উত্তরাধিকার পর্ব-০৮

0
1087

#উত্তরাধিকার
#৮ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



আজও মেহের ঘুম থেকে সকাল সকাল উঠতে পারেনি।হেমা ওকে ভালো করেই চিনে।যেদিন ওর কাছাকাছি হতো মেহের সেদিন সকালে আর তার ঘুম ভাঙতো না। নাশতার জন্য ডাকলেও উঠতো না।শেষে অফিসের সময় হয়ে এলে যখন ওর গা ধরে জোরে ধাক্কা দিয়ে বলতো,’অফিসের সময় বুঝি আজ গেল! এখনও উঠার নাম গন্ধ নেই যে!’
তখনই লাফিয়ে উঠতো সে। এবং দু হাতকে যেন দশ হাত বানিয়ে নিতো সে।ব্রাশ করা, গায়ে সাবান ঢলা,শাওয়ার নেয়া, শরীর মোছা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কলাটা,এক চামচ নুডুলস,এক কাপ দুধ খেয়ে টাইটা বাঁধা। তারপর টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হতে রাগ দেখিয়ে বলা,আরেকটু আগে ডাকলে কী দোষ হতো? একেবারে সময়টা শেষ করে ডেকেছে!
হেমা তখন রাগও পেতো এবং খানিক হাসতোও।সে কী আর কম করে ডেকেছে? কিন্তু ওর যে অভ্যেসটাই এমন। আগে উঠবে না ডাকলেও। কিন্তু সময় যখন শেষ শেষ তখন উঠবে।হেমা অন্য আরো দশটি মহিলার সাথে এই নিয়ে কথা বলেছে।ওদেরও একই অভিযোগ।সে বুঝতে পারে না। পৃথিবীর সব পুরুষই কী এমন নাকি?
অথচ মেয়েরা সারাটা রাত তার স্বামীকে সঙ্গ দিয়েও ক্লান্ত শরীরে ভোর সকালেই জেগে উঠে। তারপর পবিত্র হয়ে কিচেনে যায়। রান্না করে।ছেলে মেয়ে থাকলে ওদের যত্ন নেয়। খাইয়ে দেয়।অফিস থাকলে অফিসের জন্য প্রস্তুতি নেয়। সাথে বরকেও ডেকে তুলে খাইয়ে দিয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়ায়।বর প্রস্তুতি নিয়ে ঘর থেকে বের হলে পেছনে মেয়ে লোকটি বের হয়।সাঁজবাতিকেও সে দেখেছে এমন।মেয়েরা কী জন্ম থেকেই তবে অপরিসীম ধৈর্য্য ধারণ করার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়?
হেমা এটা ভালো করে জানে না। কিন্তু তার নিজেকে আর সাঁজবাতিকে দেখে তার এমনটিই মনে হয়!

সকালে নাশতা খেতে বসে ওরা দুজন মুখোমুখি।হেমা আর সাঁজবাতি।
সাঁজবাতি বলে,’আপু, আমার রান্না খুব বাজে হয় তাই না?’
হেমা বলে,’ধুর!কী সব আবোল তাবোল বকছিস!তোর রান্না আমার চেয়ে ভালো হয়।সত্যি বলছি!’
সাঁজবাতি কিছু বলে না। চুপচাপ রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরে দেয়। তারপর চামুচ দিয়ে প্লেট থেকে সবজি নিয়ে মুখে দেয়।
হেমা এক গ্লাস পানি খায় ঢকঢক করে। তারপর বলে,’একটা সুখবর আছে সাঁজ!’
সাঁজবাতি শোনার জন্য মুখিয়ে থাকে সুখবর টি!
সে বলে,’কী সুখবর বলো না আপু। এক্ষুনি বলো প্লিজ প্লিজ প্লিজ!’
হেমা মিষ্টি করে হেসে বলে,’আজ বাবা আসবে আমাদের নিয়ে যেতে।তুই ফেরত নাইওর করবে বাপের বাড়িতে!’
সাঁজবাতি খাবার রেখে উঠে আসে হেমার পাশে। হেমাকে খুব সাবধানে জড়িয়ে ধরে যেন হাতে লেগে থাকা রুটির ময়দা হেমার জামায় কিংবা শরীরের কোথাও না লাগে। তারপর আবেগতাড়িত গলায় বলে,’আমি খুব খুশি হয়েছি আপু।আমি কিন্তু ওখানে গিয়ে এক সপ্তাহ থাকবো।’
হেমা বললো,’ঠিক আছে এক সপ্তাহই থাকবি।’

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই দু হাত ভর্তি মিষ্টির কার্টুন নিয়ে এসে হাজির হলেন আজমল হোসেন।যেন তিনি এর আগে এ বাড়িতে কখনো আসেননি। এই জন্য অনেক গুলো কার্টুন ভরে মিষ্টি এনেছেন। তিনি দরজার কাছে এসেই ডাকলেন,’আমার ছোট মা বড় মা কই গো তোমরা?’
হেমা বাথরুমে ছিল।ডাক শোনেও আসতে পারলো না এগিয়ে। তবে সাঁজবাতি সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এলো। এবং কীভাবে যেন দেখেই বোঝে ফেললো এটা হেমার বাবা।সে সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো ‘বাবা কেমন আছেন আপনি?’
তারপর সে আজমল হোসেনের পা ছুঁয়ে সালাম করলো। আজমল হোসেন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,’আহ্ এসবের কী প্রয়োজন গো মা!উঠো উঠো!আমি ভালো আছি মা।তোমরা কেমন আছো?’
সাঁজবাতি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,’ভালো আছি বাবা । ‘
একেবারে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে আজহার হোসেনের হাত ধরে টেনে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো ঘরের ভেতরে।হেমা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এদিকে এগিয়ে আসার সময় ওদের দেখে অবাক হলো। এবারও তার চোখ ভিজে উঠলো জলে।

মেহের অফিসে গেছে।সাঁজবাতি ফোন করে বললো,’আধ ঘন্টার ভেতর তুমি বাসায় ফিরবে!’
মেহের অবাক হয়ে বললো,’কেন? অ্যানি প্রবলেম?’
‘নো প্রবলেম। আমার এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে। তুমি এসে আমার ইচ্ছে টা পূরণ করো!’
ফোন রেখে দিয়ে সে জানলাটার কাছে দাঁড়ালো।আজ বড় ভালো লাগছে তার।সে যেভাবে চাচ্ছে সেভাবেই হচ্ছে সবকিছু।একে তো মেহের একটা তেরো নম্বরের হদারাম।আর তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী লোকটি তারচে আরো বড় গাধা রাম। এবার তো দেখছে সে ওর বাপটা আরো বড়ো ধরনের বোকা রাম।
যখন থেকে এসেছে তখন থেকেই তাকে শুধু মা মা বলে ডেকে যাচ্ছে।তার যে মা ডাকটা শুনতে খারাপ লাগছে বিষয়টা কিন্তু তা না। ছোট বেলা থেকেই সে বাবাকে দেখেনি। সেদিন যে মেহেরের কাছে সে বললো তার বাবা মাকে ডিভোর্স দিয়েছিল বিষয়টি কিন্তু তা না।আসল সত্যটা সে জানে।তার বৈধ কোন পিতাই নেই। যদিও পিতা শব্দটিতে বৈধ অবৈধের কিছু থাকে না। তবুও সত্যিটা হলো সে তার মায়ের পরকিয়ার একটি ফসল মাত্র। পরকিয়া করে মার গর্ভ হয়েছে শোনে তার মায়ের স্বামী তার মাকে ডিভোর্স দিয়ে ছিলো। এরপর সে মার কাছেই বড় হয়েছে। কিন্তু মাঝ বয়সে তার মা কী এক শোকে যেন সোইসাইড করে বসলো। এরপর থেকে সে একা।চির একা। তবে এই একাকিত্ব সে খুব একটা অনুভব করেনি।তার এই রুপ তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। অনেক বড় বড় সাহেব তাকে নিয়ে বিদেশ বিভূঁইয়েও সফর করতে গেছে।বলা চলে যুবতী হওয়ার পর থেকে দুঃখ কী সে কখনো অনুভব করেনি! অথবা দুঃখ কী সে তা এখনও জানেওনি!
এ বাড়িতে না এলে তার চলতো। বিয়ে করার কোন চিন্তা সে কোনদিন করেনি অতীতে। ভেবেছিল একা একাই বহু মানুষের সাথে বহু দেশ ঘুরে সে কাটিয়ে দিবে। কিন্তু হুট করে একদিন সে একটা উপন্যাস পড়লো।সে উপন্যাসে সে দেখলো একটি মেয়েলোক যার চেহারা অতি সুন্দর। রুপ এবং শিক্ষা দুটোই ছিল তার।জীবনে সে কোন বিয়ে করেনি।রুপের মোহে ফেলে বড় বড় সাহেবদের সাথে সে দেশ থেকে দেশ ঘুরে বেড়াতো। খুব সুখেই কেটে যাচ্ছিলো তার দিন। সে কখনো ভাবেইনি তার জীবনে কোন দুঃখ নেমে আসতে পারে। কারণ সে ধরে নিয়েছিল যেহেতু সে কাউকে ভালোবাসেনি সেহেতু তার দুঃখ পাওয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তু ভালোবাসা ছাড়াও দুঃখ লাভের আরেকটি কারণ আছে।আর তা হলো সময় থাকতে ভবিষ্যত পরিকল্পনা না করা।মেয়েটি ভেবেছিল সে চিরদিন এরকমই থাকবে। সুন্দরী। যুবতী। মানুষ তার জন্য উন্মুখ থাকবে। তাদের কাছে তার সমান চাহিদা থাকবে। কিন্তু এক সময় সে বুড়িয়ে গেলো।রুপ যৌবন ফিকে হয়ে এলো। তারপর তার জীবনে নেমে এলো অবহেলা। নিঃসঙ্গতা। শেষ জীবনে সে ছিল একজন রাস্তার ভিখেরি!
এই উপন্যাস পড়ার পর পরই সাঁজবাতি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো। এবং টোপ ফেলে অপেক্ষা করতে লাগলো শিকারের। সময় হলে শিকার এসে উপস্থিত হলো। এবং তার টোপ গিললো। সেই শিকার আর কেউ না। আমাদের উত্তরাধিকার গল্পের বড় লোক মেহের।মেহের কিন্তু এখনও জানে সে বড্ড জিতে গেছে। কিন্তু সে এটা জানে না যে সে কোন একটি কলে খুব বাজে ভাবে ফেঁসে গেছে!

মেহের বাসায় ফিরে এসে অবাক হলো।তার শশুর মশাই এসেছেন।সে এসে অবশ্য পা ছুঁয়ে সালাম করলো না আজমল হোসেনকে। মুখ দিয়ে সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু সাঁজবাতি তাকে শশুরের পা ছুঁয়াতে বাধ্য করলো।সে বললো,’আমার বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করলে না কেন?আমি তোমার সাথে আর কথাই বলবো না!’
মেহের বোকা ভনে গেল।সবার সামনে তাকে লজ্জায় ফেলে দিলো সাঁজবাতি।সে সঙ্গে সঙ্গে আজমল হোসেনের পা ছুঁয়ে সালাম করলো।

দুপুরের খাবার খেতে বসে আজমল হোসেন আসল কথাটা বললেন। তিনি বড় শান্ত অথচ মধুর গলায় বললেন,’বাবা মেহের,আমি আমার দুই মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছি!’
মেহের সরাসরি বললো,’এখন তো যেতে পারবে না। সামনের মাসে আমিই নিয়ে যাবো।’
কিন্তু সাঁজবাতি গা ধরে বসলো।সে বললো,’আজ সন্ধ্যার আগেই আমরা বাবার বাড়ি যাবো। বিয়ের তিনদিন হয়ে গেছে।ফেরত নাইওরের সময় চলে যাচ্ছে।আর অপেক্ষা করতে পারবো না আমি!’
ওর কথাই শেষ কথা।সাঁজবাতির এই সাহস কিংবা কথা বলার ক্ষমতা একদিনে হয়নি।সে এই ছয় সাত মাসে মেহেরকে আদ্যোপান্ত চিনে নিয়েছে।চিনে নিতে পেরেছে বলেই সে এবার তাকে নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারছে। কিন্তু মেহের সুন্দর্যের মোহেই হোক অথবা জ্ঞান স্বল্পতার কারণে।সে কিন্তু সাঁজবাতির এসব আধিক্যেতা অথবা বাড়াবাড়িকে ভালোবাসাই ভাবছে। কিন্তু এটা বুঝতে পারছে না যে এসবের ভেতর ভালোবাসা কম প্রতারণা বেশি! এবং এও বুঝতে পারছে না যে সে এই মুহূর্তে একটা প্রাণ এবং বোধহীন খেলনায় পরিণত হয়েছে।যার রিমোট কন্ট্রোলার সাঁজবাতি নামক মেয়েটির হাতে।

শেষমেষ কিন্তু সেদিন সন্ধ্যার আগেই ফেরত নাইওর করতে গেলো ওরা দুজন।সাঁজবাতি আর হেমা। পরদিন তাদের সাথে গিয়ে যোগ দিলো মেহেরও।প্রায় এক সপ্তাহ ফেরত নাইওর করে ওরা ফিরে এলো বাসায়।সাঁজবাতির ব্যবহারে হেমাদের বাড়ির সবাই মুগ্ধ। সপ্তাহ পর চলে আসার সময় হেমার মা সাঁজবাতির গলায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেটে খান খান হলো।কী অদ্ভুত দুনিয়ার মানুষ।সবার চোখের সামনেই একটি আটাশ বছর বয়সী মেয়ে অতগুলো লোককে ধোঁকা দিয়ে বেড়াচ্ছে কিন্তু তারা তা ধরতে পারছে না। উল্টো তারা ভাবছে এটা মায়া।এটা ভালোবাসার বন্ধন।


#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে