেও, একসাথে হলে দুজনেই বাচ্চা হয়ে যায়।

কিছুদূর যেতেই হঠাৎ আদিত্য উদয় হল তাদের সামনে। দুজনেই খানিকটা চমকে গেল।
আদিত্য তিথির মুখোমুখি দাঁড়ালো।
বললো,”আমাদের সম্পর্ক নিয়ে কি ভাবলে?”

“আমি যা ভেবেছি সেটা তোমায় জানিয়ে দিয়েছি আদিত্য।”
আদিত্য তানিশার দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি একটু ওই দিকে যাও। আমার তিথির সাথে ইম্পরট্যান্ট কথা আছে।”
তানিশা তাকালো তিথির দিকে। তিথি ইশারায় তাকে সরে যেতে বলল। তাই সে একটু সরে গিয়ে আড়ালে দাঁড়ালো।

আদিত্য সরাসরি তিথির দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমাকে আর একবার জিজ্ঞাসা করছি তিথি, আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে কি ভাবলা?”

তিথি তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো, ” তুমি আমায় থ্রেট দিচ্ছো আদিত্য? শুধু একবার কেন, হাজার বার জিজ্ঞাসা করলেও আমি একই উত্তর দিব। তুমি আমার যত বড়ই পিরিতের মানুষ হও না কেন, মন থেকে একবার উঠে গেছো আর জীবনেও পাত্তা পাবা না!”

তিথির এরূপ উত্তরে আদিত্যর মাথায় রক্ত উঠে গেল। আচমকাই ঠাস করে একটা থাপ্পর দিল তিথির গালে। সাথে সাথে ঠোঁট কেটে রক্ত বেরোলো। তিথি মোটেও এটার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। সে গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে আদিত্যর দিকে চেয়ে রয়েছে।

আদিত্য এক হাত দিয়ে তিথির চুলের মুঠি ধরে, আরেক হাত দিয়ে তিথির গাল চেপে ধরে পাশে দেওয়ালের সাথে ঠেসে দাঁড় করালো।
তারপর বললো, “তোর ডিমান্ড বেশি হয়ে গেছে তাই না? কি মনে করিস নিজেকে? এতদিন নিজে ভালবাসি ভালোবাসি করে মুখে ফেনা তুলতিস, আর এখন আমি তোকে ভালোবাসি তার দাম নাই তোর কাছে।
শুনে রাখো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালবাসি মানে ভালোবাসি!”

শেষের কথাটা সে তিথির চুলের মুঠে ধরে কয়েকটা ঝাকি দিতে দিতে বললো।

.
.
.
চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে