উত্তরাধিকার পর্ব-০৯

0
1032

#উত্তরাধিকার
#৯ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



এতো দিন সবকিছু ঠিক ভাবেই চলছিল। সমস্যা টা শুরু হলো আরো বছর খানেক পরে। হেমার মা তখন মারা গেছেন।বাবা আছেন। তবে সেও বড় অসুস্থ। কোন রকম জীবন পাড় করছেন কষ্টে।
কিছুটা অপ্রকৃতিস্থের মতোও হয়ে গেছেন তিনি। এলোমেলো কথা বলেন। মাঝেমধ্যে নিজের মানুষদেরকেই চিনতে পারেন না।হেমাকেও কয়েকবার নিজের সন্তান বলে অস্বীকার করেছেন।এ নিয়ে হেমার কী কান্না!কী কষ্ট!
সেদিন বাবাকে দেখতে গেলে বাবা যা করলো।সবার সামনে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে বললো,’আমার কোন ছেলে মেয়ে নেই। এখানে কেন এসেছিস? আমার ধন সম্পদ কেড়ে নিতে চাস?এই সুযোগ পাবি না।ধন সম্পদ আমি লিখে দিবো ভাই ভাতিজার নামে?’
হেমা কেঁদে কেটে বাবার বাড়ি ত্যাগ করে নিজের বাসায় ফিরে এলো।
এই সুযোগে হেমার চাচারা কৌশল খাটিয়ে ভিটে সহ সবটুকু জমি তাদের নিজেদের নামে লিখিয়ে নিলো। আজমল হোসেনের এখন নিজের একটি ঘর আছে,ঘরের সামনে এক চিলতে উঠোনে সবুজ কিছু দূর্বাঘাস,লতা গুল্ম,দুটি আম গাছ,একটি কাঁঠাল গাছ,আর তিনটে পেয়ারা গাছ আছে।আর আছে পুকুরের জল, সেই জলে গোটা কতক রুই কাতলা আর মৃগেল মাছ। এইগুলো থাকলেও ওই পুকুরটি কিম্বা ঘরের আর উঠোনের জায়গাটুকু এখন আর তার না!এর মালিক আজমল হোসেনের আপন তিন ভাই।
হেমা এই জন্য জেল পুলিশ করতে চেয়েছিল। কিন্তু মেহের বলেছে এসব করে লাভ নাই।মান সম্মান নষ্ট হবে। আমার তো অনেক কিছু আছে। বাবাকে বলো এখানে এসে যেতে। আজমল হোসেন অপ্রকৃতিস্থ হওয়ায় মেয়ের এই প্রস্তাবকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি বললেন, আমায় নিয়ে মেরে ফেলবার পরিকল্পনা করছিস। এই সুযোগ পাবি না। তিনি আরো বললেন,যতোদিন বেঁচে আছেন ততদিন নিজের ঘরেই থাকবেন।মেয়ের বরের বাড়িতে আশ্রিতা হবেন না! তিনি অতো ছোট লোক না।যদি প্রয়োজন হয় তবে যেন তার বর চৌদ্ধ গুষ্ঠী নিয়ে তার বাড়িতে এসে হাজির হয়।সারা জীবন এদের তিনি বিনা শর্তে খাইয়ে পরিয়ে নিবেন। এতে তার আধ আনা সম্পত্তিও ফুরোবে না!
শুধু যদি এই দুঃখটাই হতো হেমার তবে বড় ভালো ছিল।সংসারে তো সে সুখের ছিল। কিন্তু এখানেও আগুন লাগলো ঠিক এই সময়টিতেই।যেন সাঁজবাতি এই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষাটিই করে গেছে এতো দিন!
হেমা কিন্তু এই এতো দিন জানতো সাঁজবাতি তার আপনার বোন। কিন্তু যেই না সাঁজবাতির গর্ভে সন্তান এলো এবং গর্ভের সন্তানের বয়স হলো পাঁচ মাস তখন থেকেই যেন সাঁজবাতি বদলে যেতে শুরু করলো। আগে সে অফিসে যেতো। এখন যায় না। ঘরের টাকা পয়সা গহনা ঘাটি দলিল পত্র সবকিছু জমা থাকতো হেমার কাছে। কিন্তু একদিন এক অদ্ভুত কান্ড ঘটে গেল। হেমা সোকেশের উপর চাবির গোছা রেখে বাথরুমে গেছে শাওয়ার নিতে।আর এই সুযোগে চাবি দিয়ে আলমারির লক খুলে পাঁচ লাখ টাকা সরিয়ে দিয়েছে সাঁজবাতি। তারপর আবার আলমারিতে লক দিয়ে জায়গামতো চাবির গোছা রেখে দিয়েছে। সমস্যা টা অবশ্য সেদিন হয়নি। সমস্যা টা হয়েছে এর আরো সপ্তাহ খানেক পরে।যেদিন কী এক প্রয়োজনে ঘরে রাখা দশ লাখ টাকা চায়লো মেহের হেমার কাছে।হেমা টাকা আনতে গিয়ে দেখে দশ লাখের বান্ডিল থেকে পাঁচ লাখ উধাও।সে খুব করে খোঁজাখুঁজি করলো। কিন্তু টাকার হদিস পেলো না।চিন্তায় তার জীবন যায় যায়!
সে তো জানে না এই টাকা থেকে এক টাকাও নিজের জন্য খরচ করতে।সে ভয়ে ভয়ে গিয়ে মেহেরের হাতে পাঁচ লাখ টাকা তুলে দিলো।মেহের বললো,’দশ লাখ আনবে তো পাঁচ লাখ নিয়ে এলে কেন?’
হেমা বললো,’আর পাঁচ লাখ নাই ওখানে!পাচ্ছি না খোঁজে। অনেক খুঁজেছি!’
বড় সরল মেয়েটি হেমা।অত সাত পাঁচ সে কোন কালেই বোঝেনি।তাই সরল করে উত্তর দিয়েছে। যদিও এই পাঁচ লাখ টাকা মেহেরের জন্য কিছুই না। এমন পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে বিয়ের আগে সে সাঁজবাতিকে ঈদের মার্কেট করে দিয়েছে।প্রায় অর্ধ কোটি টাকার গাড়ি কিনে দিয়েছে। তবুও কেন জানি এই পাঁচ লাখ টাকা নিয়েই সে মেজাজ দেখাল হেমার সাথে। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে ওর গালে চড় বসিয়ে দিলো দু দুটো। তারপর ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো সামনের দিকে।নিচে পড়ে গিয়ে ঠোঁট কেটে রক্ত বেরোতে লাগলো গলগল করে।মেহেরের একটুও মায়া হলো না।সে বরং বললো,’তোরে দিয়ে কী করবো বল?তুই তো অকর্মার ঢেকি!না আছে রুপ না দিতে পারলি সন্তান। এবার দেখি টাকাও রাখতে পারিস না নিজের জিম্মায়।নাকি চুরি করে বাপকে দিয়ে দিয়েছিস?’
মেহের এর আগে কখনো হেমার গায়ে হাত তুলেনি।জোরে ধমক দেয়নি।দুটি কটু কথা বলেনি। কিন্তু আজ আবার তার চুলে ধরলো।গালে থাপ্পড় দিয়ে আবার বললো,’টাকার প্রতি লোভ এসে গেছে না?কী ভেবেছিস তুই?ওর সন্তান হবে আর তোর হবে না। এই জন্য টাকা সরাতে শুরু করেছিস।ঘর বাড়ি প্রপার্টি করবি তাই না? তারপর এ বাড়ি ছেড়ে শান্তি করতে নিজের কেনা বাড়িতে চলে যাবি?’
হেমা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো।
এই সময় এলো সাঁজবাতি। এমন ভাবে এলো যেন সে আধমরা। এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বললো,’এসব কী শুরু করলে তোমরা? পাঁচ লাখ টাকার জন্য তুমি আপুর গায়ে হাত তুলেছো। ছিঃ! হয়তোবা আপু টাকাটা কোন প্রয়োজনে খরচ করে ফেলেছে। এই পাঁচ লাখ টাকা কী তোমার কাছে বিরাট কিছু! এতিমখানাতেই তো তুমি প্রতি বছর এরচেয়ে বেশি টাকা দেও।তো এই সামান্য পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে এসব কী শুরু করলে তুমি!’
মেহের আর কোন কথা বললো না। চুপচাপ বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।ও চলে যাওয়ার পর সাঁজবাতি বললো,’আপু,বলেও তো নিতে পারতে টাকাটা!কেন শুধু শুধু মার খেলে?’
হেমা অবাক হলো। ভীষণ ভীষণ অবাক হলো।কী বলছে এসব সাঁজবাতি তাকে। টাকাটা নাকি সে সরিয়েছে!
হেমা কেঁদে কেঁদে বললো,’এসব কী বলছিস রে তুই সাঁজ?আমি কেন টাকা নিবো এখান থেকে!’
সাঁজবাতি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,’যা হয়েছে তো হয়েই গেছে। এই সামান্য কটা টাকা নিয়ে এসব ঝগড়া ঝাঁটি করা মোটেও উচিৎ হয়নি। তুমি ডেটল দিয়ে ঠোঁট ধুয়ে নেও। তারপর শুয়ে থাকো গিয়ে। রেস্ট নেও।’
হেমা কেঁদে কেঁদে তার ঘরের দিকে চলে গেল।
আর ভাবতে লাগলো জীবন এমন কেন? পৃথিবীতে সহজ সরল মানুষ গুলোর অত দুঃখ কেন?

সে রাতেই কিন্তু হেমার হাত থেকে আলমারি,সোকেশ এবং আর যা কিছুর চাবি আছে সেই চাবির গোছা চলে গেল সাঁজবাতির হাতে।সাঁজবাতির মুখ দিয়ে বলতে হয়নি যে চাবি আমার হাতের মুঠোয় দাও।সে শুধু একটু দূরন্ত বুদ্ধি খাটালো।এতেই হয়ে গেল। বাকী কার্জ সমাধা করলো মেহের নিজে।সে রাতে ডেকে নিলো হেমাকে।হেমা মনে মনে ভাবলো মেহের বুঝি তার কাছে সরি বলতে ডাকছে। হয়তোবা খানিক আদর করে দিবে!কেটে যাওয়া এবং ফুলে থাকা ঠোঁট দেখে লজ্জিত হবে। কিন্তু হেমাকে ভীষণ রকম চমকে দিয়ে মেহের বললো,’সবগুলো চাবি নিয়ে এসো আমার কাছে।কোয়িক!’
হেমা বুঝতে পারলো না। তবুও সঙ্গে সঙ্গে সে ঘর থেকে সবগুলো চাবি এনে মেহেরের হাতে দিলো।
মেহের সেই চাবি নিয়ে একটা একটা করে আলমারি,সিন্ধুক,সোকেশের ড্রয়ার খুলে খুলে দেখলো সবকিছু ঠিক আছে কি না। তারপর দেখে শুনে সাঁজবাতির হাতে চাবিগুলো তুলে দিয়ে বললো,’এইগুলো তোমার আমানতে।’
সাঁজবাতি অবাক হওয়ার ভান করে বললো,’ও মা,আপুর চাবি আমায় দিচ্ছো কেন?’
মেহের বললো,’আপুর চাবি না আমার চাবি। আমার চাবি আমি তোমায় দিচ্ছি।’
সাঁজবাতি আর কিছু বললো না!

এরপর থেকে একে একে ভয়াবহ কিছু ঘটনা ঘটতে লাগলো এ বাড়িতে। সবগুলোই হেমার সাথে ঘটছে। সাঁজবাতির তখন ছ মাস চলে।হুট করে একদিন সে বললো,’খাটের উপর চাবি রেখে সে বাথরুমে গেল। এসে দেখে চাবিটা খাটের উপরই কিন্তু আগের স্থানে নেই। সামান্য দূরে।তার মনে এটা দেখে কেমন খটকা লাগলো।তাই সে আলমারি খুলে দেখলো একটা গহনার বক্স উধাও।কী সর্বনাশের কথা!
এই কথাগুলো সে মেহেরকে ফোন করে জানালো। যদিও এইগুলো সম্পূর্ণ বানোয়াট কথা।সাঁজবাতি নিজেই গয়নার বক্স লুকিয়ে রেখে মেহেরকে এসব বললো।
মেহের অফিসে ছিল।শোনে অফিস ফেলে রেখে সঙ্গে সঙ্গে সে বাসায় এলো। এবং কোন কথাবার্তা ছাড়াই হেমাকে ডেকে কাছে আনলো।এনে বললো,’বক্সটা কোথায় লুকিয়েছো?’
হেমা বড় অবাক হলো।বললো,’কিসের বক্স?’
মেহের বললো,’যেটাতে গোল্ড ছিল।’
হেমা আঁতকে উঠলো শোনে।সে বললো,’আমি কীভাবে জানবো বক্সের কথা? আমার কাছে কী চাবি আছে নাকি?’
‘চুরি করার ইচ্ছে হলে চাবির অভাব হয় না!’
হেমা কেঁদে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে হাউমাউ করে।
মেহের বললো,’কান্নাকাটি করে তো কোন লাভ হবে না।বক্সটা বের করে দাও ভালোয় ভালোয়!’
হেমা কেঁদে কেঁদেই বললো,’আল্লার কসম আমি এই সম্পর্কে কিছুই জানি না। কীভাবে জানবো বলো? তাছাড়া আমি এই সংসার থেকে কোনদিন তোমায় না বলে একটি পয়সাও সরাইনি!’
মেহের এবার রেগে গিয়ে বললো,’তুমি যদি অত সাধু সন্ন্যাসীই হয়ে থাকো তবে কদিন আগে পাঁচ লাখ টাকা কে সরিয়েছিলো ?সাঁজবাতি তাই না?’
হেমা বললো,’ছিঃ ছিঃ ও সরাবে কেন?আমি মরে গেলেও এটা কখনো বলবো না!’
মেহের এবার হাসলো। হেসে বললো,’যেহেতু সাঁজবাতি নেয়নি তবে তুমি নিয়েছো। এবার তুমি পাঁচ লাখ টাকা এবং গোল্ড রাখা বক্স দুটোই একসাথে বের করে দেও। তারপর আমার বাড়ি ছাড়ো!’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে