উত্তরাধিকার পর্ব-০৭

0
993

#উত্তরাধিকার
#৭ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



বিকেল বেলা বাবার কাছে ফোন করে হেমা।
আজমল হোসেন জিজ্ঞেস করেন,’কেমন আছো গো মা? এখনও মন খারাপ করে আছো তাই না?’
হেমা মিষ্টি গলায় বলে,’আমার একটুও মন খারাপ নেই। বাবা আমি খুব ভালো আছি। গতকাল তোমার কাছে ফোন দিয়ে আমি কেঁদেছিলাম। বলেছিলাম,আমি সোইসাইড করবো। এই বিয়ে মেনে নিতে পারবো না। তুমি বুঝিয়েছিলে আমায়।বলেছিলে, ভাগ্য হলো আসল জিনিস। ভাগ্য ভালো থাকলে স্বামী চার বিয়ে করলেও কোন সমস্যা হবে না। আমার শান্তি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।বাবা তোমার কথা সত্যি।সাঁজবাতি খুব ভালো মেয়ে বাবা! খুব খুব ভালো মেয়ে।জানো,সাঁজবাতি আজ সকাল বেলা কী করেছে?আমায় কিচেনেই যেতে দেয়নি। বলেছে,সব সে করবে।করেছেও।করে আমায় নিয়ে একসাথে টেবিলে বসে নাশতা করেছে।আর নাশতা করার সময় বলেছে,তার তো বাবা মা নাই। তুমি আর মাই নাকি এখন থেকে তার বাবা মা।সে নাকি আমাদের বাড়িতে ফেরত নাইওর করবে!বাবা আমা সম্ভবত ভাগ্য ভালো। গতকাল যে আমি মন খারাপ করে কেঁদেছিলাম এই জন্য বরং খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে অযথাই আমি কান্নাকাটি করলাম!’
মেয়ের মুখ থেকে কথাগুলো শোনে আজমল হোসেনের চোখ জলে ভিজে উঠে। তিনি মনে মনে আল্লাহর শোকর গুজার করেন। তারপর মেয়েকে বলেন,’আমি নিজেই নিতে আসবো তোমাদের মা। আগামীকাল আসবো। আমার দুই মেয়েকে আমি আমার বাড়িতে নাইওর নিবো। এখন আর আমার একটি মেয়ে না। আমার দুই দুটি মেয়ে!’

অফিসে চলে গিয়েছিল মেহের।অফিস থেকে ফেরার পর ফ্রেশ হয়ে ওরা তিনজন মিলে রাতের খাবার খায়।মেহের হেমা আর সাঁজবাতি।
খাবার শেষে মেহের সাঁজবাতি মেহেরের ঘরে এসে ভেতর থেকে যখন দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে তখন সাঁজবাতি বললো,’দরজা বন্ধ করছো কেন?’
মেহের বললো,’তো দরজা খোলা রেখেই শুয়ে পড়বো নাকি?’
‘না তুমি এখানে শুবে না আজ।’
মেহের বড় অবাক হলো।সে বললো,’তবে কোথায় শুবো?’
‘আপুর সাথে।আপুর ঘরে।’
শোনে মেহেরের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হয়। নতুন বউ রেখে সে পাঁচ বছর সাত মাসের পুরনো বউয়ের কাছে যাবে কোন দুঃখে? চাঁদ রেখে সে সামান্য কুপির কাছে গিয়ে কী করবে?
মেহের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললো,’গতকাল সময় পাইনি। গল্প করেই রাত প্রায় কাবার করে দিয়েছিলে!আজ আর কোন গল্প হবে না!’
সাঁজবাতি বলে,’আজ আসলেই কোন গল্প হবে না।আজ আমি ঘুমাবো।আজ তুমি গিয়ে গল্প করবে আপুর সাথে।তার মন খুব খারাপ। তাকে আদর করে দিলে মনটা ভালো হয়ে যাবে।’
মেহের তবুও ওর কাছে আসে।দু হাতের বাহু ধরে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দেয় ওকে।
সাঁজবাতি এবার বলে,’তুমি যদি জোর করে কিছু করো তবে এটাকে আমি রেপ হিসেবেই ধরে নিবো। সুতরাং তুমি এটা বুঝে নাও!আমি চাই এখন থেকে একদিন তুমি আমার ঘরে থাকবে।আর একদিন আপুর ঘরে।কারোর ঘরে বেশি কম নয়।দুজনকেই সমান চোখে দেখতে হবে।’
মেহের নিজের সাথে বড় যুদ্ধ করে শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারপর চুপচাপ ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় ও ঘরে। অবশ্য গিয়ে দেখে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে হেমা।সে তখন কলিং বেল চাপে।হেমা দ্রুত বিছানা থেকে নেমে এসে দরজা খুলে অবাক হয়।মেহের এখানে কেন এই মুহূর্তে? নতুন বউ রেখে তার কাছে আসার কী কারণ?
হেমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,’কোন সমস্যা মেহের?’
মেহের বলে,’ভেতরে ঢুকো।বলছি।’
হেমা ভেতরে ঢুকে। তারপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে পেছন পেছন মেহেরও আসে। এসে বলে,’মেয়েটা মনে হয় মাথা খারাপ! পাগল পাগল!’
হেমা অবাক হয়ে বলে,’কেন?কী করেছে?’
মেহের বলে,’ওর সাথে থাকতে দেয়নি।আজ নাকি তোমার সাথে থাকতে হবে। দুজনকে সমান চোখে দেখতে হবে।আজ তার সাথে থাকলে নাকি তোমার প্রতি অবিচার করা হবে! কিন্তু আমার বিষয়টাও তো বুঝতে হবে। গতকাল বিয়ে হলো। সপ্তাহ খানেক হলেও তো—
কথা শেষ করতে হয়নি মেহেরের।হেমা এমনিতেই সব বুঝতে পারে।সে জানে এই মুহূর্তে মেহের কী চাচ্ছে।তাই সে মেহেরকে বললো,’তুমি আসো আমার সাথে।’
মেহের ওর পেছন পেছন হাঁটে।
হেমা ওকে নিয়ে সাঁজবাতির ঘরে যায়। গিয়ে বলে,’সাঁজ, ওকে তাড়িয়ে দিলে কেন?’
সাঁজবাতি হেসে বলে,’কেন?মেহের কী বলেছে তাকে আমি তাড়িয়ে দিয়েছি?’
হেমা বলে,’আরে না।এমনিই বললাম।শুনো,তোমরা নতুন বিয়ে করেছো। এখন একসাথে কটা দিন সময় দেয়া উচিৎ দুজন দুজনকে। তাছাড়া আমি অসুস্থ।ও জোর করলেও তাকে আমার সাথে কিছুতেই রাখবো না! ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিবো দূরে!হি হি হি।’
হেমা শেষের কথাটি মিথ্যে বললো।আজ এশার নামাজও আদায় করেছে সে। নামাজ শেষে সূরা আর রাহমান পড়েছে। তারপর দোয়া করেছে। সে অসুস্থ না। তবুও মিথ্যে কথা বললো।যেন সাঁজবাতি মেহেরকে তার ঘরে রাখতে কোন প্রতিবাদ না করে।

হেমা ঘরে এসে সারা রাত ঘুমোতে পারলো না।তার চোখ বার বার ভিজে উঠছে।সে শুয়া থেকে উঠে বিছানার উপর জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল।তার এতো দিন বড় দুঃখ ছিল আপনার কোন বোন নাই বলে। কিন্তু সাঁজবাতি এ বাড়িতে বউ হয়ে এসে তার সব দুঃখ মুছে দিয়েছে।কী মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ে।কন্ঠও কী মধুর!আর মনটাও এতো ভালো!হেমা এরকম আশা কোনদিন করেনি।সে কোন নাটক সিনেমাতেও এতো লক্ষ্মী সতীন দেখেনি। কিন্তু আল্লাহর কী অসীম কৃপা।সাঁজবাতিকে তার সতীন ভাবতেই খারাপ লাগে।সে বরং সাঁজবাতিকে বোন ভাবে।সাঁজবাতিও তাকে কী মিষ্টি করে ডাকে।আপু।হেমা ফের চোখের জল মুছে।আর মনে মনে আল্লাহর কাছে বলে,আল্লাহ,সাঁজকে তুমি কষ্ট দিও না। তার গর্ভে তুমি আমার স্বামীর উত্তরাধিকার জন্ম দাও।সহিহ সালামতে সেই সন্তানকে তুমি পৃথিবীর আলো দেখাও।আমিন।

পরদিন সকাল বেলা আগে ভাগেই উঠে পড়ে সাঁজবাতি। উঠে হেমাকে ডেকে নেয়।হেমা তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এলে বলে,’আজ কী খাবে বলো সকালে?’
হেমা বলে,’তোমার যা ইচ্ছা!’
সাঁজবাতি কিন্তু এবার খানিকটা রাগ করে।সে বলে, ‘তুমি তুমি করলে খারাপ লাগে। দূরের মনে হয়। তুমি বরং আমি তুই তুকারি করবে। এখন থেকেই!’
হেমার শুধু কারণে অকারণে বারবার চোখ ভিজে উঠে।সে আড়ালে চোখ মুছে।মনে মনে বলে,তুই অমন মায়াবতী কেন রে সাঁজ? আমার হায়াত থেকে কিছু হায়াত নিয়ে আল্লাহ তোর হায়াত বৃদ্ধি করুন।
তারপর হেমা তুই করেই ডাকে।বলে,’চল দুজন মিলে নাশতা তৈয়ায করি ‌।’
সাঁজবাতি বলে,’আচ্ছা ঠিক আছে। তবে একটা শর্ত আছে কিন্তু!’
হেমা বলে,’আবার কী শর্ত?’
‘তুমি চেয়ারে বসে থেকে তদারকি করবে।আমি আর বুয়া রাঁধবো!’
হেমা বলে,’ও মা,আমি কী কাজ না করতে করতে অকর্মা হয়ে যাবো নাকি?তুই কাজ করলে তোর অফিস কে করবে?’
সাঁজবাতি বলে,’অফিসের সময় সকাল নটা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা । সকালের নাশতা তৈরি করার সময় দুপুরের রান্নাও হয়ে যাবে। এবং রাতের খাবার আমি বাসায় ফিরে তৈরি করতে পারবো। বুঝেছো?’
হেমা বলে,’বুঝেছি। কিন্তু তুই বাইরের দায়িত্ব নে বোন।আমায় ঘরের দায়িত্ব দে। সবকিছু তুই করলে সুন্দর চেহারা মলিন হয়ে যাবে।কষ্ট হবে তোর!’
সাঁজবাতি হাসে। হেসে বলে,’চেহারা দিয়ে কী হবে গো আপু? বিয়ের পর মেয়েদের আর চেহারার প্রয়োজন পড়ে না!’
হেমার ভেতরটা কেমন কেঁপে উঠে। বুকের ভেতর ধুকপুক করে কী যেন বাজে!তার কেবল মনে হয় সাঁজবাতি অনেক কিছুই জানে না। ওই যে সে বললো বিয়ের পর মেয়েদের চেহারা সুরতের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সে তো ভালো করেই জানে বিয়ের পরেও চেহারা সুরতের মূল্য আছে।যদি মূল্য না থাকতো তবে আজ মেহের দ্বিতীয় বিয়ে করতো না।সে এও জানে যে মেহেরের যতোটা না উত্তরাধিকার এর আশায় এই বিয়ে করা তারচেয়ে বেশি লোভ সাঁজবাতির সুন্দর চেহারায়। পুরুষ মানুষ সুন্দরী মেয়ে দেখলে মাথা ঠি রাখতে পারে না। তবুও মেহেরকে সে দোষ দেয় না।সে জানে তার গায়ের রং ময়লা।মেহের যেহেতু একটা সুন্দরী মেয়ে নিয়ে সংসার করতে চায় তবে এতে তার আপত্তি থাকবে কেন?সে না পেরেছে মেহেরকে রুপ দিয়ে আকৃষ্ট করতে না পেরেছে সন্তান দিয়ে! সবদিক থেকে ব্যর্থ সে অত নাক গলাবে কেন?তাই সে নাকটা ডুবিয়ে রাখে বালিশের ভেতর। এখানেই সে কাঁদে।অভিযোগ করে। যদিও এই মুহূর্তে তার মন খুব ভালো। ঘরে সতীন নিয়েও যে এমন স্বর্গীয় সংসার করা যায় তা ওদের তিনজনকে স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করবে কে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে