অস্পষ্টতা – পর্ব : ৮

0
940

#অস্পষ্টতা
পর্ব – ৮

লেখা : শঙ্খিনী

এমন একটা সময়ে আমার জীবনে এলো মালা ভাবী। তিনি তারিফের কোনো এক চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী। আমাদের বিয়ের পরপরই পারিবারিক কোনো এক বিষয় নিয়ে মায়ের সঙ্গে ছিল মান অভিমান। কিন্তু তখন আর সেটা ছিলো না।

মালা ভাবী প্রায় প্রতিদিনই আমাদের বাসায় আসতেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তার সঙ্গে আমার ভাব জমে যায়। খুব ভালো বন্ধু মনে করেছিলাম তাকে।

সেদিন তিনি আমাদের বাসায় এসে, আমার ঘরে গিয়ে বসলেন। আমি চা বানিয়ে নিয়ে গেলাম তার জন্যে।

চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “ভাবী আপনার চা।”
তিনি চায়ের কাপ আমার হাত থেকে নিতে নিতে বললেন, “থ্যাংক ইউ।”
“ইউ আর ওয়েলকাম।”
“জামাই কই তোমার?”
“আর কোথায় থাকবে? অফিসে।”
“তোমার আসিফ ভাই গতকাল গিয়েছিল, তারিফের অফিসে।”
“তাই?”
“হুঁ।‌ তারিফকে দেখে আসলো, তার নতুন পিয়েসকেও দেখলো।”
“ও, নতুন পিয়েস পেয়েও গেছে? আমি গত সপ্তাহে শুনছিলাম যে, ওর পিয়েস চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।”
“আশফা? তারিফের অফিসে যে নতুন পিয়েস জয়েন করেছে, এটা তুমি আমার মুখ থেকে প্রথম শুনলা?”
“হুঁ!”
“এতটা কেয়ারলেস হলে কি করে হয় বলো তো? তোমাদের বিয়ের তো প্রায় দেড় হতে চলল। এখন এইসব বিষয় নিয়ে একটু সতর্ক না থাকলে কি চলে?”
“কোন বিষয়ে ভাবী?”
“তোমার হাসবেন্ডের অফিসে একজন সুন্দরী তরুণী জয়েন করেছে, তাও আবার তার পিয়েস হিসেবে। ব্যাপারটা কিন্তু সহজভাবে নেওয়ার মতো না।”
“কেন? আপনার এমনটা মনে হয় কেন?”
“তুমিই দেখো, এতদিন ওর পিয়েস ছিল একটা ছেলে। এখন হয়তো তারিফের কাছে তুমি পুরোনো হয়ে গেছো, তাই হয়তো বা তারিফ ওই ছেলেটাকে চাকরি থেকে বাদ দিয়ে একটা মেয়েকে অ্যাপ্রোচ করেছে।”
আমি চুপ করে রইলাম।
“তুমি আজকেই তারিফের সাথে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলবা। দরকার পরলে ওই মেয়ের ফোন নাম্বার নিবা। বুঝছো?”
“কিন্তু ভাবী, এটা কি ঠিক? আপনার কথা গুলো তো শুধুই অ্যাসাম্পশনস। সত্যি নাও হতে পারে। এই বিষয়টা নিয়ে তারিফের সঙ্গে কথা বলা মানে ওকে হ্যারাস করা না?”
“হ্যারাসমেন্ট হলে হবে। তোমার সংসার সবার আগে। সংসারটাকে তো আগে বাঁচাতে হবে না-কি।”

মালা ভাবীর কথা দ্বারা আমি এতটাই প্রভাবিত হয়ে গেয়েছিলাম যে সত্যি সত্যিই এই বিষয় নিয়ে তারিফের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছি। তারিফ তখন বসার ঘরে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল।

আমি ওর পাশে বসে বললাম, “তোমার অফিসে নতুন পিয়েস জয়েন করেছে?”
“হুঁ।”
“আমাকে কিছু বলোনি তো!”
“অফিসে প্রতি মাসেই নতুন কোনো না কোনো স্টাফ জয়েন করে। সবার কথা কি তোমাকে বলি?”
“না সবার কথা আমাকে বলো না, কিন্তু তোমার এই নতুন পিয়েসের কথা আমাকে বলা উচিত ছিল। আচ্ছা আমি কি এতটাই পুরনো হয়ে গেছি যে তোমাকে এখন সুন্দরী মেয়েদের অফিসে চাকরি দিতে হয়!”
“আশফা? কি যাতা বলছো এসব? পুরনো হওয়ার সাথে পিয়েসের সম্পর্ক কি? তাছাড়া মানুষ কি কখনো পুরনো হয় না-কি?”
“আমি যদি পুরনো না-ই হয়ে থাকি, তাহলে তোমাকে সুন্দরী মেয়েদের চাকরি দিতে হয় কেন?”
“তোমার মত একজন ফেমিনিস্ট মনের মানুষ এই কথা বলছে? ছেলে মেয়ে অনেকেই ইন্টারভিউ দিয়েছে। যার ইন্টারভিউ ভালো হয়েছে তাকেই চাকরি দেওয়া হয়েছে। আর কোনো কারন নেই।”
“আমাকে ভুল-ভাল বুঝিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি খুব ভালো করেই বুঝি তোমার আসল উদ্দেশ্য।”
“তোমার যা মনে আসে তাই বুঝে বসে থাকো!”

ক্রমেই বদলে যাচ্ছিলাম। আগের ‘আমি’কে যতই ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিলাম, পারছিলাম না। তারিফের কাছে হয়ে উঠেছিলাম এক অসহনীয় ব্যাক্তি। আমিও বোধ হয় ওই সময়টাতে এটাই চেয়েছিলাম।

মাঝে মাঝে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিল তারিফের। বিয়ের প্রথম বছরটায় এ নিয়ে আমার কোনো সমস্যা না থাকলেও ওই সময়ে খুব বেশি সমস্যা হতে শুরু করলো।

আমি তারিফের কাছে গিয়ে বললাম, “তারিফ!”
“কি?”
“তুমি আজকে থেকে বাসায় সিগারেট খাবে না।”
“মানে? কেন?”
“কেন, সেটা তোমাকে বলতে হবে?”
“অবশ্যই বলতে হবে।”
“আমার সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না।”
“তাহলে এতদিন সহ্য হতো কিভাবে?”
“সহ্য করে নিয়েছি এতদিন। কিন্তু এখন আর পারবো না। আমার একটাই কথা, তুমি এখন থেকে আর বাসায় সিগারেট খেতে পারবে না!”

তারিফকে বাসায় সিগারেট খেতে নিষেধ করার পেছনে তেমন কোনো যুক্তিযুক্ত কারন ছিল না আমার। তবুও সে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করে দেয়, বাসার শান্তি রক্ষায়। তারিফ বাসার শান্তি রক্ষার চেষ্টা করলেও আমি করিনি।

এই ঘটনার পরদিন, তারিফ অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিল।

আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম, “তারিফ শোনো!”
“বলো।”
“তুমি এই কালো শার্টটা পরে অফিসে যাবে না!”
“কি? আশফা তুমি যে দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছ, এটা কি বুঝতে পারছো?”
“এই, আমাকে মোটেও পাগল বানানোর চেষ্টা করবে না। আমি খুব ভালো করেই জানি এত সেজেগুজে তোমার অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্য কি।”
“আমি নিজেই জানি না, আর উনি জেনে বসে আছেন। আশফা একটা কথা মন দিয়ে শুনে রাখো, তোমার এসব উদ্ভট আদেশ পালন করার মধ্যে আমি নাই। গেলাম আমি!”

একটু একটু করে নরকে পরিণত করছিলাম তারিফের জীবনটাকে। ওর ভালোবাসার মূল্য ভুলে যাচ্ছিলাম আমি। উন্মাদ হয়ে যাচ্ছিলাম।শুধু আমার কাছ থেকে কেন, পৃথিবীর করো কাছ থেকেই অমন খারাপ আচরন ডিজার্ভ করে না তারিফ। এটা তখন বুঝতেই পারিনি, এখন পারছি।

এই অশান্তির মধ্যেই তারিফের এক বিজনেস ট্রিপ ঠিক হলো, কক্সবাজারে। এই বিজনেস ট্রিপ নিয়েও শুরু করি আমি অশান্তি।

তারিফকে কঠিন গলায় বলি, “তারিফ শোনো, তুমি এই বিজনেস ট্রিপে যেতে পারবে না।”
“আজকাল তোমার কথাগুলো প্রায় বিষের সমতুল্য।”
“ঠাট্টা করবে না! আমার ঠাট্টা একদমই পছন্দ না।”
“তোমার কি মনে হয়, আমার অনেক ঠাট্টা পছন্দ? আমারও ঠাট্টা পছন্দ না। এইযে তুমি এইমাত্র বললে আমি ট্রিপে যেতে পারবো না, এটা ঠাট্টা ছাড়া আর কী?”
“আই অ্যাম সিরিয়াস, তুমি যাবে না।”
“আমার প্রত্যেকটা কাজেই তো তোমার আপত্তি থাকে, তা এই কাজে আপত্তি কেন?”
“তুমি ওখানে গিয়ে কাজের নামে কী কী করবে খুব ভালো করে জানা আছে আমার!”
“আচ্ছা, আগে আমি কখনো ট্রিপে যাইনি? কই তখন তো তোমার এসব আবোল তাবোল জানা ছিল না!”
“কারন তখন আমি বোকা ছিলাম।”
তারিফ হাসতে হাসতে বলল, “তখন তুমি বোকা ছিলে না আশফা, এখন তুমি বোকা।”
“আমাকে জ্ঞান দিবে না! খবরদার আমাকে জ্ঞান দিবে না তুমি!”
“ঠিক আছে, জ্ঞান দিচ্ছি না। কিন্তু একদিন তোমার নিজেরই জ্ঞান হবে। আর ট্রিপে কিন্তু আমি যাবোই। তোমার যা খুশি করতে পারো।”
“তাহলে তো আমি যা খুশি তা-ই করবো। তুমি যদি সত্যি সত্যিই যাও তাহলে ফিরে এসে আমার রুমে তুমি থাকতে পারবে না!”
“তোমার রুমে থাকার কোনো ইচ্ছাও আমার নেই। এবাড়িতে অনেক রুম আছে, সেগুলোর একটাকেই না হয় আমার ঘর বানিয়ে নিবো।”

তারিফ বিজনেস ট্রিপে গেলো এবং ফিরে এসে সত্যি সত্যিই অন্য ঘরে থাকতে শুরু করলো। ব্যাপারটা আমার মোটেও সহ্য হলো না। রাগের মাথায় একটা কথা বলেছি বলে কি সত্যি সত্যি তা করতে হবে না-কি?

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে