উত্তরাধিকার পর্ব-১১

0
1170

#উত্তরাধিকার
#১১_তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক



সাঁজবাতির ছেলে সন্তান হয়েছে। সেই ছেলের নাম বিপুল।বিপুলের বয়স এখন আড়াই।ছেলে জন্মের পর এই আড়াই বছরে সে মেহেরের আরো প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠেছে।ছেলেও হয়েছে রুফে গুণে তার মায়ের মতই।সে তার মাকে মাম্মি আর বাবাকে পাপাই বলে ডাকে।মেহের কিন্তু তার একমাত্র ছেলের জন্য উন্মুখ।সে এই ছেলের জন্য তার জীবনও দিয়ে দিতে পারে! যদিও ছেলে অতটা বাপ পাগল নয়। বাপের কাছে সে তেমন যেতে চায় না। তবুও ছেলের প্রতি মেহেরের সোহাগের কোন কমতি নেই!
তবে ছেলেটি বড় হচ্ছে তার মায়ের আদর্শে।সাঁজবাতিকে ছাড়া বিপুল কিছুই বোঝে না।
সাঁজবাতি এতে খুবই আনন্দিত। তবে তার এই একগুঁয়ে জীবনটা আর ভালো লাগে না! এই একটি পুরুষের নিচে আর কতো পিষ্ট হওয়া! তার এখন মেহেরের স্পর্শ অস্বস্তিকর লাগে।ও যখন কাছে আসে, মুখের উপর নিঃশ্বাস ফেলে তখন সাঁজবাতির ইচ্ছে করে ওর গলা টিপে মেরে ফেলতে।
কিন্তু সে এই কাজটি এখনই করতে চায় না।এর জন্যও সময় প্রয়োজন। আগে তার ছেলেটি একটু বড় হোক। পাঁচ ছয় বছর বয়স হোক ওর। তখন আসল কাজটি করবে সে।
তবে শরীর যে তার বাঁধন হারা।অশৃঙ্খল।পাগলা ঘোড়ার মতো সে শুধু এ শরীর থেকে ও শরীরের কাছে ছুটে যেতে চায়। তবে তার ইতর কিংবা ছোট লোক পছন্দ না।তার প্রয়োজন সাহেবদের মতো নামিদামি লোক।যারা গায়ে দামি পারফিউম মাখে। পকেটে সোনার পয়সা নিয়ে ঘুরে।যাদের আছে মস্ত দাপট।
অবশ্য ইতিমধ্যে সে একটা লোকের সাথে ফেসবুকে পরিচিত হয়েছে। এই লোকটির সাথে হোয়াটসঅ্যাপ এ কথা বলতেও শুরু করেছে কদিন ধরে। এই লোক সাধারণ কেউ নয়। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী পার্লামেন্ট মেম্বার। এই পার্লামেন্ট মেম্বারের বড় ভাই আবার মিনিস্টার। লোকটি তার চেহারা দেখে বিষ্মিত।যার প্রাণি মুগ্ধ।মুগ্ধ আর বিষ্মিত বলেই তার সাথে গায়ে পড়ে কথা বলতে চায়।সাঁজবাতি এক মেসেজ দিলে ওই লোক দশটি ম্যাসেজ দেয়।ওর কাছে সেলফি চায়।সাঁজবাতি অবশ্য সহজে সেলফি দেয় না।যখন আট দশবার অনুরোধ করে কেবল তার পরেই সে সেলফি দেয়। নিজের মূল্যটা সব সময় সে উঁচুতে রাখে। তাকে যে কম মূল্যে কেনা যাবে না তা সে তার অ্যাটিচিউডেই বুঝিয়ে দেয় যেন! তবে সে এক্ষুনি ওই লোকটির সাথে কোন ধরনের সম্পর্কে জড়াতে চাচ্ছে না । আপাতত কথা বলে যাওয়া। লোকটিকে তার প্রতি আকৃষ্ট করা।এর বেশি কিছু এখন হবে না।তার আরো অপেক্ষা করতে হবে। উপযুক্ত সময় এলেই সে কাজে নামবে।

মেহের এখন সাঁজবাতির কথা ছাড়া দম ফেলতেও যেন ভুলে যায়।সাঁজবাতি যদি বলে আজ তুমি সারাদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবে তবে তাই করবে সে। যদিও সাঁজবাতি এমনটি কখনোই করে না। বরং তার ভালোবাসা দিন দিন আরো উতলে উঠছে মেহেরের প্রতি।সে মেহেরকে এটা বিশ্বাস করাচ্ছে যে এই পৃথিবীতে সাঁজবাতির চেয়ে বেশি ভালো আর কেউ তাকে বাসে না। সাঁজবাতি তার রুফ গুণ ভালোবাসা সবকিছু দিয়েই মুগ্ধ করেছে তাকে। এরচেয়ে বড় কথা সে তাকে একটি সোনার পুতুলের মতো ফুটফুটে পুত্র সন্তান উপহার দিয়েছে। এই পুত্র সন্তান হবে তার উত্তরাধিকার।তার ঘরের ঝলমলে আলো। এই ছেলে বাবার সম্মান অক্ষুন্ন থাকবে।মেহের ছেলের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবে। ছেলেকে কোথায় পড়াবে, ছেলের জন্য কী কী কিনবে, ছেলের নামে কোন কারখানাটি নতুন করে খুলবে তাই ভেবে যায় শুধু রোজ দিন!
এসব ভাবতেও আনন্দ লাগে। আসলে সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে সব পিতারাই পছন্দ করে।

ওদিকে সাঁজবাতি বৃটেনে থাকা তার চিকিৎসক বন্ধু আলী আহসান সাবেরের সাথে পরামর্শ করে।সে জানতে চায় কীভাবে দ্রুত তার স্বামীকে সে মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিতে পারে।সাবেরও কম শয়তান নয়।সে এর আগে সাঁজবাতির সঙ্গে মিলে অনেক ভয়াবহ কাজ করেছে। এই জন্য অবশ্য তাকে কোন ফিস দিতে হয়নি। সাবের অন্যজনের কাছ থেকে মোটা অংকের ফিস নিলেও সাঁজবাতির কাছ থেকে সে ফিস নিতে অপারগ। বরং সে নিজের টাকা খরচা করে সাঁজবাতিকে তার কাছে নিয়ে যায়।সাঁজবাতির রুফের কাছে কুটি টাকাও যে নস্যি এটা খুব ভালো করেই জানে ডাক্তার আলী আহসান সাবের!
তাই এবারও সে সাঁজবাতিকে সান্তনা দেয়।বলে টেনশন করো না বন্ধু।সময় হলে তুমি আমায় নক করবে। কীভাবে কী করতে হবে সব আমি বলে দিবো।
এবার শুধু সাঁজবাতির অপেক্ষা।সে জানে খুব বেশিদিন আর নেই তার এ দেশের সবচেয়ে বড়ো এলিটদের একজন হওয়ার। মাত্র কয়েক বছর পরই তার হবে অনেক অনেক গুলো মিল ফ্যাক্টরি। জায়গা জমি।ব্যাংক ভর্তি টাকা পয়সা।আর তখন সে আরো একটি কাজ করবে। সুন্দরী আর প্রভাবশালী মেয়েদের এ দেশের রাজনীতিতে ভালো জায়গা করে নিতে সময় লাগে না।সে খুব সহজেই এই কাজটি করে নিতে পারবে।
—————— ———— ————–
হেমার আনন্দ এখন আর দেখে কে!
আহা সুখ!এতো সুখ কার বা আছে এই পৃথিবীতে?
হেমার ছেলেটির নাম বাঁধন। মেয়েটির নাম হেরা। বাঁধনের বয়স এখন আট।সে ক্লাস থ্রি তে পড়ে।আর হেরার বয়স ছয়।সে ক্লাস ওয়ানে পড়ে।ছেলে মেয়ে দুটি তার মায়ের ন্যাওটা একেবারে।মা ছাড়া ওরা কিছু বোঝে না। স্কুল থেকে ফিরেই ওরা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে।গালে চুমু খায়। কখনো মায়ের জন্য কিনে আনে লাল টুকটুকে গোলাপ ফুল। কখনো বা আইসক্রিম।মার হাতে দিয়ে বলে,’তোমার জন্য উপহার!’
হেমা কেঁদে খান খান হয়। আল্লাহর দরবারে শতো কুটিবার শুকরিয়া জ্ঞাপন করে সে। এমন সুখ আর কার আছে তার মতো!
তার স্বামী সজল চৌধুরী উচ্চ শিক্ষিত মানুষ। তবে অসম্ভব রকমের ভালো মানুষটি।শত কাজের চাপ থাকলেও তার নামাজ কাজা হয় না।ফজর আর মাগরিবের পর কুরআন তেলাওয়াত করতে সে ভুলে না। অসহায়ের, মজলুমের পাশে দাঁড়ানোকে সে পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। তার কাছে হিন্দু মুসলমান কারো কোন ভেদাভেদ নাই।সে সব ভালো মানুষকেই ভালোবাসে। সম্মান করে। এমনকি তাদের ফেক্টরির সবচেয়ে নিচু পদের যে কর্মচারীরা আছে ওদের সাথেও সে হাত মিলায়।সুখ দুঃখে ওদেরকেও বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে। তাদের ফেক্টরি গুলোতে আগে মসজিদ ছিলো না।সে মসজিদের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। হিন্দু সহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রার্থনা করার ব্যবস্থা করেছে। এছাড়াও সে স্ত্রীর প্রাপ্য মর্যাদা দিতে সব সময় তৎপর। হেমা প্রতি মাসে যখন কয়েকদিন অপবিত্র থাকে তখন সজল তার সব কাজ নিজের হাতে তুলে নেয়। কাপড় কেচে দেয়া, কাপড় ইস্ত্রি করা।আরো যতো কাজ আছে সব করে।পিরিয়ডের প্রথম দু দিন হেমার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়।সে মাঝেমধ্যে অজ্ঞানের মতো হয়ে যায়। তখন সজল পাগলের মতো হয়ে উঠে।কী করবে না করবে বোঝে উঠতে পারে না!
হেমা ওর অস্থিরতা বুঝতে পারে।তাই সে শুধু বলে,’তুমি আমার পেটে হাত বুলিয়ে দাও সজল। তখন আর আমার কষ্ট হবে না!’
সজল তাই করে। হেমার তখন বড় আরাম লাগে।সে পেটের ভয়াবহ ব্যথা ভুলে গিয়ে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তমো সজলের মুখের দিকে। এই অত কষ্টের মাঝেও সে সজলের মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে। সজলের বড় ভালো লাগে হেমার এই হাসি।তার তখন মনে হয় এই একটুকু হাসিই তার অন্ধকার ঘরটি আলোকিত করে রেখেছে।
হেমার বাবা আজমল হোসেনের মৃত্যুর কথা ভুলে গেছে হেমা। বুলবুল চৌধুরীর মতো এমন আদুরে শশুর থাকতে বাবার কথা মনে পড়ার যে কোন সুযোগটিই নেই!
বুলবুল চৌধুরী আজ অবধি হেমাকে নাম ধরে ডাকেননি। তিনি তাকে ডাকেন মা বলে। হেমা তো কোনদিন এতো এতো সুখের আশা করেনি! কিন্তু পরম করুণাময়ের ইচ্ছে রুখবে কে!
হেমার আর কোন চাওয়ার নেই দুনিয়াতে। তবে তার খুব ইচ্ছে সে তার দু চোখ দিয়ে প্রতারক ভাইটিকে একবার দেখতে চায়।তার খুব ইচ্ছে ওর সাথে একবার দেখা হয়ে গেলে ইচ্ছে মতো অপমান করবে ওকে।তার বাবা কতো কষ্ট করে তার ভাইটিকে পড়াশোনা করিয়েছেন।আর শেষে কি না বাবা মা বোন ছেড়ে বিদেশি এক ম্যাম সাহেবের সাথে জীবন বাঁধলো।সে বাঁধতো এটা তার ইচ্ছে। কিন্তু বাবা মা আর বোনটিকে কী করে ভুলে গেলো এভাবে?
সে নামাজ পড়ে সব সময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে।বলে, আল্লাহ তুমি এই প্রতারককে না দেখিয়ে আমার মৃত্যু দিও না!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে