এই প্রেম তোমাকে দিলাম পর্ব-২১+২২

0
2000

#এই প্রেম তোমাকে দিলাম
#পর্ব_২১
#আফিয়া_আফরিন

আদিত্যকে দেখে চমকে উঠল তিথি। অনেকদিন পর আদিত্যের সম্মুখীন হওয়া।

আদিত্য প্রশ্ন করলো, “কেমন আছো?”

তিথি এখনো বিস্ময় ভাব কাটাতে পারে নাই।
কোনমতে বললো, “ভালো আছি। তুমি?”

“আমিও আছি।”

“ওহ।”

আয়াশ সামনে আসতে নিলে আদিত্যকে দেখে অবাক হয়ে যায়। সে আর এগোলো না। একটু আড়াল এ দাঁড়িয়ে রইলো।

আদিত্য বললো, “একজনকে একদিন খুব বাজে ভাবে ঠকিয়েছিলাম, তাই আজ নিজে নিজের কাছে ঠকে গেলাম।”

তিথি মৃদু হাসলো। আদিত্য ফের বলল, “এইটুকু অন্তত বুঝেছি তুমি ছাড়া আমাকে বোঝার মত কেউ নাই। তুমি ছাড়া আমাকে ভালোবাসার মতো কেউ নাই। কি অদ্ভুত মানুষ আমি! এতদিন চোখে রঙিন চশমা পড়েছিলাম, তাই তোমার ভালোবাসা দেখতে পাইনি। আর যখন উপলব্ধি করতে পারলাম, কি কপাল আমার তোমাকেই হারিয়ে ফেললাম!”

“হঠাৎ এতদিন পর এসব বলার জন্যই আসছো নাকি?”

“নাহ। একটা বিশেষ কারণে তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছিলাম কয়েকদিন থেকে। কিন্তু সুযোগ মতো পাচ্ছিলাম না তোমায়। আজ এখানে একটা কাজে এসেছিলাম, তোমায় দেখে তোমার সাথে কথা বলতে এলাম।”

“আচ্ছা, তোমার বিশেষ কারণটা কি?”

“আমাকে ক্ষমা করে দাও তিথি।”

“সেই সুযোগ আর কোনদিনও পাবা না আদিত্য। অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছ।”

“বিশ্বাস করো আজ আমি কোন সুযোগ চাইতে আসি নাই। আমি ক্ষণে ক্ষণে বুঝতে পারছি আমি ভুল করেছিলাম। তোমার সাথে দীর্ঘ এক বছরের সম্পর্ক ছিল আমার। কিভাবে যেন ভালোবেসে ফেলেছিলাম, নিজেই বুঝতে পারি নাই। এখন প্রতিটা মুহূর্তে আমি তা উপলব্ধি করতে পারছি, কিন্তু নিজেকে বোঝাতে বারংবার ব্যর্থ হচ্ছি। একটা ভিত্তিহীন প্রতিশোধের নেশায় আমি আমার ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছি। জেনে হোক বা অজান্তেই হোক তোমায় বহুৎ কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমায় প্লিজ ক্ষমা করে দাও তিথি। ক্ষমা না করলে যে আমি শান্তি পাচ্ছিনা।”

তিথি আনমনে কিছুক্ষণ হাসলো। তারপর বলল, “তুমি যেদিন সেই লেইম এক্সকিউজ দিয়ে আমার সাথে ব্রেকআপ করেছিলে সেই দিনই তোমার উপর আমার সব শেষ হয়ে গেছে। সেটা রাগ বলো, অভিযোগ বলো, অভিমান বলো কিংবা অধিকার! কিন্তু আমি সেটা কখনো বুঝতে পারি নাই।
অযথাই তোমাকে মনে করে, কেঁদে বুক ভাসিয়েছি। আর ক্ষমা করার কথা বললা না, ক্ষমা অনেক আগেই করে দিয়েছি। কারো ওপর অকারণ ক্ষোভ জমিয়ে রেখে আমি নিজেকে অশান্তি দিতে চাই না।”

ততক্ষণে আয়াশ এসে তিথির পাশে দাড়িয়েছে। আয়াশকে দেখে অবাক হলো আদিত্য, সাথে সাথে নাক মুখ কুঁচকে ফেলল।

তিথি এত কিছু খেয়াল করলো না। সে ফের বলতে শুরু করলো, “একদিন তুমি বলেছিলে না, তোমার গার্লফ্রেন্ড হওয়ার কোনো যোগ্যতা আমার নেই। তুমি ঠিকই বলেছিলে, সত্যি তোমার গার্লফ্রেন্ড হওয়ার কোন যোগ্যতা আমার নেই। শুধু তোমার কেন কারোর গার্লফ্রেন্ড হওয়ার যোগ্যতাই আমার নেই!”

তারপর আয়াশের দিকে আড়চোখে তাকালো।
ফের বলল, “কিন্তু কারো ভালোবাসার মানুষ হওয়ার যোগ্যতা আমার আছে।”

তিথির চোখের চাহনি, মুখের ভাবভঙ্গি, আয়াশ কে দেখে আদিত্য যা বোঝার বুঝে গেল।
স্থিরচিত্তে বললো, “ভালো থেকো তোমরা।”

তারপর চলে গেল। আয়াশ আর তিথি দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে স্বস্তি হাসি হাসলো।

.
.
সকাল দশটা বেজে পার হয়েছে।
তিথি একটু আগেই ভার্সিটিতে গেছে।
হঠাৎ করে কলিং বেজে উঠলো। ফারজানা বেগম দরজা খুলতে গেলেন। দরজা খুলেই বেশ অবাক হলেন তিনি। আকাশ আর আকাশের মাকে দেখে। আগে তো প্রায় তাদের দেখা হতো, মাঝখানে কয়েক মাস হচ্ছে দেখা হয় না।
দুজনে সালাম বিনিময় করে ভিতরে এসে বসলেন।

আয়েশা বেগম বললেন, “আপনার সাথে দেখা হল অনেকদিন পর। আজকে এসেছিলাম একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ বলবেন। আমি আসছি একটু।”

ফারজানা বেগম উঠে চা নাস্তা বানাতে গেলেন। তিনি এলে আয়শা বেগম বলতে শুরু করলেন, “আমার বড় ছেলে আয়াশ কে চেনেন না?”

এই মুহূর্তে আয়াশের কথা শুনে ফারজানা বেগম একটু অবাক হলেন। বললেন, “হ্যাঁ চিনি তো।”

“আমি আসলে তিথির সাথে ওর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম।”

হাসি ফুটে উঠলো ফারজানা বেগমের মুখে।
“এ তো খুবই খুশির খবর!”

“হ্যাঁ, তিথিরও তো মত থাকতে হবে।”

“আপনি কি মনে করেছেন তিথির মত নেই। ওই আরো আগে মত দিয়ে বসে আছে।”

“মানে?”

“দুই দিন আগে ওর জন্য সম্বন্ধ দেখছিলাম। তখন ওই বলল ও নাকি আয়াশ কে ভালোবাসে।”

অবাক হলেন আয়েশা বেগম।
আকাশ মনে মনে আওড়ালো, “এই হল আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী এবং ভাইয়ের কাহিনী! দুজনে মিলে চুটিয়ে প্রেম করছে অথচ আমি কিছু জানি না। ওয়েট, দেখাচ্ছি মজা!”

আয়েশা বেগম, ফারজানা বেগম মনসুর সাহেব মিলে একটা দিন ঠিক করল যেদিন ওদের আংটি পড়ানো হবে।
.
.
.
বিকেলবেলা আকাশ ফোন করলো তিথিকে। বললো,
“বান্ধবী, ভালো আছিস?”

“হ্যাঁ, কিন্তু আমার সাথে হঠাৎ করে এত ফর্মালিটি দেখাচ্ছিস কেন? কি হইছে?”
“কিছু না, বলতেছি যে মার্কেট করা শুরু করে দে বোন।”

“কিসের মার্কেট?”

“আমার ভাইয়ের বিয়ের সামনে, আসবি না বুঝি তুই?”

তিথি অবাক হয়ে বললো, “কার বিয়ে?”

“আয়াশ ভাইয়ার।”
বলেই আকাশ মিটিমিটি হাসতে লাগলো।

তিথি জিজ্ঞাসা করল, “কবে?”

“এই সপ্তাহের মধ্যে।”

“ও আচ্ছা, রাখছি। পরে কথা হবে।”

তিথি ফোন রাখতেই ঘর কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে দিল। মেয়েটার সাথে মজা করতে পেরে বেশ আনন্দ লাগছে। এখন সে নিশ্চয়ই আয়াশ কে ফোন করবে।

তিথি আকাশের কথা বিশ্বাস করলো না। আকাশের স্বভাব ই হচ্ছে কারণে অকারণে ফাজলামি করা।

তবুও দ্বিধা দূর করার জন্য আয়াশকে ফোন করল।

প্রথমেই অভিমানী কন্ঠে বলল, “কংগ্রাচুলেশন!”

আয়াশ অবাক হয়ে বললো,
“কিসের জন্য?”

“আপনার নাকি বিয়ে।”

“কার?”

“আপনার।”

“তোমায় কে বলছে আমার বিয়ে?”

“আকাশ যে বলল।”

“ধুরো, তুমি ওর কথা বিশ্বাস করছো। ফাজলামি করছো হয়তো।”

“ও বলল এক সপ্তাহের মধ্যে নাকি আপনার বিয়ে!”

“ওরে আল্লাহরে আমার বিয়ে আমি জানিনা। আচ্ছা দাঁড়াও।”

আয়াশ তিথির কল কেটে দিয়ে মায়ের কাছে গেল।
মাকে বলল, “মা তোমরা নাকি আমার বিয়ে ঠিক করেছ?”

আয়েশা বেগম ভুরু কুঁচকে বললেন, “কে বলল?”

“শুনলাম।”

“যা তো। আজাইরা সব কথা শুনে আমার সাথে প্যাচ প্যাচ করতে আসিস না। কাজ আছে আমার।”

আয়াশ মুখ কালো করে বলল, “আমার সাথে ওভাবে কথা কেন বলছো?”

“কথা বলিস না আমার সাথে, সর।”

আয়াশ বুঝলো তার মা হয়তো কোন কারনে রেগে আছে, তাই চুপচাপ চলে এলো।
আয়েশা বেগম নিজ মনে হেসে দিলেন। বেচারা ছেলেটা তার বড় কনফিউশন এর মধ্যে পড়েছে। সমস্যা নাই, আর মাত্র হাতে গোনা কয়েকদিন। তারপরে সব কনফিউশন দূর হয়ে যাবে।

দিনগুলো এভাবেই হাসি আনন্দে কেটে যেতে লাগলো। আয়াশ আর তিথির সমীকরণ টা দিনকে দিন সহজ হচ্ছে, বোঝাপড়ার সম্পর্কটা বেশ গাঢ় হচ্ছে।

ওই দিনের পর কেটে গেল পাঁচ দিন। এই পাঁচটা দিন খুব ভালোভাবে কাটলেও বিপত্তি নেমে এলো ছয়দিনের দিন রাতের বেলা।

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে তিথি মা এসে বললেন, “তোর ফোনটা দে তো আমায়।”

তিথি একটু অবাক হল তার মাকে ফোন দিয়ে দেয়। কারণ প্রায় তিনি তার ফোনে ব্যালেন্স না থাকায় তিথির ফোন নিয়ে কথা বলেন।
তিথি ভাবল এইবারও সেই রকম কিছু হবে। কিন্তু না, উল্টো একটা ঘটনা ঘটে গেল।
ফারজানা বেগম ফোন হাতে নিয়ে বললেন, “আজকে রাতে ফোনটা আমার কাছে থাক।”

বলেই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে গেট লক করে দিল। তিথি কোনমতেই কিছু বুঝতে পারল না।
.
.
আয়াশের মাও ঠিক একই কাজ করল আয়াশের সাথে। আয়াশের ফোনটা নিয়ে নিজের কাছে রেখে তাকে রুমে বন্দী করে রাখলো।
কিছুক্ষণ পর একটা অফ হোয়াইট কালার পাঞ্জাবি দিয়ে বললেন, “কালকের জন্য এটা, রেডি হয়ে থাকবি।”
আয়াশ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।

একটি শহরে থাকা দুটি মানুষ দু প্রান্তে থেকে সারা রাতটা কি ভীষণ অস্থিরতার মধ্যে কাটালো, তা বোঝার সাধ্য ঐ দুইজন ব্যতীত কারোরই নাই।
.
.
.
.
সকালবেলা।
সারাটা দিন কাটল খুব অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে।
বিকাল ৫ টা পার হয়েছে।
ফারজানা বেগম তিথির ঘরের দরজা খুলে একটা হালকা গোলাপি রঙের জামদানি শাড়ি হাতে দিয়ে বললেন, “এটা পড়ে রেডি হো‌ তাড়াতাড়ি।”

তিথি অবাক হয়ে বলল, “কেন?”

“যা বলেছি তাই করবি, অযথা প্রশ্ন করে মাথা খাবি না।”

“আচ্ছা, আমার ফোন দাও আগে।”

ফারজানা বেগম মেয়ের কথার উত্তর না দিয়ে নিজ দায়িত্বে শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে রেডি করিয়ে দিলেন।
তিথি থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। সামনে কি হতে যাচ্ছে সে এখনো তা জানে না!

বিকেলবেলা আয়াশের ঘরে গিয়ে আয়শা বেগম তাকে রেডি হতে বললেন।
আয়েশা বেগম এখানে একটা মিথ্যা কথা বললেন।
বললেন, তার এক আত্মীয়ের বিয়ে সেখানে যেতে হবে আজকে।
তাই আয়াশ নির্দ্বিধায় তৈরি হয়ে নিল।
.
.
সন্ধ্যার পরপর তিথিরা চলে এলো এক বিশাল কমিউনিটি সেন্টারে। তিথি এখানে এসে অবাক। কেউ তাকে কিছু বলছে না। কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেই শুধু মুখ টিপে হেসে যাচ্ছে।
তিথি একপর্যায়ে উঠে গিয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করল, “তোমরা কি এখানে আমায় বিয়ে দেয়ার জন্য নিয়ে আসছো?”

“এত কথা বলিস না, যা।”

“প্লিজ মা বল। তোমরা কি আমাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছো?”

“যদি তাই মনে হয়, তাহলে তাই।”

তিথি বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। সবকিছু কেমন যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। চারিপাশে এত ঝলমলে আলো, কিন্তু তার সবকিছু অন্ধকার লাগছে। ‌তারমানে, তার মা বাবা আগে থেকেই সব পরিকল্পনা করে রাখছে।
তিথি একসাইডে দিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো।

কিছুক্ষণ কেটে গেল এমন অস্থিরতার মধ্যেই। এমন সময় সামনে থেকে তিথিকে কেউ ডাক দিল।
“তিথি!”

তিথি মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল আয়াশ। অবাক হলো সে। কিন্তু এটা স্বপ্ন না বাস্তব তা ধরতে পারল না। মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল আয়াশের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে। কিন্তু আয়াশকে ছোঁয়া মাত্র সে যদি স্বপ্নের মত হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
.
.
.
আয়াশ এখানে কি তিথিকে দেখে বিস্ময়ের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেল। তিথি এখানে কেন? তাও আবার এই রকম সাজে!

কোনমতে মুখে কথা ফুটিয়ে বললো, “তুমি এখানে?”

তিথি উত্তর দিতে পারল না।
তার আগেই আকাশ, তানিশা অরিন আর তাদের কাজিনরা মিলে সমস্বরে চিল্লায় বলে উঠলো,
“আজ তোমাদের এনগেইজমেন্ট!”
.
.
.
.

চলবে…..

#এই_প্রেম_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব_২২
#আফিয়া_আফরিন

তিথি আর আয়াশ দুজনেরই অবাক হওয়ার ক্ষমতাটাও নষ্ট হয়ে গেছে।
হ্যাঁ হয়েছে চেয়ে রয়েছে।
‘আজ তোমাদের এনগেজমেন্ট’ এই শব্দটা এখনো কানে ঝংকার তুলছে।
এটা কি আদৌ সত্যি কথা? নাকি ফের তাদের সাথে কোন মজা করা হচ্ছে।
উত্তর খুঁজতে তিথি তাকালো তার মায়ের দিকে।
ফারজানা বেগম মুচকি মুচকি হাসছেন।
বললেন, “আর দেরি করার দরকার নাই। মেইন দুইজন যেহেতু এসে গেছে, অনুষ্ঠান শুরু করা যাক।”
এরপর তিনি তানিশার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আংটিটা দিয়ে যা।”

তানিশা এসে আয়াশ এবং তিথির সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “চাপ নিও না আপু এবং ভাইয়া। তোমাদের এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান আরও সপ্তাহখানেক আগে ঠিক করা হয়েছিল। জাস্ট তোমাদের সারপ্রাইজ দেবো বলে কিছু জানানো হয়নি।”

তিথি আয়াশ দুজন দুজনের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকালো।
.
.
অতঃপর তাদের আংটি বদলের অনুষ্ঠান শুরু হলো।
আয়াশ খুব সযত্নে তিথির হাত ধরে আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে দিলো।
এভাবে এত মানুষের সামনে আয়াশ থেকে হাত ধরলো।
লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে তিথি।
ভিতর থেকে বারবার উপচে আসছে, “ইস, কি লজ্জা! কি লজ্জা!”

তিথি ও আয়াশকে আংটি পরিয়ে দিল। কিন্তু, সারাটা মুহূর্ত তাকে সমস্ত লজ্জা রা ঘিরে রেখেছিল।

সবাই যখন বিয়ে নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিল আয়াশ তখন তিথির পাশে গিয়ে আলতো করে ঘাড়ে টোকা দিল।
তিথি লজ্জাবতী গাছের ন্যায় নিজেকেও লজ্জায় গুটিয়ে ফেলল।
আয়াশ সামান্য ঝুঁকে এসে বলল, “কি হলো?”

তিথি আয়াশকে হালকা ধাক্কায় একটু সরিয়ে দিয়ে বলল, “কি করছেন কি আপনি? এখানে কত মানুষ!”

“আমি আবার কি করলাম?” ঠোঁট উল্টে জবাব দিল আয়াশ।

তিথি কিছু বলতে যাবে তার আগে আকাশ সামনে এসে বলল, “ভালোই তো ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে তোমাদের!”

আয়াশ উত্তর দিল, “ডুবে ডুবে জল কখন খাইলাম?”

“বুঝি বুঝি। প্রেম করলা আমার বান্ধবীর সাথে আমাকে একবার বললেও না।”
তারপর তিথির দিকে তাকিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল, “তুই তো শালি আরেক মীরজাফর। তোর সাথে আসলে মীর জাফরের বিয়ে হওয়া উচিত ছিল। তুইও আমায় একবারও বলিস নি। কি হতো আমায় বললে?”

তিথি অসহায় মুখে তাকালো দুই ভাইয়ের দিকে। বলল, “মাঝখান থেকে আমায় ফাঁসিয়ে দিলি তো! উনিই তো কিছু বলে নাই।”

আকাশ অবাক হলো।
বলল, “তুই কি ভাইয়াকে আপনি আপনি করে ডাকিস নাকি?”

“হু।”

“কেন?”

“এমনিতেই ভালো লাগে তাই।”

“হুশশশশ, ঢং!”

তিথি বা আয়াশ কেউ আর কিছু বলল না।

ওই সময় তানিশা পাশ থেকে এসে বলল, “সারপ্রাইজ টা কেমন ছিল তোমাদের?”

তিথি কিংবা আয়াশ কেউ কিছু বলল না। এটা সারপ্রাইজের থেকেও তাদের কাছে অনেক বড় কিছু ছিল। যা কখনোই ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।
তাই দুজনেই মৌন হয়ে রইল।
তানিশা এতকিছু পাত্তা না দিয়ে ফের বলল, “আজকে যেমন তোমাদের এনগেজমেন্ট হলো, তোমাদের না জানিয়ে। তোমাদের বিয়েও দিব তোমাদের না জানিয়ে।
সেটা আরও বড় সারপ্রাইজ হবে।”

তিথি হাসতে হাসতে বলল, “বিয়ের কথা জানানো লাগবে না। ওইটা এমনিতেই জানা যাবে।”
.
.
.
রাতে তারা সবাই সেখানেই খাওয়া দাওয়া করল। বাড়ি ফেরার মুহূর্তে মনসুর সাহেব তিথিকে ডেকে বললেন, “আমরা আজ তোর চাচার বাসায় যাব। সে নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তুই আর তানিশা বাড়ি ফিরে যা।”

এটা শুনে আয়াশ বলল সে নিজে বাড়ি নিয়ে যাবে তাদের। আশ্বস্ত হলেন মনসুর সাহেব।
.
.
রাস্তায় বের হওয়া মাত্রই তানিশা বলে উঠলো, “আপু তুমি আর ভাইয়া একসাথে যাও। আমি একটা রিক্সা নিয়ে যেতে পারবো একাই। কাবাব মে হাড্ডি হওয়ার শখ আমার একদমই নেই! তোমরা বরং কচ্ছপের নাই ধীরে ধীরে পা চালিয়ে এসো।
সারা রাস্তা এই সেই গল্প করতে করতে আসো, কতো কথা জমে আছে দুজনের।
আমি চললাম।”
বলেই তানিশা আর দাঁড়ালো না। দ্রুত পা চালিয়ে রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্য।

তানিশার এভাবে কথা বলার ধরন দেখে লজ্জায় পড়ে গেল তিথি। মাথা নিচু করে আছে সে।

আয়াশ তিথির থুতনি ধরে মাথা উপর দিকে উঠিয়ে বলল, “তোমার এত লজ্জা পাওয়ার বাতিক কেন, বলতো?”

তিথি উত্তরে সামান্য হাসলো।
আয়াশ কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললো, “চলো।”

“কোথায় যাবেন?”

“সামনে হাঁটতে থাকি চলো।”

তিথি দুপাশে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
.
.
.
.
আজ সম্ভবত জ্যোৎস্না রাত। গোল থালার মতো বিশাল একটা চাঁদ উঠেছে আকাশে। নিজের অবস্থান থেকেই সামনে দূর-দূরান্তে বহুদূর দেখা যাচ্ছে।
প্রকৃতির এতটাই স্বচ্ছলতা!

এই রাস্তাটা বেশ সরু। পিচঢালা একটা রাস্তা। গাড়িঘোড়া যাতায়াত করে খুবই কম। চারিপাশটা নানান ধরনের গাছ পালার বেষ্টনীতে আবদ্ধ।
তিথি আর আয়াশ পাশাপাশি দুজন দুজনের হাত ধরে হাঁটছে।

দমকা হাওয়া বইছে। হঠাৎ করে আকাশে মেঘের গুড় গুড় শব্দ শোনা গেল। হয়তো বৃষ্টি আসবে।

তিথি খুব ইচ্ছা ছিল বৃষ্টিতে ভিজার, সেই ইচ্ছেটা অবশ্য এখনো পর্যন্ত বহমান।
আজ সেই ইচ্ছেটা পূরণ হলে মন্দ হয় না!
আরেকদিন যখন বৃষ্টিতে ভেজার প্রহারও ইচ্ছেটা হচ্ছিল, তখন কেবলমাত্র আয়াশের সাথে সম্পর্কটা ছিল তার ভালো লাগার।
আর এখন সম্পর্কটা অন্যরকম। এইতো, আর মাত্র কয়েকটা দিন শুধু বাকি। তারপরই তো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে দুটি হৃদয়।
.
.
গুড়ি গুড়ি ফোটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। তিথি হাত মেলে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ফোটা গুলো গায়ে মাখছে। আয়াশ প্রশ্বচ্ছ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, আর ভাবছে,
“আচ্ছা পৃথিবীর সব মেয়েরাই কি এরকম সুন্দর হয়? নাকি শুধুমাত্র ভালোবাসার মানুষটি এত সুন্দর আর স্বচ্ছ হয়! তাদের সবার মধ্যে এরকম নেশা জাগানো একটা ভাব থাকে কি?”

আয়াশের ধ্যান ভাঙলো তিথির ডাকে। তিথি বলল, “কি হলো, এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

“তোমায় দেখছি!”

তিথি ভুরু কুঁচকে বলল, “আমায় আবার কি দেখছেন? এর আগে কখনো দেখেন নাই?”

“দেখেছি, তবে এই রূপে তো কখনো দেখি নাই। তার মধ্যে পড়েছ শাড়ি, সেই শাড়ি পড়েই আবার বৃষ্টিতে ভিজছো।
চোখের কাজল গুলো লেপটে গেছে। ঠোঁটে লিপস্টিক উঠে গেছে। এই সূক্ষ্ম সাথে তোমায় দেখে আমার নিজের কাছেই নিজেকে মাতাল মাতাল লাগছে!”

তিথি নিজেই নিজের কপাল চাপরে বললো, “পাগল হয়ে গেছেন আপনি?”

“হয়তোবা।”
.
.
অতঃপর দুজনে গিয়ে নদীর কিনারে বসে পড়ল।
আজও তিথি নিজে থেকে আয়াশের কাঁধে মাথা রাখলো।
আর যে কোন দ্বিধা, জড়তা নেই।
মাত্র আর কিছু সময়ের ব্যবধানে এই মানুষটা একদম নিজের হয়ে যাবে। নিজের সত্তায় মিশে যাবে।
আয়াশ দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে নিলো তিথিকে।

দূর থেকে তিথি আয়েশকে দেখে যে কেউ মনে করবে, ‘ছায়া ময় দুটি সুদর্শনী মানব মানবী!’

দুজনের কতশত গল্প মিশে যাচ্ছে এই নদীর পাড়ে।
কত স্বপ্ন বুনছে তারা এই নদীর তীরে বসে।

আয়াশের খুব ইচ্ছে করলো নিজের একটা প্রগাঢ় ঠোঁটের ছোঁয়ায় তিথি উন্মুক্ত কপাল কে আবদ্ধ করতে!
কিন্তু সে করলো না, নিজেকে দমিয়ে রাখল। সঠিক একটা সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
.
.
.
.
এতক্ষন রিমঝিম ধারায় বৃষ্টি পড়লেও এখন প্রবল বেগে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাতাস আর বৃষ্টির ঝাপটা সামনে এগোনো দায় হয়ে যাচ্ছে। তিথি আয়াশ এমন তান্ডবের মধ্যেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
তিথির চোখে মুখে তার চুলগুলো বারবার লেপটে যাচ্ছে। আয়াশ এক পলক দেখে খুব সযত্নে কানের পাশে গুজে দিয়ে, চুলগুলো নিজ হাতে খোঁপা করে দিল।

তপ্তশ্বাস ছাড়লো তিথি। আয়াশের সামান্য এইটুকু ছোঁয়াতেই কেমন জানি ভেতরটা উথাল পাথাল হয়ে যায়।
আয়াশ স্মিত হাসলো।

আচ্ছা, এই মানুষটা এত হাসে কিভাবে? বিন্দু পরিমাণ গম্ভীরতা নেই কেন তার ভিতর?
সে কি বোঝে না, এই হাসি মাখামুখ খানাতেই বারবার হারিয়ে যায় তিথি।

হাঁটতে হাঁটতে তারা বাড়ির সামনে চলে এসেছে। মেইন গেটের ভেতর পর্যন্ত এলো আয়াশ।
তিথি বিদায় নিয়ে যেইনা উপরে উঠতে নিবে তখন আয়াশ এক হাতে টেনে তাকে একেবারে নিজের কাছে নিয়ে এলো।

তিথির একটা হাত এসে পড়ল আয়াশের বুকে। আয়াশের প্রতিটা হৃদস্পন্দন হারে হারে টের পাচ্ছে তিথি। আয়াশের প্রতিটা নিঃশ্বাসে বারবার কেঁপে উঠছে তিথি।

আয়াশ তাকালো তিথির দিকে। তিথিও আয়াশের চোখে চোখ রাখল। কি স্বচ্ছ সেই চোখের চাহনি!
এই চাহনির দিকে দৃষ্টি নিহিত করলেই বোঝা যাবে কি পরিমান ভালবাসা সে আবদ্ধ করে রেখেছে!
মায়া জড়ানো দৃষ্টি নিবদ্ধ করল দুজন দুজনার দিকে!

বৃষ্টিতে ভেজার ফলে আয়াশের চুলগুলো কপালে লেপটে রয়েছে। এতেই তাকে আরো বেশি সুদর্শন লাগছে। তিথি সযত্নে চুলগুলো সরিয়ে দিল।
নিজের ভেজা হাতেই আয়াশের সারা চোখে মুখে হাত বুলালো।

আচমকাই তিথি পা উঁচু করে আয়াশের গালে এক হাত রেখে ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো।
আয়াশ নির্দ্বিধায় দুই হাত দিয়ে তিথির কোমর জড়িয়ে ধরলো অকপটে!
.
.
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল এভাবে। তিথি আয়াশ কে ছেড়ে লজ্জায় উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
তিথি এত লাজুক ধরণের মেয়ে, এটা কখনো সে করবে আয়াশ বা তিথি দুজনের কারোর ই বিশ্বাস হচ্ছে না এখনো।

সবকিছু স্বপ্নের মত লাগছে। তিথির পক্ষ থেকে আসা এই অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শটুকু সামান্য ছিল না আয়াশের কাছে।
অনেক, অনেক, অনেক বড় কিছু ছিল।
তিথির থেকে পাওয়া প্রথম এমন গাঢ় স্পর্শ!

আয়াশ তিথিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
নেশা জড়ানো কন্ঠে বলল,
“সেই দিনটা খুব বেশি দেরি নেই, অতি সন্নিকটে সেই দিন।
যেদিন এই লেপ্টে যাওয়ার শাড়ির মতো অঙ্গে তোমার জড়িয়ে যাব!”
.
.
.
.

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে