আংটি পর্ব_১

0
1952

আংটি পর্ব_১

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
লেখনীতেঃ- অনামিকা ভট্টাচার্য্য

এ গল্পের নায়িকার নাম হচ্ছে উপমা।নামের মতোই সুন্দর সে মেয়ে।যাকে বলে একেবারে রূপে লক্ষী,আর গুণে সরস্বতী।বিধাতা অতি যত্ন করে রূপে-গুণে সাজিয়েছেন মেয়েটাকে।দুধে-আলতা গায়ের রঙ।স্বচ্ছ দীঘির মতোই টলমল করছে টানা টানা চোখ দুটি।ডালিম ফলের মতো রাঙা দুটি ঠোঁট।মায়াবী চেহারা!মাথা ভর্তি দীঘল কালো চুল পিঠ ছাড়িয়ে গেছে।লম্বা, ছিপছিপে গড়নের মেয়ে।

এতো গেলো রূপের বর্ণনা।এবার গুণের কথায় আসি।সর্বদা স্বল্পভাষিণী,সুহাসিনী,মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে উপমা।বিদ্যা দেবীর কৃপায় জীবনের কোন পরীক্ষায় ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয় নি সে।মা সরস্বতী ওকে কন্ঠ ভরা সুর দিয়েছেন।নটরাজের আশীর্বাদ আছে উপমার মাথার ওপর।তাই তো সে নাচে-গানে সমানভাবে পারদর্শী।

বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে উপমা।আমাদের দেশে যেখানে কলেজের গন্ডি পেরোনোর আগেই অধিকাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়,সেখানে উপমার মতো মেয়ে এখনো অবিবাহিত।এটা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়!
উপমা দু বছর আগে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে।সাহিত্যের ছাত্রী ছিলো সে।মধুসূদন বাবুর মতোই বাংলা ভাষার অমৃত সুধা পান করেছে সে।তাই তো ভাষা কে ভালোবেসেই অন্য সব সাবজেক্ট বাদ দিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য বাংলাকেই বেছে নিয়েছিলো।শুরু থেকেই শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহ ছিলো।সেভাবেই প্রিপারেশন নিয়েছে।প্রথমবারেই সফলতার সহিত বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।এখন পোস্টিং এর অপেক্ষায় আছে।
এর মাঝেই উপমার বিয়ের জন্য অনেকগুলি প্রপোজাল এসেছে।কিন্তু কথায় আছেঃ-

“অতি বড় সুন্দরী না পায় বর
আর অতি বড় ঘরণীর না হয় ঘর”।

উপমার ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে।একটার পর একটা বিয়ের সম্মন্ধ আসে।আবার কোন এক অদৃশ্য কারণে সেটা ভেঙেও যায়।এই তো গতবছর ওই ডাক্তার ছেলে যে কি-না কোন এক বান্ধবীর বিয়েতে উপমাকে দেখে পছন্দ করেছিলো।তার পরিবার নিজে থেকেই এসে উপমাকে আশীর্বাদ করে যান।খুব আগ্রহ ছিলো উনাদের।বিয়ের দিন-তারিখও প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিলো।অবশেষে পাত্রের বাবা ফোন করে সবকিছু বাতিল করে দেন।।উপমা উড়ো উড়ো শুনেছে সেই ছেলে নাকি মারাত্মক অ্যাকসিডেন্ট করে ছয়মাস হসপিটালাইজড ছিলো।কোনমতে বেঁচে ফিরেছে।এরকম ঘটনা আরো কয়েকবার ঘটেছে।উপমাকে দেখে যাবার পরই নাকি পাত্রপক্ষের পরিবারে কোন না কোন অঘটন ঘটে।তা-ই বিয়ে বাতিল হয়ে যায়।

উপমা আধুনিক যুগের শিক্ষিত মেয়ে।এসব বিষয় খুব একটা পাত্তা দেয় না।বিয়েটাই ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়।বিয়ে হলে হবে,না হলে নাই।তার থেকে ও ক্যারিয়ারের বিষয়েই বেশী কনশাস।উপমার বাবা-মা কিছুটা চিন্তিত হলেও কোথাও একটা স্থির বিশ্বাস আছে উনাদের মেয়ের বিয়ে খুব ভালোভাবেই হবে।শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা।কিছু আত্মীয়স্বজন,বন্ধু-বান্ধব আকারে ইঙ্গিতে বুঝাতে চান উপমা একটা অপয়া মেয়ে।
হায়রে আমাদের সমাজ!একদিন যারা উপমাকে নিয়ে গর্ব করতো,নিজেদের সন্তানদের কাছে উপমাকে আইডল সাজাতো।তারাই আজ উপমাকে অপয়ার অপবাদ দিচ্ছে।এখনো এ সমাজে বিয়েটাই যেন একটা মেয়ের যোগত্যার সবচেয়ে বড় মাপকাঠি।অবশ্য উপমার বাবা-মা কখনোই তা বিশ্বাস করেন না।উনাদের কাছে মেয়ে আগের মতোই আছে।মেয়ের জন্মের পর বাবার ব্যবসা দিন দিন বেড়েই চলেছে।ছোটবেলা থেকেই কতো সুনাম কুড়িয়ে এনেছে মেয়েটা।

এরমাঝেই একদিন সুখবরটা আসে।উপমার পোস্টিং হয়েছে কোন এক উপজেলা শহরে।আগামী সপ্তাহেই জয়েন করতে হবে।উপমার এতোদিনের স্বপ্ন সত্যি হয়েছে।এতে ওর বাবা-মাও খুব খুশী।কিন্তু মেয়ের এতোদূরে পোস্টিং হওয়ায় মনটা কিছুটা খারাপ।একটা অচেনা অজানা জায়গায় মেয়েটা চাকরি করতে যাবে।তাও বিবাহযোগ্য সুন্দরী কন্যা।তাছাড়া মেয়েটাকে না দেখে থাকবেন কিভাবে।কিন্তু উপমা ওদেরকে বুঝায় যে বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে না দেখে থাকার কিছু নেই।ভিডিও কলে রোজ দেখতে পাবেন মেয়েকে।আর এখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব উন্নত।যে কোনদিন মেয়েকে দেখতে যেতে পারবেন।আর উপমাও তো ছুটি পেলেই বাড়িতে আসতে পারবে।তাতে বাবা-মা কিছুটা আশ্বস্ত হোন।যেহেতু আগামী সপ্তাহেই জয়েন করতে হবে,তাই উপমা সবকিছু গুছগাছ করা শুরু করে দেয়।কিছু টুকিটাকি শপিং করতে হবে।কয়েকটা শাড়ী,দুটো শীতের পোশাক,একটা রেইনকোট,একটা ফার্স্ট এইডেড বক্স আর কিছু কসমেটিকস কিনে নেয় উপমা।এরপর ব্যাগ প্যাক করে নিতে হবে।

তারপর একদিন সকালবেলা অচেনা কর্মস্থলের উদ্দেশ্য রওয়ানা হয়ে যায় সে।যদিও উপমার নিজেরও খুব খারাপ লাগছিলো বাসা ছেড়ে যেতে।ছেলেবেলার কতো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বাসায়।ছাদের ওপর উপমার বসার একটা আলাদা জায়গা আছে।নিজের রুমের বেড,চেয়ার,টেবিল, বুকশেলফ,আলমারি, আয়না, সবকিছুর ওপরই মায়া লেগে আছে।তবু বাবা-মার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের মন খারাপ ভাবটাকে দূরে স্মরিয়ে রাখলো উপমা।হাসিমুখে বিদায় নিলো।বাসা থেকে বের হতেই মনে হলো এই চেনা গলি,পরিচিত মুদির দোকান,ফ্ল্যাক্সি লোডের দোকান,পাড়া প্রতিবেশী সবকিছুই মিস করবে ভীষণ রকম।

বাবা স্টেশনে ছেড়ে দিলেন ওকে।বাসে বসে ম্যাগাজিন পড়া শুরু করলো উপমা।কিছুক্ষণ পর টিফিনবক্স টা বের করলো।মা রুটি-চিকেন বানিয়ে দিয়েছেন।পরিচিত হাতের রান্নার সুগন্ধ নাকে এলো।আর বহুদিন মায়ের হাতের রান্না খেতে পারবে না।বাবা ফল কিনে দিয়েছেন।বাবা-মায়ের আদরগুলি ব্যাগে ভরে নিয়ে নতুন জায়গায় যাচ্ছে উপমা।জানিনা নতুন জায়গায় কি অপেক্ষা করে আছে উপমার জন্য।

বাসায় এসে মেয়ের জন্য খুব মন খারাপ হয় উত্তম বাবুর।ঘন্টায় ঘন্টায় মেয়েকে ফোন করেন।মেয়েটা নিরাপদে পৌঁছাতে পারলেই বাবা নিশ্চিন্ত হোন।

লং জার্নি শেষে গন্তব্যে এসে পৌঁছে উপমা।এখানে কোয়ার্টারে থাকার ব্যবস্থা আছে।স্টেশনে নেমে সিএনজি ভাড়া করে নিজের বাসস্থানে পৌঁছে যায়।এখানকার কেয়ার টেকার রুস্তম চাচা ওর রুম দেখিয়ে দেন।এসেই স্নান সেরে নেয় উপমা।তারপর বাবা-মার সাথে কথা বলে লম্বা একটা ঘুম দেয়।ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা খায়।রাতের খাবার রুমে এসে দিয়ে যায় এক মহিলা।আগামীকাল কলেজে জয়েন করবে।এটা নিয়ে খুব বেশী এক্সাইটেড উপমা।রাতে ভালো ঘুম হয় না।খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়।ঘুম ভাঙতেই মায়ের কথা খুব মনে পড়ে উপমার।প্রতিদিন এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙতো ওর।এলার্ম বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে যেতো ও।মা এসে জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেন।সকালের মিষ্টি রোদ এসে ঘরে ঢুকতো।মা ওকে আদর করে ডেকে তুলতেন ঘুম থেকে।ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে পড়তে বসতো সে।রুটিন করে গানের রেওয়াজ করতো।মা তখন আদা-চা বানিয়ে দিতেন।রাত জেগে পড়লেও মা ফ্লাস্কে চা বানিয়ে রাখতেন মা।মাঝে মাঝে অকারণেই মায়ের সাথে রাগারাগি করতো।মা সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিতেন।আগে এসব নিয়ে কখনো ভাবে নি উপমা।এখন দূরে এসে কেবল মনে পড়ছে কেন যে মায়ের সাথে এতো রাগ দেখাতো।আর কখনো এমনটা করবে না।এসব ভাবতেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো উপমার।চাকরি পাবার পর এতো খুশী হয়েছিল উপমা।তখন বুঝতে পারে নি একা থাকতে এতোটা কষ্ট হবে।যা-ই হোক,উপমা খুব বাস্তববাদী মেয়ে। কিছুতেই ভেঙে পড়বে না সে।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে আট টা বেজে গিয়েছে।স্নান করতে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।

#চলবে

#পরবর্তী_পর্ব

https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/962284550868931/

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে