আবছা আলোয় তুমি পর্ব-০১

0
4822

সূচনা পর্ব
#আবছা_আলোয়_তুমি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

আমার স্ত্রীকে পরপুরুষের সাথে আবাসিক হোটেলের পাওয়া গেছে। অনৈতিক কাজ করতে গিয়েছিল সেখানে। আমি গেলে ওঁদের ছেড়ে দিবে। মিনিট দুয়েক আগে একজন অচেনা ভদ্রলোক কল দিয়ে কথাগুলো জানালেন আমাকে। বিরক্ত হয়ে কলটা কেটে দিলাম। পিয়াসী এমন মেয়েই নয়। আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি ওঁকে। তাছাড়া পিয়াসী বাড়ি থেকে খুব একটা বের হয় না। বাড়িতে মা, ছোটবোন, বাবা সবাই থাকে। ওঁরা বেশ নজরে রাখে পিয়াসীকে। তাই আর এসব কথায় কান দিলাম না। অফিস ছুটি হয়েছে অনেকক্ষণ হলো, বাড়ি ফিরতে হবে।

সবে চার মাস বিয়ে হয়েছে আমার। নতুন বউ রেখে অফিস যেতে একটুও ভালো লাগে না। তবুও কি আর করার! বাড়ি ফেরার পথে বউয়ের জন্য দুইটা বেলি ফুলের মালা কিনলাম। হয়তো খুব খুশি হয়ে মেয়েটা। বেলি ফুলের মালাটা পকেটে রাখতে গিয়ে মনে পড়লো, বউ শিউলি ফুল খুব পছন্দ করে। তবে কোনো দোকানে শিউলি ফুল পেলাম না। এক প্রকার বাধ্য হয়েই বেলি ফুল নিয়ে বাড়ি ফিরতে হলো। পিয়াসীর সাথে সময় কাটাতে না পারলে আজ-কাল কিছুই ভালো লাগে না আমার।

বাড়ি ফিরতেই পিয়াসী ঠান্ডা এক গ্লাস শরবত নিয়ে আমাদের ঘরে এলো, টেবিলের উপর গ্লাসটা রাখতে রাখতে বললো, ” অনেক কষ্ট হয়েছে না তোমার? সারাদিন এতো কাজ করলে বাড়িতে ফিরে বড্ড ক্লান্ত লাগে। নাও এই শরবত টুকু খেয়ে নাও জলদি। ”

–” সে না হয় আমি শরবত খেয়ে নিলাম। কিন্তু মহা রাণীর কি আমার সাথে দুদণ্ড সময় কাটানোর ইচ্ছে আছে নাকি আবার রান্নাঘরে পাখির মতো উড়াল দিবে? ”

–” তুমি যে কি বলো না। জানো এখনও কত রান্না বাকি? সবকিছু সময় মতো শেষ না করলে মা বাবা বোন কি খাবে রাতে?”

পিয়াসীকে পিছন দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। মেয়েটা আমার কাছে আসলেই পালাই পালাই করে, কিন্তু কেন যে বোঝে না আমাকে! পারলে আমি ২৪ ঘন্টাই ওর সাথে থাকতাম।

–” আরে কি করছো তুমি? কেউ দেখে ফেললে কি হবে শুনি? আমি গেলাম, কাজ আছে আমার। ”

পিয়াসী রান্নাঘরে চলে গেলো। আমি শরবতের গ্লাসে চুমুক দিলাম। মেয়েটার রান্নার হাতটা যা না। একদম অমৃত লাগে সবকিছু।

রাতের খাওয়া শেষ পিয়াসী ঘরে আসলে ও-র হাতে বেলি ফুলের মালাগুলো ওর হাতে দিলাম। মন ভুলানো হাসি দিয়ে মালাগুলো হাতে নিলো মেয়েটা। এই হাসির থেকে বড় প্রাপ্তি হয়তো আর কিছুই হতে পারে। বউটাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি।

–” আমি চুলে খোঁপা করি। তুমি নিজের হাতে পরিয়ে দাও। ”

পিয়াসীর খোঁপায় মালা পরিয়ে দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, ওর ঘাড়ে একটা কাটা দাগ। কেউ হয়তো ইচ্ছে করে এমনটা করেছে। আমার নামের প্রথম অক্ষরের মতো অনেকটা।

–” পিয়াসী তোমার গলায় এই কাটা দাগটা কিসের?”

–” কি জানি, বলতে পারবো না আমি। হয়তো ছোট বেলায় কেটে গিয়েছিল। ঠিক মনে নেই। ”

আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। আমি যেমনটা ভাবছি তেমনটা জানি কখনোই না হয়। পিয়াসীকে ছেড়ে বাথরুমের দিকে হাঁটা দিলাম। চোখেমুখে পানি ছড়িয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছি। একটু স্বাভাবিক হয়ে ঘরে ফিরে এলাম।

পিয়াসী তখন শুয়ে পড়েছে। ওর কোমর সমান চুল সারা বিছানা ছুড়ে ছড়িয়ে আছে। অদ্ভুত মায়া সারা মুখে। যে কোনো পুরুষই এই মায়াতে আকৃষ্ট হয়ে যাবে।

এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ও-র দিকে। কয়েক মুহুর্ত পরে পিয়াসীর মুখটা ঝাপসা হয়ে এলো, চোখের সমানে ভেসে উঠলো বারো বছর আগের কাহিনী।

” সন্ধ্যায় দিকে সবুজ আর আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। এই পথ দিয়েই তেরো বছর বয়সী এক কিশোরী বাড়িতে ফিরবে। স্বভাবে এখনও বাচ্চামি রয়ে গেলেও আজকাল মেয়েটার শরীরটা বেশ সুন্দর হয়ে উঠেছে। যেন সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপ। এমন শরীরের লোভ পাড়ার বখাটে ছেলেদের বহুকাল ধরেই।

সবুজ হাতে কয়েকটা আইসক্রিম নিয়ে এসে বললো, ” দোস্ত মেয়েগুলো দিয়ে আয় তো। আর এইটা আমাদের শিকারকে দিবি। আমি ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছে এতে৷ তবে সাথে সাথে ঔষধ কাজ করবে না। ”

সবুজের থেকে আইসক্রিম নিয়ে মেয়েগুলো কাছে গেলাম। ওরা তখন নিজেদের পৃথিবীতে মত্ত হয়ে আছে।

–” এই যে বনুরা, কেমন আছো তোমরা?”

আমার কথায় হয়তো ওঁরা বিরক্ত হলো, পিছন ফিরে একসাথে বলে উঠলো, ” কে তুমি? দেখছো না আমরা খেলা করছি। ”

–” আমি তোমাদের বড় ভাইয়া। দেখো তোমাদের জন্য আইসক্রিম নিয়ে এসেছি। ”

আমাদের শিকারটা বড্ড চালাক। হুট করে বলে ফেললো, ” তোমাকে তো চিনি না। আর অচেনা লোকের থেকে কোনো খাবার খেতে নেই। আমরা কেউ আইসক্রিম খাবো না। ”

অন্যরা অসন্তুষ্ট হলেও ওর কথায় সায় দিলো। ন্যাকা কান্না ভাব ধরে বললাম, “আসলে আমারও না তোমাদের মতো ছোট একটা বোন ছিলো। কয়েকদিন আগে গাড়ির নিচে চাপা পড়েছে, এখন সে আকাশে চলে গেছে আমাকে রেখে। বোন ছাড়া কেউ ছিলো না আমার। তোমরাও তো আমার বোনের মতো তাই এগুলো নিয়ে এলাম। থাক তোমরা নিতে না চাইলে এসব নিতে হবে না। ”

এরপর সকলেই একে একে আইসক্রিমগুলোকে নিয়ে নিলো। মুচকি হেসে মনে মনে বললাম, ” বইয়ের বিদ্যায় কি আর চালাক হওয়া যায়!”

আপাতত এখানের কাজ শেষ। তুড়ি বাজাতে বাজতে নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। সবুজ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলো, ” কি রে মামা কাজ হয়েছে তো?”

শয়তানী হাসি দিয়ে বললাম, ” কোন কাজটা হয় না আমাকে দিয়ে?”

সবুজের চোখে মুখে হাসির ছাপ ফুটে উঠলো। সন্ধ্যে তখনও নামেনি ধরণীর বুকে। চারিদিকে শেষ বিকালে আলো ছড়িয়ে আছে। কিশোরী মেয়েটা নিজের বাড়ির পথ ধরেছে। কাছাকাছি আসতেই সবুজ গিয়ে ওকে বাঁধা দিলো।

–” একি তুমি আজ এতো সকাল সকাল বাড়িতে ফিরে যাচ্ছো যে? তোমাদের খেলা শেষ?”

সবুজকে আগে থেকেই চিনতো মেয়েটা। ওঁদের বাড়ির পাশেই বাড়ি।

–” সবুজ ভাইয়া মাথাটা খুব ব্যাথা করছে, বড্ড ঘুম পাচ্ছে গো। তাই চলে এসেছি। ”

–” কেন শরীর খারাপ নাকি? দেখি তোমার জ্বর এসেছে কিনা।”

সবুজ মেয়েটার কপালে হাত চেপে ধরে, ঠোঁটে কোণে বিশ্রী একটা হাসি খেলা করছে ওর। মেয়েটা মিনিট পাঁচেক ও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। সবুজের হাতের উপর ঢলে পড়ে গেলো।

–” যা কড়া ঔষুধ মিশিয়েছি না মামা। কাজ হতেই হবে। ”

প্রতিত্তোরে আমার চোখে মুখে এক বিশ্রী হাসিতে ভরে গেলো। পাঁজা কোলা করে পাশের পোড়া বাড়িতে নিয়ে গেলাম মেয়েটাকে। ক্ষুদার্থ পিশাচের মতো শরীরের প্রতিটা ভাঁজের স্বাদ নিতে লাগলাম দুই বন্ধু মিলে। কড়া ঘুমের ঔষধের ফলে মেয়েটা চোখ খুলতে পারেনি, তবে সবকিছু অনুভব করেছে। ব্যাথায় চিৎকার করেছে, গোঙ্গানির শব্দে চারিপাশ মুখরিত হয়েছে।

সবশেষে পকেট থেকে একটা ধারালো ব্লেড বের করলাম। সবুজ চমকে বলে উঠলো, ” তুই কি ওঁকে মেরে ফেলতে চাইছিস? দেখ ভুলেও একাজ করিস না। ”

হেসে বললাম, ” আরে না পাগলা! চিহ্ন দিয়ে দিবো, এ মেয়ে শুধুই আমার। ”

বলতে বলতে মেয়েটার ঘাড়ে একটা পোঁচ দিলাম। নিজের নামের প্রথম অক্ষরের মতো। সাদা চামড়া কেটে গিয়ে রক্তে ভরে গেলো জায়গাটা ।

–” এতো রক্ত কেন রে এর? কি খায় রে?”

সবুজ বিরক্ত হয়ে বললো, ” তুই দিলি ঝামেলা করে। ”

পাশের ঝোপ থেকে কিছু পাতা এনে কাটা জায়গায় লাগিয়ে দিয়ে বললাম, ” যা গোসল করে এসে তোর কাজ কর। ”

সবুজ মেয়েটাকে কোলে করে ওঁদের বাড়িতে নিয়ে গেলো। গিয়েই ন্যাকা কান্না শুরু করে দিলো।

–” দেখেন চাচি বোনের কি দশা হয়েছে। ”

মেয়েটার মা বাবা আৎকে উঠে ছিলো তাদের মেয়ের এমন দশা দেখে। মেয়ের বাবার চোখে মুখে ভয়। নতুন এলাকায় কাজে এসেছে, সৎ লোক তিনি। মুখের উপর সত্যি কথা বলতে ভয় করেন না। সেদিনও মাস্তান মন্টুর মুখের উপর বলে এসেছে,” যে জমি তোমার নয় সে-ই জমির কাগজ আমি তোমাকে দিতে পারবো না। দরকার হলে ভূমি অফিসের চাকরি ছেড়ে দিবো। ”

সে-ই সাহসী লোকটাকে আজ বড্ড ভিতু লাগছে। তার শত্রুদের তিনি ভয় করেন না ঠিকই। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে বড্ড ভয় তার। একটাই মেয়ে তাদের। বিয়ের পনেরো বছর পরে বাবা হয়েছে লোকটা। এ সাতরাজার ধন সে হারাতে চায় না। এই ভয়েই সাতদিন পর লোকটা এলাকা ছাড়ে। থানা পুলিশ করেনি ভয়ে কারণে।

আমি অবশ্য এসব চোখে দেখিনি। সবুজের থেকেই বর্ণনা শুনেছি। লোকটা কাপুরুষতা দেখে সেদিন যেমন হেসেছি, তেমন খুশিও হয়েছিলাম। কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি আমার। ”

অতীতের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলাম। পিসায়ী ঘুমিয়ে পড়ছে। কিন্তু আমি কিছুতেই শান্ত হতে পারছি না। পিয়াসী ঘাড়ে ঠিক তেমন কাটা দাগ। না না আমি কোনো ভুল করছি না, এটাই সে-ই পিয়াসী। মাথা কাজ করছে না। উপায় না পেয়ে সবুজকে কল দিলাম। ছেলেটার সাথে আজও সম্পর্ক রেখেছি।
কয়েকবার রিং হওয়ার পর কলটা রিসিভ করলো।

–” কি হলো রে? এতো রাতে বউ রেখে আমাকে কল দেওয়ার কারণ?”

–” কারণ ছাড়া তোকে কল করিনি ভাই। ওই মেয়েটার নাম কি ছিলো?”

–” কোন মেয়েটা?”

–” আরে ওই বরিশালের বাচ্চা মেয়েটা। পোড়াবাড়ি! ”

–” কার কথা বলছিস বুঝতে পারছি না, ম্যাসেজ দিয়ে সবটা খুলে বল। আমার কথা বলার সময় নেই। বউ জেগে আছে, ডাকছে আমাকে। ”

সবুজ কলটা কেটে দিলো। কাজের সময় ছেলেটাকে পাওয়া যায় না। দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়লাম। হঠাৎ খেয়াল এলো বিকেলের অচেনা লোকটার কথা! বউকে আবাসিক হোটেলে পাওয়া গেছিলো। কে আমার সাথে এমন মজা করলো নাকি সত্যি!

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে