অস্পষ্টতা – পর্ব : ৭

0
950

#অস্পষ্টতা
পর্ব – ৭

লেখা : শঙ্খিনী

আমার জীবনের প্রথম অধ্যায়ের কথা বলছিলাম না! জীবনের প্রথম অধ্যায়টা যেমন সুখময় তেমনি বিপন্ন, বিষন্ন, বিষাদময় ছিল আমার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়টা। সেই অধ্যায় শুরু হয় দুই বছর আগে।

আমি সেদিন নিজ হাতে রান্না করে নিয়ে গেছি তারিফের জন্য, তার অফিসে।

অফিসে পৌঁছে রিসেপশনে জিজ্ঞেস করলাম, “তারিফ কোথায়?”
রিসেপশনিস্ট বলল, “স্যার তো মিটিংয়ে।”
“মিটিং কি ওর কেবিনেই হচ্ছে?
“জি। আমি কি স্যারকে বলবো আপনি এসেছেন?”
“না, না বলতে হবে না। আমি ওয়েট করছি।”

আমি গিয়ে বসলাম রিসেপশনের এক চেয়ারে। আমার চেয়ার থেকে কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল মাথায় টাক পরা এক লোক। সম্ভবত হবে আমার মামার বয়সী। লোকটার পরনে পাঞ্জাবি, চোখে সোনালী চশমা। এ ধরনের লোকদের পোশাক-আশাকই বলে দেয়, যে এরা ধনী।

লোকটা আমার দিকে এগিয়ে এসে আহ্লাদী কণ্ঠে বলল, “এক্সকিউজ মী মিস!”

একটা মেয়ে পুরুষ মানুষের কথা বলার ভঙ্গিতেই তার উদ্দেশ্য টের পেয়ে যায়। আমিও টের পেলাম, লোকটার উদ্দেশ্য মোটেও সুবিধার নয়।

তাই কঠিন গলায় বললাম, “জি?”
“ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি কি আপনার পরিচয় জানতে পারি?”
আমি কণ্ঠস্বর আরেকটু কঠিন করে বললাম, “আমি এই কোম্পানির মালিক। আপনার কোনো সমস্যা?”
“ও, আপনি তাহলে মিসেস চৌধুরী!”
“জি না। আমি মিসেস তারিফ চৌধুরী।”
“আপনাদের দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক কেমন? ভালো?”
“এক্সকিউজ মি!”
“না মানে, তারিফ সাহেবের মেজাজ সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানি আমি। আপনি নিশ্চয়ই অনেক নিঃসঙ্গ। একা একা দিন কিভাবে কাটে আপনার?”
এই কথা শুনে আমি রাগে চিৎকার করে বললাম, “সাহস কি করে হয় আপনার এই প্রশ্ন করার? কি ভাবেন নিজেকে?”
“আমি আসলে সেটা বোঝাতে চাইনি…”
“শাট উইর মাউথ অফ! গেট আউট, গেট আউট অফ হিয়ার। আই শেইড, গেট আউট!”

রাগে গজগজ করতে করতে হেঁটে চলে যায় সে। কথাগুলো বোধ হয় লোকটার গায়ে লাগে। গায়ে লাগুগ অথবা টাক পরা মাথায় লাগুক, তাতে আমার কি!

আমি রেগে গেলে সাধারনত চুপ করে থাকি। কিন্তু সাংঘাতিক রেগে গেলে চেচামেচি শুরু করে দেই। লোকটা আমাকে সাংঘাতিক রাগিয়ে দিয়েছে।

তারিফের মিটিং শেষ হলো আরও মিনিট দশেক বাদে। এই সময়ের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলাম। আমার রাগের প্রভাব ছেলেটার ওপর কিছুতেই পরা যাবে না।

স্যার তো আমাকে তার কেবিনে দেখে মহাখুশি।

তারিফ আনন্দিত গলায় বলল, “তুমি? এইসময়?”
“কেন, ডিস্টার্ব করলাম না-কি?”
“কি যে বলো না! কখন আসলে?”
“এইতো, কিছুক্ষণ হলো।”
“তাই? আমাকে কেউ বলেনি কেন?”
“আমিই মানা করেছি। তুমি মিটিংয়ে ছিলে না! আচ্ছা শোনো, আজকে তোমার জন্য নিজ হাতে রান্না করে এনেছি। খেয়ে বলবে কিন্তু!”
“ইশ! তুমি না থাকলে যে আমার কি হতো!”
“সেই চিন্তা করতে হবে না। আমি তো আর কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না! আচ্ছা, এখন আমি গেলাম। মা বাসায় একা।”
“মাত্র বললে কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না। আর নিজেই যাওয়ার কথা বলছো!”
আমি হেসে বললাম, “পাগলামি করো না তো তারিফ! ফোন দিও আর তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু!”
“যথাআজ্ঞা ম্যাডাম।”

অফিস থেকে বাসায় ফিরে এলাম কিন্তু তারিফের ফোন আসলো না। নিশ্চয়ই চার্জ শেষ হয়ে গেছে।

সন্ধ্যায় সময়মতোই বাসায় ফিরে এলো তারিফ। তাকে দেখে বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। যেন বড়সর এক ঝড় বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে।

আমি দরজা খুলতে খুলতে বললাম, “কি ব্যাপার তারিফ? তোমার ফোন বন্ধ ছিল কেন?”
তারিফ হতাশভঙ্গীতে বলল, “এমনি।”
“এমনি? তোমার ফোন তো কখনো এমনি এমনি বন্ধ থাকে না।”
“আজ ছিল।”
“কি হয়েছে তোমার বলো তো! টায়ার্ড?”
“তাহলে?”
“কিছু না।”
“আচ্ছা, ফ্রেশ হয়ে আসো। খুব ক্ষুধা লেগেছে!”
“আমি খেয়ে এসেছি।”

তারিফ আমাকে অভয়েড করে ঘুমাতে চলে গেলো। আজ দুপুরেও যে মানুষটাকে এত হাশিখুশি দেখলাম, তার হঠাৎ কি হলো!

সকালে ঘুম থেকে উঠেও দেখি একই অবস্থা। তারিফের মন খারাপ না মেজাজ খারাপ ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। নাস্তা করে সে সোজা চলে গেল ঘরে। আমিও কিছুক্ষণ পর ঘরে গিয়ে দেখি তারিফ ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।

আমি পরিষ্কার গলায় বললাম, “অফিসে  যাবেনা?”
“না।”
“কেন?”
“যেতে ইচ্ছা করছে না।”
“তারিফ তোমার কি হয়েছে বলো তো! আমি কালকে থেকে লক্ষ করছি তুমি অন্যরকম বিহেভ করছো! কি হয়েছে।”
“কিছু হয়নি, হলে জানতেই পারতে।”
“জানতে পারিনি বলেই তো জানতে চাচ্ছি!”

দুদিন এভাবেই কেটে গেলো। ওই দুদিনে তারিফ প্রয়োজন ছাড়া আমার সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। কোনো কারন ছাড়া আমার তারিফ কেন এমন করবে!

সেদিন দুপুরে তারিফ ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসে ছিল। আমাকে গিয়ে ওর মুখোমুখি থাকা চেয়ারটায় বসলাম। আমাকে বসতে দেখে তারিফ উঠে চলে যাচ্ছিল।

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, “তারিফ উঠবে না! বসো।”
তারিফ সাথে সাথে বাধ্য ছেলের মতো বসে পরলো।
আমি আবার বললাম, “কি হয়েছে তোমার? এরকম কেন করছো? অফিসে কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“তুমি খুব ভালো করেই জানো কি হয়েছে।”
“না আমি জানি না।”
“তুমি জানো না?”
“না, বললাম তো!”
“সেদিন আমার অফিসে কি করেছিলে তুমি?”
“তুমি জানো আমি কি করেছিলাম।”
“তাহলে যেটা জানি না সেটা বলো!”
“তারিফ কথা প্যাচাচ্ছো কেন? কি বলবে পরিষ্কার করে বলো প্লিজ।”
“পরিষ্কার করেই বলছি! আমার তখন মিটিং চলছিল, তুমি বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে। তখন একটা লোকের সঙ্গে তোমার কথা হয়। মনে আছে?”
“মাথায় টাক পরা লোকটা?”
“হ্যাঁ।”
আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললাম, “মনে আছে। এও মনে আছে যে লোকটার সঙ্গে আমি স্বাভাবিক গলায় কোনো কথা বলিনি, চিৎকার করে কথা বলেছি।”
“লোকটা কে তুমি জানো?”
“জানি না, কিন্তু এখন জানতে চাচ্ছি।”
“লোকটা আমাদের কোম্পানি ক্লাইন্ট।”
“সে যেই হোক না কেন, আমার সাথে খারাপ ইন্টেনশন নিয়ে কথা বলতে এসেছিল। তাই আমি তার সঙ্গে চেঁচামেচি করেছি।”
“খারাপ ইন্টেনশন? আপনার সাথে আপনার হাসবেন্ডের সম্পর্ক কেমন – এটা জিজ্ঞেস করা কি খুব খারাপ ইন্টেনশনের লক্ষণ?”
“তুমি সবসময় কথার পরিণাম নিয়ে ভাবো, অথচ এটুকু বুঝতে পারছো না যে এই প্রশ্নটা করার অর্থ কি?”
“না পারছি না। বুঝিয়ে বলো!”
“আমি কিচ্ছু বুঝিয়ে বলতে চাই না তোমাকে! একটা লোক তোমার ওয়াইফের সাথে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করেছে, আর তুমি সেই লোকটার পক্ষ নিয়ে কথা বলছো? আই ক্যান্ট বিলিভ দিস!”
“আই অলসো ক্যান্ট বিলিভ যে এত ছোট একটা বিষয় নিয়ে আমরা তর্ক করছি!”
“তর্ক করার মতো পরিস্থিতি তুমিই তৈরি করেছ তারিফ!”
“তৈরি করবো না কেন? তুমি জানো, লোকটার সাথে এবছরের সবথেকে বড় ডিল হয়েছিল আমাদের। তোমার কারনে, শুধুমাত্র তোমার কারনে সেটা ক্যানসেল হয়ে গেল।”
“আই অ্যাম স্যরি, আমি যদি তোমার বিজনেসে কোনো ক্ষতি করে থাকি। কিন্তু আমার সাথে বাজে ইন্টেনশন নিয়ে কথা বলতে আসলে, আমি কিন্তু কখনোই ছেড়ে দিবো না।”
“প্রতিটা ক্ষেত্রে নিজের ভেতরে থাকা ফেমিনিস্টকে বাইরে আনতে হয় কেন তোমার?”
“কারন, আমার ভেতরে থাকা ফেমিনিস্টকে বাইরে না আনা পর্যন্ত কোনো ক্ষেত্র থেকে যথাযথ সম্মান আমি পাই না!”

এই ঘটনায় ঠিক কে ছিল আর ভুল কে ছিল? মাঝে মাঝে মনে হয় আমি ভুল ছিলাম। আবার মনে হয় হয়তো তারিফই ভুল ছিলো।  প্রকৃতপক্ষে কিন্তু আমরা দুজনেই নিজ নিজ পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে ঠিক ছিলাম।

এই ঘটনা ভুলতে আমাদের সপ্তাহখানেক সময় লাগলো। সপ্তাহখানেক পর সবকিছু আগের মতো হলেও আমাদের মাঝে তৈরি হলো এক সূক্ষ্ম দূরত্ব। সেই দূরত্ব দেখা যায় না, অনুভব করা যায়।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে