আবছা আলোয় তুমি পর্ব-০৩

0
2406

#আবছা_আলোয়_তুমি
পার্ট -৩
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

–” লা’শটা কার বলতে পারেন মনির সাহেব?”

ওসি সাহেবের কথায় ধ্যান ভাঙলো আমার। এতো সময় এক দৃষ্টিতে সবুজের লা’শের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কত স্মৃতি দু’জনের! সবুজের পরিচয় লুকিয়ে রাখলে আমি নিজের ফেঁসে যাবো। তাই কোন ঝুঁকি নিতে চাইলাম না।

–” হ্যাঁ, উনি আমার বাল্যকালের বন্ধু। মাঝে মাঝেই কথা হতো আমাদের। ”

–” তা উনার কল লিস্ট দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তা উনি কি আপনার কাছে এসেছিল কাল? আপনার এলাকায় লা’শ পাওয়া গেছে। ”

–” না, আমাদের দেখা করার কোন পরিকল্পনা ছিলো না। ”

–” আপনি কয়েকদিন শহরের বাইরে যেতে পারবেন না। উনার হ’ত্যার সাথে আপনার সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। ”

–” কি বলতে চান আপনি? আমি আমার ব্যালকালের বন্ধুকে খু’ন করেছি? এমনটা কখনোই নয়। ”

–” হ’ত্যা’কা’রী ধরা না পড়া পর্যন্ত আইনের চোখে সবাই অপরাধী। সন্দেহের বাইরে কেউ নেই। ”

–” আচ্ছা। ”

–” উনার বাড়িতে খবর দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। কাল পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুসারে হ’ত্যা’কা’রীর সন্ধান করা হবে। ”

–” আমার কি আর কোন কাজ আছে এখানে?”

–” না, আপনি চাইলে এখন আসতে পারেন। না চাইলে চা খেয়ে যেতে পারেন। ”

— আপাতত চা খাওয়ার ইচ্ছে নেই। ধন্যবাদ। ”

মনির থানা থেকে বেরিয়ে গেলো। ওসি সাহেব হেসে কনস্টেবলকে বললো, ” লোকটার তেজ দেখেছিস। খু’নের আ’সা’মী হলে আমি রি’মা’ন্ডের দায়িত্বটা নিবো। ”

প্রতিত্তোরে কনস্টেবল হেসে কুটিকুটি হয়ে গেলেন।

রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে হেঁটে চলেছে মনির। সবুজের কে’স ওপেন হলে সে নিজেও ফেঁসে যেতে পারে। এসব নিয়ে দারুণ চিন্তা তাঁর, আবার মনের মাঝে রহস্য দানা বেঁধেছে। কে এ কাজ করতে পারে? সবকিছু মিলিয়ে পাগল পাগল অবস্থা মনিরের।
সেদিন বাড়ি ফিরে পিয়াসীর সাথে তেমন কথা হয়নি তার, একদম চুপসে গেছে লোকটা। পিয়াসীও নিজের মতো কাজ করে গেছে। মনির কাছে তেমন প্রশ্ন করেনি।

পরেরদিন সকাল দশটা। থানার এককোণে দাঁড়িয়ে আছে মনির। সাথে সবুজের স্ত্রী আর তার ভাই। সকলেই ওসির দিকে তাকিয়ে আছে, কি-না কি-না সংবাদ দিবে সে। ওসি সাহেব কিসব রিপোর্ট দেখে চলেছে তখন থেকে। কপাল কুঁচকে আছে তার।

মিনিট দশেক পর ওসি মুখ খুললেন। সবুজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ” আপনার স্বামীর সাথে কেমন সম্পর্ক আপনার?”

নবনীতা চোখের কোণে জমে থাকা পানিটা মুছতে মুছতে বললো,” বিয়ে হয়েছে সবে দু’মাস। এতোদিন সম্পর্ক ভালোই চলছিলো। দু’দিন আগে উনার সাথে ঝগড়া হয়েছে। উনার অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো। এটা নিয়েই ঝামেলা। ”

ওসি সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ” উনাকে কেউ খু’ন করেনি। বরং অতিরিক্ত ম’দ্য পান ও নে’শার দ্রব্য সেবন করার জন্য উনার মৃত্যু হয়েছে। ”

–” তাহলে গায়ে অমন আছড় এলো কেন? মা’দ’কদ্রব্য খেয়ে মৃ’ত্যু বরং করলে গায়ে নিশ্চয়ই এমন আঁচড়ের দাগ হবে না।'”

মনিরের এমন প্রশ্ন হয়তো ওসি সাহেবের পছন্দ হয়নি। এমন গোয়েন্দাদের মতো জেরা করলে কারই বা ভালো লাগবে। ওসি সাহেব মনিরের দিকে তাকালেন, তাঁর চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ ফুটে ওঠে। তবুও নিজেকে সামলে জবাব দেয়,

–” আঁচড়ের দাগগুলো কুকুরের নখের! অন্তত পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এটাই বলছে। বাকিটা বলতে পারবো না। ”

–” কুকুর কেন হঠাৎ সবুজের সাথে এমন করতে যাবে?”

–” তা না হয় আপনি কুকুরে গিয়ে প্রশ্ন করেন। ”

ওসির উত্তর তেমন পছন্দ হলো না মনিরের। তবুও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। কোনো প্রকার ঝামেলা চায় না সে। এমনিতেই নিজের জীবন নিয়ে বিপাকে আছে মনির। সে-ই মেয়েকেই বিয়ে করছে যাকে বারো বছর আগে বন্ধুর সাথে মিলে নিজেই ধ’র্ষ’ণ করেছে। অতিরিক্ত পৈশাচিক আনন্দের আশায় মেয়েটার ঘাড়ে ধা’রা’লো ব্লে’ড দিয়ে নিজের অক্ষর খোদাই করে দিয়েছে। আজকাল পিয়াসীকে তেমন স্পর্শ করতে ইচ্ছে হয় না মনিরের, সবসময় ভয়ে থাকে এই বুঝি পিয়াসী তাকে চিনে ফেললো। সাজানো সংসার হয়তো এইবার শেষ হয়ে যাবে। সে-ই সাথে পরিবারের আদর্শ ছেলের মুখোশটা ছিঁড়ে আসল রূপটা বেরিয়ে আসবে। নানান চিন্তায় বেহাল দশা তার। এর মাঝে সবুজের খু’নের কোনো দায় নিতে চায় না সে।

–” আপনাদের কি কাউকে সন্দেহ হয়? তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। ”

ওসি সাহেবের কথায় নবনীতার দিকে তাকায় মনির। নবনীতা ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দেয়। ওসি সাহেব টেবিলের উপর ফাইলগুলো রাখতে রাখতে বললেন,” তাহলে কিছু কাগজে সই করে লা’শটা নিয়ে যান। কে’স এই পর্যন্ত! ”

কোন হ’ত্যার মামলা এতো তাড়াতাড়ি বন্ধ হতে পারে জানা ছিলো না মনিরের। তবুও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সবুজের খু’ন হোক বা নিজের দোষে মা’রা যাক। এটা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই মনিরের। বরং বেশ ভালোই হয়েছে তার। সবুজের সাথে সাথে মনিরের কুকর্মগুলোও চাপা পড়ে গেছে। থা’না থেকে লা’শ ছাড়িয়ে নিয়ে সবুজের বাড়ির দিকে রওনা দিলো সবাই। থানা থেকে লাশ ছাড়িয়ে নিয়ে এতো ঝামেলা আগে জানতো না মনির। তবুও বন্ধু লা’শ ছাড়িয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেলো। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কবর খুঁড়ে, লা’শ মাটি দিয়ে তারপর বাড়ির পথে রওনা দিলো।
ওদিকের সবুজের কাজ শেষ করতে করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রাত দুইটার দিকে বাড়িতে ফেরে মনির।

পিয়াসী তখনও পায়চারি করেছে বারান্দায়, বারবার গেটের দিকে উঁকি দিচ্ছে। যদি কোথাও মনিরের চিহ্ন দেখতে পায়, এই আশায়! বারবার কল দিচ্ছে স্বামীকে কিন্তু মনিরের মোবাইল বন্ধ।

দরজায় কড়া নাড়তেই পিয়াসী দৌড়ে আসে। হয়তো তাঁর অপেক্ষায় শেষ হয়েছে।

–” কে ওখানে? ”

–” পিয়াসী আমি মনির। দরজা খোল। ”

মনির কন্ঠ শুনে দরজা খুলে দেয় পিয়াসী। তারপর কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে মনিরকে। মনির অবাক হলেও প্রকাশ করে না। পিয়াসীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,” দরজায় দাঁড়িয়ে রাখবে বুঝি আমাকে?”

–” আপনার সাথে তা-ই করা উচিত। কোথায় ছিলেন আপনি এতো সময়? জানেন কত চিন্তা হচ্ছিল আমার! ”

মনির হয়তো পিয়াসীর অভিযোগ বুঝতে পেরেছে, পিয়াসীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, ভুং হয়ে গেছে আমার। আর কখনও এমন কাজ করবো না,। ”

পিয়াসী তবুও মন খারাপ করে থাকে। মনির পিয়াসীর মন ভালো করার চেষ্টা করে না, বরং নিজের মতো করে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ে। সারাদিন অনেক ধকল গেছে আজ।

সকালে ঘুম থেকে উঠে পিয়াসীকে কোথাও দেখতে পায় বা মনির। পিয়াসীর নাম ধরে ডাকতে থাকে। পিয়াসী তখন রান্নাঘরে সকালের নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। মনির পিয়াসীকে খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে চলে আসে। পিয়াসী রান্না করছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কেন জানি খুব ভয় পেয়ে গেছিল সে।

–” পিয়াসী এতবার ডাকছি, সাড়া দিচ্ছো না কেন?”

–” আমি রাগ করে আছি। ”

মনির কর্কশ গলায় বলে, ” কি জন্য রাগ করে আছে তুমি?”

পিয়াসী কিছু বললো না। মনির নিজের রাগকে সংযত করে পিয়াসীকে জড়িয়ে ধরলো।

–” আমার বউটা বুঝি ভীষণ অভিমান করে আছে আমার উপর? কি করবে বলো! তোমার বরটা যে একটুও ভালো না। শুধু শুধু এতো ভালো একটা বউকে কষ্ট দেয়। ”

পিয়াসী মুখ ফুলিয়ে বলে,” আমার বরটাও অতো খারাপ না। আমাকে অনেক ভালোবাসে। ”

মনির কোনো কথা বলে না, পিয়াসীকে ছেড়ে রুমে চলে আসে। মনিরের এমন ব্যবহারে পিয়াসীর খুব খারাপ লাগে। চোখের কোণে অশ্রু টলটল করে। ওড়না দিয়ে জমে থাকা পানিটা মুছে নিজের কাজে মন দেয় পিয়াসী।

সকালে খাওয়ার সময়, মনির পিয়াসী সামনা-সামনি দুইটা চেয়ারে বসে আছে। নিরবে খাবার খাচ্ছে দু’জন। নিরবতা ভেঙে মনির প্রশ্ন করে

–” বাকিরা কবে বাড়িতে আসবে?”

–” মা বলেছে আজ বিকালে। ”

–” তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। ”

–” কি সারপ্রাইজ? ”

–” বলে দিলে কি আর সারপ্রাইজ থাকে নাকি হুমমম?”

–” তবুও বলেন না!”

–” আমরা আগামীকাল কক্সবাজার যাচ্ছি। আমাদের হানিমুনটা বাকি রয়ে গেছে কিনা!”

পিয়াসী উওর দেয় না। লজ্জায় মুখ নিচু করে থাকে। পিয়াসীর অভিমান ভাঙাতে পেরেছে বলে মনিরও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কোনো রকমের অশান্তি চায় না সে। পিয়াসীর সাথে সংসার করবে কিনা এটা নিয়ে বড্ড চিন্তিত সে। বাড়ি থেকে দূরে কোথাও গিয়ে নিরালায় সিদ্ধান্তটা নিতে চাইছে। তারপর কি করা যায় দেখা যাবে। তাছাড়া পিয়াসীর নামে অঢেল সম্পত্তি রয়েছে। পিয়াসীর দাদা তার সকল সম্পত্তি একমাত্র নাতির নামে লিখে দিয়ে গেছেন। তাছাড়া পিয়াসীর নানাও পিয়াসীর জন্য ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে। মকবুল সাহেবের একমাত্র মেয়ে পিয়াসী। তাই বাপের সম্পত্তিও কোন এক সময় পিয়াসীর নামে চলে আসবে। জায়গা জমি বিক্রি করার লোক তার শশুর নয়। এসব কালে কালে মনিরই ভোগ করবে। হুটহাট পিয়াসীকে তালাক দিয়ে সে-ই সম্পত্তি হারাতে চায় না। আবার পিয়াসীকে তা’লা’ক দিয়ে তাকে নিয়ে নানান কথা ছড়াবে, পিয়াসীর আচরণ খুবই ভালো৷ আজও কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে দেখেনি মনির। তাই স্বভাব চরিত্রের দোষ দিয়ে পিয়াসীকে তা’লা’ক দেওয়া সম্ভব নয়। এতে পরিবারের কাছে তার ইমেজ নষ্ট হয়ে যাবে। পিয়াসী একজন ভালো বউ, ভালো ভাবি। বাড়ির সকলেই ও-র উপর সন্তুষ্ট। তবুও নিজের দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারে না মনির।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে