অস্পষ্টতা – পর্ব : ৯

0
986

 

#অস্পষ্টতা
পর্ব – ৯

লেখা : শঙ্খিনী

তারিফ যে ঘরে থাকবে বলে ঠিক করেছিল, আমি সেই ঘরে গিয়ে হাজির হই।

নিচু গলায় ওকে বলি, “তারিফ নিজের ঘরে চলো।”
তারিফ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, “আমি নিজের ঘরেই আছি।”
“এটা তো তোমার ঘর না।”
“তাহলে কোনটা আমার ঘর?”
“উফ, তুমি যাবে কিনা বলো!”
“কেন যাবো? তুমিই আমাকে ওই ঘরে থাকতে মানা করেছিলে। মনে নেই?”
“মনে আছে। এখন আমি তোমাকে আবার যেতে বলছি।”
“আমি যাবো না।”
“তুমি না গেলে কিন্তু আমি অন্য ব্যবস্থা নিবো।”
“তোমার যা খুশি তাই করো!”

আমি কোনো কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ গিয়ে তারিফের পাশে শুয়ে পড়লাম। এতে অবশ্য স্যার কোনো আপত্তি করলেন না। সেও অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পরলো।

ঘড়িতে তখন রাত বারোটা। আমি জানি তারিফ তখনো ঘুমায়নি। চুপ করে শুয়ে আছে।

তখন আমি তারিফকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “আই অ্যাম স্যরি।”
তারিফ কিছুটা হাসি নিয়ে বলল, “কি বললে? শুনতে পাইনি!”
“আবার ঠাট্টা করছো না?”
“সত্যি শুনতে পাইনি। সবসময় তোমার চিৎকার শুনে অভ্যস্ত তো, এত ধীরে বললে শুনতে পেলাম না।”
“আই অ্যাম স্যরি। আই অ্যাম ভেরি স্যরি।।আমি তোমাকে খুব যন্ত্রণা দেই। আমি অনেক খারাপ, অনেক!”
“ইটস ওকে!”
“তোমার ছোট ছোট ভুলগুলোকে বড় করে দেখতে গিয়ে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি।”
“এখন তো মনে পড়েছে। এতটুকুই যথেষ্ট।”

একটু একটু করে আমাদের মধ্যকার দূরত্ব কমে আসছিল। সম্পর্কে আবার আগের মাধুর্য দেখতে শুরু করলাম আমরা। জীবনটা ঠিক এই জায়গায় থেকে গেলেও হতো। কিন্তু জীবন যে চলমান, তাকে তো চলতেই হবে নিজ গতিতে।

এরই মধ্যে একদিন আমাদের বাসায় আবার এলেন মালা ভাবী। কিন্তু বাসায় প্রবেশের পর থেকেই তার মুখটা গম্ভীর।

আমি শান্ত গলায় তাকে বললাম, “আপনার কিছু হয়েছে ভাবী? মন খারাপ?”
তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “না, মন খারাপ না। মেজাজ খারাপ।”
“মেজাজ খারাপ? কার উপর?”
“তোমার উপর!”
“আমি আবার কি করলাম?”
“কালকে ফেইসবুকে দেখলাম, তারিফ ওর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। ওই বন্ধুদের তুমি চেনো?”
“চিনি। হাসান আর আবেদ ভাই”
“আবার ভাই বাঁধিয়েছ?”
“বাঁধবো না কেন? ওনারা তো তারিফের ছোট বেলার বন্ধু।”
“ওরা দুজনেই যে আনম্যারিড এটা জানো?”
“জানবো না কেন? জানি।”
“এটা জেনেও যে তুমি তারিফকে ওদের সাথে মিশতে দাও, এটা দেখে আমার মেজাজ খারাপ।”
“ওমা, মিশতে না দেওয়ার কি আছে? তাছাড়া তারা তো তারিফের খুব ভালো বন্ধু। কত বছরের বন্ধুত্ব তাদের।”
“তাতে কি? তুমি জানো এসব ছেলেরা নেশা-টেশা করে? দেখবা কোন দিন, তারিফকেও ওই লাইনে নিয়ে যাবে।”
“না না ভাবী, তারা সিগারেট পর্যন্ত খায় না। তারিফই তো বরং মাঝে মাঝে সিগারেট খায়।”
“আচ্ছা, মানলাম ওরা নেশা করে না। কিন্তু মনে রেখো, ওই দুইজন কিন্তু সংসারী না। উশৃঙ্খল জীবন যাপন করলেই করতে পারে।”
“মানে?”
“এইসব ছেলেদের ওইসব জায়গায় আশা যাওয়া থাকে। বুঝছো তো, বুঝছো না?”
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, “জি।”
“সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎসঙ্গে সর্বনাশ। কথাটা মনে রেখো। এই সঙ্গদোষই যথেষ্ট একটা ছেলেকে নষ্ট করার জন্যে।”
“তাহলে আমি এখন কী করবো?”
“মিশতে দিবা না ওদের সাথে!”
“তারিফ তো আমার কথা শুনবে না।”
“শুনবে না মানে? শুনতে হবে!”

এর কিছুদিন পর, তারিফ অফিসে যাচ্ছিল। আমি রান্নাঘরে কাজ করছিলাম।

যাওয়ার আগে সে রান্নাঘরে এসে আমাকে বলল, “আশফা গেলাম। আর আজকে কিন্তু ফিরতে দেরি হবে।”
আমি শীতল গলায় বললাম, “কেন? অফিসের পর কোথাও যাবে?”
“হুঁ, হাসানরা আসবে। ওদের সাথে দেখা করতে যাবো।”
“তারিফ শোনো!”
“কি?”
“তুমি তোমার বন্ধুদের সাথে আর দেখা করবে না।”
“ইউ মাস্ট বি কিডিং!”
“নো, আই অ্যাম নট। তুমি আড্ডায় নামে কোথায় কোথায় যাও বলোতো!”
“সকাল সকাল কি পাগলামি শুরু করলে তুমি? তুমি খুব ভালো করে জানো আমি ওদের সাথে কোথায় কোথায় বসে আড্ডা দেই।”
“তাহলে যেটা জানি না সেটা বলো! আমিও ভাবি, অফিসে চাকরি দেওয়ার জন্য এত সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের খোঁজ তুমি কোথা থেকে পাও! এখন বুঝলাম। তোমার ওই বন্ধুগুলো ওদের খোঁজ দেয় তোমাকে।”
“আচ্ছা এই ফালতু কথাগুলো কি কেউ তোমাকে শিখিয়ে দেয় না-কি তুমি নিজেই নিজের মনে এগুলোকে বানাও একটু বলবে?”
“তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করার মুডে আমি নেই। আমি বলে দিয়েছিলাম তুমি যাবে না মানে যাবে না।”

তারিফ বেশ কিছু সময় চুপ করে রইলো। তীব্র রাগ দেখতে পাচ্ছিলাম ওর চোখে মুখে।

এক পর্যায়ে নীরবতা ভঙ্গ করে কঠিন গলায় বলল, “লিসেন টু মি ভেরি কেয়ারফুলি আশফা, ইউ হ্যাভ নো রাইটস টু কন্ট্রোল ম্যাই লাইফ।”
আমিও রাগী গলায় বললাম, “আই হ্যাভ হান্ড্রেড পার্সেন্ট রাইটস টু কন্ট্রোল ইউ অ্যান্ড ইয়োর লাইফ!”
“আমি তোমাকে অনেক সহ্য করেছি, আমার পক্ষে আর তোমাকে সহ্য করা সম্ভব না।”
“ও তাই না? তুমি আমাকে সহ্য করেছ না আমি তোমাকে সহ্য করেছি? আমার কোন কথাটা শুনেছ তুমি? আমি বিজনেস ট্রিপে যেতে মানা করেছি কিন্তু তুমি তো ঠিকই গিয়েছ। আমি সিগারেট খেতে মানা করেছি কিন্তু তুমি সিগারেট খেয়েই যাচ্ছ!”
“তোমার কোনো কথাই যখন শুনিনি তখন আজকেও শুনবো না।”
“তুমি তাহলে তোমার লম্পট বন্ধুদের সাথে দেখা করবেই?”
“কি বললে তুমি? না, না কি বললে? আরেকবার বলো তো!”
“আমি কিছুই বলছি না। যাও, তোমার লম্পট বন্ধুদের কাছে আর নিজেও লম্পট হয়ে ফেরো।”
“আজকের দিনটা তুমি সারা জীবন মনে রাখবে আশফা!”

বলেই হনহন করে হেঁটে চলে গেল তারিফ। আমার সারাটা দিন খুবই অস্থির ভাবে কাটলো। কোনো কিছুই ভালো লাগছিলো না সেদিন।

রাত তখন প্রায় এগারটা। তারিফ সাধারনত সাতটার মধ্যে বাসায় চলে আসে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করলে কমপক্ষে নয়টা। কিন্তু সেদিন ওকে দেরি করতে আমার মেজাজ করো খারাপ হয়ে গেল।

আমি অনবরত তাকে ফোন করছি, কিন্তু বারবারই কেটে দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আমি মায়ের ঘরে গেলাম।

মা চিন্তায় অস্থির হয়ে আমাকে বলল, “তারিফ এসেছে?”
“না। আমার ফোনও কেটে দিচ্ছে।”
“এখন কি করি বল তো!”
“তুমি ওকে একটা ফোন দাও। স্পিকার দিয়ে ফোন দাও! আমি নিজ কানে শুনতে চাই, কাজের নামে ও কী কী করে বেড়াচ্ছে।”

মা আমার কথাটা মতো স্পিকারে রেখে ওকে ফোন করলো। একবারেই সে মায়ের ফোন ধরলো।

মা কাঁপা গলায় বলল, “হ্যালো বাবা তারিফ, কোথায় তুই? বাসায় আসছিস না কেন এখনো?”
তারিফ ওপাশ থেকে শীতল গলায় বলল, “আমি আর বাসায় ফিরবো না মা।”
“ফিরবি না মানে? কোথায় তুই?”
“আমাদের গুলশানের বাসায়।”
“ওখানে গিয়েছিস কেন?”
“কারন আমি একটু শান্তি চাই, ভালোভাবে বাঁচতে চাই। এখন রাখলাম, পড়ে কথা হবে।”

তারিফের কথাগুলো শুনে আমার কান টান গরম হয়ে গেল।

চিৎকার করে বললাম, “দেখলে মা, দেখলে তোমার ছেলের কান্ড! আমার সঙ্গে থাকলে নাকি তার শান্তি ভঙ্গ হয়। ও থাক! ও ওখানেই থাক! ও কি ভেবেছে আমি ওকে আনতে যাবো? কোনোদিনও না!”

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে