আংটি পর্ব ৫

0
1118

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
লেখনীতেঃ- অনামিকা ভট্টাচার্য্য

আংটি পর্ব ৫

আজ মাজেদা খালা পুঁইশাক দিয়ে পুঁটি মাছের চচ্চড়ি আর হাঁসের ডিম ভুনা রান্না করেছে।খাবার নিয়ে উপমার রুমে আসে।উপমাকে খাবার দিয়ে বলেঃ-
-একটা কথা কমু ম্যাডাম।
-নিশ্চয়ই বলেন খালা।
-আসলে এই যে আফনে পড়াশুনা করে চাকরি বাকরি করতাছেন এইটা আমার বেবাক ভালা লাগছে।মাইয়া মানুষ হইলেই কি খালি বিয়ে-শাদির চিন্তা করন লাগবো?পরতমে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করন দরকার।আমার মাইয়াটারেও আমি আফনার মতো বানাইতে চাই ম্যাডাম।ওর লগে আমি আপনার কথা আলাপ করছি।হে আপনেরে একটাবার দেখবার চায়।আজকে আমার মাইয়াটার জন্মদিন।আমি কি একবার ওরে আফনার রুমে নিয়া আইমু।আফনে একটু দোয়া কইরা দিবান।

-নিশ্চয়ই। নিয়ে আসেন।আপনার কয় ছেলেমেয়ে খালা?বাড়িতে আর কে কে আছেন?

-আর কেউ নাই।সবই আমার পোড়া কপাল।অল্প বয়সে বাপ-মা বিয়া দিয়া দিলো।কতো শখ ছিলো পড়াশোনা করুম।তা আর হইলো না।বিয়ার বছর দুই ভালাই গেলো।এরপরই সোয়ামীর আসল রূপ দেখলাম।মদ খাইয়া বাড়ি আয়।টেকার লাগি মাইরধর করে।বাপ-মারে কইলাম।হেরা সব মানায়া নিতে কয়।কতো আর মানানি যায়।একসময় ছোট্ট ফুলি রে নিয়া পথে বাইর হইলাম।বাপ-মায় আশ্রয় দেয় না।পরে মাইয়াটারে লইয়া এইখানে আইলাম।আপনাগোর কলেজের বড় স্যারে এই রান্দোনের কাম পাওয়াইয়া দিলো।ভাবলাম ওউয়ে যখন ডেগ মাস্টারি কইরা ওউ জীবন কাটানি লাগবো তহন কলেজে ওউ মাস্টরি করি।কারো উপর আমার কোন অভিযোগ নাই।বাপ-মায়ে সুখের আশায় বিয়া দিছিলো।কপালে সুখ নাই, হেরা কি করবো।আর সোয়ামী এই লাহান করায় আইজ নিজের পায়ে খাড়াইতে পারছি।মাইয়াটারে নিয়া ভালা আছি।মাইয়ার বাপ আর এক বিয়া করছে।হেরা ভালা থাহুক দোয়া করি।বলেই কেঁদে উঠেন মাজেদা খালা।

-খালা কাঁদবেন না।মেয়ের জন্মদিনে মায়ের চোখের জল মানায় না।এতে মেয়ের অকল্যাণ হবে।আপনার মেয়েকে নিয়ে আসুন।

১২ বছরের এক মেয়ে রুমে ঢুকে।উপমাকে সালাম করে।

-থাক,থাক।কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?

-ক্লাস সেভেনে।

-শুভ জন্মদিন।আশীর্বাদ করি অনেক বড় হও তুমি।জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা তোমার।পড়াশুনার ব্যাপারে যখনই কোন হেল্প লাগবে,আমার কাছে চলে আসবে।আর এই নাও তোমার জন্মদিনের উপহার।
বলেই নিজের টব থেকে একটা নীল অপরাজিতা ফুল আর বুকশেলফ থেকে একটা ডিকশিনারি উপহার দেয় উপমা ফুলিকে।আর মাজেদা খালার হাতে এক হাজার টাকার একটা নোট দিয়ে বলেঃ

-ফুলির জন্য পোলাও মাংস রান্না করবেন আজকে।আর একটা কেকও কিনে দেবেন।
খুশী মনে ওরা মা-মেয়ে চলে যায়।

***************

কলেজ থেকে পিকনিকের আয়োজন করা হয়।
পিকনিক স্পট ঠিক হয় রাতারগুল ও বিছানাকান্দি – সিলেট।
সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার রস্তুমপুর ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষা এ জায়গা এখন পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। পাথর বিছানো বিস্তীর্ণ প্রান্তরের উপরে বয়ে চলা মেঘালয়ের পাহাড়ি ঝরনাধারা বিছনাকান্দির মূল আকর্ষণ।

কোন এক শুক্রবারে সব টিচার্সরা মিলে রওয়ানা দেন সিলেটের উদ্দেশ্যে।উপমা আজ পরেছে বাসন্তী রঙের সালোয়ার-সালোয়ার কামিজ।সাথে লাল-হলুদ শেডের ওড়না।কপালে সিলভার স্টোনের টিপ।ঠোঁটে মেরুন কালারের লিপস্টিক।কানে ম্যাচিং দুল।হাতে সিলভার ব্রেসলেট।খোলা চুল বাতাসে উড়ছে।কলেজে উপমা প্রতিদিনই শাড়ি পরে যায়।তাই অন্য কোন পোশাকে ওকে কেউ দেখে নি।আজ এই নিউ লুকে উপমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে।রিমি তো বলেই ফেললোঃ-

-আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে বয়স দশ বছর কমে গিয়েছে উপমা দি।

-তাই নাকি?আপনাকেও তো অন্য রকম লাগছে দিদি।বুঝাই যাচ্ছে না আপনার সাত বছর বয়সী একটা ছেলে আছে।

-হাহাহা……ধন্যবাদ।

অরণ্য পরেছে মেরুন রঙের টি-শার্ট আর ব্লু জিন্স প্যান্ট।চোখে কালো সানগ্লাস।ডিএসএলআর ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে নিয়েছে।খুব হ্যান্ডসাম লাগছে অরণ্যকে।এমনিতেও লম্বা,ফর্সা,সুস্বাস্থ্যের অধিকারী,সুদর্শন ছেলে অরণ্য।কলেজে প্রতিদিন ফরমাল শার্ট-প্যান্ট পরে যায়।আজ সবাই নিজেদের ইচ্ছেমতো পোশাক পরেছেন।গাড়ীতে সব কলিগরা মিলে খুব আনন্দ করে যাচ্ছেন।গানের কলি খেলা হচ্ছে।কৌতুক,কবিতা আবৃত্তি নানা রকম মজা হচ্ছে।

একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে গাড়ি থামে।সবাই চা বিরতি দেন।তারপর নৌকায় উঠেন রাতারগুলের উদ্দেশ্যে।দু পাশে সবুজের সমারোহ।মাঝখানে নৌকা ভেসে যাচ্ছে।হাত দিয়ে ছোট ছোট গাছগুলোকে ছোঁয়া যাচ্ছে।সত্যি!প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি সিলেট।অরণ্যের ছবি তোলার শখ!সে ফ্রেমে আটকে ফেলছে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে।অনেক উঁচুতে উঠা রাতারগুল টাওয়ারে উঠলো তারা।যাদের উচ্চতা ভীতি আছে তারা নীচে রয়ে গেলো।টাওয়ারের ওপর থেকে নীচের সৌন্দর্য দ্বিগুণ দেখাচ্ছে।সেখান থেকে নেমে আবার নৌকায় করে বিছানাকান্দির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন সবাই।

উপমা মুগ্ধ হয়ে বিছানাকান্দির সৌন্দর্য দেখছে।এখানে পাহাড় আর মেঘ একসাথে মিশে গিয়েছে।ছোট বড় অসংখ্য নুড়ি পাথর বিছানো আছে জলের ওপর।ঠিক যেন জলের ওপর পাথরের বিছানা পাতানো।ছবির মতো সুন্দর এ জায়গা।কি স্বচ্ছ জল!এতোটাই স্বচ্ছ যে গলা পর্যন্ত পানিতে নেমে গেলেও পায়ের পাতা দেখা যায়।এখানে আকাশ নীল,পানি নীল,আর পাহাড় সবুজ।আকাশ টা যেন নুয়ে পাহাড়কে ছুঁয়ে দিচ্ছে।উপমার একটা গানের কলি মনে পড়ায় গুনগুন করে গাইলোঃ-

“এই অবারিত সবুজের প্রান্ত ছুঁয়ে
নির্ভয়ে নীল আকাশ রয়েছে নুয়ে”।

পাথরের ওপর বসে কয়েকটা ছবি উঠালো উপমা।ওখানে ছবি উঠানোর জন্য ভাড়ায় ক্যামেরা ম্যান পাওয়া যায়।জলের ওপর বিশাল এক পাথর।তার ওপর বসে থাকা উপমাকে অরণ্যের চোখে জলপরীর মতোই লাগছে।যদিও অরণ্য কোনদিনও জলপরী চোখে দেখে নি।তবু গল্পে শুনে শুনেই কল্পনায় ছবি এঁকেছে।অনুচিত জেনেও বীনা অনুমতিতে উপমার কয়েকটা ছবি তোলে নেয় অরণ্য।জীবনে অনেকসময় এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন প্রচন্ড ন্যায়বান মানুষটাও ঠিক-ভুলের সংজ্ঞা ভুলে যায়।

দৃঢ় পায়ে হেঁটে যাচ্ছে উপমা।হুট করে একটা পিচ্ছিল পাথরে পা পিছলে পরে যায় উপমা।প্রচন্ড স্রোত এসে ওকে প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো।কিছু বুঝে উঠার আগেই অরণ্য ওকে টেনে তোলে।ভয়ে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে উপমা।জানিনা কি ছিলো উপমার স্পর্শের মধ্যে।অরণ্য যেন কেমন একটা মায়ায় ডুবে যায়।একটু পর স্বাভাবিক হয় উপমা।অরণ্যের বুক থেকে মাথা তোলে ওর চোখের দিকে তাকায়।তাকাতেই যেন বিদ্যুৎ চমকে যায় উপমার চোখে।মনে হয় এই চোখ দুটি ওর চিরচেনা।যেন বহুকাল আগে এই চোখের ভাষা ও পড়তে পারতো।কি যাদু আছে ওই দুটি চোখে।
অরণ্য বলে উঠেঃ-
-এখানে স্রোত খুব বেশী।তাই তো সবসময় কলকল ধ্বনি হয়।সাবধানে চলবেন।আর একটু হলেই তো ডুবে যেতেন।
-ডুবেছি তো।তোমার ওই চোখের সাগরে।

এর মধ্যেই বাকি সবাই এসে যাওয়া ছিটকে স্মরে যায় অরণ্য আর উপমা।

#চলবে

#পরবর্তী_পর্ব
https://www.facebook.com/groups/golpopoka/permalink/963078340789552/

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে