আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ পর্ব-১০

0
447

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ
#পর্ব১০
#Raiha_Zubair_Ripti

-“ সেদিন যখন তোমায় দেখলাম রায়ান ভাইয়াকে পাওয়ার জন্য বড় মামির হাত ধরে আকুতি মিনতি করে কান্না করতে ট্রাস্ট মি ইচ্ছে করছিলো তোমাকে জাপ্টে ধরে বুকের মধ্যে নিয়ে বলি- এই চিত্রা ভুল মানুষের জন্য একদম চোখের জল ফেলবা না। এই শাস্তি টুকু তোমার প্রাপ্য, তুমি কেনো আমায় ভালো না বেসে রায়ান ভাইয়া কে আমার ভালোবাসা দিয়ে দিয়েছো। কিন্তু বলতে পারি নি নিরবে সয়ে গেছি। রায়ান ভাইয়ার বিয়ের কথা শুনে আমার চাইতে বেশি মনে হয় খুশি আর কেউ হয় নি সেদিন,রায়ান ভাই নিজেও না। ভেবেছি রায়ান ভাইয়ের বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলে এবার সত্যি সত্যি আম্মুকে পাঠাবো তোমার আর আমার বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা বলার জন্য। কিন্তু হুট করে বিয়ে দিন ছোট মামুর সাথে আমেরিকা চলে গেলে। কথাটা যখন আমার কানে এসেছিল বিশ্বাস করো খুব ইচ্ছে করছিল তোমাকে সামনে এনে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা থাপ্পড় দিতে। যখনই তোমাকে নিজের করে নেওয়ার প্ল্যান করি তখনই তুমি সেই প্ল্যানে এক বালতি জল ঢেলে দাও।

চিত্রা মনোযোগ দিয়ে তুষারের কথা শুনলো।
-“ এর মধ্যে আর কাউকে ভালোবাসেন নি?
-“ আর কাউকে ভালোবাসার মত সময় পাই নি তাই বাসি নি। তুমি আমেরিকা চলে যাওয়ার পর আমি পড়াশোনার পাশাপাশি আব্বুর বিজনেসের হাল ধরি,শ্রম+সময় পড়াশোনা আর বিজনেসেই দিতে গিয়ে আর সময় হয়ে উঠে নি অন্য কাউকে ভালোবাসার।

-“ আপনি তো জানেন আমি রায়ান ভাই কে ভালোবাসি।
চিত্রার উদাস ভঙ্গিতে বলা কথাটা তুষারের বুকে তীরের মতো বিঁধে। জিহ্বা দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট টাকে ভিজিয়ে বলে-
-“ এখনও ভালোবাসো রায়ান ভাইয়া কে?
চিত্রা হুঁশে ফিরে। কেনো যে মুখ থেকে এটা বের হলো। দৃষ্টি তুষারের দিকে রেখে বলে-

-“ সত্যি বলবো?
-“ হ্যাঁ।
-“ আমি এখনও তাকে ভুলতে পারি নি তুষার ভাই। প্রথম অনুভূতি ছিলো তাকে ঘিরে। তাকে পাই নি বলে যে বলবো তাকে ভালোবাসি না এটা ভুল। আমার এখনও রায়ান ভাইকে দেখলে কষ্ট হয়।
-“ বুঝতে পারছি,তাকে তো পাওয়া সম্ভব না সে ম্যারিড, বাচ্চা আছে।

চিত্রা মুচকি হাসলো তুষারের কথা শুনে।
-“ আপনি কি ভাবছেন তাকে দ্বিতীয় বার পাওয়ার সুযোগ আসলে আমি তাকে গ্রহণ করবো? কখনই না। সে বউ বাচ্চা নিয়ে সুখী থাকুক এটাই চাই।
-“ আর তোমার সুখ?
-“ সুখ কি নিজের হাতে ধরে আনা যায় জীবনে তুষার ভাই?
-“ চাইলেই আনা যায়। আমি চাই তোমার লাইফে সব সুখ এনে দিতে,কিন্তু সেক্ষেত্রে তোমার অনুমতি তুষার চায় না।

-“ আজ আসি,ভালো থাকবেন।

কথাটা বলে চিত্রা উঠতে নিলে তুষার বলে উঠে-
-“ জবাব টা দিয়ে গেলে না?

চিত্রা তুষারের পানে চেয়ে বলে-
-“ কিসের জবাব?
-“ বিয়ে করার ব্যাপার টা নিয়ে।
-“ আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না। বিয়ে করার ইচ্ছে থাকলে রাতুল ভাইয়া কে ফিরিয়ে দিতাম না।

রাতুলের নাম চিত্রার মুখে শুনে তুষারের কপালে দু ভাজ পড়লো। মুখটা গম্ভীর হলো।
-“ তুমি ফিরিয়ে না দিলেও বিয়েটা কিন্তু হতো না।
-“ কেনো?
-“ কারন এই তুষার হতে দিতো না।
-“ কি করতেন?
-” বেশি কিছু না, রাতুল কে বুঝাতাম চিত্রা শুধুই তুষারের, তাকে বিয়ে করার স্বপ্ন যেনো মাথা থেকে বের করে দেয়।
-“ আপনি আগের তুষার ভাইই ঠিক ছিলেন। এখন আপনার সাথে কথা বলতে গেলেও আনইজি লাগবে।
-“ আচ্ছা তাহলে মেসেজে বলে দিয়ো।
-“ মেসেজে কি বলবো?
-“ বলবা আমি রাজি বিয়ে করতে।
-“ আমি বললাম না আমি রাজি না। আপনাকে আমি ভাইয়ের ন….
তুষার চিত্রা কে পুরো কথা শেষ করতে দিলো না,তার আগেই বলে উঠল-
-“ জাস্ট শাট-আপ, তোমার এটা জাতীয় ভাষা হয়ে গেছে আমি আপনাকে ভাইয়ের নজরে দেখি এটা বলা। দেখে তুমি ভাইয়ের নজরে আমায় দেখো নাকি কি নজরে দেখো সেসব নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই,আমি তোমাকে কখনও বোনের নজরে দেখি নি বিকজ আমার নিজের একটা বোন আছে। যাকে তাকে বোন বানানোর রুচি আমার নেই। তবে আমি বাদে আর সবাইকে ভাইয়ের নজরে দেখো কোনো সমস্যা নেই। আর একটা কথা।

চিত্রা ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ কি?
-“ তুমি তো সবাইকে ভাইয়ের নজরে দেখো তাহলে রায়ান ভাইকে ভাইয়ের নজরে না দেখে এক্সট্রা নজরে কেনো দেখলে?
-“ আমি কি জানতাম নাকি সে আমার ভাগ্যে নাই তাহলে তো জীবনেও তার কেয়ার দেখে এসব একতরফা ভেবে বসতাম না।
-“ রায়ান ভাইয়ার কেয়ার গুলো তোমার চোখে পড়লো কিন্তু আমার ভালোবাসা গুলো চোখে পড়লো না তোমার। তোমাকে এক নজর দেখার জন্য বারবার ছুটে যেতাম।
-“ পুরোনো কাসন্দ কেনো ঘাটছেন? আমি বাসায় যাচ্ছি আপনিও বাসায় যান।
-“ বিয়ে…
-“ আশ্চর্য বিয়ে বিয়ে করছেন কেনো? বিয়ের বয়স হয়েছে আমার আপনার?

তুষার একবার নিজের দিকে তাকিয়ে ফের চিত্রার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে-
-“ তোমার একুশ আর আমার আটাশ। এটাকে বিয়ের জন্য উপযুক্ত বয়স বলে না?
-“ আমি অত কিছু জানি না,আমার সামনে পড়াশোনা আছে সেটায় ফোকাস দিতে চাই।

তুষার বসা থেকে উঠে চিত্রার হাত ধরে গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলে-
-“ সমস্যা নেই বিয়ের জন্য তোমার পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হবে না।
-“ আবার সেই বিয়ে!

তুষার গাড়ির দরজা খুলে চিত্রা কে ইশারায় বসতে বলে। চিত্রা গাড়িতে বসলে তুষার চিত্রার দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলে-
-“ দেখো আমার ওসব নিব্বা নিব্বির মতো লুতুরপুতুর প্রেম করার বয়স নেই,ডিরেক্ট বিয়ে করে হ্যাপিলি একটা সংসার গড়তে চাই হালাল ভাবে।

-“ আমি কখন বললাম আপনি আমার সাথে লুতুরপুতুর প্রেম করেন।
-“ বলো নি আমিই বললাম।

চিত্রা আর কিছু বললো না। তুষার গাড়ির দরজা টা লাগিয়ে নিজের ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। দু’জনের কারো মুখে আর কোনো কথা নেই,তুষার চুপচাপ গাড়ি চালাতে থাকল। সে জানতে চিত্রা রাজি হবে না। কিন্তু তুষারের মনে হলো তার সব বলে দেওয়া উচিত। এতোগুলো বছর তে নিজের মাঝে চেপে রেখেছিল আজ না হয় সেসব বলে দিলো। কাউকে ভালেবাসলে তাকে বলে দেওয়া উচিত,তবে সবার ক্ষেত্রে না। এই জিনিস টা সবার লাইফে সুট করে না।

ওপর পাশের মানুষ টা সঠিক হলে কেবলই নিজের অনুভূতি গুলো জানিয়ে দেওয়া উচিৎ। ভুল মানুষকে বলে নয়। ভুল মানুষ কে বললে সবসময় আফসোস করতে হবে কেনো তাকে নিজের অনুভূতি জানাতে গেলে এটা ভেবেই।

তুষার চিত্রা দের বাসার সামনে এনে গাড়ি থামায়।চিত্রা গাড়ি থেকে নামলো,তুষার কে নামতে না দেখে বলে-
-“ যাবেন না ভেতরে?
-“ না।
-“ তাহলে সাবধানে যাবেন।
-“ হু।
-“ আসি।

কথাটা বলে চিত্রা ভেতরে ঢুকে যায়। তুষার চিত্রার যাওয়ার পানে তাকিয়ে অফিসে চলে যায়।

বাড়ির পাশে রাস্তার পাশ ঘেঁষে হেঁটে চলছে তৃষ্ণা আর লিমন। গন্তব্য তাদের টিএসসি। লিমন তৃষ্ণার খুব ভালো ফ্রেন্ড। বাসা তৃষ্ণা দের তিন বাড়ি পেছনে। হালকা রোদ শরীরে ব্লাক কালারের কুর্তি তার উপর জ্যাকেট। বেশ মিষ্টি লাগছে দেখতে তৃষ্ণা কে। লিমন এটা ওটা বলছে আর তৃষ্ণা হেসে হেসে সেই কথার পৃষ্ঠে কথা বলছে। রাফি এসেছিল টিএসসি ঘুরতে কিছু ফ্রেন্ডের সাথে। কিন্তু ঘুরতে এসে যে তৃষ্ণা কে একটা ছেলের সাথে এভাবে হেসে কথা বলতে দেখবে ভাবে নি। মেয়েটা না সেদিন বললো তার নাউজুবিল্লাহ জিনিস নেই। আজ তো দেখছি আসতাগফিরুল্লাহ নিয়ে ঘুরছে।

রাফি ফ্রেন্ড’দের থেকে সরে গিয়ে তৃষা আর লিমনের সামনে দাঁড়ালো। তৃষ্ণা লিমনের সাথে কথা বলছিলো রাফি কে দেখে নি। হঠাৎ সামনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে রাফি। তৃষ্ণা অবাক হয় রাফিকে এখানে দেখে। লিমন রাফির দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ কিছু বলবেন ভাইয়া?

রাফির দৃষ্টি তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণা লিমনের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ তুমি যাও লিমন আমি আসছি।
লিমন মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। তৃষ্ণা রাফির দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ভাইয়া আপনি এখানে? ঘুরতে এসেছেন?

রাফি ভ্রুকুটি করে বলে-
-“ ভাগ্যিস ঘুরতে এসেছিলাম বলে এসব দেখলাম।

তৃষ্ণা আশেপাশে তাকিয়ে বলে-
-“ কি দেখলেন?
-“ আজকাল কার মেয়েরা রাস্তায় আসতাগফিরুল্লা জিনিস নিয়ে ঘুরাফেরা করে।
-“ সেটা আবার কি?
-“ ছেলেটা কে ছিলো?
-“ কোন ছেলে?

রাফি দাঁতে দাঁত চেপে বললো-
-“ যার সাথে রংঢং করে হাসতে হাসতে আসছিলে।
-“ ওটা লিমন আমার ফ্রেন্ড।
-“ কেমন ফ্রেন্ড।
-“ জাস্ট ফ্রেন্ড।
রাফি মাথার চুল গুলো কে পেছনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে-
-“ আজকাল জাস্ট ফ্রেন্ডের সাথে কত কিছু ভাইরাল হয়।
-“ কি ভাইরাল হয়?
-“ কি আবার আমার মাথা। মেয়ে মানুষ ছেলে ফ্রেন্ড কেনো থাকবে?
-“ আশ্চর্য এভাবে কথা বলছেন কেনো? ফ্রেন্ড থাকা দোষের নাকি। আপনার ও তো ফ্রেন্ড আছে।

রাফি তার ফ্রেন্ড সার্কেলের দিকে হাত তাক করে বলে-
-“ দেখো তো আমার ফ্রেন্ড সার্কেলে কোনো মেয়ে ফ্রেন্ড আছে নাকি?
তৃষ্ণা তাকালো। তিনজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
-“ না নেই।
-“ তাহলে তোমার কেনো ছেলে ফ্রেন্ড থাকবে?
-“ আমরা একই ডিপার্টমেন্টে পড়ি।
-“ সো হোয়াট?
-“ বাসাও পাশাপাশি।
-“ সেজন্য তার সাথে মিশতে হবে তোমার?

-“ আশ্চর্য মিশলে কি হবে?
-“ মিশবা কেনো?
-“ তো আমি কি মিশবো না? ও কথা বলতে আসলে কি করবো?
-“ কিছু জিজ্ঞেস করলে হ্যাঁ হু বলবে। বেশি মিশার দরকার নেই কেমন?
-“ আচ্ছা। আপনি এখানে এসেছেন কেনো বললেন না তো?
-“ এমনি ঘুরতে।
-” বাসায় যাবেন এখন?
-“ না অফিসে যাবো, আজ জমির ওখানে যেতে হবে।
-“ এখন?
-“ হ্যাঁ।
-“ আচ্ছা তাহলে সাবধানে যান।
-“ হু। ছেলেদের সাথে মিশবে না। মনে যেনো থাকে?
-“ আচ্ছা।

রাফি আর কিছু না বলে ফ্রেন্ড দের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। তৃষ্ণা ক্লাসে চলে আসে।

চিত্রা বাসায় ঢুকে নিজের রুমে ঢুকতেই দেখে তার মা তার বিছানা গোছাচ্ছে। চিত্রা মাকে জড়িয়ে ধরে। চয়নিকা বেগম মেয়েকে সামনে এনে বলে-
-“ তোমার এডমিশন পরীক্ষা কবে?
-“ এই তো সপ্তাহ খানেক পর। কেনো বলো তো?
-“ তোর পরীক্ষা শেষ হলে আমরা সবাই গ্রামে বেড়াতে যাবো।

চিত্রা উৎফুল্ল নিয়ে বলে-
-“ দাদু বাড়ি?
-“ হ্যাঁ। তোর দাদা ভাই আজ ফোন করে বলেছে যেতে। কতগুলো দিন তোকে দেখে না আর শীতের কাল তো চলেই এসেছে।
-“ হ্যাঁ দাদির বানানো পিঠা জাস্ট ওয়াও আর ওয়াও।
-“ আজ কোচিং থেকে ফিরতে দেরি হলো যে?

চিত্রা চুপ হয়ে গেলো। মাথা থেকে হিজাব খুলতে খুলতে বলে-
-” ঐ এমনি নতুন ফ্রেন্ড হয়েছে গল্পগুজব করছিলাম একটু।
-“ ওহ্ আচ্ছা তোর ফুপি কে একটু ফোন দে তো।

চিত্রা ভ্রুকুটি করে বলে-
-“ কেনো?
-“ তোর ফুপি কে বলতে হবে তোর ফুপা যেনো আসার সময় সিলেট থেকে চা আনে। তোর দাদু নিয়ে যেতে বলেছে।
-“ ফুপিরা সবাই যাবে নাকি?
-“ সেটা তো জানি না। হয়তো যাবে।
-“ ওহ আচ্ছা, তুমি যাও আমি ফ্রেশ হয়ে ফোন দিচ্ছি।

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে