অসাধারণ পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
285

#অসাধারণ ৩

ক্লাবঘরের আধো অন্ধকারে টগরকে অপার্থিব রকমের সুন্দর লাগছে। তার দৃষ্টিতে যেমন আমার প্রতি মুগ্ধতা কাজ করছে, সেই সাথে খেলা করছে বিষ্ময়৷ তবে কিসের একটা ঘোর কাটিয়ে উঠতে না পেরে দু’জন পরষ্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। চমক ভাঙল বাজ পড়ার শব্দে।

টগর জিজ্ঞেস করল, “তুমি চিঠি দিয়েছ?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“একটা কথা বলতে।”

“কী কথা?”

“আপনি বিয়ে করতে রাজি হচ্ছেন না কেন?”

“তা দিয়ে তোমার কাজ কী?”

“ন্যাকামো করবেন না প্লিজ!”

“ন্যাকামো আমি করছি না তুমি? এই ঝড়বাদলের দিনে আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে আসার মানে কী? আমার বিয়ে হলো কী হলো না তাতে তোমার কী?”

আমার মাথায় যেন একটা আকাশ ভেঙে পড়ল! আমার কী মানে? তাহলে কার কী? অনেক কষ্টে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কার জন্য বসে আছেন?”

“আছে কেউ একজন।”

বলতে বলতে হঠাৎ সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে বলল, “তুমি কি ভাবছো তুমি?”

আমি চুপ করে মাথা নিচু করে রইলাম। সে বলল, “শোনো পুঁচকে মেয়ে, বেশি পাকনামি করবে না৷ তোমাকে আমি একবারও বলেছি তোমাকে পছন্দ করি বা এ জাতীয় কথা? নাকি কোনো ইঙ্গিত দিয়েছি? আঙ্কেলকে আমি খুব রেস্পেক্ট করি, সেই হিসেবে তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করি। তার মানে যা খুশি তাই ভেবে বসবে? আমার প্রেমিকা আছে। আমরা একসাথে লন্ডনে পড়াশুনা করেছি। তার ভিসা নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছে বলে আসতে পারছে না।”

আমার চোখ দিয়ে তখন অঝোর ধারায় জল ঝরছে। কী ভীষণ কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে আসছে ভেতরটা যে আমি বলে কাউকে বোঝাতে পারব না৷ শুধু মনে হচ্ছে আমার সবই শেষ। আর কিচ্ছু বাকি নেই।

আমার অবস্থা দেখে বোধহয় টগরের একটু দয়া হলো। সে নরম সুরে বলল, “দেখো শিলা, তুমি ছোটো। এখনো পুরো জীবন পড়ে আছে। প্রেম ভালোবাসা এসব ফ্যান্টাসির জন্য অনেক সময় পাবে। এখন মূল্যবান সময়টা নষ্ট করো না৷”

আমি কিছু বললাম না৷ বাইরের দিকে তাকালাম। ঝড় থেমে গেছে। বৃষ্টি পড়ছে এখনো।

টগর বলল, “বাড়ি চলে যাও। আমি বাজারের দিকে যাব।”

তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। একা যখন ঝুম বৃষ্টিতে চুপচুপে হয়ে বাড়িতে ফিরছি তখন আমার ভেতরে কোনো বোধ নেই। সবকিছু যেন চোখের পলকে বাষ্পের মতো উড়ে উড়ে চলে যাচ্ছে। পড়ে রয়েছি শুধু আমি আর আমার আহত পাখির মতো ছোট্ট মন।

কী করে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম মনে নেই। এরপর আমার জ্বর এসেছিল। প্রচন্ড জ্বর। দিন রাতের পার্থক্য বুঝতাম না৷ ভুলভাল বকতাম সারাদিন৷ সেই ভুল বকা থেকেই বোধহয় মা বাবা আমার সমস্যাটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি৷

আমার জ্বরে থাকা অবস্থাতেই একদিন টগরের প্রেমিকা চলে এসেছে। তাদের বিয়ে হয়েছে। আমি এরপর যেদিন টগরের খবর প্রথম শুনলাম, তখন সে হানিমুনে গেছে।

আমি কেমন যেন নির্জীব হয়ে গেলাম৷ দিনগুলো ঝুপসি অন্ধকার সোঁদা সোঁদা গন্ধওয়ালা আর রাতগুলো অসহনীয় কষ্টের।

একদিন বিকেলে হিমেল স্যার পড়াতে এসে চুপচাপ বসে রইলেন৷ আমি স্যারের কাছেও ঠিকমতো পড়তাম না৷ পড়া শুনতে ইচ্ছে করত না৷ স্যার তবুও পড়িয়ে যেতেন। আমার মগজ সেসব ধরতে পারত না৷

সেদিন স্যার পড়ালেন না৷ আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “পড়াবেন না?”

“না।”

“না পড়ানোই ভালো।”

“আসলে তোমাকে পড়ানো না পড়ানো একই কথা। খামোখা এনার্জি নষ্ট করে কী লাভ?”

“বাবাকে কিছু বলবেন না প্লিজ!”

“তোমার বাবা সব জানে।”

“তবুও।”

“ঘুরতে যাবে শিলা?”

আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম, “ঘুরতে?”

“হ্যাঁ। যাবে?”

“আপনার সাথে?”

“হ্যাঁ।”

আমি প্রস্তাব শুনে অবাক। রাজি হব কি না বুঝলাম না। তিনি বললেন, “চলো যাই।”

কিন্তু আমার উঠতে ইচ্ছে করল না। স্যার নিজে উঠে গিয়ে মাকে ডেকে অনুমতি নিয়ে আমাকে সাথে করে বেরিয়ে পড়লেন। আমরা হাঁটতে থাকলাম৷ জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাব?”

“একটা বাড়িতে।”

“কার বাড়ি?”

“চলোই না আগে।”

আমি তার পিছু পিছু চলতে লাগলাম। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা বাড়ির সামনে এসে পৌঁছুলাম। বাড়িতে অনেক গাছপালা, উঠানো বড় একটা বড়ই গাছ। একধারে সবজির বাগান। ইটের দেয়াল, টিনের ঘর।

স্যার বললেন, “আমাদের বাড়ি।”

আমি চারদিক ভালো করে দেখে বললাম, “সুন্দর।”

স্যার আমাকে তার মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন৷ খুব মিষ্টি তার মা। ভীষণ আদুরে। আমাকে যত্ন করে বসালেন৷ ফল কেটে দিলেন।

স্যার মায়ের সামনে ছোটো টুল পেতে বসে বললেন, “মা, তোমার গল্পটা বলো।”

“আমার গল্প?”

“স্যরি গল্প না। জীবনকাহিনী।”

“সে আবার শোনাবার মতো কাহিনী নাকি?

“আহা! বলোই না৷ প্লিজ!”

মা বলতে শুরু করলেন, “ঠিক আছে। বলি। তুমি জানো মেয়ে, আমার বিয়ে হয় কত বছর বয়সে? যখন তোমার থেকেও বছর চার ছোটো ছিলাম, তখনকার কথা। মাত্র বারো বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বিয়ে কী তাই জানতাম না। প্রথম প্রথম শ্বশুরবাড়িতে যা ভয় পেতাম! সবাইকে ভয় পেতাম। সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাম হিমেলের বাবাকে। আমার চেয়ে অনেক বড় ছিল কি না!

আমার শ্বশুরবাড়ি ছিল বড় পরিবার। একগাদা লোকজন, বাড়ির লোক, আত্মীয় মিলে রমরমা বাড়ি। দিনরাত কাজ লেগেই রয়েছে। একবার রান্নাঘরে ঢুকলে বের হবার উপায় নেই। সারাদিন সেখানেই কেটে যেত। তোমার যা বয়স এই বয়সে আমি প্রথম স্বামীকে ভালোবাসতে শিখি৷ এর আগ পর্যন্ত ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম। কিন্তু যখন থেকে তাকে ভালোবাসি, তখন থেকে তার সাথে যতটুকু সময় কাটাতাম, স্বপ্নের মতো মনে হতো। সেই রান্নাঘরে কাটানো জীবনটাও বড় আনন্দের মনে হতো। হিমেলের বাবাও আমাকে খুব ভালোবাসতেন।

এরপর একদিন হিমেল পেটে এলো। আমাকে বাপের বাড়িতে রেখে গেল ওরা। দেখতে পর্যন্ত এলো না! হিমেলের জন্ম হলো আমার বাপের বাড়িতে। ওকেসহ আমাকে যখন আমার বাবা শ্বশুরবাড়িতে দিয়ে এলেন তখন গিয়ে দেখি আমার ঘরটা দখল হয়ে গেছে। আমার স্বামী আরেকটা বিয়ে করেছেন।

এই তো তোমার কাছাকাছি বয়সেই আমার মন ভাঙল। কী যে কষ্ট পেয়েছিলাম তা বলে বোঝাবার মতো হয়। বাড়তি ঘর ছিল না। গুদামঘরের একপাশে বিছানা করে থাকতাম। ইঁদুর তেলাপোকার বাসা ছিল ওটা। কত কষ্টে যে ছেলে নিয়ে দিন কাটিয়েছি কী আর বলব! আমার স্বামী তো ফিরে তাকিয়েও দেখতেন না৷ তার নতুন বউকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকতেন।

আমি একদিন আর সইতে পারলাম না৷ ফিরে গেলাম বাবার বাড়িতে৷ বাবা মা রাখলেন, তবে বেশিদিন ওভাবে থাকা গেল না। হিমেলকে নিজেরা রেখে আমাকে আবার জোর করে বিয়ে দিলেন এক বুড়ো লোকের কাছে। আমার দ্বিতীয় স্বামী বিয়ের বছর তিনেক পরে মারা গেলেন৷ তার থেকেই এই বাড়িটা আমার পাওয়া।

তিনি মারা যাবার পর ছেলেকে নিয়ে এখানেই আছি। মা ছেলে মিলে বেশ আছি।”

স্যার বললেন, “যদিও মাঝখানে অনেক কিছু বাদ দিয়েছ, তবে চলবে। তোমাকে একটা প্রশ্ন করব ঠিক জবাব দেবে মা?”

“কী প্রশ্ন?”

“তোমার সবচেয়ে বড় আফসোস হয় কী নিয়ে?”

“কোনো আফসোস নেই। আমি ভালো আছি।”

“উহু, একটু কিছু বলতেই হবে।”

তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “পড়াশোনাটা করতে পারিনি।”

“ঠিক বলেছ। এখন ওকে দিয়ে আসি ওর বাড়িতে।”

আমরা সেখান থেকে বের হলাম৷ স্যার এবার আমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “মায়ের কাহিনী শোনাতে চাইলাম কেন বুঝেছ?”

“না।”

“ভালোমতো আজ রাতে ভাববে। আমি আগামীকাল তোমাকে পড়াতে যাব। যদি দেখি ভালোভাবে পড়ছ তাহলে পড়াব, আর যদি দেখি একটা ছেলের জন্য একতরফা ভালোবাসার কষ্ট নিয়ে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস তৈরি করতে যাচ্ছ, তাহলে বিদায় নেব চিরতরে।”

আমি সারারাত ছটফট করলাম। শুধু মনে হতে লাগল স্যারের মায়ের জায়গায় থাকলে কেমন লাগত? পুরো বিষয়টা যখন কল্পনা করলাম, তখন নিজের দুঃখটাকে খুব ছোটো মনে হতে লাগল। এত কষ্ট করেও ভদ্রমহিলা হাসিমুখে বাস করছেন, ছেলেকে এত সুন্দর করে মানুষ করেছেন। আর আমি কী করছি?

ভোরবেলা খুব ভালো করে গোসল করলাম। পুরানো নোংরাগুলো ধুয়ে ফেলার মতো সব ভাসমান স্মৃতি ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করলাম। তারপর অনেকদিন পর বই খুলে সত্যিকার অর্থেই পড়াগুলোর দিকে চোখ মেলে তাকালাম।

এরপরেই মাথাটা ঘুরে গেল। দু’বছরে যা শিখেছি সব ভুলে গেছি!

বিকেলে স্যারের সামনে বসে কেঁদেই ফেললাম কথাটা বলতে বলতে। স্যার দেখলাম হাসছে। সুন্দর হাসি৷

স্যার আমাকে খুব যত্ন করে বাকি মাসগুলো পড়ালেন। যেন ছোট্ট আহত পাখির ছানাকে যত্ন করে সারিয়ে তোলা। আমি মাঝেমধ্যে ধৈর্যহারা হয়ে যেতাম৷ এসএসসির আগের প্রিপারেটরি পরীক্ষায়ও তিন বিষয়ে ফেল করে ভেঙেই পড়েছিলাম৷ কিন্তু স্যার হাল ছাড়ার পাত্র নন। নিজের পড়াশুনা রেখে আমাকে নিয়ে লেগে রইলেন। আমার আত্মবিশ্বাস খুব ধীরে হলেও একটু একটু করে ফিরে এলো। নিজেও প্রচুর খাটতে শুরু করলাম।

এক রাতে দুটো পর্যন্ত পড়াশুনা করে শুয়ে পড়ার পর কী একটা এলোমেলো স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম৷ উঠে বসে মনে হলো, আমি প্রায় পাঁচ ছয়দিন হলো দিনে একবারও টগরের কথা মনে করে কাঁদিনি। দারুণ একটা প্রশান্তিতে মন ভরে গেল।

শেষ পর্যন্ত আমার এসএসসি চলে এলো। পরীক্ষা ভালোই দিলাম। আমার পরীক্ষার পর স্যার তার পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন৷ আমাদের আর দেখা হলো না।

আমার রেজাল্ট দিল। টেনেটুনে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছি৷ বাবা খুশিতে আমাকে মাথায় তুলে নাচতে বাকি রাখলেন৷ এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করা হলো। স্যারের বাড়িতেও আমরা মিষ্টি নিয়ে গেলাম৷ তার মায়ের সাথে দেখা হলো, তবে স্যার নেই। চলে গেছেন চাকরির পরীক্ষা দিতে। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। একবার বলে যেতে পারতেন!

এই হলো আমার সেসব দিনের গল্প। গল্পটা শেষ। উপসংহারটুকু বাকি।

ঠিক পাঁচ বছর পর স্যার ফিরেছিলেন৷ আমি তখন অনার্সে পড়ছি। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এমন সময় একদিন তিনি এলেন৷ জানালেন, আমাকে তার পছন্দ, ঠিক তখন থেকেই। তবে যে ভুলটা থেকে আমি সদ্য বেরিয়ে এসেছিলাম তার পুনরাবৃত্তি চাননি বলেই চলে গিয়েছিলেন। এখন উপযুক্ত সময়ে ফিরেছেন।

আমার আপত্তি করার কোনো কারন ছিল না৷ তার মতো ধীরস্থির, সুন্দর মনের মানুষ খুব কমই হয়। সে টগরের মতো সুন্দর নয়, একটু খাটো, গায়ের রঙ কালো। তবুও তার দিকে তাকালে মনে হতো, এত অসাধারণ মানুষ আমি জীবনে দেখিনি।

আজও তাকে দেখলে আমার তাই-ই মনে হয়।

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে